জ্বলদর্চি

লাগে দোল পাতায় পাতায় ( দ্বিতীয় পর্ব )/ মাতৃভাষার টানে /মিলি ঘোষ

লাগে দোল পাতায় পাতায় ( দ্বিতীয় পর্ব ) 
মাতৃভাষার টানে 

মিলি ঘোষ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগের রাত থেকেই ফেসবুক ভরে উঠল বাংলা ভাষার প্রেমে। 
মধুবন্তী পোস্টগুলো দেখছে আর ভাবছে, সারা বছর এরা কোথায় থাকে ? হঠাৎ একটা পোস্টে মধুর চোখ আটকে গেল। ভাষা আন্দোলনের বিস্তারিত খবর দিয়ে একজন পোস্ট করেছেন। বেশ বড়ো লেখা। মধু পুরোটা পড়ল সময় নিয়ে। তার মধ্যে দু'বার অনুরাগের মেসেজ ঢুকেছে।
মধু জানে, উত্তর না দিলে অনুরাগ রেগে যাবে। 
   মধু বলেছে, "একটু পরে আসছি।"
কিন্তু 'একটু পর' তো সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। কথাটা শুধু আপেক্ষিক নয়, সম্পর্কের ওপরও নির্ভরশীল।
   তাই, মিনিট দুই বাদে আবার মেসেজ, "কী করছিস বল তো ?"
   "একটা আর্টিকল পড়ছি। হয়ে গেলে তোকে লিঙ্কটা দেব।"
অনুরাগ তখনের মতো থেমে গেল। 
  
    পড়া শেষ করে অনুরাগকে লিঙ্ক পাঠিয়ে মধু বলল, "বল।"
সিরিয়াস কিছু তো নয়। রোজ যেমন ঘুমোতে যাবার আগে গল্প চলে, তেমনই। প্রতি রাতেই অনুরাগ, কথা বলা হয়ে গেলে মধুর কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে। তবে, আজ ও মধুর পাঠানো লিঙ্কটা খুলে পড়তে শুরু করল।  
    নিজের মনেই বলল, "না পড়লে তো আবার ক্ষেপে যাবে। বলা যায় না, কাল পড়াও ধরতে পারে।" 
পড়তে গিয়ে এতটাই আকৃষ্ট হলো লেখাটাতে, না শেষ করে ঘুমোতে পারল না। বিষয়টা ভীষণভাবে নাড়া দিল অনুরাগকে, ওর একবার ইচ্ছে হলো, মধুকে ডেকে এই নিয়ে আলোচনা করে। 
    আবার ভাবল, "থাক, ঘুমোচ্ছে।"
কিন্তু নিজে ঘুমোতে পারল না। 
   "সত্যের মুখ বন্ধ করার কৌশল তাহলে সব দেশেই এক! প্রথম শহীদ, রফিকউদ্দিন আহমেদ। ছেলেটাকে মেরে রাত তিনটের সময় কবর দিয়ে দেওয়া হলো। বাড়ির লোক জানতেও পারল না! রটিয়ে দেওয়া হলো কোনও একটি বিশেষ দলের মদতে আন্দোলন বিশৃঙ্খলার রূপ নিয়েছে। সংবাদপত্রগুলোকেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রচার করতে বাধ্য করা হলো।" অনুরাগ এই সমস্ত ভাবছিল আর ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হচ্ছিল। 

   পরদিন কলেজে ঢুকেই হর্ষ বলতে শুরু করল,
"এইবার শুরু হবে,আমি বাংলায় গান গাই।" 
হর্ষ'র কথায় বন্ধুরা সবাই হাসল।
হর্ষ, স্বভাব রসিক। ওর বাচনভঙ্গিতেই মানুষ আকৃষ্ট হয়। একই কথা অন্যদের মুখে ততটা মধুর হয় না, যতটা হয় হর্ষ'র বলার স্টাইলে। ও মিমিক্রি করতেও ওস্তাদ। কলেজের প্রফেসর থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারা, কেউই ছাড় পান না। অফ টাইমে হর্ষ'ই মাতিয়ে রাখে ক্লাসটাকে। কিন্তু কোনওদিন আবৃত্তি বা নাটক কিছুই করল না। ইচ্ছা করলেই পারত। বন্ধুরা বলেওছে অনেকবার। কানে নেয় না।  
হর্ষ'ই দলের কেন্দ্রবিন্দু। 

   "ফেসবুক খুললে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। বাংলায় স্বপ্ন দেখি, বাংলায় ভাবি! একটা 'ওলা' বুক করলে ড্রাইভার স্বপ্ন দেখিয়ে দেবে। বাইরে থেকে এসে এখানে কাজ নেবে, এদিকে পুরো হিন্দীতে বলে যাবে।" মুখে বিরক্তি এনে বলল হর্ষ।
   অনুরাগ আঙ্গুল তুলে বলল, "এখনের বাচ্চাগুলোকে দেখেছিস ? বলিহারি এদের মা-বাবারাও। 'বাংলা' শব্দটা বলতেও তাঁদের আপত্তি। বলে 'বেঙ্গলি'। 'বেঙ্গলিতে আমার ছেলে  একটু উইক আছে'। কী গর্ব রে মাইরি!" 
    "সে থাক উইক। আমিও বাংলায় বিরাট কিছু ছিলাম না কোনওদিন। বাংলা মাতৃভাষা বলেই তাতে ভালো নম্বর পেতে হবে, এমন কোনও কথা নেই।  কিন্তু বলতে লজ্জা বোধ করব কেন ?"
হর্ষ'র কথাগুলোকে সব বন্ধুরাই সমর্থন করল।
    শ্রেষ্ঠা হাসতে হাসতে বলল, "আমি তো পাতি বাংলা মিডিয়ামে পড়েছি। তোদের মতো ইংলিশে  অতটা ফ্লুয়েন্সি নেই, ঠিকই। তবে, চালিয়ে দিতে পারি।"
    "কিন্তু, তুই ইংলিশে যা নম্বর পেয়েছিস, আমরা তার ধারেকাছেও নেই।" বলল অনুরাগ।
    মধুবন্তী বলল, "আমার তো আবার বাংলাতেই নিবেদিত প্রাণ।"
    অনুরাগ যোগ করল, "তোর বাংলা অনার্সই পড়া উচিত ছিল।"
    "বিজ্ঞান বুঝি না বলছিস ?"
অন্য বন্ধুরা রে রে করে উঠল। 
     "ফিজিক্সের টপার বলে কথা!"
   দু'একজন এগিয়ে এলো, "একটু পায়ের ধুলো দে না, মধু।"
     মধুবন্তী বেঞ্চে বসে থেকেই পা দু'টো বাড়িয়ে বলল, "নে।" 
   হর্ষ মধুবন্তীকে বলল, "নে, শুরু কর। তবে, 'বাংলায় গান গাই' এটা করিস না দয়া করে। একটা ভালো গানকে পচিয়ে দিল।"
   বন্ধুরাও সমস্বরে বলল, "অন্য গান, অন্য গান।"
তখনই দেখা গেল, কেমিস্ট্রির স্যার এগিয়ে আসছেন করিডর দিয়ে। 
ব্যাস, গানের ওখানেই ইতি। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



স্যার ক্লাসে এসে বললেন, "আজ তোমাদের কী পড়াব বলেছিলাম ?"
   "স্যার, ইনার্ট গ্যাস।" বেশ কয়েকজন এক সঙ্গে বলল।
   স্যার বললেন, "তার আগে, আজ একটা অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা আছে।"
   স্যার শুরু করলেন, "আজকের তারিখটা কত ?"
   "একুশ স্যার। একুশে ফেব্রুয়ারি।"
   "কেন বললাম, বুঝতে পেরেছ তোমরা ?"
 অনেকেই ঘাড় নাড়ল। 
    "সবাই তো জানো না, মনে হচ্ছে। কে কে জানো না, আজকের তারিখটার বিশেষত্ব ?"
সবাই চুপ। 
   স্যার এবার বললেন, "তাহলে কি আমি ধরে নেব, তোমরা সবাই জানো।"
   "হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার।"
পুরো ক্লাস প্রায় সমস্বরে বলল।
   স্যার বললেন, "বেশ। এবার একটা ঘটনা বলি তোমাদের।"
   "আমি যখন পড়াই, বাংলা, ইংরেজি দু'টোই বলি। নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ। কারোর ইংরেজিতে অসুবিধা হতে পারে, কারোর বাংলায়। অনেক নন-বেঙ্গলি স্টুডেন্ট আছে ক্লাসে। সবার কথা ভেবে দু'টোই বলি। তোমরা জানো কি, আমি কনভেন্ট থেকে পাশ করেছি ? আমার কিন্তু সে'জন্য বাংলা বলতে এতটুকু অসুবিধা হয় না।"
পুরো ক্লাস নিস্তব্ধ। 
    স্যার একটু থেমে বললেন, "আমাকে দু'টো ভাষাতেই সমান সাবলীল করেছেন, আমার মা-বাবা। একবার ছুটিতে বাড়ি ফিরে ফুলকপিকে,  কলিফ্লাওয়ার বলেছিলাম বলে,  পিঠে তাল পড়েছিল আমার। 
    মা আমার পিঠে গুম করে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললেন, 'তোমাকে কনভেন্টে পড়ানো হচ্ছে বাংলা ভুলে যাবার জন্য নয়।' 
বাবারও সমর্থনও ছিল মায়ের দিকে।"
ক্লাসের সবাই স্থির হয়ে বসে শুনছে স্যারের কথা।
     "তোমরা বুঝলে কিছু ?"
     "হ্যাঁ, স্যার।"
     "তোমাদের কাছে একটাই অনুরোধ, নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা কোরো না। বাংলা একটা মধুর ভাষা। বাংলাকে ভালোবাসো। আরও বৃহত্তর জগতে যখন প্রবেশ করবে, দেখবে, সারাদিনে হয়তো  একটাও বাংলা শব্দ উচ্চারণ করতে পারোনি। তখন দিনের শেষে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেও। সে তোমার গলায় সুর থাকুক আর না থাকুক। আমাদের বাংলা সাহিত্য, এক বিশাল খনি। অবসরে সে'সব পড়বে। বাংলা ভাষার প্রতি কতটা টান থাকলে, মানুষ সেই ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীতে  আন্দোলনে নামে! শহীদ হয়! ভাবতে পারো ?"

পিন পতনের নিস্তব্ধতা স্যার নিজেই ভাঙলেন।
     হাসতে হাসতে বললেন, "বাড়ি ফিরে সব বন্ধুরা কত আদর যত্ন পেত, স্কুল জীবনে। আর আমি খেলাম মার।' 
     হর্ষ বলল, "স্যার, আমরা একদম পাড়ার ভাষায় কথা বলি। খালি মধু, সাধু ভাষায় বলে।"
     "মধুবন্তী ? কিরকম শুনি একটু।" বলেই স্যার মধুর দিকে তাকালেন।
     "স্যার, হর্ষ'র কথা বিশ্বাস করবেন না।" মধুবন্তী  প্রতিবাদ করল।
     "কেন, তুই বলিস না, 'ওগো, কে আছে চাহিয়া শূন্য পথপানে' ?"
 ক্লাসের সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল হর্ষর কথায়।
       স্যারও হাসতে হাসতে বললেন, "মধুবন্তী তো সুগায়িকা।" 

সেদিন ক্যান্টিনে মধুবন্তী বলল, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, এই গানটা পর্যন্ত ব্যান করা হয়েছিল, জানিস ?"
 গতকাল রাতে যে লেখাটা মধু আর অনুরাগ পড়েছে, সেটা নিয়েই আলোচনা চলল বেশ কিছুক্ষণ। 
    দু'একজন বলল, "লিঙ্কটা দিস তো।"
    অনুরাগ বলল, "ঠিকমতো না জেনেই সব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে গা ভাসিয়েছে।" 
   তারপর মধুর দিকে তাকিয়ে বলল, "তুই এই গানটাই কর।"
   বন্ধুরাও বলল, "হ্যাঁ, এটাই এটাই।"
   মধুবন্তী শুরু করল, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কী ভুলিতে পারি! ...." 

( চলবে )


Post a Comment

0 Comments