পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৬০
দেউলপূজা ব্রত
ভাস্করব্রত পতি
"রচিয়াছিনু দেউল একখানি
অনেক দিনে অনেক দুঃখ মানি।
রাখি নি তার জানালা দ্বার,
সকল দিক অন্ধকার,
ভূধর হতে পাষাণভার
যতনে বহি আনি॥
রচিয়াছিনু দেউল একখানি।
দেবতাটিরে বসায়ে মাঝখানে
ছিলাম চেয়ে তাহারি মুখপানে।
বাহিরে ফেলি এ ত্রিভুবন
ভুলিয়া গিয়া বিশ্বজন
ধেয়ান তারি অনুক্ষণ
করেছি একপ্রাণে॥
দেবতাটিরে বসায়ে মাঝখানে।
যাপন করি অন্তহীন রাতি
জ্বালায়ে শত গন্ধময় বাতি।
কনকমণি পাত্রপুটে
সুরভি ধূপধূম্র উঠে,
গুরু অগুরু গন্ধ ছুটে,
পরাণ উঠে মাতি...."
১২৯৯ এর ২৩ শে ফাল্গুন তালদণ্ডা খাল বালিয়া থেকে কটক যাওয়ার পথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন এটি। 'দেউল' অর্থে দেবমন্দির বা দেবালয় বোঝায়। এই দেউলকেই পূজা করার মতো অতি স্বল্প পরিচিত লৌকিক উৎসব পরিলক্ষিত হয় পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায়। এই কোচবিহার জেলার কিছু সীমিত সংখ্যক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের নিষ্ঠাবান সধবা নারীদের ভক্তিশ্রদ্ধায় পালিত হয় দেউলপূজা লৌকিক উৎসব তথা ব্রত। টিমটিম করে চলতো একসময়। কালের অন্তরালে আজকের Fast যুগে সেসব হারিয়ে যাওয়ার মুখে।
সংস্কৃত 'দেবকুল' > প্রাকৃত 'দেউল' > বাংলা 'দেউল'
হিন্দিতে বলে 'দেৱল' ( দেবালয় ), পাঞ্জাবীতে 'দেৱালা' এবং মারাঠিতে 'দেউল' বলে। শূন্যপুরাণে আছে 'দেহারা দেউল'।
কেবলমাত্র একটি মাসের জন্য পালিত হয় এই দেউলপূজা লৌকিক উৎসবটি। সারা মাঘ মাস জুড়ে প্রতিদিন ব্রতটি উদযাপন করেন সধবা মহিলারা। এই ব্রত পালন করলে স্বামী পুত্রের মঙ্গলসাধন হয়। পরিবারের প্রভূত পরিমানে ধন সম্পদ লাভ হয়। সেইসাথে সকলকে নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটানোর সুযোগ জোটে। লোকসমাজে দেউলপূজা ব্রতে এ ধরনেরই প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে। আসলে নারী সমাজের চিরন্তন প্রার্থনা এবং লোকবিশ্বাস প্রতিভূত হয় এখানে।
এই উৎসবের উপচারে অভিনবত্ব লক্ষ্য করা যায়। ব্রতীনীরা নিজেরাই মাটির দেউল বা মন্দির তৈরি করেন। সেই মন্দিরকেই পূজা করেন তাঁরা। তাই বলা হয় 'দেউলপূজা'। দেউল বানানোর জন্য একটু শৈল্পিক ধারনা থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রথমে চারটি মাটির তথা কাদার তাল দিয়ে চতুর্ভুজ আকারের অবয়ব বানাতে হয়। এবার এগুলির উপরে মাটি দিয়ে আরও চারটি অবয়ব বানিয়ে রাখা হয়। সবশেষে এগুলির উপরে ফের দু'টি মাটির তাল দিয়ে মন্দিরের মতো দেউল বানানো হয়। সেই দেউলই পূজা করা হয় মাস জুড়ে। সমগ্র মন্দির নির্মাণ করে দেবতা জ্ঞানে পূজা করেন মহিলারা।
দেউলপূজার জন্য অতি অবশ্যই প্রয়োজন সরষে ফুল। ঠিক এ সময়েই অবশ্য সরষে গাছ জন্মায়। দেউলের সামনে সরষে ফুল হাতে নিয়ে উচ্চারণ করা হয় এই মন্ত্র--
"আগদেউল পাছদেউল,
মধ্যে হইল চম্পা দেউল।
চম্পা দেউলে হবে রাজা,
মুই তাঁর প্রিয় ভার্যা।
এ দেউল পুজিলে সর্বসিদ্ধি,
হউক সম্পত্তি নিজ সম্পত্তি,
মরিলে মাধব গতি।"
প্রথমে সিঁদুর দিয়ে ত্রিকোণ মণ্ডল আঁকা হয় মেঝেতে। এবার ঐ ত্রিকোন মণ্ডলের ওপর সর্বাগ্রে প্রস্তুত মাটির দেউলটি বসানো হয়। এখন ধূপ, ধুনা ও প্রদীপ জ্বালিয়ে বেলপাতা, সিঁদুর দিয়ে সকালবেলাতেই এই পুজো করা হয়। যাঁরা পূজা করবেন তাঁরা সকাল থেকে স্নান করে শুদ্ধাচারে ও শুদ্ধবস্ত্রে নিয়মনীতি পালন করেন।
ফুল দিয়ে পূজা করার পর দেউলকে স্নান করানো হয়। চন্দন ছেটানো হয়। পুনরায় দেউলকে ফুল, দুর্বা দিয়ে পূজা করে মনের কামনা বাসনা নিবেদন করেন ব্রতীনীরা। তখন তাঁদের মুখে শোনা যায় --
"সীতা হেন সতী হং (হই),
রামচন্দ্র হেন স্বামী পাং (পাই),
লক্ষ্মণ হেন দেবর পাং (পাই),
দশরথ হেন শ্বশুর পাং (পাই),
কৌশল্যা হেন শাশুড়ী পাং (পাই),
শাঁখা সেন্দুরে কাল কাটাং (কাটাই)।"
আসলে রামায়ণের এই চরিত্রগুলি আপামর হিন্দু সমাজে প্রণাম ও শ্রদ্ধা পেয়ে আসছে। প্রতিটি হিন্দু মহিলার মনে সীতাদেবী, রামচন্দ্র, লক্ষ্মণ, দশরথ এবং কৌশল্যা চরিত্রের প্রতি আলাদা সমীহভাব রয়েছে। প্রত্যেকেই চান এঁদের মতো মহান Character তাঁদের সংসার জীবনে আলোকিত হোক। দেউলপূজায় সেই আত্মিক চাওয়াটাই ফুটে উঠেছে।
শুধু নিজে, নিজের স্বামী, দেওর, শ্বশুর, শাশুড়ি ভালো হোক -- এই প্রার্থনায় সীমাবদ্ধ রাখতে চাননা তাঁরা। তাঁদের আর্তিতে ভরে ওঠে নিজের বাবা, ভাই, সন্তান, পাড়াপড়শী সকলের মঙ্গল কামনা, উন্নতি এবং ভালো থাকার প্রার্থনা। এই কামনায় তাঁরা বলেন ---
"মাধব টক মাধব টক,
মোর বাপ পণ্ডিত হউক।
মাধব টক মাধব টক,
মোর ভাই পণ্ডিত হউক।
মাধব টক মাধব টক,
মোর পতি পণ্ডিত হউক।
মাধব টক মাধব টক,
মোর পুত্র পণ্ডিত হউক।
মাধব টক মাধব টক,
মোর পাড়াপড়শী পণ্ডিত হউক।"
পূজা শেষে এই দেউলকে স্রাস্টাঙ্গে প্রণাম করে পুকুরের জলে বিসর্জন দিয়ে শেষ হয় সেদিনের উপচার।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
0 Comments