জ্বলদর্চি

স্রোতপ্রবাহে বাঙালি ও বাংলা ভাষার জয়যাত্রায় 'একুশের' অবদান / প্রসূন কাঞ্জিলাল

স্রোতপ্রবাহে বাঙালি ও বাংলা ভাষার জয়যাত্রায় 'একুশের' অবদান

প্রসূন কাঞ্জিলাল


যুগে যুগে বিপর্যয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ঐতিহাসিক বিপ্লব, বাঙালীকে ধ্বংস করতে পারেনি। সাময়িক অধোগতি হওয়া সত্ত্বেও, চিন্তাধারা ও নতুনকে গ্রহণ করার শক্তিতে বাঙালী আজও প্রাণধর্মের প্রতীক দেখিয়ে চলেছে। অতীতে এবং অদূর অতীতেই দুশো আড়াইশো বছরের মধ্যেই বাংলা অন্ততঃ দেড়শো মনীষিদের জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আর এটাই তার প্রাণবন্ত জাতির লক্ষণ। উদাহরণ স্বরূপ হাজী মহম্মদ মহসীন, রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, স্যার আশুতোষ মুখার্জী, মেঘনাদ সাহা, অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ ব্যানার্জী প্রমুখেরা। তাহলে কি অবনতি হয়নি বা অপমৃত্যুর কি সম্ভাবনা নেই? আছে তবে অবনতির সঙ্গে তীব্র সচেতন মন, বাঙালীকে নিয়ে চলেছে নবযুগের উদয়াচলের পথে। এটা একটা বিপর্যয়, অপমৃত্যু নয়। এটা শুধু এক অপরিমেয় দিগন্তের পূর্বাভাস। রবীন্দ্রনাথ পরিত্রাণ কর্তার কথা বলেছেন এবং মহামানবকেও স্মরণ করেছেন। মহামানব বা পরিত্রাণ কর্তা আসবে, কিনা জানিনা। তবে বুদ্ধি, অনুভূতি এবং কল্পনা নিয়ে পরিত্রাণ আসবেই। 

    এ যুগ নেতার যুগ নয়- কর্মীর যুগ। বহু অখ্যাত অজ্ঞাত লোক গভীর আদর্শবাদ নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে তিলে তিলে খেটে চলেছে তলায় তলায়। তাঁদের সাধনার যৌথশক্তি একদিন নিশ্চয়ই আসমুদ্র হিমাচল বাংলাকে, সমূলে পরিবর্তন করতে পারবেই। কারণ সংকটের চরম প্রহরেই নেতৃত্ব, আপনিই আসে। উদাহরণ স্বরূপ এথেনীয়েরা নতুনকে অস্বীকার করেছিল বলে, তাই তারা মারা গেছে। কিন্তু বাঙালী তার নতুনকে গ্রহণ করে, নিজের করে বেঁচে থাকবে। কারণ বাংলার পূর্ণজাগরণের সময় পাশ্চাত্য ভাষা ও সংস্কৃতিকে তৎকালীন বাঙালীরা শুধু গ্রহণই করেননি বরং সেগুলোকে নিজের করে নিয়েছিলেন এবং এটাও লক্ষ্য করা যে বাংলাভাষার মধ্যে অন্যভাষাকে গ্রাস করার কোন মনোবৃত্তিও থাকেনা। কেননা বাংলাভাষার মধ্যে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার শক্তি আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪ - ১৮৪৬), রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২ - ১৮৩৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ - ১৮৯১), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪ - ১৮৭৩), হরিশ্চন্দ্র মুখার্জী (১৮২৪ - ১৮৬১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮ - ১৮৯৪) প্রভৃতি মনীষীদের কথা মনে পড়ে। প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা এমনকি অন্ধজাতীয়তাও হবে যুগবিরোধী। স্বাতন্ত্র্য থাকবে, বৈচিত্র্য থাকবে কিন্তু তা যেন সমন্বয় বিরোধী না হয়। স্বার্থ যেন সুবুদ্ধিকে গ্রাস না করে।
       

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


সর্বনাশের প্রহরেই আসে, জাতীয় গভীরতম আধ্যাত্মিক শক্তির জাগরণ। নতুন পন্থা খুঁজে ফেরে মানুষের আলোড়িত সমাজবুদ্ধি। আর এখানেই জেগে উঠে জাতির জীবনশক্তির উৎস। বাঙালীজাতি আত্মকেন্দ্রিক হতে পারেনি। এই সম্পর্কে মনে করা হয় যে বাংলা বহু যুগ ধরে মোঘল সম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ফলে মোঘল সংস্কৃতি, বাঙালীর জীবনে একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দোলা (১৭৩৩ - ১৭৫৫), লর্ড ক্লাইভের (১৭২৫ - ১৭৭৪) কাছে হারার পর, ইংরেজ সরকার পাকাপাকি ভাবে রাজত্ব করতে শুরু করে। মুসলমান সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি যুক্ত হয়। বিবেচনায় বোঝা যায় যে, আদিবাঙালীর সংস্কৃতির সঙ্গে মুসলমান সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে, ফলে দুটো সংস্কৃতি কালে কালে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটতে থাকে। ফলস্বরূপ বাঙালী সংস্কৃতি এত উন্নত হতে পেরেছে। এ বিষয়ে তৎকালীন ইংরেজ সমাজের উদার মনোভাবও খুব উদ্বুদ্ধ করে এই জাতিকে। এইজন্যে বাঙালীর মন প্রান গোঁড়ামি বর্জিত এবং বহুমুখিনতা বিলাসী। তাই বাঙালীর হৃদয়ের আকাশে, জাতীয় স্বরূপ বিস্তার করে জন্ম দিয়েছে অতীশ দীপঙ্কর (৯৮২ -১০৫৪), চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬-১৫৩৪), লালন ফকির (১৭৭২ - ১৮৯০), শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬ - ১৮৮৬) এবং কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) মত প্রমুখদের।
   প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্রের কথা।

 “ইনি বাঙালীর ইতিহাস প্রয়োজন আছে বলে মনে করেছিলেন। তা ছাড়াও বাঙালীর আত্ম বিস্মৃতির
জন্য আক্ষেপও করেছিলেন। পন্ডিত বৃন্দের চেষ্টায় এই আত্মবিস্মৃতি ঘুচেছে বলে মনে হয়। আবার
এমনও মনে হয়, আমরা প্রায় জাতিস্মর হয়ে উঠেছি। তবে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, 
অতীত সমন্ধে অতিরিক্ত চেতনার  বিপদ ও আছে। আবার বর্তমানকে অস্বীকার করে, ভবিষ্যতও গড়া
যায় না। আবার ভবিষ্যত না থাকলে, অতীতও নিরর্থক হয়ে পড়ে।”

 ভারতের উত্তরে আর দক্ষিণে শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘুরছে অগ্নি চক্র। আর এই অগ্নি চক্রের
তমসাচ্ছন্ন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীরা পূর্বভারতের বাঙালী।
 সেই খন্ড - ছিন্ন - বিক্ষিপ্ত বাঙালী- ই, আজ সারা
ভারতের সমস্যা। তবুও নতুনকে গ্রহন করবার ক্ষমতার সমীকরনে অসাধারন শক্তিতে, সে আজও
দীপ্যমান। তার বর্তমান বিপর্যয়, এক অপরিমেয় দিগন্তের পূর্বাভাস। তাই বাঙালীর ঐতিহ্য এবং
ভবিষ্যতের পটভূমিকাতেই এই প্রবন্ধ রচনার পরিবেশনা।
   বর্তমানে বাঙালী সন্তানের কর্মজীবনের উন্নতি কল্পনায় তারা তাদের মাতৃভাষাকেও পদদলিত করতে, আজ আর কেউ অস্বস্তিবোধ করেনা। পিতা-মাতারাও এ বিষয়ে নির্বিকার চিত্তে অংশগ্রহণ করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সন্তানের বাহ্যিক সাফল্যের ব্যবসাবৃদ্ধি, এখন আমাদের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চর্মচক্ষে দেখা যায় না বলে, তাদের আভ্যন্তরীণ শুভাশুভের বোধটুকুকেও অপ্রয়োজনীয় বলে ধরে নিয়ে, এদিকটাকে অবহেলা করি। আর এই অবহেলা সুদূরপ্রসারী। শিক্ষার অবক্ষয়ে যে আত্মশক্তি ক্ষয় হয়, সেটা কি কেউ আর খেয়াল রাখবে না? জানি, বর্তমান ইংরাজীভাষা বিশ্ববাজারে প্রবেশের সিংহদ্বার। তবুও সে যতই ঐশ্বৰ্য্যমণ্ডিত হোক না কেন, যে ভাষাতে মায়ের প্রথম আদর খেয়েছি, আবদার করেছি, কেঁদেছি – সেটাই তো আমার অন্তরের ভাষা, বাংলা। তাকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করে, দূরদৃষ্টির অভাবে আমরা যদি আমাদের আত্মিক লোকসান ঘটিয়ে ফেলি, তার কথা কি আমরা একবারও ভাববো না?
    তাই বঙ্গভাষা কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন
   "হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।"
 বর্তমানের বিশ্বায়নের প্রকোপে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে নৈতিকতা ও মানসিকতার আদর্শে সমাজের নানান সমাজসেবা মূলক কাজ এবং সাহিত্যের পরিচিতিতে বিশ্বের দরবারে আজ এই বাঙালী জাতি প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে, তাদের অবদান কি কেউ একবারও ভাববে না?
                               
নিজের অতীতের প্রতি, নিজের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি সম্মানবোধ, যদি আমরা এখনও আমাদের প্রজন্মদের জানাতে না পারি, তাহলে সে নিজেকে কেমন করে সম্মান করবে? কীভাবে গড়বে সে নিজেকে? মান্য করতেই সে পারবেনা এই কারণে যে, সে জানে যে ভাষাতেই সে লিখুক, পড়ুক বা বলুক না কেন, সে আসলে একজন বঙ্গসন্তান। বাংলাভাষাকে সে যদি অন্তর থেকে হারিয়ে ফেলে, সে কিভাবে তার বুকের ভিতরকার আমিকে স্পর্শ করতে পারবে? যদিও বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এটা সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সে যদি ইংরাজী ভাষা না জানে তাহলে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই জীবনযাপনের জন্য, আশৈশব যত্ন করে ইংরাজী ভাষা শিখতে থাকে। তাই প্রশ্ন এটাই যে তারসঙ্গে নিজ মাতৃভাষা না শেখার কি কোন যোগ আছে? মাতৃভাষাতো ঘরের ভাষা, বাইরের জুতো পড়ে কি আমরা ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াই? করিনা, কারণ এটা আমাদের প্রথম থেকেই সংস্কারের মধ্যে পড়ে। তাহলে ইংরাজী ভাষাও তো বাইরের ভাষা, তাহলে তাকে নিয়ে এতো মাতামাতি করি কেন? যে ভাষা যতই মূল্যবান হোক না কেন, তাহলে যে ভাষাতে মায়ের কোলে বুলি ফুটেছে, সেটাইতো আমাদের প্রথম ভাষা হওয়া উচিত। কেননা, আমাদের সব অনুভূতির চাবিতো মায়ের আঁচলে বাঁধা। অল্প-সল্প ব্যাথা লাগলে আমরা ‘আউচ' বলিনা বা অভ্যেসও করিনা। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেহমনের গভীর যাতনার অসতর্ক মুহুর্তে, মুখ থেকে বেরিয়ে যায় ‘উঃ মাগো'। বাঙালীর যে অখন্ডতা বা বৈশিষ্ট্য সমন্ধে আমরা বিশ্বাসী, সে বস্তুটি কিন্তু প্রাচীন যুগে অসম্পূর্ণ ছিল।

    বাঙালীর পূর্ব ইতিহাসের প্রসঙ্গে এইকথা চিহ্নিত হয়  যে, যারা গঙ্গা, মেঘনা ও পদ্মানদীর
পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস করতেন এবং যাদের রক্তের সংমিশ্রণে  আছে আর্য,  অনার্য, দ্রাবিড় ও
মঙ্গল প্রভৃতি জাতির সঙ্গম ; তাদেরকেই অধুনা বাঙালী জাতির পূর্বপুরুষ বলে ধরা যেতে পারে।
বহু মানবজাতির মিলন ভূমির ফলেই বাঙালীর মানবতত্ত্ব এত সচেতন হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা যে ভাষা
বলতেন তার সঙ্গে আদি বাংলাভাষার  ক্ষীণ যোগাযোগ থাকায় ভাষা, সাহিত্য এবং চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্যের মিলনও একটা প্রধান কারণ ।
   পূর্বভারতে আর্যসংস্কৃতি প্রথমে এবং প্রধানভাবে বয়ে এসেছিল গঙ্গা-ভাগীরথীর পথ দিয়ে। এইজন্যেই গঙ্গা-ভাগীরথীর দুই পাশে থাকায় বাঙলা, আর্যসংস্কৃতির আদিভূমি ছিল এবং বাঙালী সংস্কৃতির প্রাচীন পীঠস্থানগুলি রাঢ় এবং বারেন্দ্র অঞ্চল ছিল বলে ধরা যেতে পারে। আর এই দুটি অঞ্চলই প্রধানত লালমাটির দেশ। তাই শতাব্দীর পর শতাব্দী আর্যাবর্ত আর উত্তরাপথ, দাক্ষিণাত্যের আর পশ্চিম ভারতের মধ্যেই অগ্নিচক্র বর্তমান থাকে এবং পূর্বভারতে ও বাংলায় অন্ধকারচ্ছন্ন অলক্ষ্য ঐতিহাসিক তমসাচ্ছন্ন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হয়ে উঠে, বাঙালী। কারণ আর্য, অনার্য দ্রাবিড় ও মোংগল প্রভৃতি জাতির রক্ত মিলেছে এই বাঙালীর দেহে। ফলে তার দেহে এসেছে ব্যাপকতা। বহুজাতির মিলনভূমি হওয়াতেই মানবতত্ত্ব সমন্ধে বাঙালীরা এত সচেতন।    
   প্রসঙ্গত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারটি পংক্তি মনে পরে-
 "কেহ নাহি জানে, কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা। হেথায় আৰ্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়-চীন শক-হুন-দল পাঠান-মোঘল এক দেহে হল লীন।”
 এই রক্ত মিশ্রণে বাঙালীকে দিয়েছে অনার্যের শিল্পকৌশল আর ভাবপ্রবণতা। আর্যের সংস্কৃতি, তার তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ম চিন্তাশক্তি এবং মিশ্রণের উদারতা। বাঙালীর নেতৃত্বে জাতি সমন্বয়ের প্রাচুর্য্য, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি প্রধান কারণ। (পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর ১৯৩৪ -৩৫ সালে লেখা - 'গ্লিমসেস্ অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রীতে ২৫২ পাতায় জানা যায় যে, ১৫০০ শতাব্দীতে উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরের কাছে এক পার্সীভাষী মুসলমান রাজা, প্রজাদের খুশী করার জন্য সংস্কৃতে লেখা 'গীতা ও মহাভারতকে বাংলাভাষায় অনুবাদ করে অতীত ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। আর এটাই প্রমাণ করে যে, সেইসময়ে ঐ অঞ্চলে বাঙালীদের কত বাস ছিল।) পট পরিবর্তন আসে আঠারো শতকের শেষার্ধে। নতুন ঐতিহাসিক শক্তির আবির্ভাব হয় এবার আর উত্তর পশ্চিমে নয়, পূর্ব ভারতে এবং বাংলায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আধুনিক জন্ম নিল বাংলাদেশে। বদলে গেল ইতিহাসের ছন্দ। অজস্র গ্লানির ভিতর দিয়ে, নতুন সভ্যতার আভাস এসেছে। আর সেই গ্লানিতেই আজও অবসন্ন বাঙালী। উদাহরণ স্বরূপ আমরা মনে রাখতে পারি যে, প্রাক-১৯৭১ এর সময়ে যখন পূর্ববাংলা ইস্ট পাকিস্তান ছিল, তখন সেই দেশের মানুষদের অনেক গ্লানি সহ্য করতে হয়েছিল, বাংলাভাষার কারণে।
   "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, 
        একুশে ফেব্রুয়ারী 
     আমি কি ভুলিতে পারি।। 
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু            
      গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী।।
    আমার সোনার দেশের 
রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী।।"
   খ্রিস্ট পূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় বঙ্গরাজ্যের বিস্তার ছিল পাঞ্জাব পর্যন্ত। গ্রীক  ও রোমান ঐতিহাসিকদের কাছে কোনো তথ্য না থাকায়, তারা ওই রাজ্যের বাঙালি জাতিকে ' গঙ্গারিডি' মানুষদের সাথে  তুলনা করেছিলেন। কারণ এই গঙ্গারিডি উপজাতির রাজ্য ছিল ভাগীরথী ও গঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে শুরু করে গঙ্গা নদীর মোহনা পর্যন্ত। মহাকবি কালীদাস ও নাকি, এই অঞ্চলকে ' বঙ্গদেশ ' বলে অভিহিত করেছিলেন। এই অঞ্চলে চন্দ্রকেতুগড় ও ওয়ারীবটেশ্বর নামে দুই নগর পাওয়া যায়। এই গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজারা যুদ্ধ কৌশল, গজসেনা ও নৌসেনায় ভীষণ পটু থাকায় গ্রীক বিজয়ী আলেকজান্ডারকে পূর্ব ভারতে ঢুকতে দেয়নি । ফলে আলেকজান্ডারের নন্দ রাজ্য জয় করার অভিলাষ অসমাপ্তই থেকে যায়।
 খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে এই স্বাধীন বাঙালি রাজাদের বস্ত্র শিল্পের খ্যাতি খুবই প্রবল ছিল। কিন্তু প্রায় দুশো বছরের উত্থান পতনের ধারায় গ্রীক- শখ- হুন- পহনব জাতির অভিযানের ফলে আর আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের যুগ পরিবর্তনে বাংলার চিহ্ন আর পাওয়া যায় না ।বাঙালির ইতিহাসে এটি একটি বিস্তৃত ধূসর অধ্যায়।
         বাঙালিকে আবার দেখা যায়, খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে। ওই সময় বাংলায় ছিল কয়েকটি স্বাধীন রাজ্য। সিংহ বর্মা এবং তার পুত্র চন্দ্র বর্মা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীন রাজা। বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া তে এদের প্রাচীন লিপি এখনো পাওয়া যায়। দামোদর নদীর দক্ষিণে " গোখর্ণা " গ্রামেই এদের রাজধানী ছিল বলে মনে করা হয়। গুপ্তেরা কিন্তু সম্পূর্ণভাবে বাংলাকে জয় করতে পারেনি। খন্ড- ছিন্ন- বিভক্তভাবে বাংলায় স্বাধীনতা ছিল।
সার্বভৌম রাজাদের মধ্যে ছয় শত খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম বাঙালি রাজা হন "শশাঙ্ক বেরা"। তারই অধিনায়কত্বে সমস্ত খন্ড রাজ্যগুলি সম্মিলিত হয়। আর তার রাজধানী হয় "কর্ণসুবর্ণ"। যা বর্তমানে মুর্শিদাবাদের জেলার বহরমপুরের কাছে অবস্থিত। বানভট্টের ও হিউয়েন সাং এর নিন্দা সত্ত্বেও আর্যাবর্তে বাঙালির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ও আংশিক সাফল্যের জন্য শশাঙ্কের নাম বাংলার ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। কারণ তার কূটনীতি ও সামাজিক শক্তির প্রকোপে মৌখ বিরাজ ও উত্তরা পথের অধীশ্বর " হর্ষবর্ধনের " চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং গঙ্গারিডি জনজাতির আধিপত্য বজায় থাকে।(অধিশ্বর হর্ষবর্ধনের প্রসঙ্গে জানা যায়- এল মুখার্জি লেখা হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া (হিন্দু)তে। তার রাজত্ব কাল ৬০৬ থেকে ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ৬১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সমস্ত উত্তর ভারত সমেত বাংলার বৃহৎ অংশের সাথে পূর্ব পাঞ্জাবকেও নিজের অধীনে রেখে রাজত্ব করতেন । এটাও একটা প্রমাণ রাখে যে সেই সময়ে ওই অঞ্চলে বাঙালির কত বাস ছিল।)
   শশান্তের মৃত্যুর পর, একশো বছর কাটে আত্মঘাতী অন্তদ্বন্দ্বে আর বহিশত্রুর আক্রমণে। গণতান্ত্রিক সমাজবোধ ও শান্তির জন্য স্বার্থত্যাগ আসে, দীর্ঘকালের রক্তপাত আর শোষণের ফলে। ভারতবর্ষের অষ্টম শতাব্দীর এই বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনা, দেশের নেতা এবং জনসাধারণের সমস্ত বিরোধ বিসর্জন দেওয়াতে, আর পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালকে নির্বাচন করে রাজপদের সিংহাসনে বসাতে পারায়। তাই শুরু হয় একশো বছরের উজ্জ্বল অধ্যায়।
                            
বাঙালীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার মূলকারণ হয়, ধর্মপালের আত্মশক্তিবোধ এবং সেই শক্তিতে পূর্ণ আস্থা হওয়াতে। এই নতুন জাতীয় জীবনই অনুপ্রাণিত করেছে তার সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা। গুর্জরাজ ও রাষ্ট্রকূটরাজের কাছে ব্যাহত হয়েও, ধর্মপালের নতুন শক্তি নিরুদ্যম হয়নি। সারা আর্যাবর্ত্তে বাঙালীর এই প্রতাপের ইতিহাস দিবাস্বপ্নের মতই অনিশ্চিত বলে, মনে করা হয়। কারণ শুধু কয়েকটা তাম্রপত্রে, শিলালিপিতে এবং তিব্বতী পুঁথিতে লেখা সেই অতীতের দুর্বার আশার ক্ষীণ প্রতিধ্বনি পেয়ে যাওয়ার ফলে, দেবপালের সময়েও সাম্রাজ্য বিস্তার অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু পরে আরম্ভ হয় গৃহবিবাদ এবং বহিঃশক্রর ধারাবাহিক আক্রমণ। একশো শতাব্দীর শেষে বা দ্বাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে, পালবংশের ধ্বংসাবেশ জেগে উঠে সেনরাজ্যে। যদিও সেনবংশীয়রা কর্ণাটকের ব্রহ্মক্ষত্রীয়। দাক্ষিণাত্যের কোন এক অভিযানের সময় তারা এদেশে আসায়, পালদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হয়তো স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। রাজা বিজয় সেন প্রায় গোটা বাংলাতেই আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। পালযুগের শেষে, সেনবংশয়ীরাই অরাজকতা ও মাৎস্য ন্যায় থেকে বাঙালীদের রক্ষা করেছিলেন। শান্তি ও সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বল্লালসেনের মিথিলা জয় এবং সমাজ সংস্কারক কাজ এক অবিস্মরণীয় হয়ে ফুটে উঠে। কিন্তু তাঁর সমাজ সংস্কারক কাজ যে একদিন  বালাই হয়ে উঠবে, তা কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। তাঁর পুত্র লক্ষণ সেন সারাজীবন ধরে যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যে থেকে বাংলার সীমানা বিস্তার করেন উত্তরে গৌড়, পূর্বে কামরূপ দক্ষিণে কলিঙ্গ ও পশ্চিমে মগধের খানিকটা। পরিশেষে বৃদ্ধ বয়সে যখন তিনি নবদ্বীপে অবস্থান করেছিলেন তখন তাঁর রাজ্যে আন্তবিপ্লবের সূচনা শুরু হয়। সুন্দরবনের খাড়ী পরগনায় ডোম্মন পাল স্বাধীন খণ্ডরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উত্তরাপথে সারা আর্যাবর্তে, তখন চলছে যুগ-বিপর্যয়-মহম্মদ ঘোরীর বিজয় অভিযান। মিনহাজ্জুদিন, নিজেই লক্ষণসেনের শৌর্য ও শাসন নৈপুণ্যের জন্য আর্য্যাবর্তের শ্রেষ্ঠ রাজা বলে প্রশংসা করতে থাকেন। তাই আল্লার কাছে বিধর্মী 'লখমনিয়ার' লঘু শাস্তির জন্য আবেদন পেশ করেন। আসলে নদীয়া বিজয় একটি অতর্কিত সামরিক 'কুপ' বা 'ব্লিটজ' চাল থাকায়, রাজপ্রসাদে একটা তুমুল গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়। ফলে বৃদ্ধ রাজাকে পালাতে বাধ্য করে। ১২০২ অব্দে নদীয়া আক্রমণের পরও সেনবংশ রাজত্ব করেছিলেন । কিন্তু তখন থেকেই আঞ্চলিক স্বাধীনতার সাড়া পড়ে যাওয়ায়, খণ্ড খণ্ড রাজ্যের উদ্ভব হতে থাকে। তাছাড়া তখন তুর্কী আক্রমণ তো ছিলই। পাল সাম্রাজের দুর্বলতার সুযোগে পূর্ববঙ্গে বর্মাবংশের উৎপত্তি হয়। ঠিক তেমনই সেন রাজত্বের শেষের দিকে গজিয়ে উঠে, দেববংশ ও পট্টিকাদের রাজত্ব। ঢাকা ও শ্রীহট্টের তাম্রপত্রেই দেববংশ বিবরণ পাওয়া যায়। অবশ্য পট্টিকেরা অনেকদিন ধরেই রাজত্ব করে। ১৯৪৩ সালে সামরিক অভ্যুদানের কারনে মাটি খুঁজতে গিয়ে কুমিলায় ময়নাবতী পাহাড়ের কাছে প্রায় দশমাইল জুড়ে এই জায়গায় রাজ্যের বিশাল নিদর্শন পাওয়া যায়। রাজা বিস্তারের যুগে বাঙালীরা ভারতের নানান স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। 
      খৃষ্টীয় দশম শতাব্দী (৯৩৯-৯৬৭) অব্দে রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় কৃষ্ণের অধীনে বরেন্দ্রভূমির গদাধর। মাদ্রাজের বেলারী জেলায় 'কোলগুলু' গ্রামে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। ১২০০ সালে গাঢ়ওয়াল অঞ্চলে, অনেক মল্লবাঙালী রাজত্ব করতেন। হিমাচল প্রদেশে সুকেত, কাষ্টওয়ার, কেওস্থল ও মন্ডিরাজ্যের রাজারা ছিলেন বাঙালী। কালীদাসের 'রঘুবংশ' কাব্যে রঘুর দ্বিগবিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালির নৌশক্তির প্রসিদ্ধতার বর্ণনা পাওয়া যায়।
    ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে কথা সংস্কৃতের যে রূপ ধরেছিল তাকে বলা হয় প্রাচ্য অপভ্রংশ। এই প্রাচ্য অপভ্রংশের অর্বাচীনরূপ আনুমানিক একহাজার খৃষ্টাব্দের কাছাকাছিতে, তিনটি আঞ্চলিক আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষায় পরিণত হয়। পশ্চিমে বিহারী, উত্তর-পশ্চিমে মৈথিলী এবং পূর্বে বাঙলা-উড়িয়া। বিহারীভাষা হইতে আধুনিক ভোজপুরী পশ্চিমবিহারে এবং মগহী ভাষা আসিয়াছে দক্ষিণ বিহারে। বাঙ্গালা হইতে আরো পরে অসমীয়া ভাষা উৎপন্ন হইয়াছে।
   আচার্য সুকুমার সেনের গবেষণায় জানা যায় যে, 'বাঙ্গালা' ভাষার মূল, প্রাচীন ভারতীয় আর্য (অর্থাৎ সংস্কৃত) ভাষা। খৃষ্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতাব্দ হইতে প্রচলিত এদেশে এই আর্যভাষা। অষ্টাদশ শতাব্দের গোড়ার দিকেই দেখা যায় যে, বাঙ্গালা দেশের লোক বুঝাইতে 'বাঙালী' শব্দ চলে গিয়েছে। 'বাঙালী' ভাষার স্থানে 'বাঙ্গালা' ভাষাকে প্রথম ব্যবহার করিয়াছেন, সেই কথা জানা নেই। তবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 'বাঙ্গালা' ভাষাই বরাবর লিখেছেন। যাহা ১৮৭২ সালে লেখা রামগতি ন্যায়রত্নের 'বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব' নামের বইতে জানা যায় এবং 'বাঙ্গালা' নামই একছত্র হয়ে ফুটে উঠে।
   বাংলা সুবা' অর্থাৎ তালুক, মোঘল সম্রাজের মধ্যে সবচেয়ে ঐশ্বর্য্যপ্রাপ্ত অঙ্গ ছিল। যে কারণে বাংলা সুবাতে পৌঁছবার রাস্তায় একটি শহর গড়ে উঠেছিল যার নাম 'দ্বারবঙ্গ'। অধুনায় যার নাম হয় দ্বারভাঙ্গা। তাছাড়া যেভাবে পালবংশের রাজারা এবং সেনবংশের রাজারা রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাঙালী জাতীর খুঁটিকে মজবুত করেছিলেন, ঠিক তেমনই আধ্যাত্মিক এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সেইসময়ে চৈতন্য মহাপ্রভু, কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস এবং লালন ফকীরের মত ব্যক্তিত্বরাও বিদ্যমান ছিল।
    একবিংশ শতাব্দীতে এই বিষয়টি ফুটে না উঠার কারণ, শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত বাংলাভাষীরাই তার নিজের ছলনাতেই নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে যে তাঁর প্রভাব আগামীদিনে এক বড়-সড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ বর্তমান ভারতের বাংলাভাষীর পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীতেই বাঙালীর মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে চল্লিশ শতাংশ এসে দাঁড়িয়েছে। পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড, যার মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মানুষই বাংলাভাষী। যাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মধ্যে বাঙালীয়ানা সম্পূর্ণভাবে বর্তমান থাকা সত্ত্বেও, কিছু কিছু জায়গার মানুষেরা রাজনৈতিক কুচক্রে পড়ে, ভাষাসত্ত্বাকে উপেক্ষা করে, নিজেদেরকে বাঙালী বলতেও দ্বিধাগ্রস্থ। কারণ তাদেরকে বোঝানো হয়েছে যে বাঙালীর জায়গায় 'বঙ্গভাষী' বললে তারা নাকী বেশি সুবিধা সরকারের কাছ থেকে পাবে। তাই তাঁরা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য থাকাতেও, ভাষাগতভাবে এই বিস্তৃর্ণ ভূখণ্ডের ভাষাকে, প্রতিষ্ঠিত গবেষকগণ সীমান্তরাঢ়ী বা ঝাড়খণ্ডী বাংলারূপে চিহ্নিত করেছেন। তাই এই বিষয়ে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন, বাঙালীর স্বার্থে।
                            
সীমান্তরাঢ়ী প্রকৃতপক্ষে কয়েকটি উপাঞ্চলিক ভাষাগুলির সমষ্টির সমন্বয়ে গঠিত। তার ঝাড়খণ্ডী বাংলা তারই একটি বিশেষরূপ সীমান্তরাঢ়ীর সঙ্গে মৌলিক রাঢ়ীর কিছু পার্থক্য থাকলেও সীমান্তরাঢ়ী সর্বাঙ্গে রাঢ়ীর ছাপই উজ্জ্বল। যদিও সীমান্তরাঢ়ীর বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় মহাপ্রাণ ধ্বনির ব্যবহারে, প্রয়োগে এবং প্রবণতার মধ্যে। ক্রিয়ারূপের ক্ষেত্রেও রাঢ়ীর চেয়ে সীমান্তরাঢ়ী অনেকবেশি মানভূম কেন্দ্রিক। ঝাড়খণ্ডীর মধ্যেও সেইরকম বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মহাপ্রাণ সম্বন্ধে তাঁর লেখা 'বাংলা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকায় বর্ণনা করেছেন, যেসব শব্দ 'হ' ধ্বনির প্রাচুর্য্য সেইখানেই মহাপ্রাণের প্রাবল্য। যেমন - কুলহি, আসহার, তুমহার, কামহার ইত্যাদি। বর্ণের দ্বিতীয় এবং চতুর্থবর্গ প্রভৃতি বর্ণ হচ্ছে মহাপ্রাণ। আর বর্ণের বাকিগুলিকে বলা হয় 'অল্পপ্রাণ'। মৌলিক রাঢ়ীর কথ্য ভাষায় যেমন বলা হয় ইচ্ছে মিথ্যে, সত্যি, পূজো, মূলো ইত্যাদি। ঠিক তেমনই এগুলিকে সীমান্তরাঢ়ীতে যথাক্রমে ইচ্ছা, মিথ্যা, সত্য, পূজা, মূলারূপে শ্রুত হয়। লোকসাহিত্যের গবেষক ড. সুধীর করণের মতে পণ্ডিতেরা বাংলাভাষাকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। রাঢ়ী, বারেন্দ্রী, বাঙালী ও কামরূপী। পরে অবশ্য আচার্য সুকুমার সেন ঝাড়খণ্ডী নামে আরও একটি ভাষা যুক্ত করেছিলেন, যার সীমারেখা তিনি বলেননি। তাই ড. করণের মতে এই ভাষাকে সীমান্তরাঢ়ী নামেই অভিহিত করেন। প্রকৃতপক্ষে সীমান্তরাঢ়ী এবং ঝাড়খণ্ডী পৃথক নয়। মৌলিক রাঢ়ী সমন্ধে গবেষকগণ বর্ণনা করেছেন যে, মূলত ভাগীরথীর দুই কূলবর্তী অঞ্চল সহ হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া, পূর্বসিংভূম ও পার্শ্ববর্তী মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের সাধারণভাবে প্রচলিত কথ্য ভাষা এবং সাহিত্যের ভাষাই হল মৌলিকরাঢ়ী। আচার্য সুকুমার সেনের মতে রাঢ়ী কোন বিশেষ উপভাষা নয়। অনেকগুলি ঘনিষ্ট আঞ্চলিক ভাষার সমষ্টি। পশ্চিমসীমান্ত বাংলার বিস্তীর্ণ পরিসরে এমনই বহু লোকভাষা আছে, যাঁদের বাংলার সমতল রাঢ়ীর সঙ্গেই ঘনিষ্ট আত্মীয়তা একটু হয়তো ধ্বনিগত বা শব্দগত কিছু পার্থক্য থাকলেও, মূলত তাদের কাঠামোকে একেবারে পৃথক বলতে পারা যায় না।
   প্রসঙ্গত বাঙালীর সংস্কৃতির ইতিহাসে, তিনটি যুগ ফুটে উঠে। প্রাচীন যুগ অর্থাৎ ১২০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় সভ্যতার ক্রমবিকাশ। আর্য-অনার্যের সমন্বয়ে ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ এবং জৈন সংস্কৃতির ব্যাপকত্বে হিন্দুরূপ। মধ্যযুগ অর্থাৎ ১২০০ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। হিন্দু মুসলমান সমন্বয়ের পূর্বে দেখা যায়, পাঠান ও মোঘল যুগের ইতিকথা। আধুনিক যুগ অর্থাৎ ১৮০০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্যের সংস্কৃতি বিরোধ ও সংস্কৃতি সমন্বয়।
    ভাষাগত ও জাতি চৈতন্যগত ঐক্য, খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে এবং মধ্যযুগের মধ্যেই বেশ পুষ্টি লাভ করে। মুসলমান আমলেই বাঙালীর জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ স্থায়ীরূপে গ্রহণ করে। কোন বিরোধই সেই অনুভূতিকে আজও নষ্ট করতে পারেনি।
   প্রখ্যাত দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৯৬ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর তারিখে, তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠকীর্তি 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, "প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে সমন্ধে এখনও বর্তমান শিক্ষিত বাঙালী সম্প্রদায়, একরূপ উদাসীনই আছেন। তাঁহারা জুলিয়াট বা এন্ডেমেকি প্রভৃতি নামের পক্ষপাতি।
  কিন্তু বেহুলা, লহনা, কানেড়া প্রভৃতি সেকেলে নাম শুনলে প্রীতিবোধ করেনা। তাঁহার মতে, অধ্যাবসায়ের সঙ্গে যুক্ত থাকিলে, তাহাদের পরিশ্রম ব্যার্থ হইবে না। কারণ বাঙালীর মন যে উপাদানে গঠিত সে উপাদানে কাব্যগুলিও গঠিত।"
     তিনি বিখ্যাত ইংরাজ পণ্ডিত (জন্ম জার্মানীতে) এবং পাচ্যতত্ত্ববিদ ম্যাক্সমুলার সাহেবের (১৮২৩ - ১৯০০) কয়েকটি বাক্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে "দেশের লোকবৃন্দ, স্বীয় প্রাচীন ইতিহাস এবং প্রাচীন সাহিত্য স্মরণ করিয়া গৌরবান্বিত না হন তাঁহাদের জাতীয় চরিত্রের প্রধান অবলম্বন শূন্য হইয়াছে স্বীকার করিতে হইবে। কারণ জার্মানী যখন রাজ্য রাজনৈতিক অবনতির নিম্নতম গহ্বরে পতিত  হইয়াছিল, তখন এদ্দেশীয় লোকবৃন্দ স্বদেশের প্রাচীন সাহিত্যের আলোচনায় নিযুক্ত হইয়া, প্রাচীন সাহিত্য পাঠে তাহাদের ভাবী উন্নতির নতুন আশার আলো সঞ্চারিত করিয়াছিলেন।"
   তাই ১৯৩৫ সালে দীনেশচন্দ্র সেনের লেখা 'বৃহৎবঙ্গ' পুস্তকে সুপ্রাচীনকাল থেকে শুরু করে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত, বাঙালী জাতীর রাষ্ট্র, সমাজ, সাহিত্য, ধর্ম, ব্যবসা বাণিজ্য, কলাশিল্প এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ের একটি বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করে রাখেন। যা পূর্বে এমন এক বিস্তৃত ইতিহাস, তার আগে কেউ লেখেননি।
    একবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র বাঙলাভাষীর মধ্যে যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে, তাতে কিন্তু বাঙালীর প্রাণধর্মের যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ তা কিন্তু পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এই জাতির বৈচিত্র্য, সমন্বয় এবং সাম্যের জন্য উনিশ শতকে বাঙালী মনীষীরা সাধনা এবং চিন্তার মাধ্যমে এই তিনটি বিষয়কে সফল করার জন্য যে চেষ্টা চালিয়েছিলেন তার কিন্তু প্রকাশ পাওয়া যায় না। ক্লান্তি, অশ্রদ্ধা এবং অবিরাম কলহকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য রাজা রামমোহন রায় উদার বেদান্ত তথ্য প্রচারের মধ্যে সমন্বয়ের সূচনা করে নতুন আন্দোলন প্রবর্তন করেছিলেন। আর সেই সমন্বয়টাই শতাব্দীর শেষভাগে শ্রীরামকৃষ্ণ এবং স্বামী বিবেকানন্দ জীবন ও কাজের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে প্রচার করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জীবনের সাধনা ও কাজের মাধ্যমে বিভিন্ন গঠন পদ্ধতির দ্বারা, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যেমন শাক্ত, বৈষ্ণব, যোগী সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়ের যে নিদর্শন রেখে গেছেন, তা এককথায় বিরল। আর এই অনুভূতি এবং সাধনার উত্তরাধিকারী হিসাবে পেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দকে। পরে স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে।
  লেখার শেষে তাই বলতে চাই যে, বাঙালীত্ব মানে সারা পৃথিবীকে অস্বীকার করে, কুঁয়ো খুঁড়ে তারমধ্যে ব্যাঙ হয়ে বসে থাকা নয়। রক্ত ও ঐতিহ্যের মূল্যবোধকে বজায় রেখে, নির্ভয়ে কালাপযোগী পরিবর্তনের পথে অগ্রসর হওয়া। প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, এমনকি অন্ধজাতীয়তাও হবে যুগধর্ম বিরোধী। স্বতন্ত্র থাকবে, বৈচিত্র থাকবে কিন্তু তা যেন সমন্বয় বিরোধী না হয় এবং স্বার্থ যেন সুবুদ্ধিকে গ্রাস না করে। একটা ভরসা আছে যে, এই জাতীর মধ্যেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, বিবেকানন্দের মত ব্যক্তিত্বরা এসেছিলেন, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। কাজেই সৃজনশক্তি না থাকলে এমন ব্যক্তিত্ত্বদের আবির্ভাব ঘটতো না। তবে আত্মতৃপ্তিরও কোন অবকাশ নেই কারণ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায়, শিক্ষার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অবস্থানও যদি ঘুরে যায় আর বর্তমান বাঙলাভাষী প্রজন্মরা যদি পথভ্রষ্ট হয়, তবে আগামীদিনে এই জাতীর ইতিহাস এবং বৈচিত্র্য এক অস্তিত্বের প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়াবে। আর নতুন প্রজন্মরা অন্য সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য আস্তে আস্তে এগোতে থাকবে। তাই সজাগ হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
    বাংলা ভাষার উত্তরণের পথে যে আত্ম বলিদান, ১৯৫২- র একুশে ফেব্রুয়ারির সেই রক্তক্ষয়ী প্রতিবাদের জন্যই  আজ বাঙালীর এই বাকস্বাধীনতা ও বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুন্ন রয়েছে, তারই গৌরবগাথা ইতিহাস থেকে থেকে প্রবন্ধের দেহে তুলে ধরছি। 
     অতুল প্রসাদ সেনের গানের সুরে-কথায় শুরু করি একুশের স্তব --

"মোদের গরব, মোদের আশা
আ-মরি বাংলা ভাষা
মোদের গরব, মোদের আশা
আ-মরি বাংলা ভাষা

মাগো তোমার কোলে
মাগো তোমার কোলে
তোমার বলে
কতই শান্তি ভালোবাসা, 
আ-মরি বাংলা ভাষা। "
   এমন মিঠে ভাষা, আমাদের মাতৃভাষা, আপামর বাঙালীর প্রানের আরাম।  আর 'একুশ' বাঙালীর অহংকার। একুশে ফেব্রুয়ারি তথা ভাষা আন্দোলন সারা বিশ্বের কাছে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বলিদানের জ্বলন্ত উদাহরণ  এবং শুধুমাত্র বাংলাভাষাকে রক্ষার তাগিদে সেইসব তেজস্বী ভাষাশহীদদের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি ' আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ' হিসেবে সারা বিশ্বে  শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়।একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির সংস্কৃতি ও সাহিত্যে চেতনার ফসল হিসেবে বিরাজ করছে। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার্থে যে সংগ্রাম হয়েছিল, যত রক্ত ঝরেছিল তা বাংলা সাহিত্যে স্থান পেয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রকে করেছে সমৃদ্ধ। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার মানুষকে দিয়েছে কথা বলার অধিকার ও সাহিত্য সৃষ্টির স্বাধীনতা। 
    এক  সাক্ষাৎকারে দারুন একটা অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৬৩ সাল। তিনি প্রথম বিদেশ যাচ্ছেন প্লেনে চেপে, কলকাতা থেকে। প্লেনটা প্রথম থামে করাচিতে। ভোরবেলা। চারিদিকে কুয়াশা। তবু তাঁর কৌতূহলী মন বাধা মানে না। দৃষ্টি চলে যায় জানলা ছাড়িয়ে এদিক-ওদিক। হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় চোখ। বিশাল একটা হোর্ডিং। তাতে বড় বড় হরফে বাংলায় লেখা 'করাচি বিমানবন্দর'। তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। খোদ কলকাতা বিমানবন্দরে তখনও বাংলায় লেখা হয়নি। আর অত দূরে -- অত হাজার মাইল দূরে বাংলায় লেখা!
    
আসলে হয়েছিল কি, শ্রী গঙ্গোপাধ্যায় যখন করাচিতে যান তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সঙ্গেই ছিল বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। তাই করাচি বিমানবন্দরেও ছিল বাংলা ভাষার ব্যবহার। সেটা অবশ্য আপনা-আপনি হয়নি। ছিল বহু বাঙালির আত্মত্যাগ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, সংগঠিত আন্দোলন। ছিল বরকত, রফিক, জব্বারদের শহীদ হওয়া। রক্ত ঝরানো একুশে ফেব্রুয়ারি …! তাই সম্ভব হয়েছিল বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদালাভ। 


একুশ আমাদের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম , তা আমাদের চেতনাকে শানিত করে।  ওই দেশের কবি, সাহিত্যিক, সুরকার, গীতিকাররা  এই দৃপ্ত একুশের গানে কবিতায় আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। 

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/
আমি কি ভুলিতে পারি।’

 একুশের এই একটি গান আমাদের একুশের চেতনার সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে, যা আমরা কখনই ভুলতে পারি না। এ গান শুনলেই মনে হয় আমরা ১৯৫২ সালের সেই দিনটিতে ফিরে যাই যেদিন সালাম, রফিক, জব্বারেরা মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এ গান তাই চির অম্লান।

আরেকটি গান এখনও সবার মুখে মুখে ফেরে। সেটি হল ---

 ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’ 

গানের মতো কবিতায়ও বারবার উঠে এসেছে অমর একুশ। একুশের প্রথম কবিতাটি লিখেছেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। সেই কবিতার চরণে আছে, ----

‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/ সেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।’

কবিতাটির আরেকটি জায়গায় আছে--

 ‘যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে/যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে/তাদের জন্য আমি ফাঁসির দাবি করছি।’ 

শামসুর রাহমানের "বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা" কবিতার একটি চরণে আছে,---


 ‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো, কি থাকে আমার? উনিশশো বাহান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছে সগৌরবে মহীয়সী।/ সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।’

আহসান হাবীব তার "মিছিলে অনেক মুখ" কবিতায় লিখেছেন---

 ‘মিছিলে অনেক মুখ/ দেখো দেখো প্রতি মুখে তার/সমস্ত দেশের বুক থরো থরো/উত্তেজিত/শপথে উজ্জ্বল!’/সূর্যের দীপ্তিতে আঁকা মিছিলের মুখগুলি দেখো/ দেখো দৃপ্ত বুক তার/ দেখো তার পায়ের রেখায়/ দেশের প্রাণের বন্যা উচ্ছল উত্তাল।’


কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তার "স্মৃতিস্তম্ভ" কবিতায় লিখছেন, ----


‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো। যে ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য/পারেনি ভাঙতে।’

এভাবেই কবি-সাহিত্যিকরা আমাদের চেতনায় অমর একুশের এই ভাষা আন্দোলন কে ৺বাচিয়ে রাখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
  মায়ের মুখের ভাষা রক্ষায় বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তে পিচঢালা কালাে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। তাদের এ আত্মত্যাগের ফসল বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। দেশ, দেশের মানুষ বা মাতৃভাষার জন্য এ আত্মত্যাগ পৃথিবীর অন্য কোনাে দেশের ইতিহাসে নেই। তাই একুশ জড়িয়ে আছে আমাদের সামগ্রিক ও জাতীয় চেতনায়। 
   একুশ সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন-- 'মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রত্যেক জাতির কাছে পরম শ্রদ্ধার বিষয়।' তিনি আরও বলেছেন, বাঙালির প্রাণের দাবি, মনের দাবি বাংলা ভাষা। এ ভাষায় তাদের কথা বলতে না দিলে তারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হবে।'

"মােদের ভাষার প্রাণ
একুশ করেছে দান
একুশ মােদের পাথেয়
একুশকে করাে নাকো হেয়।"

একুশ সম্পর্কে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর উক্তিটি বাংলা সাহিত্যে একুশের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।

বাহান্নর একুশে ফেরুয়ারিতে মাতৃভাষার জন্য যেসব তরুণ নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিল, স্বাধীনতা উত্তরকালেও সে মাতৃভাষা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের শিরায় শিরায় প্রবহমান। শামসুর রাহমান, মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সিকান্দার আবু জাফর, মুনীর চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ-কাল ও সমাজের সমকালীন আবহে বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সিকান্দার আবু জাফর তার "সংগ্রাম চলবেই" কবিতায় লিখেছেন—


"জনতার সংগ্রাম চলবেই। 
আমাদের সংগ্রাম চলবেই ।"

কবির এ সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে, নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। একুশ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রথম কবিতা লেখেন কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। তাঁর রচিত "কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি" কবিতাটি একুশের অন্যতম সেরা কবিতা। "স্বাধীনতা তুমি" কবিতায়ও কবি শামসুর রাহমান একুশের চেতনা ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি লিখেছেন—

"স্বাধীনতা তুমি
শহিদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা !"

ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী লিখেছেন ‘কবর’ নাটক । একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- জহির রায়হানের 'আরেক ফাল্গুন', শওকত ওসমানের 'আর্তনাদ', সেলিনা হােসেনের "নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি"।  একুশ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া' এবং 'Let there be Light' । এছাড়াও একুশ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক ছােটোগল্পও ।
      একুশের অবদানে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করার পর বাংলা ভাষায় পঠন  পাঠন, নানা পত্র পত্রিকা , গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাসের অগ্রগতি সাহিত্যের পরিসর ব্যাপ্তি ও স্বাধিকার অর্জনে দীপ্ত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। কবি শামসুর রহমান, শওকত ওসমান, হুমায়ুন আজাদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখেরা একুশের চেতনায় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। 

 বর্তমান প্রজন্মের কাছে একুশের তাৎপর্য সঠিকভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরী কলম ধরেছেন। 

আমরা জানি ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস একদিকে যেমন আনন্দের তেমনি অন্যদিকে বেদনার। ১৯৪৭ সালে এ উপমহাদেশ থেকে ইংরেজরা বিদায় নিলে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর অমানবিক অত্যাচার । পাকিস্তানিরা এদেশকে শােষণ করার জন্য প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির প্রাণপ্রিয় মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছে। তারা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। কিন্তু বাঙালি তা মেনে নিতে পারেনি। গড়ে তুলেছে তীব্র প্রতিবাদ। ক্রমে ক্রমে এ আন্দোলন বাড়তে থাকে এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এক প্রবল বিস্ফোরণে পরিণত হয়। এ আন্দোলনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর ও আরও অনেকে জীবন দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করার ও ভাষার মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখার প্রয়াস চালিয়েছেন। এই আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একুশ উন্নীত হয় এক স্বতন্ত্র মর্যাদায়। সেই থেকে একুশ হয়ে ওঠে সংগ্রামের উৎস, চেতনার অধ্যায় । মহান একুশ শিখিয়েছে জাতীয় স্বার্থে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে। এমনকি একুশের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে ও অধিকার রক্ষা করে মাথা উচু করে বাঁচার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে শিখেছে। এক কথায় বলা যায়, একুশই বাংলার সকল আন্দোলনের পেছনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

দেশভাগ হবার পরেই পূর্ব পাকিস্তানে দাবি উঠেছিল বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমান মর্যাদা দিতে হবে। পাকিস্তানের গণপরিষদে প্রতিটি বাঙালি সদস্যকে মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার সুযোগ দিতে হবে। সেই দাবি মতো প্রস্তাব উঠেছিল গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর নেতৃত্বে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ চেয়েছিলেন ধর্মের আড়ালে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা কায়েম করতে। সেই সংকীর্ণ স্বার্থেই ১৯৫২র ২৬ শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু'। এই ঘোষণার কয়েক দিন পর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার ছাত্রছাত্রীরা বিশাল মিছিল বের করেন। সরকারও নীরব থাকে না। উত্তাল মিছিলে সেনাবাহিনী বর্বর আক্রমণ হানে। গুলি চালায় এলোপাথাড়ি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বেশ ক'টি তরতাজা প্রাণ। এই মর্মান্তিক ঘটনায় আন্দোলন থেমে তো যায়ই না, বরং অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মতো আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। শুধু ঢাকায় নয়, গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন প্রসারিত হয়। অবশেষে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়েই উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়। প্রথমে আরবি হরফে বাংলা লেখার মতো হাস্যকর ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বাংলাকে মেনে নেওয়া হয়।

এর পরেও অবশ্য বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের 'ইসলামীকরণ' ঘটাবার, জোর করে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রচুর আরবি ফারসি শব্দ ঢুকিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষাকে পুরোপুরি 'মুসলমানের ভাষা' করে তোলবার চেষ্টা চলেছিল। হিন্দু দেব-দেবী আর প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির চিহ্ন আছে এমন বই শুধু অপাঠ্য হয়নি, বাদ পড়েছিলেন বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। স্বীকৃত হয়েছিলেন শুধুমাত্র গরীবুল্লাহ, আলাওল, কায়কোবাদরা।

এই বন্ধ্যাকাল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ঐতিহাসিক কারণেই সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৭১-এর ১৬ ই ডিসেম্বর গড়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। যে দেশের রাষ্ট্রভাষা শুধু বাংলা নয়, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম মাধ্যম বাংলা, শুধুই বাংলা। পৃথিবীর অনেক দেশে মনে করা হয় বাংলা হলো বাংলাদেশেরেই ভাষা। বোঝাতে হয় এক সময়কার অবিভক্ত বাংলার একটা অংশ আজ বাংলাদেশ। আর একটা পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও বাংলাচর্চা হয়। সেই বোঝানোর প্রয়োজনীয়তাও বোধ হয় ফুরাবে। শেষের সেদিন আর বেশি দেরি নেই।

যাইহোক। বাংলাদেশে অফিস-আদালত স্কুল-কলেজ সর্বত্রই বাংলা। দেওয়াল-লিখন, পোস্টার, দোকানের হোর্ডিং, যানবাহনের নম্বর, বাড়ির নেমপ্লেট সব কিছুই লেখা হয় বাংলায়। একেবারে ওপর থেকে নিচু পর্যন্ত সবাই সাহিত্য ভালোবাসেন। রিক্সাওয়ালা, বাড়ির ভৃত্যরা যেমন মনোযোগী পাঠক, তেমনই প্রশাসনিক কর্তারা, এমনকি হাইকোর্টের বিচারকরাও সাহিত্যচর্চা করেন, কবিতা লেখেন। আমাদের এখানে যেমন পঁচিশে বৈশাখ বা বইমেলা উপলক্ষে লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা বের হয়, ওখানেও তেমনি বের হয় একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে। এছাড়া সারা বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিনের অজস্র প্রকাশনা তো আছেই। শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ শহরে নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। ও দেশে সাহিত্যচর্চা করে, কবিতা লিখেই একজন গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে পারেন, যদি অবশ্য তাঁর লেখা মোটামুটি জনপ্রিয়তা পায়।

বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিক লেখকের সংখ্যা প্রচুর। লেখালেখিও যথেষ্ট। সাহিত্যচর্চার সবটাই যে উন্নত মানের, তা অবশ্য নয়। তবু স্মরণে রাখার মতো গল্প উপন্যাস লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ , আলাউদ্দিন আল আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জ্যোতির্ময় দত্ত, সেলিনা হোসেন, রফিক আজাদ, শওকত ওসমান, হুমায়ূন আহমেদ। এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই কম-বেশি কবিতাও লিখেছেন। তবে কবিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ শামসুর রহমানের। আর প্রবন্ধের ক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমর, আহমদ শরীফের। বাংলাদেশে অনুবাদ সাহিত্যেরও ভালো কাজ হয়েছে। শুধু সাহিত্য নয়, বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর -- বিশেষত স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে ওঠার পর, শিল্প, সঙ্গীত, নাটকেও কাজ হচ্ছে। সেলিম আল দীন সহ বেশ কয়েকজন নাট্যকর্মী দেশজ ঐতিহ্য থেকে নিত্যনতুন কাজ করছেন।

অথচ এ বঙ্গে সামগ্রিক সাংস্কৃতিক চিত্রটা কেমন? অতিশয়োক্তির মতো শোনাবে, তবু বাস্তব সত্য এটাই নিজেদের সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে এ বঙ্গের বাসিন্দারা ক্রমশই অমনোযোগী হয়ে পড়ছেন। গ্রাম-মফস্বলে একটা সুস্থ বাংলা সংস্কৃতি চর্চা থাকলেও কলকাতা-কেন্দ্রিক এলিট-ঘেঁষা বলয়টি যেন কিছুটা উন্নাসিক। নির্বিচারে মেনে নিচ্ছেন হিন্দি সংস্কৃতির দাপট। এর একটা কারণ হয়তো রাষ্ট্রীয় কাঠামো। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সর্বত্রই এই একটি ভাষাতেই কথা বলা, পথ চলা। কিন্তু ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে তো তা নয়। সুতরাং কিছু অসুবিধা এখানে আছেই। কিন্তু সর্বোপরি যে সমস্যা তা হল মানসিকতার অভাব। বাংলা যে শুধু কোটি কোটি মানুষের মুখের ভাষা নয়, একটি মুক্তমনা জাতির দীর্ঘদিনের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার আদরের মাধ্যম এবং পৃথিবীর উন্নত ও সমৃদ্ধ ভাষাগুলির সম-পংক্তিতেই যে এর স্থান, এই মোদ্দা কথাটাই স্মরণে থাকছে না এই বঙ্গের বাসিন্দাদের। বাংলায় কথা বলতে, গান করতে তাঁরা আর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত সন্ধ্যা এখন আর তাঁদের টানে না। দ্বিজেন্দ্র রজনীকান্ত অতুলপ্রসাদের গানে তাঁরা ক্লান্তি অনুভব করেন। বাংলা আধুনিক গানে, লোকসংগীতে, গণসঙ্গীতে তাঁরা মনের শান্তি, প্রাণের আরাম, প্রেরণার রসদ পান না।

ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। প্রথমত নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ ক্রমশই বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এমন প্রতিবেশ গড়ে উঠছে না যাতে তারা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে, নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয়। সাম্প্রতিক বাংলা ব্যান্ড ও কয়েকটি ভালো মানের বাংলা সিনেমার কথা মাথায় রেখেও এ কথা বলা যায়। শুধু উচ্চবিত্ত বাড়ির ছেলে-মেয়েরাই নয়, মধ্যবিত্ত বাড়ির পড়ুয়ারাও বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাটা লজ্জার ব্যাপার বলে গণ্য করছে। আর নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণীর পড়ুয়ারা, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর যারা পুরোপুরি নির্ভরশীল, তারা সরকারি শিক্ষানীতির দোলায়িত-চিত্ততার কারণে বাংলা ইংরেজি কোনওটাই ভালো ভাবে শিখছে না। দ্বিতীয়তঃ প্রশাসনিক স্তরেও বাংলাভাষাকে কাজের ভাষা করে তোলবার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশের সব সরকারি কাজ বাংলায় চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও এ রাজ্যে সরকারি কোনও স্তরের কাজকর্মে পুরোপুরি বাংলার ব্যবহার হয়নি। যা হয়েছে তা শুধুই কথার ফুলঝুরি, আর কথা খেলাপের ধারাবাহিকতা।

এই ধারাবাহিকথাতেই যে আর একটা একুশে ফেব্রুয়ারি সংযোজিত হবে, তাতে আর সন্দেহ কি! একে তো 'ও দেশে'র ব্যাপার! তাতে আবার নয় নয় করে এতগুলো বছর কেটে গেল! সুতরাং আর কেন! 

অতএব, 
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি /
এখন তো ভুলে যেতেই পারি।।

তথ্যসূত্র  ও গ্রন্থ ঋণ :-

 ১) বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা -- শ্রী সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় 
২)  ভাষার ইতিবৃত্ত -- শ্রী সুকুমার সেন
৩) সীমান্ত বাঙলার লোকযান--- শ্রী সুধীরকুমার করন 
৪) বাঙালী --   শ্রী প্রবোধ চন্দ্র ঘোষ
৫) সীমান্তরাঢ়ী ও ঝাড়খণ্ডী বাঙলার গ্রামীণ শব্দকোষ - শ্রী সুধীরকুমার করন
৬) বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা --- শ্রী বিপ্লব দাশগুপ্ত



 

Post a Comment

1 Comments