লাগে দোল পাতায় পাতায় ( প্রথম পর্ব )
মিলি ঘোষ
তবুও রবীন্দ্রনাথ
নিজের নাম যেদিন শুনেছে, সেদিন থেকেই বোধহয় 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর' এই নামটির সঙ্গেও পরিচয় ঘটেছে মধুবন্তীর। নামটাই যথেষ্ট।
তাঁর কোনও কবিতা না পড়েও মধুবন্তী জেনে গেল, তিনি বিশ্বকবি। বা যদি পড়েও থাকে, হৃদয় নেয়নি। তারপর কবে যে 'কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি' পড়েছে, সে'সব আলাদা করে আর মনেও নেই। পাঠ্য বই বা তার বাইরেও কত কবিতাই তো পড়ল মধু। সব কি আর বুঝে পড়েছে, না সব ওর ভালো লেগেছে ? স্কুলে শিক্ষিকারা অথবা বাড়িতে, মা-বাবা বোঝালেও সব সময় বুঝতে যে মন চেয়েছে, তাও নয়।
রবীন্দ্রনাথকে মধুবন্তীর মনে হতো বহু দূরের এক আকাশ ছোঁয়া পাহাড়। দূর থেকে দেখা গেলেও, ঠিক যেন বোঝা যায় না। জানলা দিয়ে তাকালে বা ছাদে উঠে দেখলে অবয়বটা স্পষ্ট। কিন্তু রঙটা হালকা। যেন মেঘের সঙ্গে একাকার। মনে হয় কাছে যাই, কিন্তু উপায় নেই।
মধু বুঝতে শুরু করল, রবীন্দ্রনাথ, রোজকার ডাল ভাতের মতোই সত্যি। খেতে ভালো লাগুক আর না লাগুক, এটা একটা অভ্যাস।
এই অভ্যাসই যে কখন ভালো লাগায় পরিণত হলো মধু নিজেও বুঝল না।
''রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে,
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে ..."
কতটা বুঝে গাইছে মধু, সে মধুই জানে। কিন্তু এ'গানের সুর ওকে আকৃষ্ট করল।
মধুবন্তী ঘুরে ঘুরে নাচে আর গায়,
'মৌমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা ...'
মৌমাছি আর ফুল ছাড়া আর কিছুই হয়তো মাথায় ঢোকেনি ওর। বাকি শব্দগুলোর অর্থ পৃথকভাবে বুঝলেও একটা শব্দের সঙ্গে আর একটা শব্দের কোনও যোগসূত্র বা সম্পর্ক মধু খুঁজে পেল না। বিশেষ করে 'ফুলের দখিনা' আর 'ভিখারির বীণা' কেন বলা হচ্ছে বোঝার বয়স তখন মধুর হয়নি। তবু ওর ভালো লাগছে। শুধুই কি সুরের টানে, না কি আরো কিছু ? কে জানে, অত ভাবার দরকার নেই তো মধুর। ভালো লাগছে, এটাই শেষ কথা।
কারণ ছাড়াই মন কাড়ছে বহু গান, বহু কবিতা। না বোঝা অংশগুলো যেন বুঝি বুঝি করেও বোঝা আর হয়ে ওঠে না মধুর।
শুধু নিজের ভালো লাগার জন্য, নিজেকে ভালো রাখার জন্য মানুষ কী না করে। সেই অমৃতই যদি, নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়, তবে তার গভীরে গিয়ে কী কাজ! রবীন্দ্রনাথকে বোঝা না বোঝার দোলাচলের মধ্যে দিয়েই পথ কেটে কেটে চলল মধুবন্তী।
যখন বোঝার, তখন নিজেই বুঝল। রবীন্দ্রনাথ তো আর শেষ হবার নয়, অনন্ত কালের সঙ্গী। আগে যা বোঝেনি বা অর্ধেক বুঝেই ভালোবেসেছে, এখন তা'ই হয়ে উঠল সহজ, সরল, প্রাণবন্ত। নতুন করে সে'সব গান, কবিতা ধরা দিল মধুর কাছে। পড়ার পরিধি ক্রমেই বাড়ছে। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক, গীতিনাট্য ইত্যাদি সব কিছুতেই যেন আচ্ছন্ন হলো মধুবন্তী।
এখন মধু বুঝেই গান গায়,
"ফাগুন প্রাতের উতলা গো, চৈত্র রাতের উদাসী,
তোমার পথে আমরা ভেসেছি।"
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
ঋতুরাজ 'বসন্ত'। কেন বসন্তকেই রাজা বলা হচ্ছে ? এ প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে মধুর মনে। রাজা যে কেউ হতে পারে, তার নিজ নিজ জায়গা থেকে। শরৎ তো রাণী। বর্ষাও রাণী। তাহলে, এক রাজার দুই রাণী। শীত, গ্রীষ্ম আর হেমন্ত কি তবে প্রজা ? সব কিছুর মতোই দাগিয়ে দেওয়া ? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। ঋতুরও শ্রেণী বিভাগ! এমন হাজারো প্রশ্ন আসে, যায় মধুর মনে।
আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথও কি বসন্তকে একটু বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন ? আর বর্ষাকেও। তার মানে বর্ষা হলো সুয়ো রাণী আর শরৎ দুয়ো রাণী। ইসসস, বর্ষায় জল, কাদা। সেই বর্ষা হলো সুয়ো রাণী! যাক গে, যাক গে, বসন্তর রাণী, বসন্ত বুঝুক। মধু সব চিন্তা বসন্তর ঘাড়ে চাপিয়ে গীতবিতান খুলে বসে। কিন্তু, ওরও কি বসন্তকে একটু বেশি ভালো লাগছে ? ওখানেই কেন চোখ যাচ্ছে বারে বারে ? নাকি রবীন্দ্রনাথই ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বসন্তর দিকে!
মধুবন্তী গুনগুন করে নিজের মনেই,
"দখিন হাওয়া জাগো জাগো,
জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ।"
স্কুলে পড়তে তো কোনও দ্বিমত থাকল না। সকলেই রবীন্দ্রভক্ত। সকলের বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ বিরাজ করছেন। রবীন্দ্র রচনাবলী যদি নাও থাকে, গীতবিতান আর নিদেনপক্ষে রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি তো সব বাড়িতেই রয়েছে। শিক্ষিত পরিবার হবার প্রথম শর্তই হলো রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁকে না জেনে, না বুঝেই।
গুটি কয় গান, যা সবার গলায় ঘোরে ফেরে। গুটি কয় কবিতা, যা যে কোনও অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করা হয়। আর নয়তো অমল আর দইওয়ালা। ব্যাস, রবীন্দ্রনাথ এখানেই শেষ। মহাসাগর থেকে এক ঘটি জল তুলে নিয়ে মানুষ রবীন্দ্রনাথকে চিনল। বুক চিতিয়ে বলল, "আমাদের রবীন্দ্রনাথ।"
আর, এক আকাশ প্রতিভা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আটকে থাকলেন, পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে।
তবুও রবীন্দ্রনাথ। বহু মানুষ তাঁকে ভালোবাসল। তাঁকে নিয়ে আলোচনা, গবেষণার অন্ত নেই। বছরে দু'বার রবীন্দ্রপুজোর বাইরেও অনেক কিছুই থাকে। অনেক কিছুই ঘটে। তাই কলেজ ক্যান্টিনে, কফি হাউজে ঝড় ওঠে। বিষয় : রবীন্দ্রনাথ। সেখানে বহু রবীন্দ্রবিরোধী, রবীন্দ্রপ্রেমীর সমাগম। যুক্তি, পাল্টা যুক্তির তুফান ওঠে। কিন্তু আলোচ্য বিষয়, সেই রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে যে থাকা যায় না, তা মধুবন্তী ভালোই বুঝল।
কলেজে একদিন অনুরাগ, মধুবন্তীকে বলল, "কী পাস, রবীন্দ্রসঙ্গীতে ? যত্তসব ঘ্যানঘ্যানে গান।"
মধুবন্তী বলল, "তা ঠিক। বেশ কিছু গান, বড্ড একঘেয়ে। কিন্তু, সেগুলো বেশিরভাগই গায়কির জন্য। কে কীভাবে গাইবে, কে কী বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করবে, সে দায় তো রবীন্দ্রনাথের নয়।'
"আরে, লোকটা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে। নিজের প্রচার নিজেই করেছে।"
"ভাগ্যিস করেছেন। তাই আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি। প্রতিদিন শিখছি। আর ঠাকুর চাকরের ঘেরা বৃত্তে, ক'দিন ঠিকঠাক খাবার পেয়েছেন তিনি ?"
এমন তর্ক বিতর্ক বন্ধুদের মধ্যে চলতেই থাকে। সব সময় যে মধুবন্তী মুখ খোলে, তা নয়।
এক এক সময় বলে, "আগে রবীন্দ্রনাথ পড়। তাঁকে বোঝ। তারপর তর্ক করিস।"
তবে কলেজ ক্যান্টিনের বেশিরভাগ তর্ক বিতর্ক শেষ হয়, মধুবন্তীর গান দিয়েই।
যারা রবীন্দ্র সঙ্গীতকে ঘ্যানঘ্যানে বলে, তারাও চুপ করে শোনে মধুর গান।
মধুবন্তী তখন গাইছে,
"আমি কী বলিব, কার কথা,
কোন্ সুখ, কোন্ ব্যাথা--
নাই কথা, তবু সাধ শত কথা কই।"
সেদিন ছিল মধুবন্তীর জন্মদিন। রাত বারোটা বাজতেই হোয়াটসঅ্যাপে, মেসেঞ্জারে বন্ধুদের শুভেচ্ছা বার্তা আসতে শুরু করল।
কিন্তু অনুরাগের মেসেজ পেয়ে মধুবন্তী স্তম্ভিত।
অনুরাগ লিখেছে,
"আমার প্রাণের সুধা আছে, চাও কি --
হায় বুঝি তার খবর পেলে না।
পারিজাতের মধুর গন্ধ পাও কি,
হায় বুঝি তার নাগাল মেলে না।"
মধুবন্তী হাসতে হাসতে বলল, "হলো কী তোর ? তোর মতো রবীন্দ্র বিরোধী .... যাই হোক, ধন্যবাদ।"
"আরে, তোকে উইশ করব বলে গীতবিতান খুলে বসেছিলাম। কিছুতেই লাইন পছন্দ হচ্ছিল না। তারপর একটা যুতসই গানের লাইন পেলাম।"
"গীতবিতানটা কার ? কাকিমার ?"
"না, না। ওই, সব বাড়িতেই যেমন থাকে না, সে'রকম আর কী।"
"যাক, আমার জন্য এত খাটলি, এবার ঘুমোতে যা।"
"যাব। তার আগে তুই দু'লাইন গান শোনা, মধু। আজকের জন্য, আমার জন্য। প্লিজ।"
মধুবন্তী থমকাল।
বলল, " এত রাতে! আচ্ছা, কী শোনাব বল।"
"আমি তোকে যা পাঠালাম, তার উত্তর।"
মোবাইল হাতে মধুবন্তী চুপ।
তারপর গাইতে শুরু করল, "যখন প্রথম ধরেছে কলি, আমার মল্লিকা বনে ...."
0 Comments