জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৬৪/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৬৪

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবধারা প্রচারের উদ্দেশ্যে একটি বাংলা মুখপত্রের চিন্তাভাবনা ১৮৯৬ সাল থেকে শুরু হয়েছিল। যেটির নামকরণ করা হয় ‘উদ্বোধন’। স্বামী বিবেকানন্দ এই পত্রিকার কাজ শুরু করে তা বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব অর্পণ করেন ত্রিগুণাতীতানন্দজীর স্কন্ধে। ত্রিগুণাতীতের হাতে এই উদ্দেশ্যে এক হাজার টাকা তুলে দেন স্বামীজী, যে টাকা তিনি পেয়েছিলেন জোসেফিন ম্যাকলাউডের কাছ থেকে। ভক্ত হরমোহন মিত্র আরও এক হাজার টাকা দেন। এই অর্থ দিয়ে ত্রিগুণাতীতানন্দজীর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল প্রেস কিনে উদ্বোধন প্রকাশনার কাজ শুরু করা। তিনি কলকাতার কম্বুলিটোলা লেনে কয়েকটি ঘর ভাড়া করেন। কোনওরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই এই কাজে নেমে পড়েন। আন্তরিকতা, ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং সর্বোপরি আদর্শের প্রতি অপার ভালোবাসাই ছিল তাঁর এই কাজের চালিকা শক্তি। প্রথম প্রথম কোনও সহায়ক ছাড়াই প্রকাশনা সম্পর্কিত কাজগুলি একার হাতেই করতেন। তিনি ছিলেন একাধারে সম্পাদক, প্রুফরিডার, প্রেসের ম্যানেজার ও সুপারভাইজার। টাইপের লোক অসুস্থ হয়ে পড়লে কম্পোজের কাজটিও করতেন নিজ হস্তে। 

 বিভিন্ন লেখকদের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করা ছাড়াও পত্রিকার জন্য ঘরে ঘরে চাঁদা আদায়ে বেরোতেন। আর্থিক সঙ্গতি অতি সীমিত থাকায় ট্রামে চড়তেন না। পায়ে হেঁটেই কাজ সমাপন করতেন। দিনে দশ মাইল হাঁটতেন। তারপর দুপুরে এক ভক্তের বাড়িতে খেতেন। সকাল-সন্ধ্যায় খেতেন কিছু মুড়ি। ভোর ৩টে থেকে ৪টে অবধি-- এই এক ঘণ্টা সারাদিনে ঘুমোতেন। ঘুম এড়াতে চোখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিতেন, অথবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রুফ দেখতেন। এই সব কিছু ছাড়া কোনও প্রেসকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সেবার দায়িত্বটিও নিয়ে নিতেন। আর নিজের শরীর খারাপ হলে একটি কম্বল মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতেন এবং পরের দিন সকাল থেকেই আবার নেমে পড়তেন কাজে।
 এইভাবে অবশেষে ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিসাপ্তাহিক উদ্বোধন নিজ কলেবরে প্রকাশিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে মাসিক প্রকাশিত হয়। স্বামীজী ‘উদ্বোধন’ (The Awakening ) নামটি দিয়েছিলেন। স্বমীজীর গৃহী শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী রচিত ‘স্বামি-শিষ্য সংবাদ’ গ্রন্থে এই বিষয়ে প্রাঞ্জল বর্ণনা রয়েছে। আছে শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে স্বামীজীর কথোপকথন। সেটি এইরকম --
 “আলমবাজার হইতে বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর বাগানে যখন মঠ উঠিয়া যায়, তাহার অল্পদিন পরে স্বামীজী তাঁহার গুরুভ্রাতৃগণের নিকট প্রস্তাব করেন যে, ঠাকুরের ভাব জনসাধারণের মধ্যে প্রচারকল্পে বাঙ্গালা ভাষায় একখানি সংবাদপত্র বাহির করিতে হইবে। স্বামীজী প্রথমতঃ একখানি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রস্তাব করেন। কিন্তু উহা বিস্তর অর্থসাপেক্ষ হওয়ায় পাক্ষিক পত্র বাহির করিবার প্রস্তাবই সকলের অভিমত হইল এবং স্বামী ত্রিগুণাতীতের উপর উহার পরিচালনের ভার অর্পিত হইল। স্বামীজীর নিজের নিকটে এক সহস্র টাকা ছিল, ঠাকুরের একজন গৃহস্থ ভক্ত ( হরমোহন মিত্র ) আর এক সহস্র ধার দিলেন -- ঐ টাকায় কার্য্যারম্ভ হইল। একটি প্রেস খরিদ করা হইল ( প্রেসটি স্বামীজীর জীবনকালেই নানা কারণে বিক্রয় করা হয় ) এবং শ্যামবাজার রামচন্দ্র মৈত্রের গলিতে শ্রীযুক্ত গিরীন্দ্রনাথ বসাকের বাটীতে ঐ প্রেস স্থাপিত হইল। স্বামী ত্রিগুণাতীত এইরূপে কার্য্যভার গ্রহণ করিয়া ১৩০৫ সালের ১লা মাঘ ঐ পত্র প্রথম প্রকাশ করিলেন। স্বামীজী ঐ পত্রের ‘উদ্বোধন’ নাম মনোনীত করিলেন এবং উহার উন্নতিকল্পে স্বামী ত্রিগুণাতীতকে বহু আশীর্ব্বাদ করিলেন। অক্লিষ্টকর্মা স্বামী ত্রিগুণাতীত স্বামীজীর আদেশে উহার মুদ্রণ ও প্রচারকল্পে যেরূপ পরিশ্রম করিয়াছিলেন তাহার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া পাওয়া ভার। কখন ভক্ত-গৃহস্থের ভিক্ষান্নে, কখন অনশনে, কখন প্রেস ও পত্র সংক্রান্ত কর্ম্মোপলক্ষে পায়ে হাঁটিয়া ৫ ক্রোশ পথ চলিয়া-- এইরূপে স্বামী ত্রিগুণাতীত ঐ পত্রের উন্নতি ও প্রচারের জন্য প্রাণ পর্যন্ত পণ করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। কারণ, পয়সা দিয়া কর্ম্মচারী রাখিবার তখন সংস্থান ছিল না এবং স্বামীজীর আদেশ ছিল, পত্রের জন্য গচ্ছিত টাকার একটি পয়সাও পত্রে ব্যয় ভিন্ন অন্য কোনরূপে খরচ করিতে পারিবে না। স্বামী ত্রিগুণাতীত সেজন্য ভক্তদিগের আলয়ে ভিক্ষাশিক্ষা করিয়া নিজের গ্রাসাচ্ছাদন কোনরূপে চালাইয়া ঐ আদেশ বর্ণে বর্ণে পালন করায়াছিলেন।
 পত্রের প্রস্তাবনা স্বামীজী নিজে লিখিয়া দেন এবং কথা হয় যে, ঠাকুরের সন্ন্যাসী ও গৃহী ভক্তগণই এই পত্রে প্রবন্ধাদি লিখিবেন। কোনরূপ অশ্লীলতাব্যঞ্জক বিজ্ঞাপনাদি যাহাতে এই পত্রে প্রকাশিত না হয় সে বিষয়েও স্বামীজী নির্দ্দেশ করিয়া দেন। সঙ্ঘরূপে পরিণত রামকৃষ্ণ মিশনের সভ্যগণকে স্বামীজী এই পত্রে প্রবন্ধাদি লিখিতে এবং ঠাকুরের ধর্মসম্বন্ধীয় মত পত্রসহায়ে জনসাধারণে প্রচার করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। পত্রের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হইলে শিষ্য একদিন মঠে উপস্থিত হইল। স্বামীজীকে প্রণাম করিয়া উপবেশন করিলে তিনি তাহার সহিত এইরূপ কথাবার্ত্তা আরম্ভ করিলেন---
 স্বামীজী। (পত্রের নামটি বিকৃত করিয়া পরিহাসচ্ছলে ) ‘উদ্বন্ধন’ দেখেছিস?
 শিষ্য। আজ্ঞে হ্যাঁ; সুন্দর হয়েছে।
 স্বামীজী। এই পত্রের ভাব, ভাষা, সব নূতন ছাঁচে গড়তে হবে। 
 শিষ্য। কিরূপ?
 স্বামীজী। ঠাকুরের ভাব ত সব্বাইকে দিতে হবেই; অধিকন্তু বাঙ্গালা ভাষায় নূতন ওজস্বিতা আনতে হবে। এই যেমন -- ঘন ঘন Verb use-এ  ( ক্রিয়াপদের ব্যবহার ) ভাষার দম্ কমে যায়। বিশেষণ দিয়ে Verb-এর ( ক্রিয়াপদের ) ব্যবহারগুলি কমিয়ে দিতে হবে। তুই ঐরূপ প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ কর। আমায় আগে দেখিয়ে তবে উদ্বোধনে ছাপতে দিবি।
 শিষ্য। মহাশয়, স্বামী ত্রিগুণাতীত এই পত্রের জন্য যেরূপ পরিশ্রম করিতেছেন -- তাহা অন্যের পক্ষে অসম্ভব।
 স্বামীজী। তুই বুঝি মনে কচ্ছিস, ঠাকুরের এইসব সন্ন্যাসী সন্তানেরা কেবল গাছতলায় ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকতে জন্মেছে? ইহাদের যে যখন কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবে, তখন তার উদ্যম দেখে লোকে অবাক হবে। এদের কাছে কাজ কি করে করতে হয় তা শেখ্। এই দেখ্, আমার আদেশ পালন করতে ত্রিগুণাতীত সাধনভজন ধ্যানধারণা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে কার্য্যে নেমেছে। এ কি কম Sacrifice-এর ( ত্যাগস্বীকারের ) কথা -- আমার প্রতি কতটা ভালবাসা থেকে এ কর্ম্মপ্রবৃত্তি এসেছে বল্ দেখি। Success ( কাজ হাসিল ) করে তবে ছাড়বে!! তোদের কি এমন রোক্ আছে?
 শিষ্য। কিন্তু মহাশয়, গেরুয়া পরা সন্ন্যাসীকে গৃহীদের দ্বারে দ্বারে ঐরূপে ঘোরা আমার চক্ষে কেমন কেমন ঠেকে!
 স্বামীজী। কেন? পত্রের প্রচার ত গৃহীদেরই কল্যাণের জন্য। দেশে নবভাবপ্রচারের দ্বারা জনসাধারণের কল্যাণ সাধিত হবে। এই ফলাকাঙ্ক্ষারহিত কর্ম্ম বুঝি তুই সাধন-ভজনের চেয়ে কম মনে কচ্ছিস? আমাদের উদ্দেশ্য জীবের হিতসাধন। এই পত্রের আয় দ্বারা টাকা জমাবার মতলব আমাদের নেই। আমরা সর্ব্বত্যাগী সন্ন্যাসী -- মাগছেলে নেই যে, তাদের জন্য কিছু রেখে যেতে হবে। Success ( কাজ হাসিল ও আয়বৃদ্ধি ) হয় ত এর income ( আয়টা ) সমস্তই জীবসেবাকল্পে ব্যয়িত হবে। স্থানে স্থানে সঙ্ঘঠন, সেবাশ্রম স্থাপন, আরও কত কি হিতকর কার্য্যে এর উদ্বৃত্ত অর্থের সদ্ব্যয় হতে পারবে। আমরা ত গৃহীদের মত নিজেদের রোজগারের মতলব এঁটে এ কাজ করছিনে। শুধু পরহিতেই আমাদের সকল movement ( কার্য্য )-- এটা জেনে রাখবি।
 শিষ্য। তাহা হইলেও -- সকলে এ ভাব লইতে পারিবে না।
 স্বামীজী। নাই বা পারলে। তাতে আমাদের এল গেল কি? আমরা criticism ( নিন্দা সুখ্যাতি ) গণ্য করে কার্য্যে অগ্রসর হই নি।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments