জ্বলদর্চি

কনকাঞ্জলি/ চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কনকাঞ্জলি/ চিত্রা ভট্টাচার্য্য  

কুয়াশায় ঢাকা ঘোর অবসাদের বিষাদে ভরা দুপুরে পুরুলিয়া স্টেশনের প্লাটফর্মে  হাওড়া গামী 'রূপসী বাংলা' ট্রেনের কামরায় বসে আছে সুচেতা। কর্মব্যস্ত স্টেশনে জন জোয়ারের ঢল নেমেছে। যাত্রীদের আসা যাওয়ার তাড়া এত কোলাহল তবু অসীম শূন্যতায় নিস্তব্ধতায় ভরে আছে ওর চারিদিক। এক কোণে ট্রেনের জানলায় মাথা রেখেছে। দৃষ্টি শক্তি ঝাপসা হয়ে বোবা কান্নায় গলা বুজে আসে অপলক চোখে একতরফা উষ্ণ জল গড়ায় , রক্তের সম্পর্ক  না হলেও ,বাৎসল্য স্নেহের মায়ার বাঁধন এত গভীর ! নিজের মনের ভিতরে সুপ্ত থাকা এক অদম্য চাওয়া হঠাৎ যেন মনের এক অদৃশ্য দ্বার খুলে  সামনে এসে দাঁড়ালো। বুকের হৃদ স্পন্দনে সব হারানোর ব্যথার হাহাকার দামামার মত বেজে চলেছে । কোনো কোনো মৃত্যু শোকের হয়তো কোনো সান্ত্বনা হয় না। চোখের জলের গড়িয়ে পড়া দাগ শুকিয়ে গালের ওপর মর্মান্তিক অন্তর বেদনার ক্ষত চিহ্ন বহন করে।গত তিনটে দিন মফঃস্বল শহরের গভর্মেন্ট হসপিটালে নানা রকম অব্যবস্থায়  উৎকণ্ঠা উদ্বেগের মধ্যে রাত্রি জাগরণে কাটিয়ে  নিজের সব টুকু ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে ও শেষ রক্ষা হলো না। অপারগতার লজ্জায় রাগে ক্ষোভে বিধ্বস্ত সুচেতা কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছে না নিজেকে। ট্রেন তীব্র হুইসেল দিয়ে ,হর্ন বাজিয়ে কখন প্লাটফর্ম থেকে  লাল পাহাড় ছাড়িয়ে ,সবুজ বনতল ,ফসলের ক্ষেত ডিঙিয়ে ছুটে চলেছে খেয়াল করেনি। মাঘের শীতের কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টায় বিধ্বস্ত চোখে জ্বালা ধরে। ওর চোখের সামনের ক্যানভাসে ভাসছে হরিণের মত সদা চঞ্চল গতি ময় সুধাময়ীর ফুলের মত নিষ্পাপ সরল মুখের যন্ত্রণা কাতর নির্বাক হাসি টুকু। সুচেতা কে অহর্নিশি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে জ্বলন্ত চিতার আগুনের লকলকে লাল জিহ্বা থেকে ছোট্ট একটা প্রাণ-- কালো কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়া হয়ে তরতরিয়ে ওপরের দিকে উঠে চলেছে। কিশোরীর সপ্রতিভ চোখের খিলখিল হাসি ভরা মুখ খানি ধুয়ার সাথে ধূসর আকাশের বায়ু মন্ডলে মিশে একাকার হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। চঞ্চল ঝর্ণার মত প্রাণবন্ত সুধা লোলুপ সমাজের অর্থহীন অবিচারের শিকার হয়ে অতীত হয়ে গেল। পড়ে রইলো তার কয়েক দিন আগের তরতাজা স্মৃতি। স্টেশন থেকে স্টেশন পার হয়ে উত্তাল গতিতে চলন্ত ট্রেন ছুটছে তার চাকায় ঝমঝম শব্দ। দুলুনিতে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে স্মৃতিরা তাড়া করে বেড়ায় ,ওর রিক্ত শূন্য মন ছুটছে পিছনে ফেলে আসা ছোট্ট সুধাময়ীর সাথে জড়িয়ে থাকা দিনক্ষণ সময়ের বয়ে যাওয়া স্রোতে। জীবনের এ কেমন নির্মম  বিচার ? কি তাড়াহুড়ো করে আজ যে বর্তমান কোন অযাচিত এলোমেলো দুর্বার ঝরে কাল সে অতীত হয়ে যায় ? সুধা কে কেন্দ্র করে ও যে ভেবেছিল সারা জীবনের নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব কাটাবে প্রত্যন্ত গ্রামের ঐ চারাগাছ গুলো কে যত্ন করে, সবুজ সবল তরতাজা গাছে পরিণতি দিয়ে নিজের এই হাল ছেড়া পাল ভাঙা  স্রোতে ভাসা দিন গুলোয়      নতুন গতি পথের সন্ধান খুঁজে পাবে।          
              
                                                                                   একাকী আনমনে স্মৃতি চারণে সুচেতা হেঁটে চলেছে ফেলে আসা বিগত সাত টি বছরের অলিগলি রাজপথ ধরে। সেদিন পৌষালী শীতের শেষে অভিমানী মেঘেদের গোমড়া মুখের আড়াল থেকে সবে মাত্র রেহাই পেয়েছে আকাশ। দুপুরের ঝকঝকে আদুরে রোদে পিঠ ঠেকিয়ে ইজি চেয়ারে একরাশ ভেজা চুলের খোঁপা এলিয়ে চোখের ওপর বই খুলে নিজের মাঝে মগ্ন ছিলো। বেশ কয়েক দিনপর এমন রোদের আদুরে পরশ ভারী মায়াময়। ছোট্ট এই দক্ষিণ খোলা ছাদটি জুড়ে ফুলের বাগান ওর ভারী প্রিয়।   মাধবী লতার ডাল টি ভুঁইফোড় হয়ে মেন গেটের পাশ থেকে তরতর করে সরাসরি উঠে এসেছে তিনতলার ছাদের রেলিঙে। সারি সারি টবে হঠাৎ রোদের চিকন আলোয় সবুজ পাতার মাঝে গোলাপী হলুদ মেরুন রঙের বাহার। ডালিয়া ,চন্দ্রমল্লিকায় সেজেছে ছাদের বাগান- ধীরে ধীরে বইয়ের পাতা হাত থেকে আলগা হয়ে যায় চোখের পাতায় তন্দ্রা নামে। মিনিট দশ ও হয়নি ডোর বেল বেজে উঠলে সুখের ঘুম পাততাড়ি গুটালো। রেলিঙের ফাঁক দিয়ে কাঁধে চিঠির বোঝা নিয়ে পোস্টম্যান দাঁড়িয়ে আছে দেখে কৌতূহল সামলে রাখা অসম্ভব। আজকাল বাইপোস্টে চিঠি ! সে এক ভারী দুষ্প্রাপ্য বস্তু। প্রায় দৌড়ে দরজায় উপস্থিত হতেই লাল খাম টি হাতে পেয়ে --খুলে দেখে বিয়ের চিঠি। তেল হলুদ সিঁদুরে ছোঁয়ানো লালের ওপর সোনালী হরপে 'শুভবিবাহ' লেখা অতিসাধারণ এক নিমন্ত্রণপত্র। খামটি হাতে নিয়ে ভাবছে যখন কার বিয়ে ? তখন এক টুকরো কাগজে পরিষ্কার গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ' বড়মা গো উয়ারা আমার বিহা দিচ্ছে বটেক। তু কখন আসবি ?  তু সত্ত্বর আসবি কিন্তুক 'মুই পথ চেয়ে আছি ।' এযে তার অত্যন্ত স্নেহের সুধাময়ীর  চিঠি । সে যে নেহাৎই বালিকা খুব বেশী হলে ১৩বছর হবে ? অযোধ্যা পাহাড়ের তলে প্রত্যন্ত গ্রাম শালডি থেকে চিঠি এসেছে !  নীলকণ্ঠ ও ফুলমনির মেয়ে ইতিমনি মানে সুধাময়ীর বিয়ে আগামী দোসরা মাঘ। বিশ্বাস হচ্ছিল না। আজ যে ২৯শে পৌষের প্রায় শেষ বেলা।     
                                                                                                                  কোনো কিছুর খবর নেই হঠাৎ বিয়ে ! সুধার বিয়ে ? পাত্রই বা কে?  কী  এমন ঘটলো যে সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হলো ? রাগে অভিমানে মাথার রগ ফুলে ওঠে ,সুধামনি কে নিয়ে ওরা দুই বন্ধুতে যে বিস্তর স্বপ্ন দেখেছিল। ওর এত বছরের নিঃসন্তান জীবনের সঞ্চিত যাবতীয় স্নেহ বাৎসল্য মায়া মমতা এক নিমেষে কেড়ে নিয়েছিল ঐ লাল মাটির অজ পাড়াগাঁয়ের কৃশকায় শ্যামলা বরণ কালো হরিণ চোখের  মেয়েটি। সুচেতার দৃঢ় প্রতিজ্ঞমন উৎসাহী হয়ে উঠেছিল সুধার এক সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার অঙ্গীকারে। মা ফুলমনির কাছ থেকে ওর দায়িত্ব ভার চেয়ে নিয়ে এক কল্পনার স্বর্গ রচনা করে সুখে দুঃখে সাধ্যমত থাকছিল ওদের পাশে। শহুরে ইট কাঠের ঘেরাটোপে থেকে ও আধুনিক সভ্যতার বিজ্ঞান ভিত্তিক সরঞ্জামে অভ্যস্ত হয়ে ও  সুচেতা  যেন ক্রমশঃ ওদের ই একজন হয়ে উঠছিল। কিন্তু যত ই রাগ অভিমান হোক ঐ কিশোরীর  হাতে লেখা গোটাগোটা অক্ষর গুলো অদৃশ্য এক সূতো ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে  সেই অখ্যাত পল্লী গ্রামে। যেখানে সরকারি   Rural  devolpopment বিভাগে  সুচেতার  ছোটবেলার বন্ধু নীলাশ্রী কর্মরতা। জীবনের বহু ভাঙা গড়ার ঢেউ সামলে দুজনের বন্ধুত্বের আন্তরিকতা এখোনো অটুট।   

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


         প্রায় সাত বছর আগের এমনি এক পৌষের শীতে সেবারে কলেজের ছকে বাঁধা রুটিনের পড়ানোর দায়িত্ব থেকে ছুটি  নিয়ে নীলাশ্রীর ডাক পেয়ে মাস খানেক অবাধ আনন্দে কাটাতে পুরুলিয়া গিয়েছিল সুচেতা। অযোধ্যা পাহাড়ের  পায়ের কাছে গড়ে ওঠা ছোট্ট ছোট্ট সারি সারি রাঙামাটির গ্রামের মধ্যে এমনি এক অখ্যাত গাঁও শালডি তে  বালিকা সুধাময়ীর দেখা পেয়ে মনে হয়েছিল ওর শূন্য বুকের মাঝে সুরেলা কণ্ঠে  লাল মুনিয়া পাখিটি গান গেয়ে উঠলো। এবং অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে উঠেছিল নিজের দেশেরই অবহেলিত পাহাড়ি গ্রাম গুলোর সহজ সরল মানুষের শত শত দুঃখ বেদনার কাহিনী অশ্রু জলে সিক্ত দিনলিপি তে। তার ই মাঝে হয়তো কোথাও লুকিয়ে থাকে ছোট্ট একটু আশ্বাস সুখের খোঁজ। বিষাদময় জীবনের জ্বালা যন্ত্রণার রোজনামচায় সুধাময়ী যেন হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা এক ঝলক আলোর আভাস ,উচ্ছল আনন্দের স্বাক্ষ্য স্বরূপ ।                                                                                               
  গ্রামের পথে  সকাল বেলায় ধানের ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে গেরুয়া মাটির পথে উঠে নীলার সাথে বেশ একটু এগিয়েছে ,পথ এখানে অনেকটা উঁচু ,নীচের দিকে ক্ষেতের পাশে শ্যাওলা সবুজ জলে ভরা নয়ানজুলি রয়েছে , তারই ধার ঘেঁষে সেখানে ছোট্ট কালো কুচকুচে এক ছাগল ছানার পা লতানো আগাছার জালে জড়িয়ে গেছে আর একটি বছর ছয়েকের বাচ্চা মেয়ে প্রাণপনে তাকে উদ্ধারের উপায়ে  মরীয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার অনর্গল বক বকানিতে ভয়ে আধখানা হয়ে ছানা টি ম্যা ম্যা করাও ভুলে গিয়েছে। সুচেতাদের দেখে মেয়েটি হাতে স্বর্গ পেয়ে ,ছুটে এসে কাতর স্বরে অনুনয় করে শাড়ির আঁচল ধরে টানে আর আঞ্চলিক ভাষায় বলছে ''কালোমানিকের  খুব বেপদ রে ওয়ারে তুরা বাঁচায়ে দিবি গো। মুর খেলনা বাটিক গুলোন সব তোদের দিবো। ওর মিষ্টি মুখের  রাঢ় অঞ্চলীয় গ্রামীণ বাংলা ভাষার কথা  সুচেতাদের বিশেষ জানা নেই। মোটেই  আয়ত্বে আসেনা অমন মধুর বোল ,তবু বুঝতে ও অসুবিধা হয় না। কালোমানিক কে লতাপাতার বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে ক্ষুদে মালকিনের হাতে তুলে দিয়ে নীলাশ্রী প্রশ্ন  করে ,তোর নাম কিরে ? কোথায় থাকিস ? সে ভারী গাম্ভীর্য্যের সাথে বলে মুই ইতিমণি আছি । তারপর কালোমানিক কে এক হাতে কোলে জাপ্টে আর এক হাতে সুচেতার আঁচল চেপে ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে যেখানে  গেরুয়া রঙের সাথে লাল মাটি  মিশিয়ে ফুল  লতা পাতার নানা  চিত্র আঁকা মাটির দেওয়ালের গায়ে ,নীচু খড়ের চালের অন্ধকার ঘরে। ওর রুগ্ন ছোট্ট শরীরের তুলনায় গলায় হাতে কুচি দেওয়া পরনের লাল ফ্রক টি বেশ বড়ো হাঁটু ছাড়িয়ে ঝুল নেমেছে। ,গায়ের গরম সবুজ উলের সোয়েটার টির হাল ও বেশ পুরোনো  ডান পাশের কাঁধ থেকে ঝুলে পড়েছে হাতের দিকে। একরাশ লালচে কোকড়া চুল কপাল বেয়ে গালের দুই পাশে ছড়িয়ে আছে। এত মায়াময় মুখের সুন্দর সরল হাসি ,নিষ্পাপ কালো কাজল চোখের তারা দেখে সুচেতা বলে তুই ইতি ? তোর নাম ইতি কেন ?  মা ফুলমনি গায়ে মোটা কাপড়ের আঁচল জড়ানো উঠোন নিকোচ্ছিলো। গোবর মাটি মাখা হাতে অতিথি দেখে  খানিক অপ্রস্তুত হয়ে  চমকে যায়।   বালতির জলে হাত ডুবিয়ে ধুয়ে আঁচলে মুছে সাদা ঝকঝকে মুক্তোর মত দাঁত বার করে সহাস্যে বলে দিদি গো  দীন হীন মনিষ্যের পরিবার মোদের  বিটিয়া র জন্ম বড়ো দাগা শোক তাপের। কুনো দর লাই গো। বাঁচন মরণ  দুই সমান । উদয় অস্ত বিটিয়ার হাড় ভাঙা খাটুনি ঘরের লাগি। বিস্তর টাকা দিয়া বিহা দেও পরের ঘরে পাঠাও ,কারি কারি টাকা খরচ করি তবে শোউর ঘর কের মান হয়। কিন্তুক বিটির কপালে সুখ আসে কই ? জ্বালায় পুড়ায়ে দগ্ধে মারে।এর আগে মোর আরো দুই বিটিয়া ছেল ,বড় জনের বিহা দিলাম ছুট বয়সে ভিন দেশে শোউর  ঘর করতে গেল জন্মের শোধ ,খবর  আর পাই  লাই।  মাঝের বেটি রে ক্ষেতের আলে কালসর্পে দংশিলে জ্ঞান হারাইলো। অচেতন হইয়া মুহূর্তে সারা দেহ বিষ ক্রিয়ায় নীলবর্ণ হইলো ,বাঁচলো লাই গো।  তাই তো  ইয়ারে ইতি নামে ডাকি। হে বাবা মারাংবুরু, বাপ্ মোর ! হেই মা টুসু দেবী খানিক দয়া করিস মা গো , মুইয়ের ঘরে আর বিটির জন্মটো দিস লা বটেক।      
                                                                       ফুলমনির কথায় বুকের নিভৃত কোণ থেকে  ব্যাথা জড়ানো হাহাকার স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসে।  এই আধুনিক কালের পৃথিবীতে প্রতিমুহূর্তে যেখানে সমাজ পাল্টাচ্ছে সেখানে এই পাড়া গাঁয়ের মেয়েদের এত টুকু ও উন্নতি নেই। কী দুর্বিষহ পরিণতি ভাবতে অবাক লাগে। এখনো নাবালিকা মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের নামে পণ যৌতুক নেওয়া আইনি অপরাধ হলে ও সেখান প্রকাশ্যে পাত্রীর বাবা মা কে নিঃস্ব করে, ছল চাতুরীতে আইন কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বিয়েতে পণ, দহেজের সিষ্টেম চলে আসছে। বেশীর ভাগ শ্বশুর ঘরে মাথার ওপর খড়ের  চালা জুটলে ও সুস্থ স্বাস্থ্য, খাদ্য বস্ত্রের অভাব শিক্ষার অভাব থেকেই যায়। কবে চলে গিয়েছে সেই আদ্দিকালের ধ্যান ধারণা ,কুসংস্কারের প্রথা ,কিন্তু এই সব পাড়া গাঁয়ে শিক্ষার আলোকপাত তেমন হলো কই ? সুচেতা ভাবে কুসংস্কারে জর্জরিত শৃঙ্খল থেকে মেয়েরা কবে মুক্তি পাবে ? ওরা যে এখোনো সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে।                                                                                                                                              বালিকাটি এবারে কালোমানিক কে সামনে বসিয়ে  উঠোনের এক পাশে  ধামা চাপা দেওয়া  আরো দুটি পোষ্য খরগোশের বাচ্চা কোলে তুলে নিয়ে    নীলাশ্রীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লাজুক মুখে বলে ইয়ার নাম উমনি ,ঝুমনি। নীলা হেসে বলে আমাকে দিবি? বালিকা দৃঢ় ভাবে ঘাড় নেড়ে বলে লাগো মোট্টে দিব লাই। সুচেতা বলে আর কে আছে তোর এমন খেলার সাথী ? ইতি মনি প্রতিবেশী মুখিয়াদের মাঠের ধারে এক গোয়াল ঘরের দিকে আঙ্গুল তুলে বলে ওই থানে চাঁদকপালি আছে।  তিনদিন আগে রাতে হাম্বা করি শোরগোল পারে সে কি চেঁচায়, কান্দে। ছুট্টে গিয়ে দেখি বিয়াইলো সাদা ধবধবে বাছুর কপালে আধখানা গেরুয়া চাঁন্দের পানা গোল তাই ,সে চাঁদকপালি বটেক। পরে ভোরের বেলায় আলো ছড়াইলে দেখি লম্ফ দিয়া সামনের পানে  ছুট  লাগায় । নীলাশ্রী ওর   গুছিয়ে বলা কথা শুনে হেসে কুটিপাটি। সুচেতা বলে তোর  নাম আজ থেকে ইতি নয়, সুধাময়ী।  ইতিমনি  একগাল হাসি ছড়িয়ে দিয়ে সারা উঠোন ময় নেচে বেড়ায়  ''হেই মা মুই সুধাময়ী আছি রে ,মুই সুধাময়ী।  সুধাময়ী কি হয় গো বড়োমা ? নীলা বলে তোর সুধায় ভরা মুখের কথা তাই তুই হয়েছিস আমাদের  সুধাময়ী।                                                                                                                                 নীলকণ্ঠ ও ফুলমনির ওপর ভারী রাগ হয় সুচেতার। ঐ নেহাৎ নাবালিকা মেয়ের এমন অন্যায় বিয়ে কি ভাবে সম্ভব ? কত বার বুঝিয়ে ছিল মেয়েদের শিক্ষা দরকার ,স্বনির্ভর হয়ে কিছু উপার্জন করতে পারলে  প্ৰাপ্ত বয়স্ক হলেই বিয়ের চিন্তা করতে হবে , কিন্তু এ কী সংবাদ ? হাতে সময় নেই। অবশেষে রাগ একটু শান্ত হলে ,মনে হলো ,এখনো সময় আছে যদি কোনো মতে বিয়েটা আটকানো যায় ? পুরুলিয়া থানায় অফিসার মিঃ বাসুদেব মাহাতো কে ফোন করে লাভ হলো না , তিনি  খবর নিয়ে জানিয়েছেন গ্রামের মুখিয়ার আত্মীয়র ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে।এবং মেয়ের বয়স ১৮ হয়ে গিয়েছে। ওরা কাগজ পত্র দেখিয়েছে। বিয়ে তাহলে কেন বন্ধ হবে ? সুচেতা  জানে এ যে ধোকা বিরাট মিথ্যে ! ,এ নির্ঘাত মুখিয়ার চাল চক্রান্ত। নিজের কিছু স্বার্থের জন্য ওদের নিদারুন দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে সঙ্কটে ফেলে পথে বসানো।  ভাবছে সুধার জন্মের ভুয়ো প্রমান পত্র ওরা দেখালো কেমন করে ?  ওরা আইন কানুন থানা পুলিশ কোতোয়ালি কিছুই বোঝে না ,শুধু ভয় পায় মহাজন মুখিয়াকে। শুধু মনে প্রাণে অন্ধসংস্কারে বিশ্বাস করে ওদের দেবতা মারাংবুরু কে। এত দূর থেকে এত অল্প সময়ে ওর পক্ষে বিয়ে বন্ধের চেষ্টা বৃথা তবু ও যদি নীলাশ্রী পুরুলিয়ায় থাকতো। নিজের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছে কী প্রকট দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে পেশায় ঘরামী দম্পতি নীলকণ্ঠ ও ফুলমনির সাতজনের সংসারের দৈনন্দিন জীবন যুদ্ধ চলে। প্রতিদিন অন্ন বস্ত্রের জোগাড়ে উদয় অস্ত পরিশ্রম করে স্বামী স্ত্রী ও পরিবারের আরো সকলে। কখোনো দূর শহরে নীলকন্ঠর মত বেশীর ভাগ পুরুষ টালির ছাদ ছাইতে বা ঘর বানাতে গেলে,বা শহরের রাস্তা ঘাট  ব্রীজ সড়ক ইত্যাদি বানাতে গেলে ,কলকাতায় মেট্রো রেলের মাটি কাটার কাজে গেলে ফুলমনিদে র মত ঘরের বৌ-ঝি রা সবাই অন্যের জমিতে বীজ বোনা জল দেওয়া বা জোগালের কাজ করে ,লোকের বাড়িতে মুড়ি ভাজে ছাগল গরু চড়ায়। বনের কাঠ কুড়োয় ,শালপাতা কুড়িয়ে খাবারের থালা বানায় ,কেউবা  বিড়ি বাঁধে , মহুয়া ফুল কুড়িয়ে হাড়িয়া বানায়। তবু ও দুইবেলা পেট ভরে আহারের সংস্থান হয়না। বাসি ভাতে জল ঢেলেই পরম তৃপ্তিতে পেটের ক্ষুধার অসীম জ্বালা মেটাতে হয়।                                                                                                                         সেই প্রথম বার থেকে প্রতি বছরই শুধু শীতে নয় যখনই মন চেয়েছে কর্ম জগৎ থেকে ছুটি নিয়ে পিছুটান হীন সুচেতা ব্যাগ গুছিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের গাঁয়ে নীলার কাছে চলে এসেছে। ওর স্বল্প ক্ষমতা দিয়ে এই পরিবার গুলোর পাশে থেকেছে সাধ্য মত। আশ্বিনে শ্বেত শুভ্র কাশের বনে হারিয়ে যাবার আনন্দে প্রকৃতির ইশারায় কখোনো ঘরে মন বসে না। বসন্তে লালমাটির ওপর ছড়িয়ে থাকা শিমুল পলাশের আগুন রাঙা লালের বন্যায় ভেসে মহুয়ার নেশা জাগানো আকুল করা আহ্বানে সাড়া দিয়ে বনের গভীরে বা বনান্তরে ঘুরতে ক্লান্তি লাগে না । বেড়াতে বেরিয়ে সুধার সাথে গাঁয়ের আরো খেলার সাথী নীতু ফুলি রতু মনুয়া কে নিয়ে প্রায় প্রতিদিন ই কখোনো পায়ে হেঁটে কর্কশ উচুঁ নীচু এবড়ো খেবড়ো ভাঙা পথে, কখোনো বা বেশ দূরে অন্যান্য পাহাড়ি এলাকায় গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছে । নীলাশ্রী সুচেতা কে ওরা প্রকৃতির পাঠ শেখায়। বনের পথে হেঁটে গাছ গাছালী দেখিয়ে  বলে ইটা  সোনাঝুরি ,ঐ শাল পিয়াল কেন্দু বয়রা হরতুকি। আর ঐ হোতা  আগুন রাঙা পলাশ শিমুলের বন ,উয়ার লালে লাল বর্ণ মন মাতাল করে ,উদাস হয়। পথের পাশে সার দিয়ে দেখা যায় লম্বা লম্বা দেবদারুর গাছ গুলো প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে। কত রকম পাখি তাদের ডাক শুনেই ওরা বলতে পারে কোন পাখির  আওয়াজ কে কোথায় বসে ডাকছে। মাঠ ভরা ফসলে সবুজে হলুদে মেশানো সর্ষের ক্ষেতে অবাধ খুশির ঢেউ  উঠতো।  প্রকৃতি এখানে পাহাড় নদী বন ঝর্ণার উজাড় করা সৌন্দর্যে রূপের রানী হয়ে আছে। কখনো শাল পিয়ালের বনে কখনো পাহাড় ধোওয়া মুরগুমা হ্রদের ধারে অথবা শিলাবতী নদীর চড়ায় কাঠ কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে ছোটদের নিয়ে বনভোজনের উৎসব চলতো।   ঝপাং করে শিলাইয়ের জলে লাফিয়ে পরে সাঁতার কেটে খেলা চলতো সারা বেলা। নীলাশ্রীর সাথে দল বেঁধে বামনি ফলসের আশেপাশে ঘুরে ,শুশুনিয়া পাহাড়ের ক্যাম্পে থেকে রাত কাটানো তারায় ভরা আকাশে সপ্তর্ষিমন্ডল কালপুরুষ  শুকতারা কে চিনিয়ে দেওয়া সে এক অনন্য অনুভূতি। সুধাময়ীর দল ওদের নিয়ে যেত মারাংবুড়ুর থানে। কাছে পিঠের গ্রামে বহুরূপীর সাজ ছৌ নাচ.ঝুমুর নাচ দেখাতে। আমন ধান কাটার পর ভাদু উৎসবে গ্রাম বাসীরা খুশির জোয়ারে ভাসতো, পৌষ সংক্রান্তির মেলায় টুসুর উৎসবে ওরা দল বেঁধে কোমড়ে হাত দিয়ে একসাথে  নাচতো। কখোনো বা মহুয়ার বন পেরিয়ে শাল পিয়ালের জঙ্গলে চলে যেত। ইতিমধ্যে কচি কাঁচা মিলে সুধার দলের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে ,ওরা ছোট বেলার বর্ণপরিচয় আদর্শলিপি সহজ পাঠ ইংরাজীর আপেল ,বল ,ক্যাট ,ডগের গন্ডি ছাড়িয়ে ছোটোদের রামায়ণ মহাভারত ,কিশলয় ,পড়া শেষ করে যোগ বিয়োগ গুন ভাগ  শিখে  সুচেতা ও নীলাশ্রীর বাধ্যের মনোযোগী ছাত্র ছাত্রী হয়ে উঠেছে। এবারে ছয় ক্লাসের পড়া শুরু করেছিল।                                                                                                                                                      পড়ন্ত বিকেলের গোধূলির রাঙা আকাশের তলে বসে সুচেতার বারবার সেদিন মনে পড়ছিল শালডি গ্রামের স্মৃতিতে ভরা কত সূর্য ওঠা ভোরের বেলা ,কত সোনালী শীতের সকাল ,কড়কড়ে দুপুরের রোদের কড়া জ্বলন্ত চাউনি। জোনাক জ্বলা বিষন্ন সন্ধ্যা মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে কানপেতে শোনা ঝিঁঝিঁ ডাকা গভীর রাত। গোধূলি বেলায় পাখি পাহাড়ের গা বেয়ে চলার সময় মাথায় লাল পাগড়ি ,হাতে বেণু বাঁশের বাঁশিটিতে ফুঁ দিয়ে কি সুন্দর সুর তুলে ইমন রাগ বাজিয়ে শোনায় বিশু দাদা। সাঁওতালি উৎসবে ধামসা মাদল মৃদঙ্গের বাজনার সাথে মন ছুটে চলে শব্দের স্রোতে ভেসে লাল পাহাড়ের দেশে। সুধা আর রতু বলে ওরা মাথায় হাঁড়ি বসিয়ে ঝুমুর নাচ শিখবে ফুলি গান গেয়ে শোনায় ''তু কেনে দাগা দিলি মোর সাদা কাপড়ে।'' ওরা ও  ঝুমুর নাচবে লোকসংগীত গাইবে বাঁশি বাজাবে -শহরে যাবে ,কলকাতার মত বড়ো শহরের উৎসবের মেলায়। আরো একটু বড়ো হয়ে বড়মার কাছে থেকে কলকাতার ইস্কুলে পড়বে।                                                                                                                নীলা দিল্লিতে গিয়েছে তিন মাসের জন্য ,এ বিয়েতে ওর আসা হলো না। দোসরা মাঘ সুচেতা লাল ঝালর দেওয়া চাঁদোয়া টাঙানো সবুজ হলুদ  নীল কাগজের মালায় সাজানো , কলাগাছ পোতা ,শিলনোড়া পাতা  , হ্যাজাক জ্বালানো মন্ডপের বিয়ের বাড়িতে যখন  পৌঁছলো তখন বিয়ের পর্ব আচার অনুষ্ঠান প্রায় সারা হয়ে গিয়েছে। হলুদ গাঁদার মালা গলায় ,খোঁপায় মহুয়া ফুলের মালা ,কপালে তীলক চন্দন আর লাল তাঁতের শাড়ি তে সুধাময়ী হঠাৎ যেন বালিকা থেকে এক লাফে সলাজ যুবতী হয়ে উঠেছে। সুচেতা বিয়ের কোনে সুধার জন্য এনেছে মঙ্গল সূত্র। রেশমী চুড়ি রূপোর গয়না পলাশ রঙা বেনারসী ,ও তার সাথে আকাশী নীল রঙা জমির শাড়িতে ধানী রঙের সোনালী জরির ফুলে ভরা আঁচল। সুধার ভারী পছন্দের আকাশী নীল শাড়ি। বড়মা কে দেখে তার ভারী অভিমান কেঁদে কেঁদে চোখ ফোলায়। এতো দেরী তে এলি কে নে ? সুচেতা  বলে তুই যে কেন বিয়েতে রাজি হলি ? সুধা বলে উপায় লাই ,গ্রামের উয়ারা চাইলো। আমাদের যে কুনো টাকা লাই গো ,ঘরে চাউল বাড়ন্ত থাকে ,বাবার জমি ঐ মহাজনের কাছে বাঁধা। ফুলমনি নীলকন্ঠ দুজনেই বোঝায় ওদের ঘরে বিয়া হলে দহেজের  টাকা লাগবেক  লাই যত্ত ধার মওকুফ হয়ে যাবে। জমি ওরা ফিরায়ে দিবে কথা দিছে। জামাই হইলো একটু বয়স বেশী ,পাল্টি ঘর ,দোজ বর ,তাতে কি বিষ্ণুপুরের শহরে স্বর্ণকাতান শাড়ি ঘরের  মস্ত কারিগর।  টাকা পয়সা,কমি লাই , বিটিরে আমার উপোস দিতে হবেক  না।  মারাংবুড়ুর আশীর্বাদে ,টুসু দেবীর দয়ায় বিটি আমার দুটি খেতে পাবে।                                                                                          
সুধার বর কে দেখে --  হাঁ হয়ে যায় আঁতকে ওঠে সুচেতা। পাশের গ্রামের ভূদেব মাহাতোর ছেলে নকুল মাহাতো বেশ কালো কুদো মোটা চেহারা ৩৫বছর বয়স। সুধা রোগা পাতলা ক্ষীণ জীবি , এই লোকটির কাছে মোমের পুতুলের মত। যেন এক জালে ফাঁস লাগা চড়াই পাখি। বছর তিন ও দেড় বছরের দুইটি  বাচ্চা আছে চার মাস আগে তৃতীয় বাচ্চার জন্মের সময় ঠিক সাত মাসের গর্ভাবতী প্রথম বৌ বিন্নি পুকুর ঘাটে আছাড় খেয়ে পড়লে  সন্তান সমেত মৃত্যু হয়। নকুল মাহাতোর ঘর সংসার লক্ষ্মীছাড়া হয়ে কতদিন থাকবে তাই সে সংসার সামলাতে সুধাই উপযুক্ত বৌ।  সুধা শ্বশুর বাড়ি যাত্রা করলো ,সোহাগ রাতে সে বায়না করে সেজেছে বড়মার দেওয়া উপহারের গয়না শাড়িতে। সোনালী আঁচলের আকাশী নীল শাড়ি আগুন রাঙা ওড়নায় তাকে দেবী প্রতিমার মত লাগে। ঢাক ঢোল ধামসা মাদল বাজলো গ্রামের নারী পুরুষ একত্রে হাঁড়িয়া খেয়ে নাচ গানে মাতলো খাওয়া দাওয়ার অনুষ্ঠানের পর সব উৎসব শেষ।                                                                                                                                              
 সুধার শ্বশুর বাড়ি চলে যাবার পর  সুচেতা  নীলাশ্রীর কোয়ার্টারে  ফিরে আসে। এ রাত বড়ো বিষাদ ময়। আগামীকাল বিকেলে কলকাতা ফেরার ট্রেন। মন খারাপে সারা রাত চোখে ঘুম ছিল না ,অসম বয়সের অসম চেহারার মানুষের সাথে ওই টুকু মেয়ে সুধার বিয়ে কোনো মতেই মেনে  নিতে পারেনি সুচেতা । সেই বালিকা বিবাহের ট্রাডিশন থেকে দেশ সর্বান্তকরণে মুক্ত হলো কোথায় ? ফুলের মত বালিকা দের জীবনের আশা আকাঙ্খা বড়ো হওয়ার স্বপ্ন ,স্বনির্ভর হওয়া কে এ ভাবেই সংসারের হাড়িকাঠে ফেলে ছল ছুতোয় অর্থকষ্ট অভাবের অস্ত্র দিয়ে বলি দেওয়া হচ্ছে ! এর কোনো প্রতিকার নেই ? অনেক রকম অসংলগ্ন চিন্তায় রাত কাটলে ও ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কেয়ার টেকারের দরজা পেটানোতে ঘুম ভেঙে গেল বাইরে বেরিয়ে দেখে ছুটে এসেছে  ফুলমনি ,ডুকরে কাঁদে পায়ে পরে বলে দিদি গো সুধারে বাঁচা ও। ও  বাড়ি থেকে খবর এসেছে খুব বেপদ রক্ত ক্ষরণ হইছে ,থামছে না , গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ওরা ভোরের বেলা ভর্তি করিদিছে। যে ভয় আশঙ্কায় সারাটা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি সুদীর্ঘ্য রাত কেটেছে এক দুশ্চিন্তায় দুঃস্বপ্নের মত , ঠিক সেটাই যে কয়েক ঘন্টার মধ্যে এতো বাস্তব এমন ভয়ঙ্কর সত্যি হবে তা কল্পনায় ও আসেনি সুচেতার । প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নীলার ড্রাইভার কে নিয়ে ছুটেছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখানে এই সাত সকালে ও পাশাপাশি  গ্রামের লোকেদের বেশ ভীড়  হৈ হৈ উত্তেজনা চলছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনের খাটিয়ায় শুয়ে নিস্তেজ অচেতন সুধাময়ীর শরীর নিঃসৃত লোহিত রক্ত  ধারায় রাঙা হয়ে উঠেছে সুচেতার ই উপহারের আকাশী নীল শাড়ি তে বেষ্টিত ওর ছোট্ট শরীর টা।  লেডী ডাক্তার ছুটে এসে জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে পেশেন্টের ? নকুল মাহাতোর মা বাঁজখায়ি গলায় চেঁচিয়ে বলে '' কি হয়েছে বুঝেলন না ! সোহাগ রাতের ব্যাপার গো ,ধকল সইতে পারে  লাই। সামান্য ঘায়ে দেখি সোহাগী বৌ মূর্ছা  যায় ,আরে আক্কেল লাই মাইয়া মানুষের কি অমন লরম সরম হওয়া চলে ?-এক হাসি ঠাট্টার ঢেউ ওঠে।যেন সব দোষ ঐ সুধার। গ্রাম্য বিবাহিত মেয়েরা যে যার নিজের সাতকাহন কানাকানি করে মুখ টিপে হাসে। পেশেন্ট কে চেকআপ করে ডক্টর জানালেন অবস্থা খুব খারাপ ইন্টারনাল হেমারেজ থামানো যাবে না এই মুহূর্তে অপারেশন করতে হবে যদিও এই সাধারণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মোটেই সে চিকিৎসা সম্ভব নয়। অল্প বয়সী সুধার দুর্বল ভার্জিন শরীরের গঠন সহ্য করতে পারেনি দীর্ঘ সময় ধরে বেপরোয়া যৌন অত্যাচারের আঘাত। রক্তাল্পতার কারণে সেন্সলেস পেশেন্ট কে শহরের হসপিটালে এক্ষুনি ভর্তি করতে হবে। সুধার রক্ত  O Negetive রেয়ার গ্রূপের যা  শহরের হসপিটালে ও দুষ্প্রাপ্য। অনেক টাকা লাগবে , নীলকণ্ঠ বুক চাপড়ায় ,ফুলমনি হাহাকার করে ,''সর্বস্ব খরচ করি বিহা দিয়ে এখন নিঃস্ব তারা ,কেমন করে চিকিৎসা চালাবে ওদের সঞ্চয় যে কিছু টি  লাই।' 'আর সুধাময়ীর শ্বশুর ঘর ? কামনা উন্মত্ত স্বামী নির্বাক। সে কেন বেকার টাকা পয়সা খরচ করবে ? ফুলশয্যার রাত ছিল ,সুধা ওর বিয়ে করা বৌ কী এমন অন্যায় হয়েছে ? স্বামী শ্বশুর বাড়ির লোক গা ঝাড়া দিয়ে নিঃশব্দে ঘরের পথে হাঁটে। সুচেতা ভাবে কী নিষ্ঠুর কী নির্মম এই সমাজ ,বিয়ের নামে বলাৎকার করে একটা জীবন কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে মুখ মুছে ফেলে ,এদের কোনো শাস্তি হয় না।       
                                                                                                         তীর বেগে এম্বুলেন্স ছোটে শহরের হসপিটালে। সুধার চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সুচেতা বহন করলে ও কোনো লাভ হয়নি,তিনদিন জমে মানুষে লড়াই চলার পর সুধা হেরে যায়। সময় মত চিকিৎসা ও রেয়ার ব্লাড গ্রূপের রক্ত জোগাড় না করতে পারার জন্য সারা শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হওয়ার ফলে হার্টফেল। সে রওনা দিয়েছে সেই অচিন পুরের দেশে। প্রদীপের আলো সম্পূর্ণ নিভে যাওয়ার আগে একবার যেমন উজ্জ্বল হয়ে  জ্বলে ওঠে তেমনি  অসমর্থ অচেতন শরীরে ক্ষণিকের তরে জ্ঞান এলো , বিদায়ী বেলায় চোখ মেলে তাকিয়ে কাকে খুঁজেছিল ? স্পষ্ট দেখা গেল রক্তহীন ফ্যাকাসে ঠোঁট নড়ে উঠছে অস্পষ্ট  ভাষায় মৃদু স্বরে বড়মা বলে ডাক টা ও শুনতে পেয়েছিল । কিন্তু কি নালিশ জানাতে চেয়েছিল ? শেষ কথা বোঝা গেলোনা। সুচেতার মনে পড়লো বাঙালি বিয়ের লোকাচারে মেয়েরা যখন পিতৃগৃহ ছেড়ে স্বামীগৃহে রওনা হয় তখন কনকাঞ্জলি নিবেদনের রীতি তে দুই হাতের আঁজলায় চাল ভরে মার আঁচলে ফেলে ঋণ শোধ করে আর  পিছন ফিরে তাকায় না। ১৩বছরের কিশোরী টি যেন পিতৃ ঋণের দায় মেটাতে নিজের জীবন কে কনকাঞ্জলি দিল। বেশ রাতে ট্রেন পৌঁছলো হাওড়ায়। অবসন্ন মনে নিরালায় ঘরে পা  দিয়ে মনে হলো একরাশ জমাট অন্ধকার যেন গ্রাস করতে চাইছে ওর একাকিত্ব কে। মাথা ঝাঁঝাঁ করে জ্বলছে এই শীতের রাতে ও । স্নান ঘরে গিয়ে শাওয়ারের তলে দাঁড়ায় ,ওপর থেকে ঝর্ণা ধারায় জল গড়িয়ে পরলে বিদ্যুৎ বেগে মাথায় খেলে যায়  জলের শব্দে সুধা যেন কাতর অনুরোধ করে বলছে আমি চলে যাচ্ছি বড়োমা আমার খেলার সাথী নীতু ফুলি রতু মনুয়া  বুড়ি গুড়িয়া কে যেন এমন করে নিজের জীবন কে কনকাঞ্জলি না দিতে হয়। স্নান সেরে ব্যালকনিতে এলে শুক্লা পঞ্চমীর তিথির  তারায় ভরা শীতের আকাশ,মৃদু হাওয়ার পরশ লাগে। কানে কানে কে যেন বলে যায় চল ফিরে যাই সেখানে যেখানে আরো অনেক সুধারা প্রতিদিন গভীর আঁধারের গহ্বরে ডুবে চলেছে  , তাদের ঘোর অন্ধকারের থেকে মুক্তি দিয়ে উজ্জ্বল এক আলোর পথের দিশা দেখাতে।

Post a Comment

4 Comments

  1. মর্ম স্পর্শী ! এরকম লেখা য় আমরা যেন সচেতন হয়ে উঠি। উপর উপর চাকচিক্যে না ভুলে সত্যদৃষ্টি দিয়ে যেন নিজেকে দেখতে পাই।সমস্যার মূল কারণ যেন আমাদের চোখে ধরা পড়ে। দীপশ্রী সেনগুপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই গল্প আমাদের সমাজে নারীদের ওপর নেমে আসা অমোঘ অত্যাচারকে তুলে ধরার এক জ্বলন্ত প্রয়াস । গল্পটা পড়ার পরে এক বিষণ্ণতায মন বেদনাতুর হয়ে ওঠে।লেখিকাকে অনেক ধন্যবাদ এরকম একটি সামাজিক অন্যায় কে গণমাধ্যমে তুলে ধরার জন্য।

      Delete
  2. একদিকে সুধাময়ীর ছোট্ট জীবনের মর্মস্পর্শী আহুতির ছবি আরেক দিকে পুরুলিয়ার শাল মহুয়ায় ছাওয়া গ্রামের প্রকৃতি ও জনজীবনের ছবি-- এই দুইয়ের সংমিশ্রণে গল্প যেন তার এক নিজস্ব মাত্রা পেয়েছে। শহুরে বড়মা আর গ্রাম্য বালিকার মানসিক সেতুবন্ধন গল্পটির প্রাণ।
    বাসবী ব্যানার্জী

    ReplyDelete
  3. সুধা হারে নি, সুধারা হারতে পারে না! এক সুধা অনেক সুচেতাকে অনুভব করাবে, এ সমাজকে শোধরাবে! সমাজ পাল্টাবে! এ নারকীয় অত্যাচার চলতে পারে না! লড়াই চলতে থাক, যতদিন না তারা সমনাধিকার পাচ্ছে!

    সমাজের একটা জঘন্য, অন্ধকার দিক তুলে ধরেছেন লেখিকা দিদি তাঁকে আমার শ্রদ্ধা জানাই! এইভাবেই সুচেতারা সচেতনতার আলো জ্বালুক, সবাইকে সাথে নিয়ে চলতে হবে, সবার উন্নতি না হলে সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়! এমন সমাজ সচেতন লেখা বারবার চাই, লেখিকা দিদির কাছ থেকে! দিদির জন্য অনেক অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো, দিদির এই লেখা একজন মানুষকেও বিচলিত, চিন্তিত ও কার্যকরী করে তুলতে পারলে দিদির আন্তরিক চিন্তা-ভাবনা সফল হবে!🙏🙏দেবব্রত ভট্টাচার্য্য 🙏

    ReplyDelete