জ্বলদর্চি

গৌরী চিত্রকর ( রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত পটচিত্রী, নির্ভয়পুর, দাসপুর)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৪১

গৌরী চিত্রকর ( রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত পটচিত্রী, নির্ভয়পুর, দাসপুর)

ভাস্করব্রত পতি 

আসল নাম গোফুরান বিবি। সবাই চেনে গৌরী চিত্রকর নামেই। স্বামী মেহের চিত্রকরের কাছে হাতে খড়ি পটচিত্র আঁকার। জন্মের সাল মনে নেই। তবে ১৩৪৯ সালের ঝড়ের সময় বয়স ছিল ১৪ বছর। তিন ছেলে তিন মেয়েকে নিয়ে তাঁর ভরাট সংসার। কিন্তু প্রায় প্রত্যেকেই এক সময় তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ঠিক সেই সময় চোখে দেখতে পেতেন না। ভালোভাবে চলতে পারতেন না। নিয়মিত খাওয়ারও জুটতো না। এক অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়েই কাটিয়েছেন জীবনের শেষ কয়েকটি দিন। শেষ প্রহরের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল এক যন্ত্রনাময় পরিনতি।

বাংলার পটশিল্পকে সারা ভারতের কাছে পরিচিত করে দিয়েছিলেন যে অশিক্ষিত মহিলা, তিনি একটা সময় চলতে পারতেননা ভালোভাবে। পা ভেঙে লাঠি ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। চিকিৎসা করার অর্থটুকুও ছিল না। কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, "একটা খোঁড়ার গাড়ি দাও না।" অর্থাৎ 'হুইল চেয়ার' চাই! কিন্তু কে দেবে? অগত্যা লাঠি ধরে ধরে তাঁর কোনো মতে বেঁচে থেকে দিন গুজরান করাই ছিল অন্যতম লক্ষ্য। চোখেও দেখতে পেতেন না ভালোভাবে। আর্তি ছিল, একটা চশমার। সব ঝাপসা দেখতেন তখন।
পশ্চিমবাংলার গর্ব গৌরী চিত্রকর বেশ কয়েকটা বছর কাটিয়েছেন নিদারুণ দুর্দশায়। তাঁর গলার আর্তনাদ পৌঁছায়নি এ রাজ্য ছাড়িয়ে দিল্লির বুকে। দেশের এক দরিদ্র মহিলা পটচিত্র শিল্পী যিনি কিনা রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত, তিনি কপর্দকহীন হয়ে ভিখিরির মতো দিন কাটিয়েছেন। মৃত্যুর প্রহর গুণেছেন। তাঁর পাশে ছিলনা কেউ। না আত্মীয়, না সরকার, না রাষ্ট্রপতি।

সেই ১৯৮৫ সালে গিয়েছিলেন দিল্লি। সেবার ভারতের রাষ্ট্রপতি জৈল সিং তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন 'রাষ্ট্রপতি পুরস্কার'। স্রেফ পটচিত্র এঁকে বিরল সম্মান পাওয়া পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার দাসপুরের নির্ভয়পুর গ্রামের প্রয়াত পটচিত্র শিল্পী গৌরী চিত্রকর মেদিনীপুরের গর্ব ছিলেন। মেদিনীপুরের মানুষ রতন ছিলেন এই নিরক্ষর মহিলা।

পটের ওপর নরমেধ যজ্ঞের দৃশ্য এঁকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। সেই অপূর্ব শিল্পসুরমাটি এখনও রক্ষিত রয়েছে দিল্লির মিউজিয়ামে। সেবার গৌরী চিত্রকরকে দিল্লি নিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন বাসুদেবপুর-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রাজকুমার মাইতি। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? দাঁত ফোকলা গৌরীদেবীর কথায়, "একটা আইসক্রিম খাইয়েছিল বাপু। এখনও মুখে লেগে আছে।” রাজীব গান্ধীর সাথেও হাত মিলিয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গে জানান, "কি তুলার মতো হাত গো তাঁদের! নরম। সেদিন তাঁকে একটা ফলক (এতে তাঁর সম্পর্কে লেখা), একটা তসরের শাড়ি, হাত ঘড়ি, গায়ের শাল দেওয়া হয়েছিল। গুরু গোলাম হজরত চিস্তিকে শালটা দান করেছিলেন। তবে বাকিগুলো কিছুই নেই। স্রেফ মানপত্রটুকু রক্ষিত ছিল বৌমা সবেজান চিত্রকরের কাছে।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিলনা। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি যাঁকে পশ্চিমবাংলার অজ পাড়া গাঁ থেকে ডেকে দিল্লি নিয়ে গিয়ে সম্মান জানিয়েছিলেন পটচিত্র অঙ্কনের জন্য, সেই শিল্পী দিনে দু'বেলা পেট ভরে খেতে পাননি। সরকার থেকে একসময় তাকে ৭৫০ টাকা করে মাসিক বেতন দিত। অবসরের পর প্রতি মাসে দেওয়া হত ৫০০ টাকা করে ভাতা। সেসবও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অজানা কারণে। এক সময় যে ছেলে মেয়েরা তাঁকে আগলে রাখতো, আজ তাঁদের অনেকেই চোখ ফিরেও তাকাতো না। অভিযোগ ছিল গৌরী চিত্রকরের। বিভিন্ন খাতে যে টাকা ছিল, তা লুঠ করে নিয়েছে এঁদের অনেকেই। তিনি হয়ে উঠেছিলেন কপর্দকশূন্য। 'ভাঁড়ে মা ভবানী' হয়ে স্মরণ করতেন শুধু দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে ২৫ টাকা দামের আইসক্রিম খাওয়ার স্মৃতিটুকু।

বয়ঃভারে নুব্জ গৌরী চিত্রকর এক সময় পটচিত্র আঁকতে পারতেন না। তাঁর ছেলে মেয়েদের মধ্যেও তেমন ইচ্ছা ছিল না এই পেশাটাকে বাঁচিয়ে রাখার। টিম টিম করে কোনোমতে চলছিল পটচিত্র আঁকা। আসলে আজকের প্রজন্মের কাছে পটচিত্র অঙ্কনের ঐতিহ্য সমাদর পায়না। তিনি এক সময় এই পটচিত্র এঁকেই পেয়েছেন দেশের সেরা রাষ্ট্রপতির পুরস্কার। ১৯৮৪-৮৫ তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পধিকার দিয়েছে কারুশিল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার। ১৯৯০ তে রাজ্য হস্তশিল্প উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় দিয়েছিলেন অভিনন্দনপত্র। ১৯৮২ তে রাজ্য লোকসংস্কৃতি উৎসবে প্রথমবার বিশেষ পুরস্কার পান কৃষ্ণলীলার পট এঁকে। সেবার তৎকালীন তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁকে পুরস্কার দিয়েছিলেন। এ রাজ্য ছাড়াও বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, রাজস্থান থেকেও সম্মান জুটেছে তাঁর। অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে তাঁকে দেওয়া হয় এক লক্ষ টাকা। যা মৃত্যুর আগে ছিল শেষ উপহার।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments