জ্বলদর্চি

অজানা পথে ( শেষ পর্ব )মিলি ঘোষ

অজানা পথে (শেষ পর্ব)
মিলি ঘোষ

খবর পেয়ে ছুটে এল মনামীর মেয়ে-জামাই।  প্রতিবেশীরা সকলেই একমত, থানায় একটু জানানো দরকার। মধুরা ও নিচের তলার দু'জন ছেলেকে নিয়ে মনামী গেল থানায় ডায়রি করতে। থানার বড়ো বাবু, মেজো বাবু সকলেই মনামীর কথা মন দিয়ে শুনলেন। ভালো ব্যবহারই করলেন। 
বললেন, "আমরা রাতে জেগেই থাকি। এরকম হলে, আপনি শুধু একটা ফোন করে দেবেন। গাড়ি রেডিই থাকে। দশ, পনেরো মিনিটের মধ্যে চলে যাব। আর আপনি দরজা, জানলা একদম ভালো করে দিয়ে ঘরের মধ্যে বসে থাকবেন। তারপর আমরা বুঝে নেব।"
ওই অবস্থায় দশ, পনেরো মিনিট! এই সময়ের মধ্যে তো অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারে। কাজেই মনামীকে ভরসা রাখতে হলো নিচের ছেলেদের ওপরেই।
মনামীর ছাদে লোহার দরজা। তারপর কাঠের দরজা। মোট চারটে তালা ঝুলছে। লোহার দরজা আর দেওয়ালের মধ্যিখানে সামান্যতম একটা ফাঁক আছে, সেই ফাঁক দিয়েই সরু কিছু গলিয়ে রাতের অতিথিরা তালা খোলার চেষ্টা করেছেন। 
সকলেই জানে, তালা ভদ্রলোকের জন্য। মানুষের বাড়িতে তালা ঝুলছে মানে, সে বাড়ি নেই। ব্যাস, এর বেশি তালার আর কোনও ভূমিকা নেই।
তাই বলে এ'ভাবে তালা খোলার চেষ্টা ? আর কাঠের দরজাকে তো এরা আমলই দিচ্ছে না। 
যেখানে যতটুকু ফাঁকফোকর আছে বন্ধ করার জন্য মনামী মিস্ত্রী ডাকল।
রাহী এসে সব শুনে চিন্তায় পড়ে গেল।
এবার মনামী অনুরোধ করল, "রাহী, তুমি রাতে এসে আমার এখানে থাকতে পারবে ?"
রাহী অনুনয়ের সুরে বলল, "না, দিদি। ভোরে উঠে সকালের রুটি তরকারি করে রেখে, আমি স্কুলে যাই। হবে না দিদি।"
মনামী জানত, তবু একবার অনুরোধ করল। 
কাজ সেড়ে রাহী বলল, "আমি সব জানলা ভালো করে আটকে দিচ্ছি। ছাদের দরজা দেওয়া আছে তো ?"
একবার ছাদে গিয়ে সব ঠিকমতো দেওয়া কি না দেখেও এল।
রাহী জানলা দিলেও, মনামী একবার দেখে নেয়। রোজই একটা দুটো জানলার ছিটকিনি ঠিক মতো লাগায়না রাহী। ছাদের দরজাতেও তাই, তালা ঠিকঠাক আছে। কিন্তু ওপরের ছিটকিনিটা ঘুরিয়ে লাগানো নেই। বিরক্ত হলো মনামী। কী যে করে না, রাহী। সব সময় দৌড়চ্ছে।
রাহীকে বলেছে মনামী, "তোমার জানলা দরজা কিছুই দিতে হবে না। সেই তো আমাকে ঠিক করে লাগাতে হয়। লাভ কী হয়, বলো ?"
রাহী অবাক হয়ে বলল, "লাগেনি ঠিক মতো ? আমি তো ঠিক করেই লাগালাম।" 

ছোটো কাজের জন্য মিস্ত্রী তো চাইলেই পাওয়া যায় না। তিন চারদিন দেরি হবে, বলেই দিয়েছে। এই তিন চারদিনের মধ্যে মনামীর ছাদে আবারো তালা খোলার চেষ্টা। মধুরা যেদিন চলে গেছে, ঠিক সেই রাতেই। সেদিন পাশের বাড়ির ভদ্রলোককেও ফোন করেছিল মনামী। সবাই জেগে যাওয়াতে পাইপ বেয়ে নেমে পালিয়েছে।

পরের দিন রাত বারোটার সময় থানার বড়ো বাবুর সঙ্গে মনামীর কথা হলো। 
মনামী অনুরোধের সুরেই বলল, "আপনারা যদি একটু টহল দেন, তাহলেই এগুলো বন্ধ হয়।
কিন্তু তাঁর একই কথা, "আপনি আওয়াজ পেলেই ফোন করে দেবেন। আর হোয়াটসঅ্যাপে আপনার বাড়ির ডিরেকশনটা দিয়ে রাখবেন।"
মিস্ত্রী পরদিনই এল। আর কোথাও কোনও ফাঁক ফোকর থাকল না। 
রাহী এসে বলল, "দিদি, আপনি সব দেখে নিয়েছেন তো ? ঠিক মতো করেছে তো কাজ, মিস্ত্রী ?"
ওপরে গিয়ে তালা খুলে একবার দেখেও এল কাজ ঠিক মতো হয়েছে কি না। 
পরেরদিন রাহী এসেই ছাদের ঘরে গেল ঝাঁটা নিয়ে। মনামী রান্না করছিল। কেন জানি না ওর মনে হলো রাহী ছাদের দরজাটা খুলবে। ঠিক তাই।
মনামী রান্না ঘর থেকে হাসতে হাসতে জোরেই বলল, "ভেতরের প্রত্যেকটা কাজ তুমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছ রাহী। পুলিশ এলে কিন্তু প্রথমে তোমাকেই ধরবে।"
রাহীও হাসছে।
দু'দিন বাদে কাঠের মিস্ত্রীর কিছু কাজ ছিল। রাহী পরদিন এসে প্রতিটি কাজের সামনে পেছনে কোথায় কী স্ক্রু, সমস্ত ভালো করে দেখতে লাগল, মনামীর সামনেই।
মনামী বোধহয় অবাক হতেও ভুলে গেল।
রাহী কাজ করতে করতেই কত কী গল্প করে।
বলে, "সত্যি তো, মধুরার আপনার জন্য চিন্তা হয়। আবার কবে আসবে ও ?"
আবার কোনওদিন বলে, "দিদি, নিচের ছেলেরা না থাকলে আপনার খুব অসুবিধা হবে। ওরা কি এর মধ্যে বাড়ি যাবে ?"
নিচের ছেলেরা কবে থাকবে না, মধুরা কবে আসবে, রাহীর এত কেন প্রশ্ন ?
মনামী নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। "রাহী ? না, না। এসব কী ভাবছি আমি ? অসম্ভব।" মনামী নিজের সঙ্গেই কথা বলতে থাকে। 

তবে, বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে মনামী বেশ কয়েকটা তালা কিনে ফেলল। এমন কিছু তালা, যা অত সহজে বাইরে থেকে খোলা সম্ভব নয়। রাহীর উপস্থিতিতে যদি কোনওদিন ছাদে যেতেও হয়, রাহীর হাতে চাবি মনামী দেয় না।
রাহী বারবার বলতে থাকে, "লাগিয়ে দেব ?"
মনামী কড়া গলায় উত্তর দেয়, "না। নিজের কাজ করো।"
মনামী যখন তালা দিচ্ছে, রাহী কাজ থামিয়ে মনামীর হাতের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকছে। কিন্তু নিচে এসে মনামী সেই চাবি কোথায় রাখল, রাহী জানতেও পারল না। 

যা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না, তাই বিশ্বাস করতে হয় মানুষকে। 
তখনও মনামী দোটানায়, "ঠিক ভাবছি তো ? না কি আমার মনের ভুল ?"
এর মধ্যে একদিন রাহী নিচের দরজার চাবি সিঁড়িতে রেখে এসেছে। 
মনামী জানতে চাইল, "রাহী, চাবি কোথায় ?"
       "ওই সিঁড়িতে। নিচটা ধুতে যাব তো। তাই আর তুলিনি।"
       "না। চাবি ওপরেই আনবে। যখন ধুতে নামবে, তখন নিয়ে যাবে। এতদিন তো তাই করেছ।" 
রাহী সিঁড়ি মুছতে মুছতে নামছে। ঘর মোছার শব্দ তেমন হয় না। অন্তত ওপর থেকে শুনতে পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু রান্না ঘর থেকে মনামীর মনে হলো রাহী কাজ থামিয়েছে। নীরবতারও ভাষা থাকে। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে মনামী স্পষ্ট শুনল, চাবির খচ খচ আওয়াজ।
রাহী চলে যেতেই, মনামী এক তলার ছেলেদের কাছে জানতে চাইল, "কোনও কিছুর ওপর চাবির ছাপ নেওয়া যায় ?"
ওরা বলল, "সাবানে নেওয়া যায়।"
মনামী সেদিনই ওই তালা পাল্টে ফেলল। একই দেখতে তালা, শুধু চাবি পাল্টে গেল। রাহীর হাতে বাড়ির যে  কোনও চাবি দেওয়া বন্ধ করল মনামী। 

মনামী বাড়ি থেকে বেরোনোই প্রায় বন্ধ করে দিল। তবু একদিন দুপুরে ওকে বেরোতে হয়েছে বিশেষ কাজে। রাহী সেটা আগে থেকেই জানত। 
যাবার আগের দিন জিজ্ঞাসা করল, "আপনি যে কাল যাবেন, ভেতরের সব দরজা জানলা খুলে রেখে যাবেন ?"
হায় রে বুদ্ধিহীনা, প্রশ্নও করতে হয় একটু অন্যভাবে। কোন্ দরজায় কোন্ স্ক্রু লাগানো হয়েছে, বিশেষ ভাবে তৈরি তালা কীভাবে খুলতে হয়, তাও দেখতে হয় বুদ্ধি করে। দেখার ইচ্ছা হলে ঝাঁট দিতে দিতেও দেখা যায়। কিন্তু তোমার দেখাতে বুদ্ধির ছাপ ছিল না। এতদিন যা করেছ, সবটাই মনামীর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে করেছ।
মনামী বলল, "আমি সব দরজায় তালা দেব। শুধু একটা চাবি নিচের ছেলেদের কাছে থাকবে। ওরা এসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করবে। আর ঘরের চাবি ও আলমারির চাবি সব আমি পাড়ার কোনও বাড়িতে রেখে যাব।"
রাহী যেন কেমন একটু মিয়িয়ে গেল শুনে।
তারপরেও বুদ্ধি দিয়েছে মনামীকে।
বলেছে, "ওপর নিচ করে এত কোমরে ব্যাথা হয়েছে আপনার। আজ রাতে ওষুধ খেয়ে ঘুমোন, তাহলে কাল আর ব্যাথা থাকবে না। যাবেন তো অত দূরে।"
রাহী বোধহয় ভুলে গেছে, ওর ছেলেকে অঙ্ক করানোর জন্য ও মনামীকে অনুরোধ করেছিল।
মনামী তার মেয়েকে রাহীর কাছে অঙ্ক শিখতে পাঠায়নি।

এরপর একদিন মধুরা এল।
মধুরা এলে রাহীই সাধারণত জিজ্ঞেস করে, "ভালো আছো ?"
সেদিন মধুরা বলল, "ভালো আছো ?"
রাহী কোনওরকমে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।
মনামী, রাহীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। সেই ফাঁকে মধুরা ওর ফটো নিল।
তারপরেই মনামী জিজ্ঞাসা করল, "রাহী, তোমাদের ফ্ল্যাটের কী হলো ?"
    "অন্য প্রমোটার করবে।"
    "কবে শুরু হবে কাজ ?
    " সামনের মাস থেকে।"
    "ওহ্। তবে তো সুতো গুটিয়েই এনেছ।
রাহী তাকাল মনামীর দিকে।

রাহী যে কোনও চক্রে জড়িয়েছে, তা স্পষ্ট। খুব সম্ভবনা আছে, নতুন প্রমোটারের থেকেই কোনও বড়সড় অফার রাহী পেয়েছে। ফ্ল্যাটটা পাবার জন্য রাহী উঠে পরে লেগেছে, যে কোনও মূল্যে। সারাজীবন শুধু খেটেই যেতে কার আর ভালো লাগে। তাই সব কৃতজ্ঞতা ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে দিদিকেই পাখির চোখ করল রাহী।
মধুরা রাতে ফোন করে বলে, "মা, তুমি না ওর মেয়ের এডুকেশনের খরচ দিয়েছ ? এই ছ'বছরে কম জিনিস তো দাওনি ওকে। আমার ভালো ভালো সোয়েটার, জামাগুলো ওর মেয়েকে দিয়েছ। নিজের নতুন শাড়ি, সালয়ারের পিস, এই তার প্রতিদান ? ওকে না দিয়ে একটা ভালো খাবার খাও না কখনও।"
মনামী বলে, "যা দিয়েছি, দিয়েছি। ওসব আর ভাবি না। এখন ওকে বিদায় করতে পারলে বাঁচি।" 

রাহীকে যে সন্দেহ করা হচ্ছে, তা বুঝতেই ওর বেশ সময় লেগেছে। আগে বুঝলে, শেষের দিকের বোকামোগুলো ও করত না।
সেই রাহী, মধুরার বিয়ের এত জিনিসের একটাতেও নিজে থেকে হাত দেয়নি, যতক্ষণ না মনামী বলেছে। কখনও কৌতূহল দেখায়নি কিছুতে। সেই রাহী। হিসেব মেলেনা মনামীর।
যে রাতে প্রথম শব্দ পেয়েছিল মনামী, সেই রাতেই ওর বেড রুমের জানলা খোলা ছিল। সেদিন দুপুরেই জানলা আটকে দেবার অছিলায়, রাহীই ছিটকিনি নামিয়ে রেখে গেছিল। আজ ভাবতে গেলে অনেক কিছুই দুইয়ে দুইয়ে চার হচ্ছে।

সব বুঝেও রাহী নিজে থেকে কাজ ছাড়তে চায়নি। কারণ, কাজ ছেড়ে দিলে, ওর শেষ আশাটুকুও যাবে। মনামীকেই নোটিস ধরাতে হলো। ইতিমধ্যে মনামী ঘরে সিসিটিভি লাগিয়েছে এমনভাবে, যাতে রাহির ঢোকা থেকে বেরোনো পর্যন্ত সবটাই কভার করে। ক্যামেরা দেখে রাহির চোখ স্থির। একটা প্রশ্ন করল না মনামীকে। রাহি যেদিকে যাচ্ছে, ক্যামেরা সেদিকে ঘুরছে। রাহি ঘর মুছছে আর দেখছে। মনামী ভেতরে বসে মোবাইলে সবটা দেখল। সব রেকর্ড হয়ে থাকল।
মনামী নতুন কাজের লোক পায়নি তখনও। 
তবু, মাইনে দেবার সময় মনামী বলল, "বুঝতেই তো পারছ। একা থাকার কী ফল। মধুরা একজন সব সময়ের লোক এনে দিচ্ছে। সে সবই করবে। দু'জন লোক রাখা তো সম্ভব নয়। তাই আর ...... দু'মাসের মাইনে বাড়তি দেওয়া আছে।" 

রাহী চলে গেল। মনামী বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।  রাস্তার এক পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে রাহী, কোন্ অজানা পথে, কে জানে!
মনামী পারত, রাহীকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু দিল না। কারণ, থানা থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কাউকে সন্দেহ হয় কি না। রাহীর দুঃখ কষ্ট কাছ থেকে দেখেছে মনামী। তাই দিল না। তবে ফটো, ফোন নম্বর আর সিসিটিভিতে রাহিকে রেকর্ড করে রেখে দিল, যদি কখনও প্রয়োজন হয় তো দেখাবে পুলিশকে।

ঘরে এসে মনামী ওর ডায়রি খুলে বসল। 
লিখতে শুরু করল নতুন গল্প : "রাহী, এক ব্যতিক্রমী চরিত্র।"
( সমাপ্ত )

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments