বিস্মৃতপ্রায় কবি হরপ্রসাদ মিত্র
নির্মল বর্মন
কবি, সাহিত্য সমালোচক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অধ্যাপক' হরপ্রসাদ মিত্র মহোদয় কাব্য ও সাহিত্য সমালোচনার জগতে খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। অধ্যাপক হরপ্রসাদ মিত্র 'র কবি হৃদয় ছিল অসাধারণ। কবি মিত্র'র কবি মন বিশিষ্ট আঙ্গিকে, সুরেলা ভঙ্গিতে তাঁর স্বরচিত কবিতাগুলো পাঠ করে চটজলদি পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছে দিতেন।। অধ্যাপক মিত্র'র বাচনভঙ্গি, শব্দ চয়নের তাত্ত্বিকতায় , মিল বিন্যাসের অভাবনীয় আস্বাদ্যমানতাকে বাড়িয়ে দিয়েছেন।
কবি হরপ্রসাদ মিত্র ১৯১৭ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। ১৯৯৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জগতে অসংখ্য মুগ্ধ ছাত্র-ছাত্রী, সহ কর্মী ,বন্ধুবান্ধব ,আত্মীয়-স্বজন কে নিমেষে অবহেলা করে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে অবস্থান করেছেন।
অধ্যাপক মিত্র'র প্রথম কাব্যগ্রন্থ ১৩৪০ বঙ্গাব্দে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভুমিকা সহ " চলার গান" প্রকাশিত হয়েছিল। কবি মিত্র'র অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ গুলি হল "চন্দ্রমল্লিকা " ১৯৩৭, "পৌত্তলিকা" ১৯৪১ , "ভ্রমণ" ,"চুনি পান্নার কান্না " ১৯৪৫, " তিমিরাভিসার" ১৯৪৫, "আশ্বিনের ফেরিওলা" ১৯৬৩,"সাঁকো থেকে দেখা" , " ইদানিং আমি"১৯৮০, " ঝাউয়ের শব্দ" , ১৯৭৩," যা আছে যা নেই " ১৯৮৪,"ছবি ফিরে দেখা" ১৯৮৫,"ইয়াক",১৯৮৫, "প্রেমকে মৃত্যুকে চিনে" ইত্যাদি। কবি হরপ্রসাদ মিত্র অনুবাদ মূলক কাব্যগ্রন্থে সিদ্ধ হস্ত প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত অনুবাদমূলক কাব্যগ্রন্থ "রুশি কবিতা"কবিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সমালোচনা মূলক গ্রন্থ গুলি হল--
"বাংলা কাব্যে প্রাক রবীন্দ্র" , " সাহিত্য পাঠকের ডায়েরি" , "সাহিত্যের নানাকথা" , "বিবেকানন্দের সাহিত্য ও সমাজ চিন্তা" , " তারাশঙ্কর ", "কবিতার বিচিত্র পাঠ", রবীন্দ্র সাহিত্য পাঠ " "বঙ্কিম সাহিত্য পাঠ'" ইত্যাদি।
অধ্যাপক কবি হরপ্রসাদ মিত্রের "বেয়াড়া" কবিতায় শিশুদের দুরবস্থা বিশেষ করে মধ্যবিত্ত জীবনের শিশু শ্রমিকদের মনোবাসনা কে চমৎকার তুলি কলমের দ্বারাই এঁকেছেন , ---দৃষ্টান্ত স্বরূপ--
"বিশ - হাজার কচি ছেলেমেয়েরা
শুধু এই কলকাতা - শহরে
ঝি - চাকর হয়ে আছে শুনলুম।
খবরটা বাড়ছেই বহরে" ।
বর্তমান সময় ও সমাজে এই সত্যি খবরে হয়তো কেউ কেউ বিচলিত হতেই পারেন কিন্তু অনেকেই বিচলিত নন।
আবার বৃষ্টির দিনে কালিদাস বন্দনার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত জীবন যাপনের চমৎকার বিচিত্র ভাবনাকে কবি - মিত্র এভাবেই তুলে ধরেছেন---
" কবিতার সুখ - অসুখ আলাদা ।
বাস্তবে ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল।
প্রতিবাদে কী যে ঘটে জানা তা ।
ন্যাড়া তাই খোঁজেই না পাকা - বেল।
হাঁটাহাঁটি শুধু নিজ - এলাকায়--
মাথাটা বাঁচিয়ে যাতে বাঁচা যায়"।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
কালের অমোঘ বিধানে কবিতা লিখে মানুষের রুজি রোজগার হয় না, তাই কবিরের ন্যাড়া পাকা বেল খোঁজেনা। কবিদের প্রসার নিজস্ব এলাকায় বাইরে প্রচার প্রসারের দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ সমস্যা কবি উপলব্ধি করেছিলেন। বর্তমান হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ,টুইটার ও ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে কবিতার প্রচার ও প্রসার অনেকখানি বেড়েছে কবি বেঁচে থাকলে হয়তো তার প্রতিফলন কবিতায় পড়তো।।
'কবিতা - গল্প- নাটক' কবিতায় কিভাবে লেখার পদ্ধতি কেমন তা কবি হরপ্রসাদ মিত্র অবলীলায় বর্ণনা করেছেন-
"কবিতা বানানো শক্ত যদি না ভেতরে মেঘেরা ঝামরায়।
ছোটো ঘরটাতে আকাশ কোথায়?
আছি ঠাশাঠাশি --- তাই না ?
সুখ ও দুঃখ মামুলি ।
চেষ্টাই নেই ধানের সবুজ
দু'মুঠিতে ধরা আঁজলায়" ।
নাটক লেখার পদ্ধতি কি? নাটক লিখতে গেলে করণীয় বা কি? কবি হরপ্রসাদ মিত্র তা সাবলীল ভাবেই জানিয়েছেন----
"নাটক তো নয় কবুতরদের বকম - বকম ঠোঁট
টিকিট - খরচা যৎসামান্য মিলন - বিরহ জোট;
না,না ---সেরকম নয় ।
হাতুড়ি, নেহাই , হাঁপর, আগুন
মিললে নাটক হয়" ।
কবি অধ্যাপক হরপ্রসাদ মিত্র জীবন প্রান্তে এসে জীবন নাটকে পৌঁছে দৃঢ় উচ্চারণ করেছেন ---
"যেদিকে উজান বেগের ক্রমেই মন্দ মন্দ ক্ষয়--
স্বখাত সলিলে ডুবতে ডুবতে সকলেই পৌঁছায়।
সেটা প্রাণহীন বিষাদ কিংবা অবসাদ
---যাই বলো,
গোধূলির আলো - আঁধারীতে দেখা
কামরাঙ্গা ,জলপাই"।
সম্প্রতি অধ্যাপক হরপ্রসাদ মিত্র মহোদয়ের এক ছাত্রী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি বিদ্যালয় পরিদর্শক কবি ও বাচিক শিল্পী সরস্বতী মন্ডল বলেন--" সে অনেক আগের কথা , আমি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বাংলা বিভাগের ছাত্রী, আমাদের স্যার হরপ্রসাদ বাবু যখন ক্লাসে আসতেন তখন আমরা সবাই চুপচাপ ।স্যারের গলার স্বর প্রচন্ড গাম্ভীর্যপূর্ণ। বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতেন। নিরবে ক্লাসে আসতেন ।বিষয়টি যুক্তি নিষ্ঠা সতর্কভাবে আলোচনা করতেন । আমাদের স্যার অধ্যাপক হরপ্রসাদ মিত্র মহোদয় কে আমার প্রণাম" ।
1 Comments
ভালো লাগলো জেনে। ড. নির্মল বর্মন এর এই যে প্রবন্ধ প্রযুক্তি তথ্য তা জেনে আপ্লুত হলাম।
ReplyDelete