জ্বলদর্চি

"কারে বলে ভালোবাসা কারে কয় প্রেম" /সালেহা খাতুন

"কারে বলে ভালোবাসা কারে কয় প্রেম"

সালেহা খাতুন

বিধাতার দেওয়া অজানা পরমায়ু পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। আশ্চর্য! এখনও প্রেমের প্রস্তাব আসে। কবিরা মাঝে মাঝে প্রেমের কবিতা পাঠান। বুঝেও না বোঝার ভাণ করি। অন্তর্নিহিত সুরটাকে পাত্তা না দিয়ে শৈলী বিশ্লেষণ করি। পোড়া কপাল আমার। কোনো নিভৃতি আমার জন্য অপেক্ষা করে না। ফলে জনজোয়ারে ভেসে যায় হৃদয়। যে হৃদয়ে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির প্রয়োজন সেখানে রাখী বেঁধে দিই। হৃদয়ের কথায় মনে এলো আমার সেই ডাক্তার বন্ধুর কথা। কয়েকবছর আগে সে আমার কাছে কনফেস করেছে আমি নাকি তার প্রথম প্রেম। কার হৃদপিণ্ড কেটেকুটে জুড়ে ওটি থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্রাম নেওয়ার ফাঁকে নিজের স্ট্রেস রিলিফের জন্য ফোন তুলে আমাকে বলেছে কিশোরকালে আমাকে দেখলেই তার  দিল ধকধক করতো। হৃদয় এমন নাচানাচি করতো যে শেষ পর্যন্ত নিজেই হার্ট সার্জেন হয়েছে। আমিও বলেছি লোভ দেখাস না। সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে  তোর ঘাড়ে চেপে বসবো। সামলাতে পারবি তো?

আর এক নাছোড়বান্দা বেকার প্রেমিক ছিল। তখন কলেজে পড়ি। কতদিন ধরে যে তার মন মজেছে কে জানে? ছোটোবেলায় গ্রামীণ জীবনে একসাথে খেলাধূলার মাঝে কখন যে সে বড়ো হয়ে গেছে জানতেই পারিনি। একদিন মরিয়া হয়ে বলেছিল- "চলো দুজনে একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যাই।" আমি বলেছিলাম পাগল নাকি! যে উত্তর সে দিয়েছিল আজীবন মনে থাকবে। পরবর্তী প্রজন্মকে সে গল্প কতবার শুনিয়েছি। উত্তর দিয়েছিল-"পাগল করেই তো রেখেছ।" কিন্তু আমি তো তখন বিদুষী হওয়ার সাধনায় মত্ত। ফিরে তাকাইনি কোনোদিকে।সে বেচারা সত্যিই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ছিল। বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন হয়েছিল।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


হাতে পত্র গুঁজে দিয়ে অনেকে অনেকবার চেষ্টা করেছে মনের কথা বলার। সে সব ছুঁয়েই দেখিনি। কিন্তু কী আশ্চর্য! জ্বলদর্চি কৌশলে মনের সব কথা জেনে নিচ্ছে। আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য কিছু সদ্য যুবক বড়ো বড়ো দর্শনীয় ঘড়ি পরে  ঘুরে বেড়াতো। কখনও কখনও কোনো এক 'বড়াই'কে অবলম্বন করে মনের বার্তা পাঠাতো তারা। সে বড়াই-ই তাদের মনে করিয়ে দিতো-" বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াস না।" বারবার প্রত্যাখাত হতে কার আর ভালো লাগে? অতএব প্রতিশোধ নাও। অবশ্য তারা কখনো অ্যাসিড বাল্ব ছোঁড়েনি। তারা একটি ইউনিক জিনিস করতো, আমাদের বাগানের সদ্যরোপিত ফুল ফল সবজির চারা উঁপড়ে ছিঁড়ে এনে আমাদের সদর দরজার সিঁড়িতে ফেলে দিয়ে যেতো। এও নৃশংসতার আর এক ধরন। অতএব প্রেমে পড়া বারণ।

কোনো কোনো অতি উৎসাহী যুবক আমার খুব কাছের বন্ধুদের জানাতো আমার দিকেই তাদের মন পড়ে রয়েছে, আর কোনো কাজে তাদের মন লাগেনা। তা বাপু আমি কী করি বলো? আমার মন তো আর পোড়েনি। বন্ধুরা বলতো তুই একেবারে ঋজু দণ্ডের মতো। কে যে এমনভাবে তোকে পুঁতে দিয়েছে। কোনো দিকে হেলানো যায় না।
নবীনবরণের  ছলে সিনিয়ররা হাতে গোলাপ গুঁজে দিয়ে গভীর চোখে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ অনেকদিন। নীরব থাকায় তারা বলেছিল হয় ও খুব বোকা না হয় খুব ধুরন্ধর। কোনো কোনো ভীত সন্ত্রস্ত ব্যক্তি ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ডেই বার্তা দিত।

এতো গেল অন্য পক্ষের কথা। আত্মপক্ষ সমর্পণও দরকার। একজনকে খুব মনে ধরেছিল।তারও কিছু বিশেষ কারণ ছিল। একদিন মাত্র একদিন, এক সন্ধ্যায় তার মুখোমুখি হয়েছিলাম। সাহিত্য নিয়ে অনেক চর্চা করেছিলাম দুজনে। হাত পা থরথর করে কাঁপছিল। লজ্জায় কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। বিজ্ঞানের জগতের মানুষ। সাহিত্যেও গভীর পাণ্ডিত্য। কথার ছলে উচ্চাশার বীজ বপন করে চলেছিল। আর কৈশোর উত্তীর্ণ আমি মনে মনে প্রেম নিবেদন করে চলেছিলাম। বহুদিন ধরে শয়নে স্বপনে জাগরণে একমাত্র সেই ছিল প্রিয়। তারপর রাধাকে জাগ্রত করে সেই কৃষ্ণ একদিন বৃন্দাবন থেকে মথুরায় পাড়ি দিল। তাকে উদ্দেশ্য করে একখান প্রেমপত্র লিখেছিলাম। মনের কথা কলমের মুখ দিয়ে বলেছিলাম। সে পত্র পৌঁছোয়নি তার কাছে। বুকের মধ্যে কতদিন আর লুকিয়ে রাখি । একদিন মধ্যরাতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে প্রদীপের আগুনে পত্রখানা পুড়িয়ে  কাজললতায় দিলাম লেপে। প্রতিদিন নয়নে ধারন করে বেরিয়ে পড়তাম সেই মুখাবয়বের খোঁজে।
আজো তাকে দেখি পাহাড়ের উচ্চ শিখরে জয়ের পতাকা উড়াতে, বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলে প্রেমের গান গেয়ে ছুটে বেড়াতে। দেশে দেশে বেড়ানো মানুষটা বুঝতেই পারেনি তার বনলতা রয়েছে প্রেমের অপেক্ষায়।


Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ।
    মন ছুঁয়ে কলেজের স্মৃতি উসকে দিল।

    ReplyDelete