জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র-৫/ দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                                              
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
                                                
পঞ্চম পর্ব             
           
সময়ের সাথে আমরা এগিয়ে যাই ইন্দ্রপ্রস্থে যেখানে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির রাজা হবার পরে স্থির করলেন রাজসূয় যজ্ঞ করার। স্বভাবতই ভারতভূমির সমস্ত রাজারা যজ্ঞারম্ভের পূর্বে তাঁকে এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়ে কর দান করলে তবেই তিনি রাজসূয় যজ্ঞ করার স্বীকৃতি পাবেন। এই উদ্দেশ্যে ভীম অর্জুন নকুল ও সহদেব চারিদিকে যুদ্ধজয়ে যাত্রা করলেন। অর্জুন গেলেন উত্তরে, ভীম গেলেন পূর্বদিকে, নকুল গেলেন পশ্চিমে এবং সহদেব গেলেন সুদূর দক্ষিণে। তাঁরা প্রায় সকলের কাছে সমাদৃত হলেন একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন চেদিরাজ শিশুপাল। কিন্তু তিনি সাদরে ভীমসেনকে গ্রহণ করে প্রচুর উপঢৌকন দিলেন। এরপরে একমাত্র চিন্তা পূর্ব দিকের অঙ্গরাজ কর্ণকে নিয়ে। পান্ডবদের সম্বন্ধে তার ঈর্ষা ও বিদ্বেষ স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে তিনি বিনা যুদ্ধে কর দিবেন তা কেউ আশা করেনি। 
কিন্তু কর্ণ উল্টো পথে হেঁটে সপার্ষদ সমভিব্যহারে আন্তরিক প্রীতি সম্ভাষণ করে ভীমসেনকে অভ্যর্থনা করলেন এবং আতিথ্য গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন। ভীমসেন বললেন "আপনি নিশ্চয়ই আমার আগমনের কারণ জ্ঞাত হয়েছেন। সেই সংবাদ না জানা থাকলে আমি আপনার কাছে পুনরায় ব্যক্ত করছি যে মহারাজ চক্রবর্তী পান্ডবশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করছেন। ভারতবর্ষের সমস্ত রাজন্যবর্গের কাছে আবেদন জানাতে আমরা চারিদিকে এসেছি। সে ক্ষেত্রে যিনি স্বেচ্ছায় স্বীকার করে কর দেবেন তার আতিথ্য গ্রহণ করতে কোন বাধা নেই, অন্যথায় যুদ্ধে জয় করে তাঁকে বশ্যতা স্বীকার করানোই প্রথা"। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
এই কথা শুনে কর্ণ তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে বললেন "প্রিয়বর, তুমি কি শোনোনি যে কর্ণের কাছে কেউ কোনো প্রত্যাশা নিয়ে এলে কর্ণ তা পূরণ করেন"। ভীমসেন বললেন "আমি কোন ভিক্ষা চাইতে আসিনি, আমি শুধুমাত্র রাজচক্রবর্তী সম্রাটের প্রাপ্য কর আদায় করতে এসেছি"। কর্ণ বললেন "ভাই বৃকোদর, সেও তো আমাকে স্বীকার করে কর প্রদান করার প্রার্থনা পূরণ করতে হবে। আমি যখন সে সুযোগ পেয়েছি তখন আমাকে তার সদ্ব্যবহার করতে দাও"। ভীম লজ্জায় অধোবদন হয়ে কর্ণের আতিথ্য স্বীকার করলেন।                 
কয়েকদিন কর্ণের আতিথ্যে থাকার পরে ভীম বিদায় নিতে চাইলেন। কিন্তু কর্ণ যেন কিছুতেই ছাড়তে চাইছেন না। কর্ণের আচরণ, সস্নেহ প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার যেন আত্মীয়বৎ। জ্যেষ্ঠ সহোদর যেন কনিষ্ঠকে কাছে পেয়ে সব তিক্ততা ভুলে গেলেন। ভীম ফিরে যাবার সময় অন্যান্য রাজাদের থেকে প্রার্থীর আকাঙ্ক্ষার থেকেও অতিরিক্ত অর্থ ও উপঢৌকন কর্ণ তাকে দিলেন। ভীম যাবার সময় কর্ণকে কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁর কৃতজ্ঞতা নিবেদন করে বললেন "পূর্বেই আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, পুনরায় আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে আবার আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার বন্ধুত্ব ও প্রীতি লাভ করলে আমার সব ভ্রাতারাই সুখী ও কৃতার্থ বোধ করবেন। আপনি আমাদের পঞ্চভ্রাতার অগ্রজস্থানীয় বন্ধু হয়ে থাকবেন এই আমার আশা ও প্রার্থনা"। 
কর্ণ এক করুন মধুর হাসি হেসে বললেন "তোমাদের সব ভ্রাতার সাথে সৌহার্দ্য স্থাপন সম্ভব, কিন্তু অর্জুনের সাথে ইহজন্মে সেই মধুর সম্পর্ক স্থাপিত হবে না"। 
ভীম বিস্মিত হয়ে বললেন "কেন, তার সঙ্গে তো আপনার কোনো শত্রুতার কারণ ঘটেনি? কোন আসরে আপনারা দুজনে পরস্পরের বিরুদ্ধে সম্মুখীন হননি"? 
কর্ণ বললেন "সেটাইতো বিদ্বেষের কারণ। শত্রুতা বা প্রতিদ্বন্দিতা নয়, তার সাথে প্রতিযোগিতা করতে চেয়েছিলাম। প্রতিযোগিতায় জয়ী অথবা পরাজিত হতাম তাতে বিদ্বেষ বা বৈরিতার কোন প্রশ্ন থাকত না, কিন্তু দু'বার চেষ্টা করেও আমার প্রার্থনা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। একবার হস্তিনাপুরের রঙ্গশালায় আর একবার দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়"। ভীমসেন বললেন "কিন্তু উপরোক্ত দুই ক্ষেত্রেই তো অর্জুনের কোন হাত ছিল না"।
কর্ণ বললেন "তুমি যা বললে তাও যেমন সত্য, তেমনি আমার এই ব্যর্থতার জ্বালাও সত্য। প্রথমবারে এক কুটিল, ক্রুরমনা ব্রাহ্মণের কৌশলে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং দ্বিতীয়বারে রাজকীয় ঘোষণা সত্ত্বেও দ্রৌপদীর অর্থহীন, জাত্যাভিমানে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই সাময়িক প্রতিযোগিতায় শেষ হয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারত ,কিন্তু ছলে-বলে-কৌশলে আমাকে বঞ্চিত করার ফলে আমার মনে বৈরিতার আকার ধারণ করেছে এবং সেই বৈরিতা সেদিন দূর হবে যেদিন সম্মুখসমরে দুজনে অবতীর্ণ হব। শস্ত্রচালনায় কে বেশি পারদর্শী তা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত আমার মনের এই খেদ দূর হবে না। তোমাকে আমি অগ্রিম ভবিষ্যৎবাণী করছি আমাদের মধ্যে সম্মুখ সমরে হয় অর্জুন না হয় কর্ণ এই ধরাধাম থেকে বিদায় নেবে। মৃত্যুতে আমার কোন দুঃখ নেই, তবে তার আগে আমি এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চাই আমি অর্জুনের থেকে কোনো অংশে হীন বা নিকৃষ্ট নই"। 
ভীমের আন্তরিক আমন্ত্রণে কর্ণ ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসূয় যজ্ঞে এসে দেখলেন এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ, সংখ্যাগণনার অতীত বিশাল যজ্ঞকাণ্ডের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু ও নিয়ন্ত্রা সেই হোমাগ্নিসম্ভূতা কন্যা কৃষ্ণা। এ জীবনে বহু নারী কামনা করেছে - মহাবীর, সূর্য তেজসম্পন্ন শৌর্যশালী কর্ণকে। ওঁর প্রধানা মহিষী পদ্মাবতীর প্রেমেও তিনি তৃপ্ত ও সুখী। তথাপি পাঞ্চাল স্বয়ম্বর সভায় দ্রৌপদী মে রূঢ় ভাষায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সে অপমান অগ্নিদাহসম প্রতিনিয়ত তাকে দগ্ধ করে। কিন্তু স্বয়ম্বর সভায় এক ঝলক দেখার পরে পুনরায় সেই নারীর মুখাবয়ব এখানে এসে দেখলেন। পাঞ্চালীকে দেখার পরে তাঁর মনে হয়েছে জীবনে আর যাকেই পান না কেন - এই নারীকে জয়লাভ করতে না পেরে অথবা বলা যায় তাকে জয়লাভের সুযোগ না দেওয়াতে তাঁর শৌর্য, বীরত্ব ও খ্যাতি সব যেন মিথ্যা হয়ে গেছে। এখানে এসে দেখলেন হোমাগ্নিসম্ভুতা সাক্ষাৎ অগ্নিশিখারূপিনী এই কন্যা বিদ্যুতাগ্নির মত নিমেষকাল মধ্যে যেন সমস্ত কিছু দগ্ধ করে দিয়ে চলে গেল। যেখানে সে অবস্থান করবে সেখানে তার দীপ্তিময়ী ছটায় আলোকিত করে রাখে। এ বহ্নির দাহিকা শক্তি আছে কিন্তু এর মধ্যে সৃষ্টির শীতলতা বা স্নিগ্ধতা নেই। পান্ডবদের অযাচিত, অপ্রত্যাশিত এই সৌভাগ্যে তার মনে ঈর্ষা অনুভূত হল। এই যজ্ঞস্থলের সর্বত্রই তার কর্তৃত্ব। এই কর্মোদ্যোগকে যদি তুরঙ্গমের সাথে তুলনা করা হয় তবে তার রশি এই একজনের হাতে, পাণ্ডবভ্রাতারা তার বাহু স্বরূপ কিন্তু মস্তিষ্ক হলেন এই দ্রৌপদী।                             
এক অপরাহ্ন বেলায় ময়দানবের রচিত ইন্দ্রের প্রাসাদতুল্য পাণ্ডবদের প্রাসাদ থেকে দিগন্তের দিকে দৃষ্টিপাত করে কর্ণ অস্তায়মান সূর্যকে নিরীক্ষণ করছিলেন এমন সময় শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন "অঙ্গাধিপতি, এখানে এসে নিমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে মাৎসর্যের বহুবিধ রূপ ও বর্ণ দেখলাম, কিন্তু আপনার মুখ দেখছি স্বতন্ত্র ও অনন্য। পান্ডবদের প্রতি আপনি কোনরূপ ঈর্ষা অনুভব করছেন না"?                        
বাসুদেবের কথায় কর্ণ ভাবলেন এই মানুষটি কি সকলের মনের গোপন খবর রাখেন। বিস্মিত হয়ে তিনি বললেন " না শক্তি থাকলে, সে শক্তি অর্জনের জন্য সাধনা থাকলে এবং তার সদ্ব্যবহার করার সুযোগ থাকলে এই রাজসূয় যজ্ঞ করা কোন অস্বাভাবিক বা অসম্ভব নয়। তাহলে আমি ঈর্ষা করব কেন? দুর্বল ও অকর্মণ্যরাই ঈর্ষা করে। ভগবান আমাকে পৌরুষ দিয়েছেন, শৌর্য আমার আয়ত্তে, অস্ত্র শিক্ষার জন্য বহু ক্লেশ স্বীকার করে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে গেছি, কিন্তু আমার ক্ষোভ সেখানেই যে সেই শিক্ষা বা শৌর্য প্রয়োগ করার কোন সুযোগ পেলাম না। জন্মটাই আমার প্রহেলিকায় ঘেরা, সেই আমার প্রবল অন্তরায়। মিথ্যা পান্ডবদের কেন ঈর্ষা করব? যারা আপনার কথায় ঈর্ষা করছে তারা কেহই শৌর্যে-বীর্যে শস্ত্রশিক্ষায় পান্ডবদের সমকক্ষ নয় একথা স্বীকার করতে বাধা কোথায়"?          
শ্রীকৃষ্ণ অত্যধিক আনন্দে বলে উঠলেন "ধন্য, ধন্য, কর্ণ আপনি ধন্য। লোকে যে আপনাকে মহান বা দেবচরিত্র মানুষ বলে আপনি তার ও উর্ধে - আপনি দেব দুর্লভ চরিত্র"। কিন্তু বাসুদেব যেন খুঁচিয়ে আরও কিছু জানতে চাইছেন। পরক্ষণেই নিজের উচ্ছাস প্রশমন করে তিনি বললেন "শৌর্য, বীর্য বা অগাধ ধনসম্পত্তিই কি একমাত্র কারণ হতে পারে অঙ্গরাজ? ঈর্ষা করার কি আর কোনও কারণ থাকতে পারে না"? 
আরক্তিম মুখে কর্ণ বাসুদেবের মুখের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন "আপনি এই প্রশ্ন কেন করলেন? অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে তা ভাবলেনই বা কেন? সমব্যথী না হলে আপনি আমার অন্তরের মর্মবেদনা অনুমান করলেন কিভাবে? তাহলে আপনার মনেও কি আমার মত ক্ষোভ আছে"? 
তার উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন "বসুষেণ পৃথিবীতে যেই দেহ ধারণ করে আসুক না কেন তার জীবনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা কখনোই চরিতার্থ বা পূরণ হয়না। এক আকাঙ্ক্ষার পিছনে আর এক আকাঙ্ক্ষা এসে হাজির হয়। শুধু সাধারণ মানুষ কেন, মুনি-ঋষিরাও শত শত বৎসর কঠোর তপস্যা করে কি তাঁরা তাঁদের প্রার্থিত বস্তু পান? কঠোর তপস্যার পরেও কেউ কেউ সামান্য সম্ভোগের নেশায় এতদিনের সাধনাকে তারা জলাঞ্জলি দিয়েছেন"। শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কর্ণ বলে ফেললেন "তাহলে আপনিও আমার মত সমব্যথী"।বাসুদেব তাকে আলিঙ্গন করে বললেন "বন্ধু, সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয় আর মনের সব কৌতূহলও প্রকাশ করতে নেই"।

(পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন)

Post a Comment

0 Comments