জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১২২

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১২২
সম্পাদকীয়,
বসন্ত এসে গেছে। কল্যাণ আঙ্কেলের তোলা প্রচ্ছদের ছবি তাই বলছে। তবে সকাল যেই দুপুরের দিকে হাঁটা দিচ্ছে আমার তো মনে হচ্ছে, বসন্ত চলে গেছে। সে যাই হোক, বসন্ত আসুক কি যাক, ছোটোবেলার পাতায় আবার ধারাবাহিক উপন্যাস এসে গেছে। শুধু তাই নয়, থ্রিলার লিখে তোমাদের টান টান উত্তেজনায় প্রতি সপ্তাহে পাহাড়ের ঠান্ডা হাওয়া খাওয়াতে শ্রীকান্ত আঙ্কেল বলতে শুরু করল ' লাচুঙের নেকড়ে' র গল্প। বসন্ত যেমন পলাশের গল্প বলে, শীত তেমন চড়ুইভাতির কথা মনে পড়ায়। সেই চড়ুইভাতি নিয়ে অনেক আগেই মৌসুমী আন্টি একটি ছড়া পাঠিয়েছিল। সেটি এবারের ছোটোবেলায় আছে। এবারের ছোটোবেলায় জমিয়ে দিয়েছে শুদ্ধেন্দু আঙ্কেলের লেখা ম্যাজিক দাদুর গল্পটি। তবে ম্যাজিক দাদুর গল্পটি যত ভালো লেগেছে ঠিক ততই ভয় পেয়েছি তোমাদের বন্ধু শ্রেয়ানের গল্পটা পড়ে। ওরে বাবা আর ভূতের গল্প নয় এবার শ্রেয়সী, তুহিন আর রাজদীপের আঁকা দেখে নিই বাবা।  কি তোমরা আমাকে ভীতু ভাবছো তো? মোটেই আমি ভীতু টিতু নই। আমি বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ। ভূতে ভয় পাই কিন্তু ভূত মানি না। আর তোমরা? আমি জানি ২৮ শে ফেব্রুয়ারী জাতীয় বিজ্ঞান দিবস। তোমরাও জেনে নাও বিজ্ঞান দিবসের তাৎপর্য দোলনচাঁপা  আন্টির লেখা থেকে। যাবার আগে জানাই একটা আনন্দ সংবাদ। সুদূর এলাহাবাদ থেকে ছোটোবেলার বন্ধু অরুণকুমার রায় এবারে পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখে পাঠিয়েছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ ছোটোবেলার নতুন পাঠককে🙏 -- মৌসুমী ঘোষ।

ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে
পর্ব ১

শ্রীকান্ত অধিকারী

আপেল গাছের ফাঁকে যেখানে একটা লাচুং নদী লুকোচুরি খেলছে। কিংবা পাথরের খাঁজে খাঁজে নাচতে নাচতে যাওয়ার দুরন্ত শব্দ ভেসে আসছে ভয়ঙ্কর ভাবে, অথচ সে সবদিকে মন দিতে পারছে না। অথবা অনেকগুলো ধাপ ভাঙা সরু রাস্তায় ধীর গতিতে চলে যাওয়া ভেড়াদের দেখতে দেখতে অত্যন্ত অন্যমনস্কতায় তখনো সে নিজেকে নিয়ে ভাবে নি। কোথায় আছে, কতদূরে আছে। শুধু ভাবছিল এখানে ভেড়া থাকতে পারে সে কথা তো বড়মামা কোনো দিন বলে নি। বলেছিল লোমশ ইয়াক কুকুর ঘোড়া রেড পাণ্ডার কথা। কিংবা আশপাশের রঙিন বনানী ও ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়ির অখন্ড পটে আঁকা ছবিগুলোর অমোঘ আকর্ষণে নিজেকে হারিয়ে ফেলে দেবার আগে পর্যন্ত সে জানে না সে কোথায়। কেবল চাপা শব্দে চুক চুক করে বলে, কুকুরের বদলে ভেড়া! 
নো নো ভাগ্নে ভেড়া নয়। এরা মেষ। যারা সমতলে থাকে তারা ভেড়া আর উচ্চ স্থানে এই পাহাড়ের ওপরে থাকে তারা হল গিয়ে মেষ! একেবারে মুখের কাছে এসে শাদুলমামা বেশ চিন্তিত হয়ে ফিসফিস করে বলে, একটু ওয়েট কর। এদের পেছনে সবার শেষে নিশ্চয় সে রকম কিছু না কিছু চতুষ্পদ থাকবে। ভল্লুক কিংবা ব্যাঘ্র না হলে নিদেন পক্ষে অশ্ব কিংবা দেশি গরুও হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমাদের সামনে দিয়ে পেরিয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে বন্ধুদের বলবি এই নর্থ সিকিমের প্রত্যন্ত জঙ্গলে আমাদের গা ঘেঁষে বাঘের দল রাস্তা পার হয়েছিল। অন্ধকার ছিল বলে আমাদের দেখতে পায়নি। আমরাও কোনো ছবি তুলতে পারি নি। 
 কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যখন সন্ধের অন্ধকার ছাড়া কেউ এলো না, তখন শাদুলমামা আফসোস করে বলে,--কিন্তু আমি এখানে তো ইয়াক কিংবা স্নো বীয়ার দেখব ভেবে ছিলাম রে। কিংবা এক দুটো অজগর পাইথন। এলে বেশ জমিয়ে একটা অ্যাডভেঞ্চারের ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করতে পারতাম। তখন দেখতিস কত লাইক কমেন্টস শেয়ার হত। টি আর পি কেমন চড়চড় করে বেড়ে হাইফাই কিছু একটা হয়ে যেত। ওহ! এত নির্জন জঙ্গল অথচ ভয়ঙ্কর কিচ্ছু নেই। ভাবা যায়! শাদুলমামা মোবাইলে ক্যামেরা তাক করে থাকে অনেকক্ষণ। --বোবা ছেলের মত চুপ করে থাক রামসি। বেশি ফড়র ফড়র করিস না। তারপরেই একটা চড়াম করে চাপর মারে উরুপ্রদেশে। রামসি চাপা স্বরে বলে, মামা ডোন্ট নয়েস! মশা কামড়ালেও না। 
ওরে এ যে আইস এজের মসকুইটো! ডাইনোসরেরও আগে এদের জন্ম। প্র্যাবসিসের  এক্সারসাইজ করে করে সলিডিটি বাড়িয়ে ফেলেছে। হাড় ফুটো করে দিল রে! 

রামসি মৃদু ধমকানোর সুরে বলে, শাদুলমামা তুমি কি এখানেও সিরিয়স হবে না। মোবাইলটা ব্যাগে রাখ। দেখছ না সামনে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। ছবি কি করে উঠবে? 
ওরে পাগলা আমার ফোনে অ্যায়সা ফ্লাসলাইট লাগানো আছে না, পাহাড় ফুটো করে পাহাড়ের তলপেট থেকে দলাপাকানো নাড়ি ভুঁড়ির পরিষ্কার ফটোকপি তুলে আনবে। 
একবার মুখেই এসে গেছিল ওর, শাদুলমামা তুমি ভাবলে কি করে যে এখানে এই সিক্কিমে স্নো বীয়ার দেখতে পাবে? বলিহারি তোমার চিন্তা। কিন্তু কথাটা মুখেই আটকে যায়। ততক্ষণে 
ভেড়াগুলো সারি বেঁধে একটা একটা করে লাইন দিয়ে নেমে যাচ্ছে আপন খেয়ালে। কখনো উচ্চ খারাই পাহাড়ের কোলে,কিংবা পাইনগাছ বা আপেল গাছের আড়ালে কিংবা বুনো এলাচ গাছের  ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে ঠিক নেমে যাচ্ছে। রামসিও সরে সরে যাচ্ছে গাছের আড়ালে,কিংবা বিশাল পাথুরে দেয়ালের আড়ালে। তারপর দেখতে থাকে চুপ করে কত কত ভেড়া নিঃশব্দে রাস্তা পার হয়ে চলে যায় আরেক রাস্তা দিয়ে। ভেবেছিল এর শেষে কোনো মানুষ না থাকুক অন্তত কোনো কুকুর টুকুর থাকবে। অন্তত এল জি ডি কুকুর। যাদের কোনো বাগানবাড়ি বা ফার্মের রক্ষণা বেক্ষণের জন্য পোষা হয়। মানুষের বদলে তারাই ওদের দেখাশুনা করে। ওরা মানুষের থেকেও বেশি সজাগ এবং কর্তব্য পরায়ন।--তবে সে রকম ফার্ম এই ১০০০০ ফুট ওপরে ছোট ছোট দশ বারো ঘরের মানুষ জন কি পাইন গাছের জঙ্গল সাফ করে বিশাল বিশাল পাথর ফাটিয়ে ফার্ম তৈরি করতে পারে ! 
--পারতেই পারে। মানুষে কি না করতে পারে। আকাশে বেলুন ওড়াতে পারে পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে পারে, কল বানিয়ে ধেড়ে ইঁদুর ধরতে পারে, ইচ্ছে করলে মশারি ছেকে গাদা গুচ্ছের মশা ধরে কুচো চিংড়ির সঙ্গে ফ্রাই করে কোনো রিসর্টের মেনুলিস্টের একেবারে টপে নিজেকে রাখতে পারে। তবে তুই যে লাইভস্টক গার্ডিয়ান ডগের আশা করছিস সে কতটা আশা পূর্ণ করবে বলা মুশকিল। ওরা থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। ওখানে তো চুটকি চাটকি ফার্ম থাকে না। একরের পর একর ফার্ম করে। ল্যান্ড লেভেল সব এক। ওখানে কুকুর পোষা সুবিধে আছে। 
কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও সে কিছুই দেখতে পেল না। না মানুষ, না কুকুর,  না অন্য কিছু। শুধু দেখলো চোখের নিমেষে ওই ঘন দীঘল লোমওলা পশুগুলো হারিয়ে গেল। 
এতক্ষণ যে ওই ছিপছিপে ভেড়াগুলো হেলে দুলে নেমে গেল, তাদের পেছনে একটাও মেষপালক ছিল না। ছিল না পিঠে বাধা পানীয় জলাধার নালুপা বা হাতে পাইন গাছের সরু লাঠি। মাথায় বেতবাঁশের টুপি কিংবা একটা রঙবেরঙের গামছা। ওর বড়মামার কাছে শুনেছিল পাহাড়ের মেষ পালকেরা ঘন জঙ্গলের মধ্যে ওদের চরাতে নিয়ে যায়। ফেরে সেই সন্ধের দিকে। কেননা এখানে বিকেল ফুরোতে না ফুরোতে রাত নেমে যায়। সন্ধে বলে কিছু নেই। একেবারে ঝুপ করে সূর্য ঢলে গিয়ে পাহাড় বন পাহাড়ের পাদদেশ এক লহমায় রাত্রি নেমে আসে। 
ভাবছিল এতগুলো ভেড়া এখানে কেন? বড়মামা সিক্কিমে যে সব অ্যানিমালসের কথা বলেছিল, তার মধ্যে আর যায় হোক ভেড়ার কথা বলে নি। শুধু বলেছিল আগে ছিল এখন নেই। তার বদলে ইয়াক এসে ওদের দখল নিয়েছে। 
এর অবশ্য একটা কারণ আছে। কী কারণ বল দেখি রাম সিং। রামসির দুই মামাই ওকে রামসিং বলে ডাকে। শাদুলমামা মুচকি মুচকি হাসে।  
রামসিং পোদ্দার মাথা চুলকায়। 
---শোন। প্রায় সবই মাংসের জন্য বা অতিরিক্ত শীতে লোপাট হয়ে গেছিল প্রকৃতি থেকে। ইয়াকের মাংসের তুলনায় ভেড়ার মাংস সুস্বাদু। 
কিন্তু মামা আমি শুনেছি যে বেশীর ভাগ নেপালি বা লেপচারা ভেজিটেরিয়ান। তবে খেল কে? 
--হা হা হা বেড়ে প্রশ্নটা করেছিস তো। কে বলে তোর মাথা ফাঁকা। সেখানেও একটা গোলমাল আছে। তবে তিব্বতীয়রা ভেজিটেরিয়ান হলেও চাইনিজ চিকেনে ওদের ভীষণ লোভ। তাছাড়া অন্যন্যা কিট পতঙ্গ সাপ ... সাইলেন্ট ! কীসের যেন আওয়াজ ! কালু খানিক্ষণ চুপ করে যায়! অদূরে ঠিক ওদের বাম পাশে কোনো বাঁশের ঝোপ থেকে কোকিল পরিবারভুক্ত গ্রিন বিল্ড মালকোহা জাতীয় কোনো পাখি। আমাদের ওখানে শুধু বসন্ত বা গ্রীষ্মকালেও দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে এই জাতীয় পাখি শীত বর্ষা ছাড়া সব সময় দেখতে পাওয়া যায়। হ্যাঁ কি যেন বলছিলাম ,-- ভেজ ননভেজ।তার জন্য দায়ী অবশ্যই আমরা মানে বাঙালীরা। বাঙালীরা ননভেজ। ডিম মাছ মাংস ভাতের থালায় বা রাতে রুটির সঙ্গে চিকেন কষা না হলেই যেন নয়। 
--কিন্তু মামা, শুধু বাঙালি ছাড়াও সিক্কিমে প্রচুর নন বেঙ্গলি এমনকি নন ইণ্ডিয়ানও আসে। তারাও তো ওদের অভ্যাসের বদল করে দিতে পারে। 
--হ্যাঁ তা পারে। কিন্তু তুই কি জানিস ভারতবর্ষের ঘুরে বেরানোর গ্রাফে বাঙ্গালিরাই এক নম্বর। তবে নেপালি তিব্বতি কিছু খাবার বা স্যুপ এদের খুব প্রিয়। যেখানে চিকেন বা এই পশুর মাংস পোড়ানো বা এখন মডার্ন খাইবার পাশগুলোতে দেদার স্মোকি ফ্লেবারে বিকোচ্ছে।গোটা সিক্কিমে মোট ভেড়ার সংখ্যা অত্যধিক কমে গেছিল। ২০০০ সালে মাত্র ২০১৬।কালুমামা বলে। ভাবতে পারছিস! 
রামসি ভাবে। এও কি সম্ভব। তবে এগুলো কি ! মাথায় বড় বড় শিং। দেখতে ছাগলের মত। পাহাড়ি ছাগল! 
--চ্যাংড়া! ছাগলের পাঁঠা। 
এলাচ আর ‘ফরগেট মি নটে’র ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে কয়েকটা বুনো ছাগল পাথর থেকে খুঁটে খুঁটে  ঘাস খাচ্ছিল। 
( ক্রমশ)

রাজদীপ মিস্ত্রি 
প্রথম শ্রেণি, সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুল, গুমা, উত্তর চব্বিশ পরগণা

চড়কতলার ম্যাজিকদাদু
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী 

গেল ছয় সাত মাস ধরে রোজ স্কুল যাতায়াতের পথে নিজের অজান্তেই চড়কতলার মোড়ের দিকে চোখ চলে যায় শুভমের। সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্প পোস্টে হেলান দিয়ে প্রিয়কাকুর দোকানের দিকে মুখ করে হাসি হাসি মুখে নির্ঘাত গলা থেকে একটা পোস্টার ঝুলিয়ে আপনমনে বকবক করবে ম্যাজিকদাদু। এই 'ম্যাজিকদাদু' নামটা তারই দেওয়া। ওই লোকটার আসল নাম তো সে জানে না। কী করে জানবে! শুভমদের স্কুলবাসটা এই চড়কতলার মোড়ে সিগনাল খাবেই খাবে। আর সিগনাল খেলেই ঠিক একশো আশি সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে পড়বে। উফরে টাইমারে টিকটিক করতে থাকে সময়। আর শুভম সেই সময়টা ম্যাজিকদাদুকে দেখার সময় পায়। হাতে গুণে ঠিক অতোটুকুই সময়। 
                  ম্যাজিকদাদুর বয়স কতো হবে?আফটারনুন স্কুল শুরু হতে হতে সাড়ে এগারোটা। স্কুলে যাবার পথে শুভম মনে মনে ভাবতে থাকে। কখনও মনে হয় ম্যাজিক দাদু ফা হিয়েনের মতো। তার বয়সের না আছে শুরু, না আছে শেষ। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, ধুস। তা আবার হয় নাকি! এটা কি গুপ্তযুগ নাকি যে ফাহিয়েন চড়কতলার মোড়ে চড়ে বসবে? মনকে বোঝালেও ভিতরভিতর শুভমের এমন মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। ফা হিয়েনের ছবি সে উইকিপিডিয়াতে দেখেছে। তার স্কুলের ইতিহাস বইতেও এই চৈনিক পরিব্রাজকের ছবি আছে। চড়কতলার ম্যাজিকদাদুর অবিকল সেই রকম লম্বা লম্বা দাড়ি, মাথা ভর্তি টাক, সরু কুঁতকুঁতে দুই চোখ আর পার্চমেন্ট কাগজের মতো কুঁচকে যাওয়া মুখের চামড়া। বেশির ভাগ দিনই শুভমের ম্যাজিকদাদু মাথায় টাক ঢাকতে একটা চোঙা টুপি পরে থাকে। একদিন শুধু ফেরার পথে শুভম তাকে টাকমাথায় দেখে ফেলেছিল। ম্যাজিকদাদুর বসার টুল আছে একটা ছোট। আর সামনে একটা ছোট কাঠের বাক্স। সেই বাক্স থেকে লাল নীল নানা রঙেল যন্ত্র বের করে নাড়িয়ে পথচলতি মানুষদের সে ম্যাজিক দেখায়। অনেকেই ভ্রু কুঁচকে সরে যায়। কেউ থমকে অবজ্ঞার চোখে দেখে বলে,"ধুস।"কেউ আবার পকেট থেকে দশ টাকা বের করে দাদুর হাতে ধরিয়ে দেয়। শুভমের কষ্ট হয়। কেন কষ্ট হয় কে জানে! সে কি তখন নিজের দাদুকে মিস করে? দাদু তো সেই কবে আকাশের তারা হয়ে গেছে ভাইরাসজ্বরে। কিন্তু শুভমের মনে হয় এই তো সেদিন। তার দাদু বিজ্ঞানী ছিলেন। মামাবাড়িতে একটা নিজস্ব ল্যাব বানিয়েছিলেন। তার ভিতরে কাঁচের নানান আকারের বোতলে নানান রঙের তরল ঢেলে দিনরাত কীসব করতেন। শুভম দাদুকে ছোটবেলায় একবার জিজ্ঞেস করেছিল,'ম্যাজিক কী হয়?' দাদু বলেছিল,'ম্যাজিক হল বিজ্ঞান। বড় হও। বুঝবে।বলে দেব।'শুভমের খুব ইচ্ছে ছিল দাদুর কাছে ম্যাজিক বুঝবে। সে সুযোগ সে আর পায়নি। তবে এই ম্যাজিকদাদুকে দেখে আবার নতুন করে তার ম্যাজিক দেখতে ইচ্ছে করে খুব। কে জানত, হঠাৎ একদিন সেই সুযোগ দুম করে পেয়ে যাবে সে!

ঘটনাটা হলো সেদিন যেন কীসের একটা প্রতিবাদ মিছিল বের হয়ে ছিল ঘড়ির মোড় থেকে। ফলে যা হবার তাই হলো। রাস্তা জুড়ে ব্যাপক যানজট। শুভমদের স্কুলবাসটা চড়কতলার সিগন্যালে একদম ল্যাম্পপোস্টটা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে পড়ল। শুভম এতোদিন পর একদম কাছ থেকে দেখতে পেল ম্যাজিকদাদুকে। দূর থেকে যতোটা ভুড়ো লাগছিল, কাছ থেকে অতোটা লাগল না তার। ম্যাজিকদাদু যেন সত্যিই ম্যাজিক জানেন। পটাং করে শুভমের দিকে সরাসরি চোখ ফেলে বলল,"কী দাদাবাবু? ম্যাজিক দেখে গা?"
শুভমের আশপাশে তখন তার বন্ধু রমিত, সপ্তর্ষি, শরন্যা আর সমৃদ্ধিও জড়ো হয়েছে। শুভম প্রবল উৎসাহে স্কুলবাসের কাঁচের জৃনলার সামনে হুমড়ি খেয়ে বলল, 'দেখে গা।'
ম্যাজিকদাদু তার কাঠের বাক্স থেকে এরপর এক এক করে বার করতে থাকল যন্ত্রপাতি। একটা বাল্ব এগিয়ে দিল ম্যাজিকদাদু। বলল,"জ্বালাও দেখি বাবু?"
শুভম ভাবল লোকটা কী বোকা রে বাবা। বাল্ব জ্বালাতে তো ইলেকট্রিক সার্কিট লাগে। এমনি এমনি জ্বলে নাকি?কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে কোনও স্যুইচ আর তার ছাড়াই ম্যাজিকদাদু বাল্বটা শুধু হাতে ধরে জ্বালিয়ে দিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিল।সবাই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠত শুভম দেখল ম্যাজিকদাদুর চোখেমুখে ঝিলিক খেলে যাচ্ছে। তারপর সে বাক্স থেকে তুলে আনল একটা কয়েন।কয়েনের দুই পিঠ কালো। তারপর শুভমকে সেটা দিয়ে বলল,"দেখ দেখি একে রঙিন করতে পারো কিনা?"
শুভম কয়েনটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক দেখার পর মনেমনে ভাবল, এই কয়েন রঙিন হবে কী করে? তার কাছে না আছে ক্রেয়ন, না কাঠপেনসিল। হিহি করে হেসে ম্যাজিকদাদু কয়েনটা ফেরত নিয়ে 'অ্যাবড়া কে ড্যাবড়া গিলিগিলি' বলে রঙিন করে ফেলল। এদিকে ঘড়ির মোড়ে জ্যামটা কাটতে শুরু করেছে। শুভমদের স্কুলবাসটা নড়তে শুরু করল। সবাই হাত নাড়িয়ে টাটা করতে শুভমও ফস করে বলে ফেলল,"আবার দেখা হবে ম্যাজিকদাদু।"
ম্যাজিকদাদু মুচকি হেসে বলল, "সে তো তুমি রোজ আমাকে দেখ দাদুভাই। আমি কী আর জানি না ভেবেছ? ঠিক দেখা হবে আবার।"যাবার সময় ম্যাজিকদাদুর মুখটা কেমন 'দুঃখ দুঃখ' লাগল শুভমের। যেন ম্যাজিকদাদু বলছিল, "তোমরা প্লিজ আমার ম্যাজিক দেখো কিন্তু। আরও অনেক এইরকম ম্যাজিক আছে। অনেক। অনেক ম্যাজিক।"
            ম্যাজিকদাদুর ম্যাজিকগুলো ওই স্বল্প সময়ে ফুরিয়ে গেলেও শুভমের মনের ভিতর তার রেশ থেকে গেল সারাটা দিন। ফেরার পথে যদিও আর তাকে ল্যাম্পফোস্টে দেখা গেল না, কিন্তু তার ম্যাজিকগুলোর কথা যতক্ষণ না সে বাবামাকে বলতে পারছিল, ততক্ষণ মনের ভিতর কেমন যেন আকুলিবিকুলি করছিল। শুভমের বাবা এই সবদলপুর মহকুমার এসডিও। সারাদিনই  তার ব্যস্ততা। মাও চোখের ডাক্তার। তবে দিনের শেষে বাবা তেমন সময় বের করতে না পারলেও শুভম দেখেছে, তার মা ঠিক যেন কোথা থেকে রোগীদেখার পর সময় বের করে ফেলে। ম্যাজিকদাদুর কথাটা শুভম তাই প্রথম মাকেই বলল। মা সেসব শুনে জগন্নাথ দেবের মতো বড়বড় অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। বাবার ফিরতে রাত হলো অনেক। শহরে আজ মিটিং ছিল। শহরে মিটিং থাকলেই শুভম দেখেছে তার বাবা বড় বড় লাল নীল হুটার লাগানো সাদা গাড়ি করে অফিস যায় আর রাতে ঢুলতে ঢুলতে ফেরে। তবু সে জেগে রইল। বাবা ফিরলে শুভম সুযোগ খুঁজছিল কখন করাটা পাড়বে। খাবার টেবিলে ঠিক সেই সুযোগ মিলে গেল। ম্যাজিকদাদুর ম্যাজিকের কথা বলতেই বাবা একটুও না অবাক হয়ে বলল।
-ম্যাজিক বলে কিছু হয়না শুভম। তোমার মনে নেই?তোমার দাদু বলত?সব হল সায়েন্স।
-কিন্তু ওই বাল্বটা...
-লোকটার তর্জনীটা দেখেছিলে? ওখানে একটা আঙটি ছিল। বাল্বের নীচে দুটো চাকতিতে ওই ধাতব আঙটি লাগলেই সার্কিট কমপ্লিট হচ্ছিল। আর বাল্বটাও জ্বলে উঠছিল।
শুভম হতাশ হয়ে বলল," আর ওই চাকতি রঙিন হওয়াটা?"
-এ বাবা। ওটা তো সিম্পল। ইউটিউবেই আছে। চাকতির দুই দিকে চুম্বক দেওয়া রঙিন সরু দুটো চাকতি আছে। কৌশলে দিক পাল্টে দিলেই কালোটা লাল নীল হতে কতক্ষণ?"

মন খারাপ হয়ে গেল শুভমের। এতক্ষণ যে ম্যাজিকগুলোর কথা ভেবে সে উত্তেজনায় ঘুমোতেই পাচ্ছিল না, এখন সেগুলোর পিছনের বিজ্ঞানটা বাবা বুঝিয়ে দিতেই শুভমের সবকিছু কেমন যেন সস্তা সস্তা লাগতে শুরু করল। মনে মনে ম্যাজিকদাদুর উপর খুব রেগে গেল সে। মনে হলো ওই লোকটা তাকে ঠকিয়েছে। পরের দিন দেখা হোক। এক হাত নেবে সে।
                    কিন্তু পরদিন শুভমের ম্যাজিকদাদুর সঙ্গে দেখা হলো না। তার পরের দিনও নয়। তার পরের দিনও। কেটে গেল গোটা একটা সপ্তাহ। প্রথম দিকের অভিমান বদলে গেল উৎকণ্ঠায়। লোকটার কিছু হলো বুঝি? ও কি তবে চলে গেল? একদিন সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন বাসের জানলা দিয়ে চেঁচিয়ে শুভম প্রিয়কাকুকে জিজ্ঞেস করল।
-ও প্রিয়কাকু। ম্যাজিকদাদু আর আসবে না?
-ম্যাজিকদাদু?
-ওই যে। যে লোকটা ম্যাজিক দেখাত এখানে?
-ও সিরাজ। ওর তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। পা কাটা গেছে ট্রেনে। হাসপাতালে ভর্তি।
গোমড়া মুখে শুভম জিজ্ঞেস করল, "কোন হাসপাতাল?"
প্রিয়কাকু পান সাজতে সাজতে বলল, "সদরে গো। সদরে।"

রাতে মাকে কথাটা বলল শুভম। একবার ম্যাজিকদাদুকে দেখতে যাবে সে সদরে। দাদুকে তো দেখতে দেয়নি ওরা। সাদা পলিথিনে মুড়ে মুখের কাছটা প্লাস্টিক লাগিয়ে রেখেছিল। মা রাজি হয়ে গেল। কাল শনিবার।
-ঠিক আছে। আমি আমার সঙ্গে যে অ্যাসিসটেন্ট ছেলেটা থাকে, ওকে বলে দিচ্ছি দাঁড়া। ও খোঁজ নিয়ে নেবে কোন বেড নাম্বারে আছে ও। কী যেন নাম বললি তোর ম্যাজিকদাদুর?
শুভম একটু ভেবে মাথা চুলকে বলল,"সিরাজ।"

বেডটা খুঁজে পাওয়া গেল সহজেই। মায়ের অ্যাসিসটেন্টের নাম অভিজিত। সে জানাল জিআরপিই ভর্তি করেছে। রেললাইনে পিথর সড়ানোর কাজ করছিল শুভমের ম্যাজিকদাদু অরফে সিরাজ। হঠাৎ ট্রেন চলে এল সিগনাল ছাড়াই। সিরাজ লাইন থেকে সরে আসার সুযোগ পায়নি। প্রাণটাই চলে যেত। আল্লার রহমতে জোর বেঁচে গেছে। কিন্তু ডান পা খানা বাঁচানো যায়নি। অভিজিতকাকুর কাছে এইসব শুনতে শুনতে শুভম ভাবছিল, খামোখা ম্যাজিকদাদু রেললাইন থেকে পাথর তুলতে গেলই বা কেন? তবে কি সেখানেও ম্যাজিকের কাজ ছিল?

সরকারি হাসপাতালে এই প্রথম এলো শুভম। ওয়ার্ডগুলো দেখে তার বুকের ভিতর ঢিবঢিব করছিল। ঘরের এক কোণায় বেডের ওপর শুয়ে আছে ম্যাজিকদাদু। তার ডান পায়ের জায়গাটা ব্যাণ্ডেজে মোড়া। শুভমকে আসতে দেখে সে উঠে বসতে গিয়ে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে আবার শুয়ে পড়ে বলল,"কেমন আছো দাদুভাই?"
-তোমার পায়ে খুব ব্যথা দাদু?
-ও ঠিক হয়ে যাবে।
-পাথর তুলতে গেলে কেন একা একা?ম্যাজিকের খোঁজে বুঝি?
ম্লান হেসে ম্যাজিকদাদু বলল,"জীবনটাই তো একটা ম্যাজিক দাদুভাই। আর তাছাড়া এখন আর কেউ ম্যাজিক দেখে না।আমার ওস্তাদের শেখানো ম্যাজিক দেখে লোকে আর অবাকই হয় না। সব ম্যাজিকের কারসাজিই তো ইউটিউবে খুঁজলে ধরে ফেলা যায়। আমার মেয়ে আমিনার খুব জ্বর। ওষুধের এতো দাম। ওরা বলল তিনদিন রেলের লাইনে পাথর সরালে ভালো দিনমজুরি পাওয়া যাবে। তখন কি আর জানতাম এইরকম হবে সব!"
শুভমের চোখ ছলছল করছিল। প্রথম প্রথম ম্যাজিকদাদুর উপর জমে থাকা রাগগুলো তার মনের ভিতর এখন আর নেই।
-তুমি আর ম্যাজিক দেখাবে না ম্যাজিকদাদু?
-ধুস। প্যায়ের নেই। খোঁড়া পায়ে কী ম্যাজিক হবে? তোমাকে ওই বাক্সটা আমি দিয়ে দেব। আর ম্যাজিকগুলো সব শিখিয়ে দেব।হবে?
-না।হবে না।
-কেন?
-তুমি আবার ম্যাজিক দেখাবে।
-কিন্তু আমি তো জানি। তোমরা আমার জাদুর সব রাজ জেনে গেছ। তাহলে?
-না গো। ম্যাজিকদাদু। আমরা কিচ্ছু জানিনি । জানতে চাইও না। আমি ইউ টিউব থেকে সব কটা ভিডিও ডিলিট করে দেব যাতে কেউ জানতে না পারে।
শুভমের কথা শুনে ম্যাজিকদাদু 'হো হো' করে হেসে উঠল। কিন্তু মা একটুও হাসল না। বেশ গম্ভীর হয়ে বলল,"তুমি একদম চিন্তা করো না সিরাজ। আমার বর অপ্রতীমকে আমি বলে দেব। তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠো। তারপর শুভমদের স্কুলে তুমি ওদের ম্যাজিক শেখাবে। আর আমিনার চিকিৎসার দায়িত্ব আমি নিলাম। আমাকে ওর ফাইলটা তুমি দেখাবে। মনে থাকবে?"
শুভম অবাক হয়ে তার মাকে দেখছিল। তার মা যে ভিতর ভিতর এতো ভালো ম্যাজিক জানে কে জানত! ওদিকে আড়চোখে সে দেখল ম্যাজিকদাদুর চোখে জল। এই এতোগুলো একসঙ্গে ঘটে যাওয়া ম্যাজিকের রহস্য যে পৃথিবীর কোনও ইউটিউবে কোনও দিন আপলোড হবে না, একথা শুভম হলফ করে বলে দিতে পারে।

তুহিন সরকার
ষষ্ঠ শ্রেণী,সুখচড় কর্মদক্ষ চন্দ্রচূড় বিদ্যালয়,উত্তর ২৪ পরগণা


চড়ুইভাতির দিনে 
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস


শীতবুড়িটা থুথ্থুরিটা শীতলডাঙার মাঠে
চড়ুইভাতির বসিয়ে আসর ডাকলো ছড়া পাঠে।
ঠান্ডা ঠান্ডা পড়ছি ছড়া, কাঁপছে নিজের গা,
শীতবুড়ি তাই গামলা করে আনলো গরম চা।
এবার মনে ছন্দ এলো, জাঁকিয়ে খুশির রেশ,
লাল জামাতে শীতবুড়োটা বললো, ফাইন, বেশ!
বুড়োর হাতে লালচে ঝোলায় নেই তো বিরিয়ানি,
দেখেই তাকে দৌড়ে এলো গুড্ডু  জিয়ান মানি। 
দিচ্ছে ওদের দু হাত ভরে সাহস মেধা আর
বিপদ দেখে না পালানোর যোগ্য পুরস্কার।
তিতলি অনি কুটুস রানি কমলালেবুর সাথে
পুলি পিঠেও সাজিয়ে দিল বুড়োর শীতল রথে।
বনভোজনের এমন সকাল, ডালিয়া গাঁদাফুলে
সাজলো দেখি শীতবুড়িও গাঁটের ব্যথা ভুলে।

শ্রেয়সী ঘোষ
চতুর্থ শ্রেণী, সাহাপুর বিবেকানন্দ শিক্ষা নিকেতন, পূর্ব বর্ধমান


ভুতুড়ে ডাক্তার
শ্রেয়ান ভট্টাচাৰ্য
পঞ্চম শ্রেণী, শ্রী অরবিন্দ বিদ্যাভবন,পশ্চিম মেদিনীপুর

আমার নাম সুবিমল  সেন। আমি থাকি পুরুলিয়ায়। বন্ধুর  বিয়ে তাই আজ বাঁকুড়া যাচ্ছি। বন্ধুর বাড়ী থেকে  যখন  বেরোলাম তখন রাত্রি ১১.২৬। বন্ধু  অনেক জোরাজুরি করেছিলো থাকার  জন্যে কিন্তু আমি বললাম যে, " কালকে অফিস  আছে। না গেলে বস  বকাবকি করবে। এখন অফিসে  খুব কাজের চাপ। আমি লাস্ট ট্রেন ধরে  বাড়ী চলে যাবো। " বন্ধুর  বাড়ী থেকে  স্টেশনে আসতে আধঘন্টা সময়  লাগলো। তখন  আমার সামনে প্লাটফর্ম এ একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। মনে  হলো  এটাই লাস্ট ট্রেন। টিকিট কেটে ট্রেন এর একটা কামরায় উঠলাম। একটা সিট্ দেখে  বসে, হাতঘড়ির  দিকে তাকিয়ে দেখলাম,এখন  রাত্রি ১১.৪৭। সিগন্যাল হওয়ার  পরে  ট্রেন চলতে শুরু  করলো। পুরো ট্রেনটা প্রায় ফাঁকা। অবশ্য এতো রাত্রে কেই বা ট্রেন এ উঠবে। একটু পরে  রেল  এর ইউনিফর্ম পরা  এক টিকিট চেকার  এসে টিকিট  দেখতে চাইলো। আমি আমার টিকিট টা দেখালাম। সে চলে  গেলো। আমি সিটে মাথা  রেখে  গা এলিয়ে দিলাম। একটু ঝিমোনি মতো  এসে গিয়েছিলো। তারপর হঠাৎ  ট্রেনটা থেমে  গেলো। কি হলো? কোনো সমস্যা  হলো  নাকি?  লোকটিকে কি হাঁক দেবো? না:থাক। আমি ট্রেন থেকে  নেমে পড়লাম। চারপাশে  তাকিয়ে দেখি, কিছু দূরে রয়েছে  বন্ধ  দোকান পাট। হঠাৎ, দূরে চোখে  পড়লো , একটি আলোকিত বিশাল  বাড়ী। আমি আশ্রয়ের  খোঁজে ওই বাড়ির দিকে এগোলাম। এটি একটি হাসপাতাল। আমি ভিতরে  ঢুকে  রাত  কাটাবার জায়গার খোঁজ করছিলাম। আমার সঙ্গে কিছু লোক ও ঢুকে  পড়েছিল।
আমি হাঁটতে হাঁটতে দোতালার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলাম। আমার সঙ্গে দুজন  লোক ও উঠছিলো। আমি দোতালার একটা ঘরের দরজার সামনে এলাম। ভিতরে এ্যাপ্রন  পরা  একজন ডাক্তার বাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আমায় ভিতরে ডাকলেন এবং  একটি সোফা দেখিয়ে  বসতে  বললেন। আমাকে বললেন " আপনার নাম কি? আপনার পা  টা একটু চেক  করবো। আপনি খোঁড়াচ্ছেন কেন?" আমার নাম সুবিমল  সেন।
  কিন্তু আমার পায়ে তো কিছু  হয়নি। ট্রেন থেকে নামতে  গিয়ে পায়ে একটু ধাক্কা  লেগেছে। ও কিছু নয়। "
" না, আপনার পা টা চেক  করতেই  হবে। " এইবলে  পায়ের পাতা টেনে ধরলেন। খানিক পরে  বললেন  " মি : সেন, আপনার ডান পায়ে ইনফেকশন হয়েছে। পা কেটে বাদ দিতে হবে। নইলে  আপনি বাঁচবেন না। ওই বেড এ গিয়ে শুয়ে পড়ুন। রামু, ভোলা, এনাকে বেড এর সঙ্গে বেঁধে  দাও। " যাদের নাম রামু, ভোলা, তারা আমার সঙ্গে আসা সেই দুজন লোক।আমি  ভীষণ ভয়  পেয়ে পালাবার চেষ্টা করতেই, তিনি তাঁর   সাঁড়াশির  মতো  হাত দিয়ে আমাকে চেপে  ধরলেন। তাঁর গলা  দিয়ে এখন  একটা অশরীরী  কন্ঠ স্বর বেরিয়ে এলো " মি : সেন, আমি শেষ বারের মতো  বলছি। আমার কথা শুনুন নইলে, আপনার ধড়  থেকে  মুন্ডু আলাদা করে  দেবো। " এইবার আমি তাঁর আসল  মুখ  দেখতে  পেলাম। তাঁর সারা মুখের  রং  সবুজ আর ঠোঁটে তাজা রক্ত লেগে আছে। তাঁর হাতে ধারালো ছুরি আর অন্য  হাতে একটা মোটা কাপড়ের  টুকরো। যেনো আমাকে টুকরো টুকরো করে  কেটে খাওয়ার  জন্যে তৈরি। ডাক্তার আর তাঁর দুজন  লোক আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম " কে কোথাও আছো, বাঁচাও  আমাকে "। এমন সময়  সিঁড়ির দিক থেকে  কিছু  লোক এর পায়ের শব্দ  শোনা  গেলো। তারা হুড়মুড় করে  ঘরে  ঢুকে, আমাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এলো। তারপর  সিঁড়ি বেয়ে সবাই  ছুটতে ছুটতে  একদম  হাসপাতালের  বাইরে বেরিয়ে এলাম। পিছন ফিরে দেখি , বাড়ী টা দাউ দাউ করে  জ্বলছে। আমি ভীষণ  ভয়  পেয়ে  গিয়ে ছিলাম। সেদিন রাত্রে ওদেরই একজনের  বাড়িতে রয়ে গিয়েছিলাম। ওরা আমাকে বলেছিলো, এটা  একটা ভুতুড়ে হাসপাতাল। প্রত্যেক অমাবস্যার  রাত্রে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি যখন ওই হাসপাতালে র আলো দেখে ঢুকছিলাম, ওরা তখন রাস্তা দিয়ে গ্রামের যাত্রা দেখে  ফিরছিলো। প্রথমে হাসপাতালে ঢুকবার  সাহস ওদের হয়নি, পরে  মনের  জোর এনে, আমাকে ওখান  থেকে  বের করে  আনে। তারপরের  দিন, বাসে করে বাড়ী ফিরে আসি। আজ প্রায় ৫ বছর কেটে গেছে। এখনো  মাঝে মাঝে মনে পড়ে সেই ঘটনাটা। এই ঘটনা কতজন  বিশ্বাস করবে জানিনা। তবে  এটা বলতে পারি, ঘটনাটা  আমার নিজের চোখে  দেখা।

স্মরণীয় দিবস
জাতীয় বিজ্ঞান দিবস
(২৮শে ফেব্রুয়ারী)

দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

আমাদের জীবনে প্রতিদিনেরই  কোন না কোন বিশেষ গুরুত্ব আছে, ঠিক যেমন আঠাশে ফেব্রুয়ারি দিনটির আছে এক বিশেষ মাহাত্ম্য। এই দিনটির পিছনে এক গৌরবায় ইতিহাস আছে, সেটি হল -২৮ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে 'জাতীয় বিজ্ঞান' দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এই দিনটিকে কেন আমরা জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে মেনে নিয়েছি?
১৯২৮ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী সিভি রমন, রমন এফেক্ট এর আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। এরপর ১৯৮৬ সালের জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা যোগাযোগ আয়োগ (NCSTC) ভারত সরকারের কাছ থেকে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন করেন।
তার পরবর্তী সরকার এই আবেদন মঞ্জুরও করেন। সেইমতো ৩৫ বছর ধরে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে।
 পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ও বিশ্ববিদ্যালয় এছাড়া শিক্ষক বিজ্ঞানী, কারিগরি, চিকিৎসা এবং গবেষণা ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে 'জাতীয় বিজ্ঞান' দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শুধু তাই নয় বিগত বছরগুলির এই দিনটিতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সভা ও সেমিনার করা হয়। সেখানে বিষয় রাখা হয়  ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ এবং শিক্ষায় দক্ষতা এবং কাজের উপর প্রভাব।

আঠাশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে কেন জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালন করি তা একটু জেনে নেওয়া যাক।
১৯২৮ সালে প্রখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমান একবর্ণি দৃশ্যমান  আলোক রশ্মিকে বিভিন্ন তরলের মধ্য দিয়ে পাঠিয়ে লক্ষ্য করেন যে আপতিত রশ্মির অবিলম্বে বিক্ষিপ্ত বিকিরণের মধ্যে মূল তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিকিরণ ছাড়াও আরো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর ও দীর্ঘতর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিকিরণ পাওয়া যায়। এই ঘটনাকে 'রমণ' ক্রিয়া বলে। এই ক্রিয়া তরল ছাড়াও গ্যাসীয় ও কঠিনেও পরিলক্ষিত হয়। রমণ প্রভাব বা রমণ বিক্ষেপণ  হচ্ছে ফোটন কণা সমূহের অস্থিতিস্থাপক বিকিরণ। ১৯২৮ সালে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণ এবং তাঁর ছাত্র এস কৃষ্ণণ তরল পদার্থে রমণ প্রভাব আবিষ্কার করেন। আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন ঘটে যখন একটি হালকা মরিচি অনুর দ্বারা বিভক্ত হয় তখন,যখন আলোকের মরিচি কোন রাসায়নিক যৌগের ধুলাবালি মুক্ত স্বচ্ছ নমুনাকে সরিয়ে দেয় তখন আলোর একটি সামান্য ভগ্নাংশ ঘটনার মরিচি বাদে অন্য দিকগুলোতে দেখা যায়। এই বিক্ষিপ্ত আলো বেশিরভাগ অপরিবর্তিত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের। এই পুরো ঘটনাটি রমণ প্রভাবের ফলা ফলেই ঘটে। আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী সিভি রমন।
উল্লেখযোগ্য এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৩০ সালে সিভি রমন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।



পাঠপ্রতিক্রিয়া
( ছোটোবেলা ১২১ পড়ে এলাহাবাদ অরুণ কুমার রায় যা লিখলেন) 

সম্পাদিকা
জ্বলদর্চি ডিজিটাল পত্রিকা
প.বঙ্গ
শ্রদ্ধেয়া 
মৌসুমি ঘোষ মহাশয়া  নমস্কার । 'জ্বলদর্চি'  ছোটদের বিশেষ সংখ্যাটি পড়লাম। খুব ভালো লাগলো প্রতিটি লেখাই। আপনার সম্পাদকীয় লেখাটি অসাধারণ । ছবি এঁকে যারা এই পত্রিকায় দিয়েছেন সেই দুই তিন জন যথা জয়দীপ সাহা ও সাঁঝবাতি দাস, অপু পাল তথা কবিতায় ' একুশ আসে- একুশ হাসে কবি সবিতা দাস তথা স্মরণ দিবস দোলন চাঁপা তেওয়ারি দের লেখা খুব ভালো  লেগেছে। 
ওনাদের আমর প্রীতি ও শুভেচ্ছা  জানালাম আপনার মাধ্যমে। আপনাদের এই পত্রিকার উত্তরোত্তর শ্রী বৃদ্ধি কামনা করি।

অরুণকুমার রায়
একজন সাধারণ পাঠক
এলাহাবাদ ।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments