জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র/ সপ্তম পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                          সপ্তম পর্ব                
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী                                                                 


কর্ণ উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন " কি সেই নিগূঢ় রহস্য যার জন্য হস্তিনাপুরের সীমা অতিক্রম করে এখানে আমাকে নিয়ে এলেন?"বাসুদেব শান্ত মধুর কন্ঠে বললেন "ভ্রাতা, তোমার জন্ম রহস্য! তোমাকে তুমি বলছি বলে মনে করো না তোমার প্রতি কোন তাচ্ছিল্য প্রকাশ করছি, তুমি আমার নিকট আত্মীয়, সম্পর্কে ভ্রাতা, বয়সেও আমার থেকে ছোট বলে এই নিকট সর্বনাম পদ ব্যবহার করছি"। 
কর্ণ বাসুদেবের মুখে আত্মীয়, ভ্রাতা প্রভৃতি শব্দ শোনার পরে বললেন "আপনি কি আমার সাথে রহস্য করছেন"? শ্রীকৃষ্ণ বললেন "আমি কোন রহস্য বা কৌতুক করছি না, যা সত্য, এতদিন গোপন ছিল তা আজ প্রকাশ্যে আনবো বলে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। তুমি আমার পিতৃষ্বসা কুন্তীর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং সেই সম্বন্ধে তুমি আমার ভ্রাতা। যদুপতির মুখে এই কথা শুনে কর্ণের মুখমণ্ডল আরক্তিম হয়ে উঠল। বিস্ময়ে তিনি বললেন "তার অর্থ"? "তার অর্থ খুব স্পষ্ট, বসুষেণ। তুমি শুধু মাত্র শৌর্যে বা ঔদার্যেই মহান নও, জ্ঞানেও তুমি মহান, শাস্ত্রজ্ঞ, ধর্মপরায়ণ, বেদবেত্তা। তোমার সহ্য শক্তি ও মনোবল অসীম। আমার সম্পূর্ণ কথা শোনার পরে আমার কথার পূর্ণ তাৎপর্য তোমার জ্ঞানের আলোকে পরিস্ফুট হবে। তুমি রাধেয় বা সুতপুত্র নও, তুমি কৌন্তেয়, তুমি জ্যেষ্ঠ পান্ডব যার রক্তে ক্ষত্রিয়ের শোণিত বিদ্যমান। পৃথা আমার আপন পিতৃষ্বসা। অপুত্রক কুন্তীভোজ আমার ঠাকুরদা বৃষ্ণিবংশের রাজা শূরের নিকট পৃথাকে দত্তক নিয়ে তাকে পুত্রীস্নেহে পালন করেছিলেন বলে তিনি কুন্তী নামে পরিচিত এবং সেই কারণে তুমি আমার আত্মীয় ও ভ্রাতা"। পৃথা থেকে কুন্তী এবং সেখান থেকে বাসুদেবের আত্মীয় ও ভ্রাতা - এই সম্পর্ক শোনার পরে কর্নের মনের মধ্যে বিহ্বলতা এসে গেল। তিনি বাসুদেবকে বললেন "এ পর্যন্ত তোমার মুখনিঃসৃত বাক্যগুলি শ্রবন করার পরে সবকিছু আমার কাছে দুর্জ্ঞেয় ও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। তুমি আমাকে দয়া করে সহজ বোধগম্য ভাষায় বুঝিয়ে বল এই অবতরণিকার অর্থ কি"?


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


 "কর্ণ, তুমি কি আমার কথার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারনি? তোমার জন্ম সম্বন্ধে এই পর্যন্ত কি কখনো মনে কোনো সংশয় আসেনি? তোমার কি মনে হয় নি সুতপুত্রের পক্ষে এই শৌর্য, বীর্য, শাস্ত্রজ্ঞান, সাহস বা উদারতা সম্ভব, বিশেষতঃ স্বয়ম্বরসভায় যখন তোমার জন্ম সম্বন্ধে পাঞ্চালী বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন? তাহলে তুমি শোনো যা সত্য তাই তোমার কাছে আমি জ্ঞাপন করছি। 
তুমি আমার পিতৃষ্বসা পৃথার কুমারী অবস্থায় প্রথম সন্তান। শাস্ত্রে এই ঘটনাকে অশাস্ত্রীয় বা অস্বাভাবিক বলা হয়নি যার জন্য কানীন বা সহোড় সন্তানকে শাস্ত্রে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই সন্তান কন্যার বিবাহত্তোর সন্তান বলে গণ্য হবে। কুমারী অবস্থার এই লজ্জা পরিবার ও সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে তিনি কাউকে জানাতে পারেননি এবং নিতান্ত বালিকা বয়সে তাঁর শাস্ত্রের নীতিও অজ্ঞাত ছিল। একমাত্র রাজপরিবারের ধাত্রী এই ঘটনা জানত এবং তারই সাহায্যে কুন্তী একটি পেটিকাতে ভরে তোমাকে অশ্বনদীতে ভাসিয়ে দিয়ে ছিলেন একমাত্র সূর্যদেবের আশীর্বাদের আশায়, যিনি তোমার সত্যকারের পিতা। তুমি নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে গঙ্গানদীতে এসে পৌঁছানোর পরে নিঃসন্তান অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধা তোমাকে নদী থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নিঃসন্দেহে পিতৃ-মাতৃ স্নেহে লালন পালন করেছেন"। এই কথাগুলি বলার পরে বাসুদেব পুনরায় বললেন "তোমার শরীরে সুবর্ণ মন্ডিত সহজাত বর্ম ও কবচকুণ্ডল মাতা কুন্তীর অনুরোধে সূর্যদেব তোমার ভবিষ্যৎ মঙ্গলকামনায় ও অনিশ্চিত বিপদে রক্ষার নিমিত্ত দান করেছিলেন। সেগুলো দেখেও তোমার মনে কোনদিন কোনও সংশয় হয়নি জেনে আমি বিস্মিত হচ্ছি। সহজাত বর্ম ও কবচকুণ্ডল কোন সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকতে পারে না, একমাত্র কোন দেবশিশুর ক্ষেত্রেই সম্ভব। তোমাকে নদীতে ভাসানোর পরে জননী কুন্তী লোকলজ্জার ভয়ে কোনদিন তোমার সম্বন্ধে কোন সংবাদ বা দুশ্চিন্তায় তাড়িত হননি- একথা সর্বৈব সত্য, কিন্তু কৌরব ও পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষা পরীক্ষার দিনে তোমাকে দেখে তার কুমারী জীবনের কথা মনে উদিত হওয়ার ফলে তিনি ঘনঘন মূর্ছা গিয়েছিলেন এবং কৃপাচার্য উপস্থিত বুদ্ধি বলে সেদিনের মত পরীক্ষা বন্ধ করেছিলেন যার জন্য তোমার মনে সংশয়ের বীজ রোপিত হয়েছিল যে কথা তুমি পূর্বে আমার কাছে উল্লেখ করেছিলে"। 
জন্মের সকল তথ্য ব্যক্ত করার পরে বাসুদেব পুনরায় বললেন "কর্ণ, তোমার জন্মের রহস্য তোমাকে বললাম, এক্ষনে আমার অনুরোধ তুমি তোমার ন্যায্য স্থান, প্রাপ্য মর্যাদা ও স্বীয় রাজ্য অধিকার কর। কুরুবংশের ন্যায্যত তুমি জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং সেই অধিকারে সিংহাসন তোমার প্রাপ্য। তোমার এই পরিচয় অবগত হলে পান্ডুর পঞ্চপুত্র তোমাকে এক বাক্যে স্বীকার করে তোমার অধীনস্থ হবে। তুমি রাজী হলে আজই আমি তোমার অভিষেকের ব্যবস্থা করব। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির তোমার মস্তকে শ্বেত চন্দন লেপন করে তোমায় স্নিগ্ধ করবেন, মহাবলী বৃকোদর তোমার মস্তোকপরি শ্বেতছত্র ধারন করবেন, স্বয়ং তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন তোমার রথের সারথি হবেন এবং অপর ভাতারা ও আত্মীয়গণ তোমার জয়ধ্বনি দিয়ে অনুগমন করবেন। আমি নিজেও বৃষ্ণি বংশের সকল আত্মীয়দের নিয়ে তোমার পশ্চাতে অনুগমন করবো। তুমি নিশ্চিন্তে সুখ লাভ করে গৌরবের সঙ্গে রাজ্য সুখ ভোগ করবে। সারা পৃথিবীর এমন কোন শক্তি থাকবে না যারা তোমার বৈরিতা কামনা করবে। পাঞ্চাল, চেদি, যাদব ও বৃষ্ণি বংশের সকলেই তোমাকে বন্দনা করবেন। বসুন্ধরার যা কিছু শ্রেষ্ঠ ভোগ্য বস্তু আছে সেসকল তোমারই অধিগত হবে, এমনকি তোমার গোপন চিন্তার ধন, তোমার মানসকল্পনায় সংসারের শ্রেষ্ঠ নারীরত্ন, তোমার চির ঈপ্সিতা দ্রৌপদীকে তুমি লাভ করবে"। কথাগুলি বলে শ্রীকৃষ্ণ কর্ণের মুখপানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বোঝার চেষ্টা করলেন তার কি প্রতিক্রিয়া হয়। 
বিস্ময়ে, উত্তেজনায় কর্ণের মুখমন্ডল আরক্তিম ও স্বেদসিক্ত হয়ে উঠল। তিনি চিন্তা করলেন লোভকে প্রশ্রয় দিলে সে প্রবল ও দুর্বার হবে এবং সেক্ষেত্রে সকলের কাছে পরিস্ফুট হবে যে বসুষেণ ঐহিক লোভ-লালসায় নীতি ও পথভ্রষ্ট হয়েছেন যা কর্ণের মত ধর্মশাস্ত্র পারঙ্গম ব্যক্তির পক্ষে মর্মান্তিক। ক্ষণিকের দুর্বলতা, অন্তরের দোলাদোল চিত্ততা উপেক্ষা করে, আবেগকে উপেক্ষা করে ললাটের স্বেদ মুছে ধীর-স্থির কন্ঠে কর্ণ উত্তর দিলেন "বাসুদেব, আমার জন্মরহস্য উদঘাটন করে তুমি প্রমাণ করে দিলে যে তুমি শুধু আমার আত্মীয় নও উপরন্তু জ্যেষ্ঠভ্রাতা - এ সংবাদে আমি যারপরনাই উৎফুল্ল হয়েছি। তোমার প্রতি চিরকালই কি এক দুর্জ্ঞেয় অথচ প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতাম যার কোনো কারণ খুঁজে পেতাম না। কিন্তু আজ দিবালোকের মতো তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। তুমি যে প্রস্তাব আমার কাছে উত্থাপন করলে তা যেমন পান্ডবদের পক্ষে শুভ ও কল্যাণকর আমার কাছেও তদনুরূপ। তোমার সকল বাক্যই যুক্তিগ্রাহ্য সে বিষয়ে আমার কোনো দ্বিমত নাই। শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী মহারাজ পান্ডু যেমন আমার পিতা সেইহেতু সিংহাসন আমারই প্রাপ্য এ কথা সত্য, কিন্তু জন্মান মাত্র জননী কুন্তী আমাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন একথাও সত্য। আবার সারথি অধিরথ আমাকে দেখা মাত্র তাঁর স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন আমাকে সন্তানবৎ লালন পালন করার জন্য। সুতপত্নী রাধেয় আমাকে তার হৃদয় উৎসারিত স্তন্যদান করে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এবং একটি শিশুর যাবতীয় পরিচর্যা করেছিলেন। নিজের গর্ভজাত সন্তানের প্রতি এক মায়ের যতখানি স্নেহ মায়া-মমতা থাকে তার সব কিছু আমাকে তিনি উজাড় করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তাঁরা আমার শিক্ষা-দীক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব স্কন্ধে নিয়ে আমাকে যৌবনে উপনীত করে আমার বিবাহ দিয়েছেন এবং অন্তিমে তারা আমার হাতের জল ও আমার দ্বারা পারলৌকিক ক্রিয়া আশা করেন। আমি ন্যায়-নীতির ধারক হয়ে তাঁদের অবহেলা করে হস্তিনাপুরের সিংহাসন কেন সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বরও হতে চাই না। আমার নিজের বিবেকের কাছে ধিক্কৃত হওয়ার থেকে আমার মৃত্যু শ্রেয়। অধিকন্তু বাল্যকালে অস্ত্রশিক্ষা পরীক্ষাকালে দূর্যোধন আমাকে মিত্রতা পাশে আবদ্ধ করে এক অজ্ঞাতকুলশীল যুবককে রাজপদে অধিষ্ঠিত ও অভিষিক্ত করেছেন। আমার মিত্রতার উপর নির্ভর করে আজ মহারণের পথে অগ্রসর হয়েছেন। তার মিত্রতাকে আজ যদি লোভের বশবর্তী হয়ে আমি ত্যাগ করি তাহলে শাস্ত্রের বাক্য অনুযায়ী আমি কি চরম অকৃতজ্ঞ বলে সমগ্র লোকসমাজে পরিগণিত হব না? এ আমি কখনোই চাইনা"।                                
   ……….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন


Post a Comment

0 Comments