জ্বলদর্চি

নেতৃত্বের অর্থ দায়িত্বশীলতা /প্রসূন কাঞ্জিলাল

নেতৃত্বের অর্থ দায়িত্বশীলতা

প্রসূন কাঞ্জিলাল


আমার কাছে নেতার সংজ্ঞা হল, তার অবশ্যই একটি দর্শন থাকতে হবে, এবং কোনও সমস্যাতেই সে ভয় পাবে না। তার বদলে সে তা সমাধানের জন্য কাজ করবে। আর সবচেয়ে জরুরী বিষয় হল, তাকে স‌ৎ হতে হবে”   

– ড. এ পি জে আব্দুল কালাম। 

মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির একটি হচ্ছে নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা। মনের গভীরে আমরা সবাই কম-বেশি নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা লালন করি। সামনে থেকে অবদান রাখতে চাই পরিবার, কর্মক্ষেত্র, সমাজ কিংবা দেশের জন্য। হয়ে উঠতে চাই অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। তবে এই অবদান রাখতে চাওয়া কিংবা একজন আদর্শ নেতৃত্ব হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য শুধু ‘ইচ্ছে’ থাকাই যথেষ্ট না। এজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে প্রয়োজন সচেতন চিন্তাধারা, নিয়মিত অনুশীলন এবং সাধনা। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিজিনেস রিভিউতে এ প্রসঙ্গে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে নেতৃত্ব বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন। পাঠক সমাদৃত ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, যদি নিজের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী গড়ে তুলতে চান তবে আপনাকে সবার আগে ‘আত্মসচেতন’ হতে হবে।
এর অর্থ দাঁড়ায়, নিজেকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। নির্ধারণ করতে হবে জীবনের লক্ষ্য। ভালো-মন্দ বুঝে নিয়ে লক্ষ্য অর্জনে তৎপর হতে হবে। কারণ, ব্যক্তিভেদে মানুষের জীবনের চাহিদা এবং পরিতৃপ্তির জায়গা ভিন্ন হয়। তাই অন্যের অন্ধ অনুকরণ না করে নিজেকে খুঁজুন। নিজের ব্যক্তিসত্তার বিশেষত্ব বুঝে নিন। চিনে নিন নিজের বিশেষ শক্তির জায়গা। মনে রাখবেন, আদর্শ নেতৃত্বের কোনো একক বা সর্বজনীন পথ নেই। বরং এ পথের আছে নানা রকমফের। অতএব, অন্যকে অনুকরণ করতে গিয়ে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেললে- তার সঙ্গে হারিয়ে যেতে পারে আপনার সহজাত নেতৃত্বের শক্তি এবং গুণাগুণ। এক্ষেত্রে একটা প্রচলিত প্রবাদের কথা মাথায় রাখা যায়। সেটি হলো: ‘ জীবন একটি পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় প্রতিটি পরীক্ষার্থীর প্রশ্নপত্র আলাদা। তাই একেকজনের উত্তরও হবে একেক রকম। অতএব, অন্যের খাতা দেখে নকল করলে আখেরে ক্ষতি আপনারই ’। তাই আত্মসচেতন হয়ে খুঁজতে হবে নিজেকে বিকশিত করার উপায়। তবে এই যে আত্মসচেতনতা গড়ে তোলা, এটি কিন্তু একেবারে সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হয়। নিজের মধ্যেকার বিচ্যুতি শনাক্ত করে তা নিরসনে উদ্যোগী হতে হয়। আত্মসচেতনতা গড়ে তোলার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে নিজের ভুল বা সীমাবদ্ধতার কথা অস্বীকার করা এবং সমালোচনা গ্রহণ করতে না পারা। এতে আত্মোন্নয়নের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই, গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করতে শিখুন- বিশেষ করে আপনার নেতিবাচক সমালোচনাগুলো যা আপনার কাছে অপছন্দনীয়। সমালোচকের আয়নায় নিজেকে নিরপেক্ষভাবে দেখুন। ভাবুন। নিজের জীবনের গল্প থেকে খুঁজে বের করুন- এই পৃথিবীতে আপনার কী ধরনের অবদান রাখার সম্ভাবনা, সুযোগ এবং প্রয়োজন আছে। নেতৃত্বের গুণাবলী গড়ে তোলার কোনো নির্দিষ্ট বা গড়পড়তা ‘সাজেশন’ যদিও নেই, তবে নিচের পরামর্শগুলো কাজে দিতে পারে:----

* সৎ মতে, সৎ পথে থাকুন।
* সংক্ষেপে, স্পষ্টভাবে কথা বলুন। যতটা বলবেন, তার চেয়ে ঢের বেশি শোনার চেষ্টা করুন। ভালো শ্রোতা হতে পারা ফলদায়ী।
* মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করুন। বিশ্বস্ততা বজায় রাখুন। বিশ্বাস তৈরির ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতা অত্যন্ত দরকারি।
* উদ্দীপনা বাড়ান, ইতিবাচক থাকুন। মানসিক ইতিবাচকতা বাড়লে বাড়ে কর্মক্ষমতা।
* পর্যবেক্ষণের অভ্যাস গড়ে তুলুন। চোখ-কান খোলা রেখে চারপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কাজ করলে তা আপনাকে আশাতীত ফলাফল এনে দিতে পারে।
* ধৈর্য্যশীল হন। জয়-পরাজয় জীবনের অংশ। অর্জনে মাত্রাতিরিক্ত গর্ব কিংবা হারানোতে মাত্রাতিরিক্ত হতাশা- দুটিই বাহুল্য।
দিনশেষে সবচেয়ে দরকারি হল নিজের দক্ষতাকে নিয়মিত শাণিত করতে থাকা। একজন ক্রীড়াবিদ বা ব্যায়ামবিদ নিজেকে যেমন নিয়মিত অনুশীলনের মধ্যমে গড়েপিটে নেয়, তেমনি নিজের দক্ষতাকে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে নিতে সচেষ্ট থাকুন। নিজের প্রতি, মানুষের প্রতি যত্নবান হয়ে নিয়ন্ত্রণ নিন নিজ জীবনের নেতৃত্বের। হয়ে উঠুন একজন দায়িত্বশীল নেতা।

পাহাড় চূড়া নেতাদের অনুপ্রাণিত করে, কিন্তু সমতলেই তারা নেতায় পরিনত হয়

– উইনস্টন চার্চিল

 “একজন সত্যিকার নেতা তার কথায় বিনীত, কিন্তু কাজে আক্রমণাত্মক”

– কনফুশিয়াস (প্রাচীন চীনা দার্শনিক)


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


সংগঠক মানে সংগঠনের নেতা। আর নেতা মানে অনেক মানুষের সমর্থন পাওয়া। স্থান, কাল, পাত্রভেদে যেকোনো মানুষের মন জয় করা ভীষণ কঠিন কাজ। নেতা মানে সাধারণ মানুষ নন, মানুষদের প্রিয়পাত্র। দিকনির্দেশনা দেওয়ার পাত্র। একজন সাধারণ মানুষের ব্যক্তিত্ব যখন অগণিত মানুষকে মুগ্ধ করে, সেই মানুষটি অন্যদের কাছে অভিভাবক বা আদর্শ হয়ে ওঠেন, সেই মানুষটি তখনই স্থান পান সবার মনে। কর্মগুণে একজন সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠেন একজন মহান নেতা বা একজন পথপ্রদর্শক। একজন নেতা সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ তখনই হয়ে ওঠেন, যখন তাঁর ব্যক্তিত্বে যুক্ত হয় অনেকগুলো গুণ।

 যেমন : একজন নেতার মধ্যে থাকতে হবে-----

১.নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা

নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মনোবল ও চিন্তাশক্তি থাকাটা ভীষণ জরুরি। একজন নেতাকে যেকোনো বৈরি পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দিতে জানতে হবে। পুরো সংগঠন বা গোষ্ঠী বা জাতি অভিভাবক মানে একজন নেতাকে, নেতৃত্বের বলিষ্ঠ গুণে একজন সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠে অসাধারণ।

২.হতে হবে সত্যবাদী ও ধৈর্যশীল

সমাজ বা জাতি কী ভাববে, এই চিন্তা মুছে ফেলে সত্যবাদী হতে হবে। মিথ্যার জয় ক্ষণস্থায়ী। সত্যের জয় চিরস্থায়ী। এই তীব্র সত্যকে বুকে ধারণ করেন একজন মহান নেতা। সত্য বলার সঙ্গে থাকতে হবে বিপদে ধৈর্য ধারণের দৃঢ় মানসিক শক্তি। একজন বড়মাপের নেতা যেকোনো বিপদে মনোবল হারান না। তিনি পুরো জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে থাকেন। আনন্দ-বেদনা সবকিছুর মধ্যে তিনি থাকেন তাঁর দায়িত্বে অটল।

৩.থাকতে হবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিক সাহস

সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন সিদ্ধান্তটি জনগণ বা অনুসারীদের জন্য নিরাপদ, সেই চিন্তাটিও মাথায় রাখাটা যথেষ্ট জরুরি।

৪. চাই বন্ধুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ভঙ্গি

জীবনে কষ্ট থাকবেই। ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে সামনে চলতে হবে। জয়লাভের জন্য চাই জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা, সংগঠনকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নেতাকে হতে হবে সৃজনশীল ও সুশিক্ষিত। মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার অতুলনীয় ক্ষমতা থাকে একজন নেতার মস্তিষ্কে।

৫. দরকার অফুরন্ত সাহস

নেতা হওয়ার জন্য প্রয়োজন বৈরী পরিস্থিতিতে অফুরন্ত সাহস। মানসিক শক্তি থাকতে হবে খুব বেশি একজন শ্রেষ্ঠ সংগঠক বা নেতার। একজন মহৎ নেতার উদ্দেশ্য থাকে দলের একজনকে খুশি করা নয়, পুরো জাতির মঙ্গলসাধনই হলো একজন মহান নেতার উদ্দেশ্য। একজন দক্ষ নেতাকে হতে হবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তিনি হন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। জনগণের ভালো-মন্দ তিনি সবার আগে বোঝেন বা গুরুত্ব দেন।

৬. হতে হবে স্বপ্নদ্রষ্টা

বিপদ যেকোনো মানুষের জীবন বা সংগঠনের জন্য অপরিহার্য। তাই বলে মন ভেঙে ফেললে চলবে না। একজন নেতা হচ্ছেন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি দুঃখের মধ্যেও মনোবল হারান না। পুরো সংগঠনকে উৎসাহিত করেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।

৭. প্রয়োজন চারিত্রিক গভীরতা

চারিত্রিক গভীরতা ও দৃঢ়তা থাকাটা ভীষণ জরুরি। একজন নেতার এমন কিছু করা উচিত নয়, যা অন্যের জন্য হবে হাস্যকর। কারণ, দলের প্রধান নেতাকে সবাই অনুকরণ করে। তাই দলনেতাকে হওয়া উচিত দলের আদর্শ। যাকে অনুসরণ করে একজন মানুষ হবে অনুপ্রাণিত। যেমন: নেলসন ম্যান্ডেলা, যিনি নেতা হিসেবে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক সম্মানিত।

৮.ভেদাভেদপূর্ণ অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক

একজন বড়মাপের নেতার মনে অহমিকা থাকাটা উচিত নয়। তাঁকে স্মরণ রাখতে হবে যে ভেদাভেদপূর্ণজ্ঞান দলের মধ্যে ফাটল ধরায়। অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক ভালো হওয়ার জন্য দলের বা সংগঠনের সবার মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক থাকাটা জরুরি। একজন নেতা তাঁর সংগঠনকে শ্রেষ্ঠ বানানোর জন্য সংগঠনের সবার মতামতের সমষ্টিকে প্রাধান্য দেন। শুধু নিজের মতামতকে শ্রেষ্ঠ বলে সবার ওপরে চাপিয়ে দেন না। সংগঠন মানেই একেকজনের মতামত একেক রকম হবে। কারও সঙ্গে কারওটা নাও মিলতে পারে। যেটা সংগঠনের জন্য ভালো, সেটাই গ্রহণ করতে হবে।

৯. পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকাটা আবশ্যক

নিজের দেহের প্রতি যত্নশীল হওয়া মানে নিজেকে শ্রদ্ধা করা। একজন মানুষ সুস্থ না হলে কোনো কাজই তার ভালো লাগবে না। প্রকৃত নেতারা অসৎ সঙ্গ, নেশা, মাদক থেকে থাকেন হাজার মাইল দূরে। কারণ, একটি সংগঠনকে চালানোর জন্য নিজেক হতে হবে সুস্থ-সবল। পৃথিবীর বিখ্যাত নেতাদের জীবনী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাঁরা ছিলেন শারীরিক ও মানসিকভাবে যথেষ্ট সবল। সমাজের অসংগতিগুলো তাঁদের দুর্বল করতে পারেনি বলেই তাঁরা সাধারণ মানুষ থেকেও জয় করেছেন মানুষের হƒদয়। নিজের কর্মগুণে স্থায়ী হয়েছেন ইতিহাসের স্বর্ণালি পৃষ্ঠায়।

১০.চাই আত্মবিশ্বাস

একজন নেতাকে হতে হবে যথেষ্ট আÍবিশ্বাসী। তাঁকে হতে হবে তাঁর কাজের প্রতি সৎ। সেই সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন তা যেন পুরো সংগঠনের জন্য হয় মঙ্গলজনক। সেটা তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে। দৃঢ় আÍবিশ্বাস থাকলে মানুষ বিপদের দিনেও মনোবল হারান না। অন্য মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে সমর্থ হন। একজন সফল নেতার কাজের ব্যাখ্যা তাঁর কাছে থাকে। তাই তাঁর অনুসারীরাও হয়ে ওঠে তাঁর মতো পরিশ্রমী। সবার মধ্যে ভালো সম্পর্ক আর আÍবিশ্বাস থাকলে বিপদের দিনেও কর্মীরা হয়ে উঠবে কর্মতৎপর। সংগঠন এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।

১১. থাকতে হবে জবাবদিহির পর্ব

একজন নেতাকে সব সময় তার অনুসারীদের সামনে জবাবদিহি করতে হবে। মিটিংয়ের মাধ্যমে সংগঠনের ভালো-মন্দগুলোকে সবার সঙ্গে পর্যালোচনা করতে হবে। পাছে লোকে কিছু বলে, এই চিন্তা বাদ দিয়ে কীভাবে কর্মী বা অনুসারীদের আরও উন্নত করা যায়, এই চিন্তাই মুখ্য হওয়া উচিত একজন নেতার। নেতা নিজেও তাঁর কৃতকর্মের জবাবদিহি করলে সবার মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায় কাজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এতে মনোমালিন্যের অবসান হবে। বড়-ছোট ভুল-ত্রুটিগুলো সব দূর হয়ে থাকে। তাই নিয়মিত বসে কাজের বা পরস্পরের প্রতি দায়িত্বের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণটা ভীষণ জরুরি।

১২. সঠিকভাবে কাজ বিতরণ

কাজের চাপে নেতাকে উদাসীন হলে চলবে না। খেয়াল রাখতে হবে, শুধু একজনকে দিয়েই যেন বারবার কঠিন কাজটা করানো না হয়। দায়িত্ব সবার মধ্যেই যেন সঠিকভাবে বণ্টন করা হয়। আবার, এটাও খেয়াল রাখতে হবে, সংগঠনে সবার কাজের ক্ষমতা সমান নয়। পরিবেশ, স্থান, কাল, পাত্র ভেদে কাজের সুষ্ঠু বণ্টন হওয়াটা ভীষণ জরুরি।

১৩..হাস্যরসবোধ

শুধু কাজের বোঝা নিলেই চলবে না। জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য সংগঠনের মধ্যে আনন্দ আড্ডা বা অনুষ্ঠান, বিনোদনের আয়োজনটাও থাকা দরকার। তা না হলে জীবন হয়ে উঠবে শুধুই কাজের বোঝা। গুরুগম্ভীরতায় মানুষ হারিয়ে ফেলবে কাজের স্পৃহা। মনে রাখবেন, আনন্দ আয়োজনটা কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য নয়, কাজে উৎসাহ ফিরিয়ে আনার জন্য।

১৪. স্বার্থহীনতা

একজন নেতাকে শুধু নিজের স্বার্থচিন্তা করলে চলবে না। একজন মহান নেতা থাকেন স্বার্থের অনেক ঊর্ধ্বে। তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে, তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় একটি সংগঠন, যে সংগঠনে রয়েছে অনেক অনুসারী, অনেক কর্মী। তাই শুধু নিজের স্বার্থ বা ব্যক্তিগত জীবনের কথা চিন্তা করলে চলবে না। একজন নেতার কাজকর্ম, উদ্দেশ্য ও স্বপ্ন হতে হবে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে তা হতে হবে পুরো সংগঠন বা জাতির জন্য।

১৫. ভালো কাজের স্বীকৃতি

কর্মীদের সমালোচনা করতে হবে তাদের আঘাত না দিয়ে। যেন সংগঠনের কারও মনে ক্ষোভ না জন্মে। দীর্ঘদিনের দুঃখ-ক্ষোভ থেকেই তৈরি হয় বড় বড় অভ্যন্তরীণ সমস্যা। তাই সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো রাখাটা ভীষণ দরকারি। কোনো কর্মীর ভালো কাজের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা উচিত। এতে ভালো কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়বে। একজন সফল নেতার বৈশিষ্ট্য হলো সফল কর্মী ও সফল সংগঠন তৈরি করা। একজন সফল সংগঠক বা নেতা এক দিনে তৈরি হয় না। দীর্ঘ বছরের শ্রম আর সাধনাতে সাধারণ একজন মানুষ বড় একজন নেতা হয়ে ওঠেন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, দৃঢ় হবেন মস্তিষ্কের অধিকারী যে মানুষটির রয়েছে ব্যবস্থাপনায় তীক্ষè জ্ঞান, তিনিই হবেন সফল নেতা, শ্রেষ্ঠ সংগঠক।

ঘৃণার কারণে মন অন্ধকার হয়ে যায়, স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি কাজ করে না। নেতা হতে হলে ঘৃণা করা যাবে না”

– নেলসন ম্যান্ডেলা। 

নেতৃত্ব হল এমন এক "সামাজিক প্রভাবের প্রক্রিয়া যার সাহায্যে মানুষ কোনও একটি সর্বজনীন কাজ সম্পন্ন করার জন্য অন্যান্য মানুষের সহায়তা ও সমর্থন লাভ করতে পারে।" জিনতত্ত্ববিদের এলান কিথ আরও সর্বব্যাপী একটি সংজ্ঞা দেন। তিনি বলেন, "নেতৃত্ব হল মানুষের জন্য একটি পথ খুলে দেওয়া যাতে তারা কোনও অসাধারণ ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে নিজেদের অবদান রাখতে পারে।" কেন অগবন্নিয়ার (২০০৭) কথায় "প্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক লক্ষে পৌঁছনোর জন্য অন্তর্বর্তী ও বাহ্যিক পরিবেশে প্রাপ্ত সম্পদকে সফলভাবে সমন্বয় সাধন করাও তা থেকে সর্বাধিক লাভ তোলার ক্ষমতাই হল কার্যকরী নেতৃত্ব।" কার্যকর নেতার সংজ্ঞা অগবন্নিয়া দেন এভাবে, "যে কোনও পরিস্থিতিতে যে ব্যক্তি ধারাবাহিকভাবে সফল হওয়ার ক্ষমতা রাখেন এবং কোনও সংস্থা বা সমাজের প্রত্যাশা পূরণকারী হিসেবে স্বীকৃতি পান", তিনিই কার্যকর নেতা।

নেতৃত্বকে একটি বিশেষভাবে আবেগবহুল প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। এখানে সামাজিক প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়ার সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে আবেগ একটি প্রতিষ্ঠানে নেতার মেজাজের কিছু প্রভাব তার দলের উপর পড়ে। এই প্রভাব্গুলিকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে। দলের প্রতিটি সদস্যের মেজাজ। যে দলের নেতার মেজাজ ইতিবাচক সেই দলের সদস্যরা, যে দলের নেতার মেজাজ নেতিবাচক সেই দলের সদস্যদের তুলনায়, বেশি ইতিবাচক মেজাজে থাকেন।নেতারা আবেগ সঞ্চারণ কৌশলের মাধ্যমে তাদের মেজাজ দলের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে চারিয়ে দেন। মনস্তাত্ত্বিক যে সব কৌশলের মাধ্যমে সহজাত দক্ষতা সম্পন্ন নেতারা অনুগামীদের প্রভাবিত করেন, আবেগ সঞ্চারণ তার অন্যতম। দলের আবেগপূর্ণ মনোভাব দলের মধ্যে ধারাবাহিক বা সমপ্রকৃতি যুক্ত আবেগের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে ফুটিয়ে তোলে দলের আবেগপূর্ণ মনোভাব। দলের আবেগপূর্ণ মনোভাব হল দলের প্রতিটি সদস্যের ব্যক্তিগত মেজাজের গড় এবং তা দলীয় স্তরের বিশ্লেষণে প্রাপ্ত মেজাজকে বোঝায়। যে দলের নেতার মেজাজ ইতিবাচক সেই দলের আবেগপূর্ণ মনোভাব, যে দলের নেতার মেজাজ নেতিবাচক সেই দলের তুলনায় অনেক বেশি ইতিবাচক হয়। সমন্বয়, প্রচেষ্টার বিস্তার এবং কাজের কৌশলের ক্ষেত্রে দলের প্রক্রিয়া। সর্বসমক্ষে মেজাজের বহিঃপ্রকাশ দলের সদস্যদের চিন্তা ও কাজ করার ধরনের উপর প্রভাব ফেলে। যখন মানুষ একটি বিশেষ মেজাজের মধ্যে দিয়া যায় ও তা প্রকাশ করে, তখন তারা অন্যান্যদের একটি সংকেত পাঠায়। নেতারা তাদের মেজাজের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং মনোভাবের সংকেত দেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নেতাদের ইতিবাচক মেজাজের বহিঃপ্রকাশ এই সংকেত পাঠায় যে নেতারা লক্ষ্যের দিকে অগ্রগতিকে ভাল বলে মনে করছেন। দলের সদস্যের এই সব সংকেতের প্রতি জ্ঞানাত্মক ও আচরণগতভাবে সাড়া দেন যা দলের প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয়।  পরিষেবা সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গিয়েছে নেতার ইতিবাচক মেজাজের বহিঃপ্রকাশ দলের কার্য সম্পাদনার মান উন্নত করে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে অন্যান্য তথ্য পাওয়া গিয়েছে। নেতার মেজাজ বাদে তার আচরণও কর্মস্থলে কর্মীদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক আবেগের উৎস। নেতা কিছু পরিস্থিতি ও ঘটনার জন্ম দেন যার ফলে আবেগপূর্ণ সাড়া পাওয়া যায়। কর্মীদের সঙ্গে পারস্পরিক ক্রিয়ার সময় নেতাদের কিছু কিছু আচরণ এই সব আবেগপূর্ণ ঘটনার উৎস। কর্মস্থলে আবেগপূর্ণ ঘটনাগুলিকে রূপদান করেন নেতারা। উদাহরণ- কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে তথ্য প্রদান, কাজ বণ্টন, সম্পদের বিতরণ। যে হেতু কর্মীদের আচরণ ও উৎপাদনশীলতা তাদের মানসিক আবেগ দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়, তাই প্রতিষ্ঠানের নেতাদের প্রতি কর্মীদের আবেগবহুল প্রতিক্রিয়াগুলিকে বিবেচনা করা একান্ত প্রয়োজনীয়। আবেগপূর্ণ বুদ্ধিমত্তা, অধিগম্যতার ক্ষমতা এবং নিজের ও অন্যান্যদের মেজাজ ও আবেগকে পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠানে কার্যকরী নেতৃত্বের প্রতি অবদান রাখে।

 নেতৃত্বের অর্থ দায়িত্বশীলতা।


Post a Comment

1 Comments