জ্বলদর্চি

অশোকষষ্ঠী /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৬৩

অশোকষষ্ঠী

ভাস্করব্রত পতি

চৈত্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে বাংলার বিবাহিত মহিলারা উদযাপন করেন অশোকষষ্ঠী লৌকিক উৎসব। বিরল এই অশোকষষ্ঠীতে উপকরণ হিসেবে প্রয়োজন হয় অশোক ফুল, মুগকলাই এবং দই। চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে ষষ্ঠী তিথিতে স্ত্রীলোকেরা ষষ্ঠীর পুজো করে। তারপর প্রত্যেকে ছ'টি মুগ কলাই ও ছ'টি অশোক ফুলের কুঁড়ি দই মাখিয়ে খায়। এদিন ভাত খাওয়ার চল নেই। লুচি পরোটা খায় অনেকেই। কেউ কেউ ফল মূলও খায়। 
 
অশোক গাছের ফুল ভারতের ওড়িশার রাজ্য ফুল। কালীদাসের 'মালবিকাগ্নিমিত্রম' এ মালবিকা নেচেছিল অশোক গাছের তলায়। কথিত আছে, গৌরী এই গাছের তলায় বসে তপস্যা করেছিলেন। এর ফলে তিনি সিদ্ধমনোরথ এবং বিগত শোক হয়েছিলেন। সিদ্ধার্থ লুম্বিনীতে এক অশোক বৃক্ষের তলায় জন্মগ্রহণ করেন। রামায়ণে আছে রাবণ সীতাকে অশোকবনে আবদ্ধ করে রেখেছিল। যা এখন শ্রীলঙ্কাতে অবস্থিত। যদিও অভিমত যে সীতাদেবী যে গাছের তলায় বসেছিলেন তার নাম সিমসাপা গাছ (Amberstea nobilis)। অশোকের মতো একই পরিবারভুক্ত। কলম্বোতে প্রচুর দেখা গেলেও ভারতে খুব কম পাওয়া যায়। একে বলে 'সীতা অশোক'। এটি বার্মা থেকে এসেছে। Pride of Burma নামেও পরিচিত। 

অশোক গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম - Saraca asoca এবং Saraca indica। একে ইংরেজিতে বলে Yellow Ashok। এটি Fabaceae পরিবারভুক্ত। এছাড়াও অশোকের আরও যে যে প্রজাতি রয়েছে তা হলো -- Jonesia asoca Roxb, Jonesia confusa Hassk, Jonesia pinnata Willd, Saraca confusa (Hassk.) Backer এবং Saraca indica sensu Richard Henry Beddome। যাইহোক, অশোকষষ্ঠীর মূল উপকরণ এই অশোক গাছের ফুল। 

অশোককে সংস্কৃতে বলে কাঙ্কেলি। গুজরাটিতে অশোপলভ, কঙ্কন, আসুনকার। অশোকের অন্যান্য যে নাম পাওয়া যায় তা হলো শোকনাশ, মধুপুষ্প, পল্লবদ্রুম, বিচিত্র, রক্তপল্লব, কঙ্গেলি, বঞ্চুলদ্রুম, হেমপু্ষ্প, কেলিক, চিত্র, অপশোক ইত্যাদি। 

পদ্মাপুরাণ অনুসারে যাবতীয় দুঃখের মোচনকারী বৃক্ষ হল অশোক। মৎস্যপুরাণ অনুসারে যদি কোনো বাড়িতে অশোক, বকুল, শমি, তিলক, এবং পুন্নাগ বৃক্ষ লাগানো থাকে তবে ঐ বাড়ির বাসিন্দাদের জন্য সৌভাগ্য বাহিত হয়। তেমনি ব্রম্ভাণ্ডপুরাণেও অশোক বৃক্ষকে শান্তি সমৃদ্ধির প্রতিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

অশোকষষ্ঠীর পেছনে যে ব্রতকাহিনীর সন্ধান মেলে তা বেশ চমকপ্রদ। একসময় এক বনে এক ঋষি থাকতেন। বনের চারদিকে অনেক অশোক গাছ ছিল। ঋষি একদিন সকালে পুজোর ফুল তুলতে তুলতে গিয়ে দেখলেন, একটা অশোক গাছের গোড়ায় খুব সুন্দর একটি সদ্যোজাত ফুটফুটে মেয়ে কাঁদছে। ঋষি তখনই মেয়েটিকে তাঁর আশ্রমে নিয়ে এলেন। পরে ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে, অভিশাপের ফলে হরিণরূপিণী এক স্ত্রীলোক এই মেয়েটির মা। যাইহোক ঋষি মেয়েটিকে খুব যত্নে লালনপালন করতে লাগলেন। আর ঐ হরিণীও রোজ একবার করে এসে মেয়েটিকে তাঁর দুধ খাইয়ে যেতে লাগল। অশোক গাছের গোড়ায় তাঁকে পাওয়া গিয়েছিলো বলে ঋষি তাঁর নাম রাখলেন 'অশোকা'।
ক্রমশঃ মেয়েটি বেশ বড় হয়ে উঠল। এখন তাঁর বিয়ের বয়স আগতপ্রায়। ঋষি তখন সিদ্ধান্ত করলেন যে, পরের দিন সকালে প্রথমে তিনি যাঁর মুখ দেখবেন, তারই সঙ্গে এই অশোকার বিয়ে দেবেন। কিন্তু দৈবের লীলা তো অন্যরকম! পরের দিন সকালে উঠে ঋষি দেখতে পেলেন যে, এক রাজপুত্র তাঁর অনেক লোকলস্কর নিয়ে আশ্রমের দরজায় অপেক্ষা করছে। ঋষি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি এখানে এসেছো কেন?” রাজপুত্র বললেন, “আমি মৃগয়া করতে বেরিয়েছিলাম — কাল রাত্তিরে খুব ঝড় জল হওয়ায় আর ফিরতে পারিনি, আপনার কুটীরে আশ্রয় নিয়েছিলাম।” ঋষি দেখলেন এই ভালো সুযোগ। তখন তিনি রাজপুত্রকে নিজের সিদ্ধান্তের কথা বললেন। ঋষির কথা শুনে রাজপুত্র মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজী হল। রাজপুত্রের হাতে অশোকাকে সঁপে দেওয়া হল। ঋষি বললেন, “কুমার! আমি তোমার পরিচয় জানি না। আর তুমিও এর পরিচয় জানো না, তবুও আমার কথায় তুমি একে বিয়ে করলে—তুমি আর তোমার বাবা, এ বিয়েতে খুশিই হবেন। অশোকা খুবই গুণবতী মেয়ে।” তারপর ঋষি অশোকাকে বললেন, “মা অশোকা, এই অশোক ফুলের বিচিগুলো দিচ্ছি। নিয়ে যেও। এখান থেকে যাবার পথে বিচিগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে দিও। তাহলে একসময়  এখান থেকে রাজবাড়ি পর্যন্ত অশোকগাছের সারি হয়ে যাবে। আর তখন যে কোনও সময় তুই একাই এই অশোকগাছের সারি ধরে আমার কাছে পথ চিনে আসতে পারবি। আর অশোক ফুলগুলো শুকিয়ে রেখে দিস, চৈত্র মাসে অশোকষষ্ঠীর দিনে ওগুলো খাবি। জীবনে কখনো শোক তাপ আসবে না।”

ঋষিকে প্রণাম করে রাজপুত্র অশোকাকে নিয়ে রাজবাড়িতে ফিরে গেল। রাজা রাণী জানলেন সবকিছু। খুশি মনেই ছেলে ও নতুন বৌমাকে বরণ করে ঘরে তুললেন। এর পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। অশোকার গর্ভে সাত ছেলে ও এক মেয়ে হয়েছে। বৃদ্ধ রাজা রাণীর দেহাবসান হয়েছে ইতিমধ্যে।

চৈত্র মাসের এক শুক্লা ষষ্ঠীতে রাজার বাৎসরিক শ্রাদ্ধের তিথি পড়ল। অশোকা বৌয়েদের ডেকে বললেন “আজ অশোকষষ্ঠী। আজ আমি ভাত খাবো না।” তখন বৌয়েরা  মুগকলাই সেদ্ধ করে দিল রাণীকে। সারা দিন কাজকর্ম করার পর ক্লান্ত হয়ে রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম থেকে উঠে অশোকা দেখল যে, ছেলের বৌয়েরা কেউই ঘুম থেকেই ওঠেনি। শেষে ঘরের দরজা ভেঙ্গে ফেলে অশোকা দেখলে যে, সকলেই বিছানায় মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তা দেখে অশোকার তখন তাঁর পালনকর্তা ঋষির কথা মনে পড়ল। তখন অশোক গাছের সারি ধরে অশোকা সেই পালনকর্তা ঋষির কাছে গেল। ঋষি অশোকার সব কথা শুনে ধ্যানের মাধ্যমে এই ঘটনার কারণ জেনে অশোকাকে বললেন, “বৌয়েরা যখন মুগকড়াই সেদ্ধ করছিল তখব অসাবধানে একটা ধান তার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। খাওয়ার সময় সেটাই খাওয়ার ফলে যে পাপ হয়েছে তাতেই এই দুর্দশা হয়েছে তাঁদের। এই কমণ্ডলুর জল দিলাম। এটা নিয়ে গিয়ে তাঁদের গায়ে ছিটিয়ে দিলেই সবাই বেঁচে উঠবে। সেইসাথে অশোকষষ্ঠীর দিন ছ'টি অশোক কুঁড়ি, ছ'টি মুগকড়াই এবং দই দিয়ে খাওয়ার পরে তবে অন্য জিনিসে মুখ দিবি।”

ঋষির দেওয়া কমণ্ডলুর জল নিয়ে এসে অশোকা সবার গায়ে ছিটিয়ে দিল এবং নিয়ম মেনে অশোক কুঁড়ি ও মুগকড়াই খেলো। এর ফলে তাঁরা সকলেই বেঁচে উঠলো। এরপরই অশোকা মায়ের মাহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে গেল চারিদিকে। মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায় যে, অশোকষষ্ঠীর ব্রতপোচার করলে সন্তানাদির দীর্ঘজীবন লাভ হয়। সেই থেকে শুরু হয় অশোকষষ্ঠীর উপচার।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments