জ্বলদর্চি

টুসু: জঙ্গলমহলের ঘরের মেয়ে /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৫৩

টুসু: জঙ্গলমহলের ঘরের মেয়ে

সূর্যকান্ত মাহাতো


"উঠ উঠ উঠ টুসু উঠ করাতে এসেছি
তোমারই সব সঙ্গীগুলি চরণতলে বসেছি
সাজ লাওমা সন্ধ্যা লাওমা স্বর্গে লাওমা বাতি গো।"

"টুসু বন্দনার একটি গান। সন্ধ্যেবেলায় কুমারী মেয়েরা টুসু পূজা করে এই গান ধরে।"

শিক্ষক মশাই বললেন, "গান কেন? 'টুসু' দেবীর পূজা যখন তখন কোন মন্ত্র পাঠ করা হয় না?"

শ্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর ভাষাতেই উত্তরটা দিলাম, "'তুষু' পূজার মন্ত্রই হল তুষুর গান। তুষু গানই হল তুষুর প্রাণ" (উদ্বোধন, ৮৭ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, বাঁকুড়া জেলার লোকসংস্কৃতিতে লৌকিক দেব-দেবী প্রসঙ্গ/শ্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী)। টুসু পূজায় টুসু উপলক্ষ্য মাত্র। টুসুর গানগুলোই হল উৎসবের মূল প্রাণশক্তি। এই গানে গানে গোটা জঙ্গলমহল উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কারণ এ গানে তাদের প্রেম-প্রীতি, সুখ-দুঃখ, হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ-বেদনা এমনকি অশ্লীলতাও প্রকাশ পায়। একটা পুরো অঞ্চলের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে এই গানে গানে।"

শিক্ষক মশাই বেশ উৎসাহ নিয়ে বললেন, "তার মানে টুসু গানগুলো যদি মনোযোগ দিয়ে শোনা যায় তাহলে সেখানকার পুরো সমাজ চিত্রের একটা আভাস পাওয়া যাবে?"

"অবশ্যই যাবে। শুধু কী আভাস! এ গানের মধ্যে পরিবেশ আছে, প্রতিবেশ আছে, বিধি-নিষেধ আছে, কর্তব্যবোধ আছে, পুরাণ আছে, কাহিনী আছে, কটাক্ষ আছে, ঈর্ষা আছে, অভিসার আছে, অভিমান আছে, এমনকি রাজনীতিও আছে।" (সীমান্ত বাংলার লোকযান/ সুধীরকুমার করন, পৃষ্ঠা- ১৯৭)

"নিজেদের জীবনযাত্রাই টুসু গানে গানে আরোপিত। তাই টুসু দেবী হয়েও এখানে দেবী নন। বরং অনেক বেশি করে মানবী। এক কথায় ঘরের মেয়েই বলা যেতে পারে।"

কয়েকটা গান মন দিয়ে শুনে উনি বললেন, "এ তো দেখছি, শাক্ত পদাবলীর আগমনী -বিজয়া গানের মতোই অনেকটা। সেখানেও তো বাঙালির ঘরের মা-মেয়ের চিরন্তন স্নেহ ও ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ ও হাসি কান্নার কথায় ফুটে উঠেছে। টুসু গানগুলোও তো তেমনি। এখানেও জঙ্গলমহলের ঘরের মেয়েদের জীবন যাপনের হাসি কান্নাই ফুটে উঠেছে। আচ্ছা এইভাবে মেয়েদের কথাই বারে বারে গানে গানে উঠে আসে কেন?"

বললাম, "এর জন্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই এক রকম দায়ী বলা যেতে পারে। একেবারে প্রাচীনকাল থেকেই যেভাবে নারীদের জীবন যাপন করতে হয় এই সমাজে, সেখানে যেমন সুখ আছে তেমনি তাদের একান্তই নিজস্ব কিছু দুঃখ বা যন্ত্রণাও আছে। চার দেওয়ালে বন্দি ছাড়াও নারীরা নানা রকমের বাধা নিষেধে বন্দি। তাদের যাতনার কথা, যাপনের কথা, জীবন সংগ্রাম ও সুখ দুঃখের কথা তাই এভাবেই উৎসবগুলোতে গানে গানে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এটাই ওদের প্লাটফর্ম বলা যেতে পারে। তাদের অবরুদ্ধ ও অব্যক্ত তথা না বলা কথাগুলোই গানে গানে ওরা ব্যক্ত করে। তাদের ইচ্ছা ও বাসনাগুলোকে তারা গানে গানে প্রকাশ করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে সেটা একরকম জানান দিতেও চায়।"

"এ ধরনের গানের রচয়িতা কারা?"

"এ গানের  নির্দিষ্ট কোন রচয়িতা নেই। বালক বালিকা থেকে শুরু করে যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই এ গান মুখে মুখে রচনা করে থাকে। এ গান এখানকার মানুষের হৃদয় উৎসারিত গান। সহজ সরল মেঠো সুরের গান। নতুন নতুন করে রচিত ও গীত হয় আবার কালের নিয়মে হারিয়েও যায়। অনেকটা প্রস্ফুটিত ফুলের মতোই। ফুটে আবার ঝরেও যায়। নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিকের উপর অবারিত ভাবে রচিত হয়ে চলে টুসু গান। সেই সময়কার জনপ্রিয় কোন বিশেষ ঘটনা বা বিষয়ের ওপরও টুসু গান রচিত হয়েছে। যেমন একসময়কার জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা "শোলে"-কে নিয়েও গান গাওয়া হয়েছে। "'রূপকথাতে' এসেছে 'শোলে' দেখতে যাবো দল মেলে/ ও মেজদি ও সেজদি যাবে গো 'শোলে' দেখতে?/ কি বা মিয়া কি বা ছেলা যাচ্ছে 'শোলে' দেখতে/ 'শোলে' বইটা কি যে ভালো, কি যে ভালো লেগেছে।"(তুষু ব্রত ও গীতি সমীক্ষা: ড. রবীন্দ্রনাথ সামন্ত) তবে সংরক্ষণের অভাবে কালের নিয়মেই সেইসব গান হারিয়েও যাচ্ছে। নতুন বিষয়ের ওপর আবার নতুন করে গান তৈরি হয়ে চলেছে। কারণ এ গান তো শ্রুতি ও স্মৃতি নির্ভর গান। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে এ গান শ'য়ে শ'য়ে সৃষ্টি হয়ে চলেছে।"

"গানগুলো তো খুব একটা বড় বা দীর্ঘ নয় দেখছি।"

"টুসু গানের আকার খুব একটা বড় হয় না। তবে এই দু চার কলি গানের ভেতরেই হাজারো কথা প্রকাশ পায় (সীমান্ত বাংলার লোকযান/ সুধীর কুমার করণ, পৃষ্ঠা- ১৯৬)। ছোট ছোট এক বা দু পঙক্তির গান। তবে বড় গান যে হয় না এমনটা নয়। আট পঙক্তির গানও আছে।"

শিক্ষক মশাই কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, "'টুসু' লৌকিক দেবী এটা তো জানলাম। আপনি বলছেন টুসু যত না দেবী তার থেকেও বেশি করে মানবী, একেবারে যেন নিজের ঘরের মেয়ে। এমনটা মনে হওয়ার কারণ?"

"কারণ এর 'গানগুলো'। আসলে টুসু গানগুলোর শব্দে শব্দে ঝংকৃত হয়ে ফুটে উঠেছে গার্হস্থ জীবনের ছবিগুলোই। ঘরের মেয়েদের জীবনযাত্রার ছবিই টুসু গানগুলোতে বারেবারে ঘুরে ফিরে এসেছে। তাই টুসু কখনো শিশু, কখনো কিশোরী, কখনো যুবতী, কখনো প্রেমিকা, কখনো গৃহবধূ। "ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য" গ্রন্থে 'বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত' আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, 'টুসু গীতে ঝাড়খণ্ডী মানুষের সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, ঈর্ষা ঘৃণা, প্রেম ভালোবাসা, জীবন সম্পর্কিত প্রতিটি অনুভব ও অভিজ্ঞতা গভীর মমতায় প্রকাশ করা হয়েছে।'"(ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত, পৃষ্ঠা- ১৫৩)

"তার মানে টুসু গানগুলোতে একটি মেয়ের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনচক্রই গানে গানে টুসুর মধ্যে আরোপিত?"

"একদম তাই। একটি গানে যেমন দেখি, ছোট্ট টুসু ঘরের শিশুটির মতোই ধুলায় খেলা করে---

"বাড়ি নাময় শিমুল গাছে পায়রা কুহরে গ
পাখি নয় পাখুড়া নয় মা টুসু খেলা করে গ।।
খেল্য না খেল্য না টুসু কাপড় হবে মলিন গ
তোমার মা ত অভাগিনী সাবন কুথায় পাবে গ।।"

"ছোট্ট ঘরের মাটির উঠোনে বালিকা বই পড়ছে। এমন দৃশ্য জঙ্গলমহলে একেবারে চেনা ছবি। সেটাও টুসু গানে গানে ফুটে উঠেছে---

"আমার টুসু পুঁথি পড়ে তপুবনের কাননে
কি কর‍্যে মা শুনতে পাব জড়ের বাণে ঢেউ মারে।"

"শৈশব পার করে বালিকা মেয়ে কিশোরী হয়ে ওঠে। একটু একটু করে তার মধ্যে সৌন্দর্য চেতনার বিকাশ ঘটে। সে তখন সাজতে পছন্দ করে। এই বয়সের ধর্মই এটা। আরো বেশি করে সুন্দরী হয়ে উঠতে চায়। এটা তো যেকোনো কিশোরী মেয়েরই মানসিক একটা ইচ্ছা। সেরকম একটি ইচ্ছাকেই টুসু গানে ব্যক্ত করা হয়েছে---

"নাকে নোলক কানে কান পাশা
টুসু করে না কারে আশা।"

"কিশোরী টুসু, একটু একটু করে যৌবনের সন্ধিক্ষণে পা দেয় বাড়ির মেয়ের মতোই। আরো বেশি করে তার রূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে। এই বয়সে অনেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। টুসুও 'ফুল' বা সখি পাতিয়েছে। সেরকমই একটি গান হল---

"আমার টুসু ফুল কর‍্যেছে ঝাড়গাঁ গড়ের রানীকে
মনে মনে চিঠি ছাড়ে গলাপ ফুলের ভিতরে।"

"টুসুর অপরূপ সৌন্দর্যের কথাও গানে গানে ব্যক্ত হয়েছে।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
আঁচিরে পাঁচিরে পদ্ম পদ্ম বই আর ফুটে নাই
টুসুর হাতে জড়া পদ্ম ভমর বই আর বসে নাই।।
আদাড়ে বাদাড়ে পদ্ম পদ্ম বই আর ফুটে নাই
আমদের টুসুর পায়ে পদ্ম ভমর বই আর বসে নাই।।"

"হেলে দুলে চলতে গিয়ে জঙ্গলমহলের তন্বী মেয়েদের মতো রোগা টুসুর শরীরও যেভাবে দুলে দুলে উঠে তা নিয়েও গান---

"এক সড়পে দুই সড়পে তিন সড়পে লোক চলে
আমার টুসু এমনি চলে বিন বাতাসে গা দুলে।"

"টুসুর গায়ের রং গৌরবর্ণ। সে কথাও গানে গানে বলা হয়েছে। আসলে জঙ্গলমহলে মেয়েদের গায়ের রঙ ফর্সা হলে সেই মেয়েদেরকে নিয়ে বাবা মায়েরা একটা আলাদা রকমের গর্ববোধ করে থাকেন। সেটাও টুসু গানে আরোপিত হয়েছে।

"দলমা পাহাড়ের উপর হাঁসা পাথর নড়ে গ
আমার টুসুর গউর বরণ হেল্যে দুলে চলে গ।"

"শিক্ষক মশাই মন দিয়ে টুসু গানগুলো শুনছিলেন। এবার তিনি সোৎসাহে বলে উঠলেন, "দারুণ! দারুণ! গানে গানে একেবারে ঘরের কথাগুলোই যেন বলা হয়েছে। সে কারণেই বোধ হয়  জঙ্গলমহলে বহু মেয়ের নামও রাখা হয়েছে 'টুসু'। আমার স্কুলেই তো দুটি মেয়ের নাম টুসু। টুসুর সৌন্দর্য যেন তাদের নামের মধ্যেও প্রতিভাত।"

বললাম, "একদম। টুসু দেবী হলেও দেবীর সঙ্গে ভক্তের যে দূরত্ব থাকে, তা যেন এখানে কোথাও অনুপস্থিত। বরং দুটো সম্পর্কই অনেক বেশি কাছের হয়ে উঠেছে।"

শিক্ষক মশাই তেমনই উৎসাহ নিয়ে বললেন, "আপনি টুসুর গানগুলো বলুন, শুনতে খুব ভাল লাগছে।"

বললাম, "যৌবনের অন্যতম ধর্মই হল প্রেম। টুসুও প্রেমিকা হয়ে উঠেছে। কোন এক রাজপুত্রের সে প্রেয়সী। একটি গানে তো সে কথাই  ফুটে উঠেছে।

"কুল গাছে কুইলির বাঁসা, ডালিম গাছে কেরকেটা
আমাদের টুসু ফাঁস আড়‍্যেছে লাগ‍্যেছে রাজার বেটা।"

"গানে গানে ফুটে উঠেছে টুসুর অভিসারও---

"কলাতলে বাট রাখ‍্যেছি পাছে টুসু পার হচ্ছে
নন্দের বেটা চিকনকালা সেও ত বাঁশি বাজাচ্ছে।"


 "টুসুর বিবাহ নিযেও একাধিক গান রচিত হয়েছে। এ গান যেন নিজেদের বাড়িরই কন্যার বিয়ের সময় গাওয়া গান।

"আল‍্যরে গুনগুনা মাছি দক্ষিণ দিগের হাওয়াতে
উড়াল‍্য সনার পালকি নিয়ে গেল টুসুকে।
... ... ...
আমাদের টুসু শিশু ছেল‍্যা শ্বশুর ঘরের কি জানে।"

"বিয়ের পর বাবা যেমন মেয়ের সন্তান হলে খুশি ধরে রাখতে পারে না। তার উপর তা যদি হয় পুত্র সন্তান তাহলে তো কথাই নেই। টুসুর পুত্র সন্তান কামনা করেও বাবা-মায়েদের একাধিক গান আছে। তার মধ্যে একটি হল---

"ই ঘর কাদা সে ঘর কাদা লুহার পাটা বসাব
আমার টুসুর বেটা হলে হাজার টাকা উড়াব।"

"সংসার ধর্ম পালন করতে গিয়ে একটি মেয়ের যা যা সমস্যা আসে যেমন সতীন সমস্যা, শাশুড়ির সঙ্গে মনোমালিন্য, জা এর সঙ্গে কথা কাটাকাটি, এসব কিছুই টুসুর উপর গানে গানে আরোপিত হয়েছে। তবে সবথেকে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে নারীর একান্তই মন খারাপ ও যন্ত্রণার কথাগুলো। জঙ্গলমহলে পৌষ পরব হল সবথেকে বড় ও শ্রেষ্ঠ পরব। এত বড় পরবে, বাবা-মা শ্বশুর বাড়িতে মেয়েকে রেখে দিলে তার যে সে কী কষ্ট হয় তা এই গান না শুনলে বোঝা যাবে না।

"এত বড় পৌষ পরবে 
রাখলি মা পরের ঘরে
ওমা পরের মা কি বেদন বোঝে
অন্তরে পুড়ায় মারে।
মা আমার মন কেমন করে
যেন শোল মাছে উফাল মারে আমি থাকবো না আর তোর ঘরে।
মায়ে দিল মাথা বেঁধে, দেগো মাসি ফুল গুঁজে
বিদায় দে মা সংসারের কাজে।"

শিক্ষক মশাই বললেন, "টুসু গানগুলো শুনে টুসুর স্বামী বা শ্বশুরের কথা তো সেরকমভাবে পেলাম না?"

"সত্যিই তাই। স্বামীর প্রসঙ্গে টুসু গানগুলো যেন বেশ নীরব। তবে এই নীরবতা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত কিছুটা উত্তর ধারণা করেছেন। তিনি মনে করেন, স্বামীদের নিদারুণ অত্যাচারের জন্যই নারী সমাজ টুসু গীতে স্বামীদের সম্পর্কে নীরব।(ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত, পৃষ্ঠা- ১৬৭) আবার পিতৃ এবং শ্বশুর প্রসঙ্গ লোকসাহিত্যে একেবারেই অনুপস্থিত। সে কারণে টুসু গানগুলোতেও তাদের প্রসঙ্গ নেই বললেই চলে।"

চলবে...

Post a Comment

1 Comments