জ্বলদর্চি

দেশান্তরী -৬/হিল্লোল রায়

দেশান্তরী -৬
হিল্লোল রায় 

আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে

তারপরের গল্প সবই মামুলি যেগুলো অনুপম বোসের সাথে হয়েছিল। নতুন প্যাকেট সিগারেট কিনে মিঃ বোস মুখাগ্নি করবার সময় আমাকেও একটি ক্যাপ্সট্যান সিগারেট অফার করেছিলেন। “নোথ্যাঙ্ক ইউবলে তাকে সহাস্যে ফেরৎ দিয়েছিলাম।

দু চারটে অনুল্লেখযোগ্য কথাবার্ত্তা হবার পর আমরা বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামের সামনে এসে দাঁড়ালাম এস্পল্যানেডমুখী বাস-ট্রাম ধরবার জন্য। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ৩০ নং ট্রাম চেপে দুজন যখন এস্পল্যানেড পৌঁছাই তখন ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁই ছুঁই । আমার পেটও তখন চুঁই চুঁই । অনুপমদা চলে গেল বাড়ির দিকে। চা-এর সংগে টা খেয়ে আমিও মানক সংস্থায়। “চা” এর সংগে “টা”এর সৎ্কার করে আমি যখন ভারতীয় মানক সংস্থাকলকাতা শাখার চতুর্থ তলে বন্ধুবর শ্রীমাণ সঞ্চয় ঘোষের চেম্বারে ঢুকলাম তখন বেলা দুটোর কাছাকাছি। মিঃ ঘোষের আকর্ণবিস্তৃত হাসি ও উষ্ণ অভ্যর্থনা আমার পথশ্রান্তিকে ভুলিয়ে দিয়ে নিমেষেই চাঙ্গা করে তুলল।

-হোয়াটস ইয়োর এ্যাচিভমেন্ট টুডেহিরেআই সিইউ আর লিটল বিট এক্সাইটেড?

-য়্যাজাস্ট রিটার্ণিং ফ্রম ইউ এস কনস্যুলেট অফিস। ইমিগ্রেশান ইজ ওপেন্ড।

-দেন ইউ সীহিরেআই টোল্ড এ বেয়ার ট্রুথইউ আর এ লাকি চ্যাপ।

সত্যি সঞ্চয়ের কথাটা হুবহু মিলে গেল। আমি তখন আনন্দে ডগমগ হয়ে এস.জি (সংক্ষেপে 'স্জিবলতাম সঞ্চয় ঘোষের নামের এ্যাব্রিভিয়েশান করে)-কে 'থ্যাংক ইউকিংবা 'টিএ নেমন্তন্ন করে ছোট করতে চাইলাম না কারণ ইমিগ্রাণ্ট ভিসা পাওয়া যখন আমার কাছে “বামন হয়ে ধরতে যাওয়া চাঁদমতলবটা ভাল নয়মস্ত অপরাধ” মত মনে হচ্ছিল এবং হয়েওছিলতখন আমার মানসপটের প্রদীপশিখাকে মিটিমিটি করে তেল-সলতে দিয়ে জ্বালি্যে রেখেছিল বন্ধুবর সঞ্চয় ঘোষ। আনন্দের আতিশয্যে এবং ভগবানের “Blessing in disguise” -পাওয়ার সৌভাগ্য হয়ত আজ আমার হয়েছে। “এ জগতে মানুষ আপনার ঘর আপনি রচনা করে”- “Man is the architect of his own fate” -ইত্যাদি অভ্রান্তিকর জ্ঞান বাণীর সু্যোগকে কাজে লাগাতেই হবে। আমার দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠযুগল দুর্জ্জয় মানস সংকল্প সাধনের বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি।

খুঁতখুঁতে স্বভাব থাকলে যা হয়। কথাপ্রসংগে তখন একটা কথা প্রায়ই বলতাম গুরুজন এমন কি বন্ধু-বান্ধব মহলেও “আপ টু মাই এনটায়ার স্যাটিস্ফ্যাকশন” না হলে মনের খুঁতখুঁতুনি কিছুতেই যেত না। আর একটা ব্যাপার হলকোন ব্যাপারে ডিসিশান নেভার আগে কি কি 'ড্র ব্যাকসএ্যারাইজ করতে পারে। প্রসেসেজ টু এসকেপস্টেপস টু এ্যাভয়েড দোজ ড্র ব্যাকসআল্টিমেট কনক্লুসানপ্রসিডিওরস টু ইমপ্রুভ এনি সিস্টেমস'- এ্যাজ এ হোলওয়াইজ সাজেসশানস রিগ্যার্ডিং ইটস এ্যাবিলিটি এ্যান্ড এ্যাপ্লিকেবিলিটি”এই জিনিষগুলো ভেবে নিয়ে এগুতাম কোনো কাজ করবার আগে। এত পয়েন্ট চিন্তা করে কাজ করার অভ্যাস্টা (কার কার মতে 'বদভ্যাসও মনে হতে পারেমাতুল সূত্রে লব্ধ। এ সম্পর্কে দ্বিমত নেই।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



মনের খুঁতখুঁতানিটা প্রকট হয়ে উঠল ইমিগ্রাণ্ট ভিসার ব্যাপারে ফর্ম FS 497 জমা দেবার পর থেকেই বিশেষ করে Item 23(FS 497) -Why do you intend to go to USA- এর উত্তরে লিখেছিলাম Like to go for M.S. and PhD in Environmental Engineering and then job seeking. ভাবছিলামএর জন্য যদি আমাকে 'স্টুডেন্ট ভিসারপর্য্যায় ভুক্ত করে তা হলেই মুস্কিল। তা ছাড়া FS 497 জমা দেওয়ার পর প্রায় একমাস হতে চললো কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছি না কন্সালেট থেকে। ভাবলাম আমার চেষ্টা করা নিরর্থক। এই ধরনের সূত্র সন্ধানে নতুন বন্ধুর আবির্ভাব।

একই পথের পথিক-মোরা চলেছি সেই পথ

শিবপুর বি..কলেজ থেকে ছাত্র সম্পর্ক ছিন্ন হবার কালক্ষণ আমার জুন ১৯৭৪কনসাল অফিসে কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ব্যাচের আর কেউ ইমিগ্রেশ্যানের ব্যাপারে দৌড়্ধাঁপ করছে না। অন্যান্য ব্যাচের (১৯৭৪ এর আগেরঅনেকেই চেষ্টা করছে এবং বি.কলেজ বলে কলেজ থাকাকালিন কোন কথাবার্তা না হলেও ভূমিকা অবতরণীকাবিহীন পরিচয়ে “চাও সিগারেট খাওয়া বেশ চলত ঐ কনসালেটে 'গ্যাদারিংসূত্রে। এই হঠাৎ পরিচয়ের সূত্রসুযোগে যে বন্ধুর সংগে হৃদ্যতাটা একটু মাখামাখি হয়েছিল তিনি হলেন চঞ্চল সেনগুপ্তবি..(ক্যালসি.১৯৭১ ব্যাচ। কোঁকড়া চুলদীর্ঘকায় ৫'-'', গায়ের রং অল্পবিস্তর কৃষ্ণকায় চশমাটা বেশ ভারী ফ্রেমের মুখে অহেতুক গাম্ভীর্য্য আনবার বৃথা চেষ্টা তিনি ভারী ফ্রেম চশমা দিয়ে করেছেন। তবে আমার সংগে পরিচয়ের পর থেকে গাম্ভীর্য্যকে তিনি শিকেয় তুলে রেখে আমার সংগে কথা বলতেন। অবশ্য এই গাম্ভীর্য্য আসবার ও বজায় রাখবারই কথা। -কারণ তিনি হলেন ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেণ্ট অথরিটি (সংক্ষেপে সি.এম.ডি..), দমদম ওয়াটার সাপ্লাই উইংস -এর এ্যাসিস্ট্যান্ট ঞ্জিনীয়ার। আগেই বলেছি আমার সংগে গাম্ভীর্য্যটা তিনি সহাস্যে পরিত্যাগ করে কথা বলতেন। আর আমিও মিঃ সেনগুপ্তকে 'চঞ্চলদাবলেই ডাকতাম। কারণদাদার পর্য্যায়ে না ফেললেআমাদের আলোচনাটাকে অহেতুক ভারী না করে সাহিত্যের হালকা পাখায় টেনে নিয়ে যেতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল।

চঞ্চলদাও আলোচনাকে হালকা করে দিলেন। ইমিগ্যাণ্ট ভিসার ব্যাপারে চঞ্চলদা আমার চেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে অন্ততঃ FS 497 জমা দেবার ব্যাপারে। কলকাতা -৩৭(পাইকপাড়াএর গভর্ণমেণ্ট হাউসিং এস্টেট -বাড়ীগুলোর বাসিন্দা হলেন এই চঞ্চলদা। ব্যাপারটা এই রকমঃ আমার বড়মামা শিশির নিয়োগী ব্লক 'ফ্ল্যাট -সাতএম.আইজি ফ্ল্যাটস৩৭ বেলগাছিয়া রোডকলকাতা-৩৭ এই ঠিকানায় থাকতেন আর চঞ্চলদা হলেন ব্লক 'বিফ্ল্যাট-৮ এর বর্ডার । চঞ্চলদার বাসস্থানের বাকী ঠিকানা একই। বিভিন্ন কাজের মূলে এবং পরামর্শ নেবার জন্য বড়মামার বাড়ীতে প্রায়ই গিয়েছি।

হাবড়া থেকে যাতায়াতের কিংবা কোনো কাজে সময় সংক্ষিপ্ততায় উদ্ভুত অসুবিধা দূর করবার জন্য বড়মামার বাড়ীতে গিয়ে থেকেছি।

হঠাৎ পরিচয়ের সূত্রে যে চঞ্চলদার সংগে আলাপতিনি যে একেবারেই মামাবাড়ীর (মামা এবং চঞ্চলদা দুজনেই চারতলায় থাকতেন)পাশের বাড়ীতে এমনকি বারান্দার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলার ও আলোচনা করবার মত জায়গায় থাকেন ভাবতেই পারি নি। ভালোই হল। আমি ও চঞ্চলদা -দুজনেই এখন একই পথের পথিক। কাজেই পারস্পরিক দেখাশোনা হলেই ইমিগ্র্যাণ্ট ভিসা নিয়েই আলোচনা চলত। চঞ্চলদার অন্য বন্ধুরা নিশ্চুপ হয়ে আলোচনা শুনত। যে জন্য চঞ্চলদার প্রসংগ তুললাম সেটা হল ও FS 497 জমা দেবার সাত দিনের মধ্যেই দ্বিতীয় ফর্ম (7-50A, দুটো কপিপেয়ে যায়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ ব্যাপারে তখন ব্যস্ত চঞ্চলদা।

কনস্যুলেট অফিস নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ায় আমি আর স্থির থাকতে পারছিলাম না। কারণ FS 497 জমা দেবার এক সপ্তাহের মধ্যে স্টুডেন্ট ভিসার চেষ্টা করতে হবে। ইমিগ্র্যাণ্ট ভিসা পাব না। আমার মনের দুর্বলতা FS 497 ফর্নে Item 23কে নিয়েই। যাই হোকহন্তদন্ত হয়ে কনস্যুলেটে ছুটলাম জুন ২৫১৯৭৪মংগলবার১১ই আষাঢ় ১৩৮১ সাল। আর্গোসি থেকে মনে মনে ঠিক করে এসেছিলাম নতুন আর একটা ফর্ম FS 497 জমা দেব। প্রথমটার ঠিকানা ছিল “আর্গোসি”পোঃ-হিজলপুকুরিয়া২৪ পরগ্ণাপঃ বংগ আর এবারের ঠিকানা কলকাতার মামাবাড়ীর, c/o শিশির নিয়োগীব্লক এ/সাত৩৭ বেলগাছিয়া রোডকলকাতা -৩৭। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। কনস্যুলেট অফিস থেকে আর একটা নতুন FS 497 ফর্ম নিয়ে পূরণ করে সেদিনই জমা দিই। এবার Item 23 তে লিখেছি “লাইক টু বি গেনফ্যুলি এম্পলয়েড।”

কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম এক মাসের মধ্যেই উত্তর পাওয়ার আসার আশায়। হাবড়ার ঠিকান্য না এলেও কলকাতা-৩৭ এ নিশ্চয়ই চিঠি যাবে। এই দ্বিতীয় ফর্ম জমা দেবার ব্যাপারে কাউকে জানাই নি। এমন কি সমস্ত ব্যাপারে সঞ্চয় ঘোষের পরামর্শ নিলেও এ ব্যাপারে আমি নীরব রইলাম। সঞ্চয় ঘোষ অতিমাত্রায় উৎসাহী হওয়ায় ইমিগ্রেশ্যান ব্যাপারে নাড়ী নক্ষত্রের খবর জোগাড় করে এনে দিত আমাকে। আমার ছোটমামা তুষার নিয়োগীও এ ব্যাপারে বেশ সোৎসাহে সঙ্গ দিয়েছিলেন।

প্রভিশন্যাল সার্টিফিকেট সন্ধানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

বেশ মনে আছে জুন ২০১৯৭৪বৃহস্পতিবার বন্ধু সঞ্চয়ের মাধ্যমে ছোটমামার লেখা একটা চিঠিতে জানলাম-”ইমিগ্রেশ্যানের দ্বিতীয় ফর্ম জমা দিতে গেলে একটা সার্টিফিকেট অন হায়েস্ট এ্যাকাডেমিক ডিগ্রী এ্যাচিভমেণ্ট (তোমার ক্ষেত্রে বি..) ফ্রম দি ইউনিভার্সিটি ইউ এ্যাটেন্ডেড লাস্ট এর প্রয়োজন । সেজন্য একটা ফর্ম ইউনিভার্সিটিতে জমা দিতে হ্য় এবং পাঁচ টাকা ফি লাগে।”

ছোটমামার চিঠি পেলাম রাত্রে ৯-৩০ মিনিট নাগাদ কারণ সঞ্চয় অফিস থেকে হাবড়া ফেরার পথে আর্গোসিতে এসে চিঠিটা আমাকে দেয়। তখন থেকেই বুঝলাম দৌড়ঝাঁপ করতে হবে। না হলে বাড়ীতে বসে থেকে বন্ধুবান্ধবদের উপর দায়িত্ব চাপালে চলবে না। পরের দিন অর্থাৎ ২১শে জুন১৯৭৪ শুক্রবার (৭ই আষাঢ় ১৩৮১ সনসকাল হতেই প্রস্তুতি পর্ব নিলাম এবং ডাইরীর পাতায় (সবুজ কভার১৯৭৪ সালের) 'ট্যুর প্রোগ্রামসহেডিং দিয়ে 'টাইমিং এ্যাডজাস্টমেন্ট শিডিউল” তৈ্রী করে নিই। পরে এজন্য আমার কাজের অনেক সুবিধা হয়েছিল।

কোন রকমে নাকে মুখে কিছু গুঁজে সকাল ৮-৩০ মিনিটের হাবড়া লোক্যালে করে শিয়ালদহ ট্রেন স্টেশনে এসে পৌঁছাই। বেলা তখন দশটা। অফিস যাত্রীদের প্রাণান্তকর ভীড়বাসে-ট্রামে ধাক্কাধাক্কিগুঁতোগুঁতি আমার ধাতে সয় না। তাই পায়ে হেঁটেই চলে এলাম শিয়ালদহ স্টেশন থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অফিস ভবনের কলেজ স্ট্রীট অঞ্চলে। ঘড়ির কাঁটায় ১০-৪৫ মিঃ। 'অনুসন্ধানবিভাগে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম Provisional Certificate পাবার জন্য ফর্ম পূরণ করতে হবে। ফর্মটা নিয়ে বেরুলাম বেলা ১-৩০মিঃ।

আমার পথ চলার সঙ্গী সবুজ ডাইরি করার মধ্যে বি.পরীক্ষার প্রভিশন্যাল সার্টিফিকেট এর এ্যাপ্লাই করার ফর্মটাকে সযত্নে শুইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়(কলেজ স্ট্রীটস্থ অফিসত্যাগ করে রাস্তায় এসে যখন পৌঁছাই ক্ষিদের চোটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে। আর একটু দেরী হলে হয়তো ডন-বৈঠক দুটোই দেওয়া শুরু করবে। কারণ সকালে হাবড়া থেকে যা খেয়ে পথে বেরিয়েছিলাম সেগুলোর সার অংশ শরীরের রক্ত তৈ্রী করবার কাজে লিপ্ত হয়েছে এতক্ষণফুসফুসহৃৎপিন্ডকে সক্রিয় করে রাখতেচেষ্টা করছে নিশ্চই আর অজীর্ণ অংশ “এগঝস্ট”(exhaust) রূপ পরিগ্রহ করেছে। সেই সাথে জলপিপাসাও পেয়েছে বেশ।

হাতের খামগুলো পারিপার্শ্বিক গরমের দাপটে লোমকূপের নীচে ঘোমটা দিয়ে চুপটি করে বসে আছে। পকেট থেকে ৮ ইঞ্চি ৮ ইঞ্চি সাদা কাপড়ের টুকরোখানা বার করে চোখ-মুখ-গলা-হাত মুছে ফেললাম। বুঝলাম শরীরে এখন কিছু “আনলিডেড ফুয়েল” (UNLEADED FUEL) জোগানোর প্রয়োজন। হঠাৎ 'আনলিডেড'- কথাটা উল্লেখ করলাম কেন প্রশ্ন উঠতে পারে। আমার জন্ডিস (লিভারের রোগযেটা ১৯৭৩ সালের ২রা এপ্রিল থেকে ৩০শে এপ্রিল পর্য্যন্ত হয়েছিলহবার পর খাওয়া -দাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতাম। মাছ-মাংস-ফ্যাট ইত্যাদি বিহীন খাবারগুলোকে আমি 'আনলিডেড ফুয়েলহিসাবে ব্যবহার করতাম আমার হাড়-মাংস-হৃৎপিন্ড ফুসফুস যন্ত্রগুলোকে সচল করে রাখতে।

নব্বই পয়সার কোকাকোলার বোতল সৎ্কার করতেই পিপাসারা যেন বেড়ে গেল। কিন্তু পয়সার কথা চিন্তা করে 'চাএর সংগে কিছু 'টা' (কেকবিস্কুটখেয়ে পাকস্থলীকে বল্লামঃ “তিষ্ঠ বৎসতিষ্ঠ।” কি আশ্চর্য্য। পাকস্থলী ও সংগে সংগে নিশ্চুপনীরব। কাছাকাছি ঘড়ি না থাকায় দৃষ্টিশক্তিকে প্রসারিত করলাম একটু দূরের বাসনপত্রের দোকানে। আমার চোখের কালো লেন্সগুলো তখন ঘড়ির কাঁটার অবস্থান জানতে উদ্গ্রীব। চোখের মধ্যে হঠাৎ একটা অদৃশ্য বস্তুর আগম হওয়াতে জ্বালা করছিল। ভালো করে চোখে মুখে জল দিয়ে যখন চোখটাকে সুস্থ করে তুললাম তখন ঘড়ির বড়হাত ও ছোটহাত পরস্পরের মধ্যে এক সমকোণ অর্থাৎ জ্যামিতির পরিভাষায় ৯০ ডিগ্রী তৈ্রী করেছে।

একটু ব্যস্ত হলাম বেলা তিনটে বেজে যাওয়ায়কারণ এবার আমাকে ছুটতে হবে শিবপুর বি..কলেজের দিকে। প্রভিশন্যাল সার্টিফিকেট এর জন্য প্রয়োজনীয় ফর্মে প্রিন্সিপ্যাল অব দি লাস্ট কলেজ এ্যাটেন্ডেড এর সিগ্নেচার করতে হবে। এবার আমার দৈহিক কসরৎ শুরু করতে হল বাস-ট্রাম ধরবার জন্য। এতক্ষণ ডন-বৈঠকটা পেটের মধ্যেই চলছিল। অনেক কষ্ট করে জামার বুকের ও হাতের বোতাম দুটোকে উৎসর্গ করে বাসে উঠলাম ৩-০৫ মিঃ। হাওড়া স্টেশনে এসে বি.কলেজ-হাওড়া রুটের ৫৫ নম্বর বাসে সৌভাগ্যক্রমে ঢুকবার সুযোগ পেয়েছিলামবসার জায়গা দূরে থাক।

তারপর শুরু হল “উদয় শংকর” নৃ্ত্য (হাওড়া গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোডের চড়াই-উৎরাই এই নৃ্ত্যের হোতা। বাসে ঝুলছি ও তালে নাচছি। প্রায় ৩-৪৫ মিঃ (বিকেলনাগাদ বিকলেজে পদার্পণ। হাতির পাঁচ পা দেখার মতোই বি.কলেজের প্রিন্সিপ্যালের দেখা পাওয়া একটা 'মার্ভেলাসব্যাপার। ডন-বৈঠকউদয়শংকরী নৃ্ত্য দিয়েজামার বোতাম খুঁইয়েপাকস্থলীতে নতুন করে জল ভর্তি করে ও ফুয়েল ভরে চাঙ্গা করে গিয়ে অধ্যক্ষ মশায়ের দেখা না পাওয়ায় মেজাজ গেল খিঁচড়ে।

কার না রাগ হয় বলুনকিন্তু রাগ করলে নিজেকেই পস্তাতে হবে বলে 'রাগজিনিসটার তাৎক্ষণিক ঘনত্ব মানসিক”হাইড্রোমিটারেমেপে ফেললামআর তাপমাত্রাটা নিরুপণে সহায়তা নিলাম সক্রিয় হাত দুটোর। আমি ও নাছোড়বান্দা। পি.টু দি প্রিন্সিপাল মিঃ এদাসকে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বল্লাম। “প্রফেসর দুর্গাদাস ব্যানার্জি (ডি.ব্যানার্জি প্রিন্সিপালছুটিতে আছেন।

সই পেতে গড়িমসিকোথা গেলো আজ শশী

শারীরিক অসুস্থতার দরুণ বাড়ীতে বসে বিশ্রাম করছেন। সো ইউ বেটার মিট হিম এ্যাট হিস রেসিডেন্স। আর এই ফর্মটা উইথ ইয়োর কলেজ এ্যান্ড ইউনিভার্সিটি রেজিস্ট্রেশ্যান নম্বর দিয়ে সাবমিট করে দিন এ্যাট এগজামিনেশন সেন্টার (ফার্স্ট ফ্লোর)” - মিঃ দাসের সংগে আমার এ আলোচনাটা বিশেষফলপ্রসূ মনে হল না। তবুও “অগতির গতি তুমি” মনে করেই এগজামিনেশন সেন্টারে(বি.কলেজের পরীক্ষা ও সার্টিফিকেট ইত্যাদি সংক্রান্ত অফিসফর্ম ও কাগজপত্র জমা দিলাম বিকেল ৪ টে নাগাদজুন ২১১৯৭৪। বিষণ্ণ মনে ফিরলাম বি..কলেজ গিয়ে প্রিন্সিপ্যালের দেখা না পাওয়ায়। সেদিনের কাজে ক্ষণিকের বিরতি নিয়ে ফিরলাম হাবড়ায়। প্রভিশন্যাল সার্টিফিকেট জোগাড়ের অন্য কোন রাস্তার সন্ধানেও সক্রিয় হলাম

একঢিলে দুই পাখী মারার উদ্দেশ্য নিয়ে পর দিন 'আর্গোসিথেকে বেরুলাম সকাল ৭-১২ মিনিটের ট্রেনে। মানুষের ভীড় গুঁতোগুঁতি ঠেলে অনেক কসরৎ করে যখন বি.কলেজে পৌঁছাই তখন সকাল ৯-২৫ মিনিট। যথারীতি অধ্যক্ষ তখনও কলেজে আসেন নি। আমারও ফর্মে সিগ্নেচার করা হয় নি অর্থাৎ অবস্থাটা 'যথা পূর্বং তথা পরং।এদিকে আমার জলপানির টাকা সরকারি ফিতার লাল ফাঁস বি..কলেজ ত্যাগ করার পর পাই জুন ২৪১৯৭৪ সোমবার বেলা এগারোটা নাগাদ। বাড়ি থেকে স্থির লক্ষ্য নিয়েই বেরিয়েছিলাম ৫ম বর্ষের জলপানির টাকা ও ফর্ম সই করে নিয়ে তবে বি.কলেজ থেকে ফিরব। আমার প্রতিজ্ঞা মতই কাজ।

এগজামিনেশন সেন্টারে গিয়ে দেখি আমার কাগজপত্র নির্বিঘ্নে দিবানিদ্রা যাচ্ছে। আর কাঁচের পেপারওয়েটটা- “ঘুম আয়ঘুম আয়” বলে তাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। মাঝখানে একটা চড়াই পাখী তার বংশবিস্তারের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শশব্যস্ত হয়ে ছুটছিল। তার মুখনিসৃ্ত তৃণখন্ড আমার ফর্মের এক প্রান্তে ঠাঁই পেল। অফিসের অন্যান্য কর্মীরা নিজেদের কথোপকথনেই মশগুল। “ঝুলপির লেংথ”কেমন হলে ভাল দেখায়কোন সেলুনে পঞ্চাশ পয়সায় চুল ছাঁটা যায়অমুকের মেয়ের বিয়েতে বেশ খাইয়েছে। গুরু তোমারটা এবার নামিয়ে দাও”। আমরা একটু লুটেপুটে খাই-ইত্যাদির অংশবিশেষ কানে আসছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বিঘ্ন ঘটিয়ে আমার ফর্মটার 'প্রসেসিংজিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি অধ্যক্ষে্র বাড়ি গিয়ে সই করে নেওয়ার চেষ্টা করুন”-উত্তর।

আমার কাছে তখন সময়ের মূল্য এত বেশী যে বাজে কাজে কিংবা কথায় সেটাকে নষ্ট করতে পারচি না। এক পকেটে জলপানির (৯৭০ টাকাদক্ষিণা অন্য পকেটে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের হিসাব নিকাশ। জুন ২৪১৯৭৪ সোমবারবেলা বারোটা নাগাদ ছুটলাম বি..কলেজঅধ্যক্ষ দুর্গাদাস ব্যানার্জীর কোয়ার্টার অভিমুখে। কোয়ার্টারে ঢুকতে লাঠি হাতে দন্ডায়মান দারোয়ান-এর সম্মতি নিতে হবে। দারোয়ান এক তলার দ্বাররক্ষী। অধ্যক্ষের অবস্থান দোতলায়। নিরক্ষর দারোয়ানের হাতে আমার প্রভিশন্যাল বি..সার্টিফিকেটের ফর্ম সই করতে পাঠালাম। সত্যি খুব খারাপ লাগছেঐ দারোয়ানের নাম মনে করতে পারছি না বলে।

ওর হাতের লাঠিটা মনে হল কোনদিন ব্যবহৃত হয় নি ঐ পদে নিযুক্ত হবার পর থেকে। তেল চকচকে গোঁফ ও এক ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট বেতের লাঠি হাতে দারোয়ানকে মন্দ লাগছিল না। এক হাতে খৈনী (চুন ও তামাক পাতা হাতের তালুতে টিপে টিপে তৈ্রী,)উড়িষ্যাবাসীদের প্রিয় নেশা ও অন্য হাতে আমার ফর্মখানা নিয়ে লাঠি ও পায়ের জুতো খুলে অতি সন্তর্পণে দোতলায় উঠছিল। আমিও নীচে দাঁড়িয়ে চারিদিকের প্রাকৃ্তিক পরিবেশ উপভোগ করছিলাম। “বাবু নিঁদ যাতা হ্যায়। সহি নাহি কিয়্যা “দারোয়ান এসে আমায় জবাব দিল। আমিও ছাড়বার পাত্র নই। একটু পরেই অধ্যক্ষের মেয়ে এসে বলল, “ আপনার ওটা যদি আর্জেন্ট হয়তাহলে বাবাকে ডেকে দিইকারণ উনি তো অসুস্থ।”

শুধুমাত্র একটা সই করতেই এত টালবাহানা। আমি বল্লামঃ “ফর্মটা পরশু দিন জমা দিয়ে গিয়েছি কলেজের অফিসে । অনেক দূর থেকে আসছি। আজ জমা দিলে সার্টিফিকেট এ সপ্তাহেই পেতে পারি।”

-ও আচ্ছা। তা হলে বাবাকে ডেকে দিআপনি বসুন”

অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা হয় নিকিন্তু তিনি তাঁর দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আমার ফর্মটায় সই করে দিলেন। আমিও ধন্যবাদ জানালাম মেয়েটাকে। সেও খুব খুশী।

ক্রমশ

ক্লিক করে পড়ে দেখতে পারেন 👇

হে, কবি হে... /ঋত্বিক ত্রিপাঠী



Post a Comment

0 Comments