জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত /পর্ব -১ /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত   
পর্ব -১

শ্রীজিৎ জানা


রাক্ষসী শিলাই। কেউ তাকে শিলাবতী বলে ডাকে না। বোধহয় নামটাই ভুলে গ্যাছে সবাই। এম্নিতে সারা বছর এই অঞ্চলে নদীটা ঠা ঠা রোদে চিত হয়ে পড়ে থাকে গোড়ালি ডোবা বালির চাদর মুড়ি দিয়ে মড়ার মতো।  দক্ষিণ পাড়ের  খাঁ পাড়ার ছেলেমেয়েরা সকাল বিকাল নদীর ছাতির উপর দাপাদাপি করে বেড়ায়। বড়দোলই পাড়ার সকলে ত্রিপল পেতে ধান শুকায়। বলা ঘাঁটি অস্থায়ী একটা গোয়াল চালা ফাঁদে। বংশী রুইদাস সারা শীতকাল নদীতেই কাটায়। মাঝে দুপুরবেলা টুকু খেতে যায়। তলতা বাঁশ কেটে,কাঠি,বাতা ছুলে কুলা,ঠাকা,ঝড়া,চাল ধোয়ার ঢুচুনি বানাতে থাকে। দুপুরে রোদ পিঠ করে নাক ঢাকিয়ে ঘুম দ্যায়। শিলাইয়ের উত্তর পাড়ে প্রামানিক,বাগ,দোলই,ডগরা,সিং রায়দের ঘর। বাঁধের কোল  ঘেঁষে দক্ষিণের চওড়া বালিচড়ার পাশ বেয়ে তিরতির করে  বয়ে চলে স্রোত। বিধবা পুনি খুড়ির সাদা কাপড়ের প্রান্তে কালো পাড়ের মতো  শিলাইয়ের জলধারা।  মরা শুখার সময় পা ছিপেছিপে জল। তাতেই দু'পাড়ের লোকজন ধোয়া কাচা সারে। উবু হয়ে বসে ঘটিতে, মগে জল ডুবিয়ে মাথায় ঢালে। খানিকটা জায়গার বালি সরিয়ে বসার মতো গর্ত করে নেয়। বংশী বাতা ছুলতে ছুলতে নাগাড়ে বকে যায়,
----ঢ্যামনী এখিনেই যেন মরণ বাঁক বেঁকেছে। ম্যাটালি সাপের মতো ইলবিলিয়ে বেঁকে তার পর সজা হইচে। উদিক বাদ দিয়ে মোদের পাড়টাকে পেটে পুরতে লেগেছে।
বাঁকের দক্ষিণ পিঠে কালসাপাটির মাঠ। চোখ কুলোয় না সহজে শেষ দেখতে। তারও দক্ষিণে হুসহুসিয়ে ছুটে গ্যাছে পিচের সড়ক।কালসাপাটির পুবে পশ্চিমে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে  হাজর দেড়েক ঘরদোর। সবাই জাতে বাগদি। মাহিষ্য,বামুন,বোষ্টম,সদগোপ কারুর নামগন্ধ  নেই। জেলে, ডোম দু'চার ঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। 

গাঁয়ের নাম ঢোল।  কেউ ঢোল বললেই লোখা উটমুখো হয়ে তেড়ে আসে,
---কুন শালা বলে মোদের গেরামের নাম ঢোল?  তরা শালা জানুনু তাই বোলুঠু। নাকি ঢোল বল্লে খুব পুলক জাগে। দলিল, পড়চায়, ইস্কুলের কাগজে কুথাও ত ঢোল লিখা নাই! গেরামের নাম রাজনগর। মৌজা দুটা। পুব্ব আর পশ্চিম। মোদের রাজনগর পশ্চিম। বল্লে ঠিকটা বলবি,নাইলে মেকান ভেঙে দুব।
লোখার মাথায় সারাক্ষণ হাপর জ্বলে। তবে তার কথায় সত্যতা আছে বৈকি। যদিবা লোকেদের কথা একেবারে ফেলে দেবার নয়। বছরের বেশিরভাগ সময় জলে ডুবে থাকে কালসাপাটি। গ্রামের পেট চিরে এঁকেবেঁকে হাজারটা খাল চলে গ্যাছে। পুকুর ডোবাও কম নেই। কালসাপাটির মাঠে বিল আছে বিশ- বাইশটা। ব্যানাবিল,বালিবিল,ভূতার থাল, বামুনবিল,লাউচিটা,খলসাখালি,মইসাখালি আরো কত নাম।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



খরাশুখার শিলাই মুখচোরা গাঁয়ের মেয়ে। সাত চড়েও রা'কাড়ে না। যারা যেমন করে পারে মেয়েটাকে জ্বালাতন করে। কার ঘরে মাটির লেপ দেবে নদীর পাড় খুুড়ে ঝড়া ভর্তি  করে পলি বয়ে নিয়ে যায়। কার উঠোনে পৈঠা বাঁধবে বস্তা ভর্তি করে নিয়ে যায় বালি। কিন্তু যেই না আষাঢ়ের মেঘ ঘনালো শিলাই তীরের ঢোলের বুকে দুশ্চিন্তার  শব্দ দ্রিমদ্রিম তালে বাজতে শুরু করে। শান্তশিষ্ট শিলাই তখন সত্যিকারের পুতনা রাক্ষসী। রাগে গরগর আওয়াজ করে যেন গিলে খেতে তেড়ে আসে গ্রামটাকে। বাঁধ উপচে জল ঢুকে পড়ে কালসাপাটির মাঠে। মাঠ ডু্বিয়ে গোটা গ্রামটাকে যেন মুখের ভিতর পুরে নেয়। নদীর বাঁধ ভাঙুক আর নাই ভাঙুক ঢোল জলের তলায় থাকবেই বর্ষার ক'মাস। বানবন্যার কথা উঠলেই নগেন পণ্ডিতের মুখে হড়পা বানের মত কথা বেরোয়,
---- কালসাবা ত জলটুঙি।  জলের হাঁড়া। চারদিকের জল চুঁচা হয়ে কালসাবার পেটে জমা হবে। আর লে পেটে জলজমা রুগীর মত  নাদ ফুলিয়ে ছটপট করে মর।
চারদিক বলতে কাঁসাইয়ের উপরমুখের গ্রামগুলো থেকে জল গড়িয়ে কালসাপাটির মাট বেয়ে শিলাইয়ে পড়ে। পশ্চিম দিকে বাছড়াকুন্ডু, রাইকুন্ডু,কল্যাণপুর, লংকাগড়, সিঙ্গাঘাই,আমডাঙরা,গ্রাম। সবাইকে জড়িয়ে আছে শিলাবতী।  কোথাও ভাঙলে রক্ষে নেই। তার উপরে মরার উপর খাড়ার ঘা আরো তিনটো নদী মিশেছে পর পর। পারাং নদী চেপেছে বুড়িগাঙের ঘাড়ে। বুড়িগাঙ আবার চেপেছে শিলাইয়ের উপর। সেদিকে কোথা থেকে হুস করে কালো বিড়ালের রাস্তা কেটে যাত্রায় ব্যাগড়া দেওয়ার মতো করে দনাই নদী ঝাঁপ মেরেছে শিলাবতীর কোলে। এত চাপ শিলাই একাই বা সইতে যাবে কেন? বোধ হয় সেই রাগে পেটের সব জল উগরে দ্যায় দুই তীরে। আর যন্ত্রণা পোহায় কালসাপা।আর  তার পাশে থাকা  ঢোল। 
ফিবছর যেন জল লেগে ফুলে ঢোলের মতো চেহারা নেয়, তাই ঢোল।
লোখা এসব মনগড়া কথা মানতে চায় না।লোখা মাল। মাল পাড়ার তাকে গ্যাঁড়া লোখা বলে। খুব বেশি লম্বায় বাড় নেই তার । কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। পাকা ঝিঙে বিচির মতো। তালহিঁড়ের এঁটেল মাটির মতো শক্ত পেটাই শরীর।গায়ে অসুরের মতো জোর।লোখা মায়ের গড়ন পেয়েছে। ফুদন লোখার মা। বাপ তাকে ফুদি বলে ডাকত। মাল পাড়ায় দিনদুবেলা কাউচান লেগেই থাকে।ঝগড়াঝাঁটির সময় লোখার মাকে কারফার পাড়ার লতি একবার গেঁড়ি ফুদি বলে গাল দ্যায়। সেই থেকে ফুদনের নাম হয়ে যায় গেঁড়িফুদি।গজেন মাল লোখার বাপ। তালগাছ পারা লম্বা চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। লাউচিটা ঢিবির খেজুর গাছকে নাড়িয়ে নাকি খেজুর পাড়ত বয়সকালে। দেড় সের চালের ভাত নুন আর কাঁচালঙ্কা দিয়েই সাবড়ে দিত সে। মালপাড়ার অনেকের মনে একটা কৌতুহল খচখচ করত সবদিন। অমন খাড়পাল্লা চেহারার গজেনের কীকরে মনে ধরল ফুদনকে। গজেনের সমবয়স্করা তার মতিগতি জানত সবই। গজেনের পুরুষালি  তেজ সহ্য করা চাট্টিখানি কথা নয়। কীকরে গজেনকে সামাল দ্যায় ফুদন!
লোখারা পাঁচ ভাই তিন বোন। লোখা ছোট। ফুদনকে সেন্টারের দিদিমণিরা কতবার বলেছিল,
---এত ঘনঘন বাচ্চা কেন নিচ্ছ?
---বুড়া যে শুনতে চাইনি। কত ঠিলে রাখব তাকে বিছনায়।
---তমার কষ্ট হয়নি?
----ছ্যানা বিয়াতে মায়েদের কুনু কষ্ট নাই গো দিদিমণিরা। সাদে কি বলে,গাছকে কী ফল ভারি লাগে?
গজেনকে গাঁয়ের অনেকেই টিটকারি দিয়েছে তখন। গাম্ভা আর গজেন একই বয়সী প্রায়। ইয়ার্কি মেরে বলে,
----কি রে গজনা তুই ত একাই মাতি দেউঠু! লিজেই একটা গেরাম করবি নাকি?
----তবে কি বাঁজা হয়ে থাকব বলুঠু? ভগমানের দান না বোলবো ক্যানে! তোর গা-জ্বালা কিসের। মোর পাত বাড়েঠে, বাড়ু। আমি বুজব। তোর কমরের জোর নাই তাই পারুনু।
 গজেনের কথায় কিছু মনে করে না গাম্ভা। লালচে ছোপ লাগা দাঁত বের করে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে সরে যায়।
(ক্রমশ)

Post a Comment

6 Comments

  1. অসাধারণ ভাবনার উপর লেখা।

    ReplyDelete
  2. লেখার বাঁধ নী কে কুর্নিশ জানাই

    ReplyDelete
  3. অসাধারণ।

    ReplyDelete
  4. বার বার মনে উঁকি দিচ্ছে উৎস কি ? জমাটি ঢোল সহরত।

    ReplyDelete
  5. খুব ভালো লাগলো।মন ছুঁয়ে যাওয়া বর্ণনা।

    ReplyDelete
  6. অসাধারণ! গদ্য পড়ছি না সিনেমা দেখছি।

    ReplyDelete