জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১২৫

 ছোটোবেলা  বিশেষ সংখ্যা ১২৫

সম্পাদকীয়,
সুদীপ আঙ্কেলের তোলা প্রচ্ছদের পাখিটার নাম কি জানো? দাগিগলা কাঠঠোকরা। সাধারণত: আমরা মনে করে থাকি যে- ‘কাঠঠোকরা’  গাছের গায়ে বসে গাছের শরীর ছিদ্র করে গাছকেই নষ্ট করতে ফেলছে। আসলে আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। প্রকৃতপক্ষে কাঠঠোকরা গাছের উপকার সাধন করে থাকে। শুধু তাই নয়, কাঠঠোকরাই একমাত্র পাখি যাদেরকে ‘গাছের চিকিৎসক’ বলা হয়। গাছের যেখানে পচা অংশ বা ভাঙ্গা অংশ আছে সেখানেই বিষাক্ত পোকা অবস্থান করে ডিম দিয়ে রাখে, কিছু দিন পর সেই ডিম ফুটে বাচ্চা পোকা জম্মায়। সেই পোকা আবার এই গাছেরই ক্ষতি করে। কাঠঠোকরা এসে কিন্তু সেই গাছের পচা অংশ থেকে সেই ক্ষতিকর পোকাগুলোকে বা সেই পোকার ডিমগুলো খেয়ে ফেলে সেই গাছের বড় উপকার সাধন করে থাকে। কাঠঠোকরাদের নিয়ে এতো কথা বললাম কেন? আরেবাবা গাছ আমাদের বন্ধু আর গাছ বন্ধুর বন্ধু কাঠঠোকরা।  তাই বন্ধুর বন্ধুকে চেনা দরকার আছে বইকি। নাহলে আমরা না জেনে চড়াইএর মতো কাঠঠোকরা কেও ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে দেখব। এবারে সংখ্যায় সেই হারিয়ে যাওয়া চড়াই নিয়ে ছড়া লিখেছে আসরফী আন্টি। সত্যিই তো চড়াই গুলো সব গেলো কোথায় বলতো! এদিকে মলয় জেঠু বলেছেন, সাদা বালির মরুভূমিতেও মাছ আছে। তার নাম হোয়াইট স্যান্ডস পাপ ফিস। কি অবাক হচ্ছো? তাহলে বড়ো হয়ে ঘুরে এসো সেই সাদা বালির দেশে। নিজের চোখে দেখে তবেই মেনো। এবার বলো মরুভূমির দেশে মাছ আছে দিব্যি এদিকে আমাদের চড়াই বন্ধুটির দেখা নেই এমন সবুজে ভরা দেশে? ভাবতে পারো? এদিকে লাচুঙে নেকড়ে এবার এলো বুঝি। নাহলে বাচ্চাটা কি দেখে অচেতন হল? অনেক প্রশ্ন ভিড় করে এসেছে। শ্রীকান্ত আঙ্কেল যেভাবে এবারের উপন্যাস শেষ করলেন তাতে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করা খুবই বেদনার। উপায় নেই চলো অন্য কিছু পড়ি। জেনে নিই বিশ্ব কবিতা দিবসের কথা দোলনচাঁপা আন্টির লেখা পড়ে। দেখে নিই ছোটো বন্ধুদের আঁকা ছবিগুলো। আর মন ভরিয়ে নিই সব্যসাচী আঙ্কেলের পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়ে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঠিক ১২৫ পর্ব থেকে ১২৬ পর্বে পৌঁছে যাব। আর জানতে পেরে যাব লাচুঙে কী হল। কি তাই তো! -- মৌসুমী ঘোষ।



ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে
পর্ব ৪

শ্রীকান্ত অধিকারী

বড়মামি অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। হাতের মুঠিতে ছোট ট্যুর ব্যাগ চেপে রেখেছে। মাথা ধরেছিল সেই দিকচু নদীর সাঁকোটা পেরোবার পর থেকেই। জানলার ধারে বসে থাকলেও গা বমি বমি ভাব কিছুতেই যায় না। গাড়িতে চাপলেই গা বমি বমি করে। আগেভাগেই হোটেলে থাকতেই ছোটমামার কাছ থেকে একটা আভোমিন চেয়ে খেয়েছিল। কিন্তু তাতে তেমন কাজ করে নি। বমি ভাব থেকেই গেছে। তাই জানলার ধারে মুখ বের করেই রেখেছিল। তাজা শিরিশিরে হাওয়া কিছুটা গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ছিল। ঠান্ডা লাগলেও মামির বমির জন্য কেউ কিছু বলে নি। মামিও নট নড়নচড়ন। শিঙি গান গেয়ে ওঠতে সবাই যেন স্বস্তির শ্বাস নেয়। মামি এক সময় বলে, ওহে নেপালি ড্রাইভার ভাই, শ্যামাসঙ্গীত টঙ্গিত লাগাও না রে ভাই। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা কত দূরে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি। ভালোভাবে ফিরতে পারব কিনা জানি না, একটু মায়ের গানও শুনিয়ে দাও। 
আমাদের ড্রাইভার যে নেপালি জানলে কী করে? ভুটানিও তো হতে পারে। ছোটমামা বলে। 
দেখ, দেখ না ওর নাকটা। কতটা ভোঁতা। কিছুটা হলে সিকিমি, খুব হলে ভুটানি। আর বেশি হলে নেপালি। ওর নাকটা বড্ড বেশিই ভোঁতা। 
ছোটমামা, বাবা হো হো হেসে ওঠে।--হ্যাঁ হ্যাঁ তাইই শোনাও। ছোটমামা লাফিয়ে ওঠে। মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে ভাবে এই বুঝি ড্রাইভারের পাশ থেকে মোক্ষম উত্তর আসে। কিন্তু তার বদলে বড় মামা সবাই চমকে দিয়ে বলে, এই গ্যাটসো গাড়ি রোকো। উসকো জানে দো। 
--কিসকো? গাড়ির সকলে এক বুক আতঙ্ক নিয়ে বড়মামার দিকে তাকায়। 
বড়মামা নিজের জায়গায় চুপ করে বসে বলে, অনেকক্ষণ ধরে দেখছি একটা লালগাড়ি নম্বর যতদূর মনে হচ্ছে ঝাড়খণ্ডের, বার বার আমাদের গাড়িটাকে ওভারটেক করছে। যত্তসব আন এথিকেল অ্যান্ড রিকলেস ড্রাইভিং! এই তুম কুছ বোলো। 
ড্রাইভার গ্যাটসো মৃদু মাথা ঝুকিয়ে গাড়িটা বাঁ দিকে আলতো করে নিয়ে যেতে যেতে একটু হেসে বলে,--বাবু ছোড়িয়ে। আগে যায়েঙ্গে।ইধার জাগা নেহি। 
সত্যিই এইখানটায় অনেকটা সংকীর্ণ। একটা গাড়ি কোনো ক্রমে যেতে পারে। নীচের দিকে পাইন গাছের জঙ্গল।ওপরের দিকে সরু রাস্তায় গাড়িগুলো সার দিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু কিছুদূরে বাঁক নিতেই একটা ছোট পরিসর। তাতে গুমটির মত একটা দোকান। একটা ঝর্ণা। না  কিছুলোকের জমায়েত। সেখানে গাড়িটাকে একদিকে সেঁদিয়ে ড্রাইভার নেমে যায়। বলে আইয়ে বাবু কুছ পানি বানি লিজিয়ে। অর প্লাস্টিক বগেরা ফেঁক দিজিয়ে। পুলিশ প্যাকড়েংগে।
বাবা বলে, গ্যাটসো এটা কি সেভেন সিস্টার্স? সাত বোনের ঝর্ণা? 
গ্যাটসে ডান হাত দেখিয়ে বলে ,--অউর উপর। হাম উধার রুকেঙ্গে। 
ওদের দেখাদেখি আরো কয়েকটা সুন্দর গাড়ি পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ে। 
এই সিকিমের রাস্তায় যেখানেই দাঁড়ানো যায় না কেন প্রকৃতির অপরুপ শোভা মোহিত করবেই। কে বলে শুধু স্যুইজারল্যান্ডই সুন্দর! সুইজারল্যান্ডের থেকেও অনেক গুন ভালো। 
--ছোটমামা এটা তো হিমালয় রেঞ্জেরই অংশ? 
অবশ্যই। পূর্ব হিমালয়ের মধ্যে পড়ে। সিকিম দার্জিলিং ভুটান ও অরুণাচল হিমালয়ের অংশ। অপূর্ব! 
কিন্তু তুমি সুইজারল্যাণ্ডের থেকে ভালো কেন বললে? শুনেছি সুইজারল্যান্ড পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর জায়গা । 
ঠিক কথা। সে তো ফ্রেশনেশের জন্য। ঘন সবুজ গালিচার জন্য। কিন্তু এমন বন জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি উপত্যকা বা ঢালে প্রকৃতির শোভায় আমি বলি হান্ড্রেড পারশেন্ট এগিয়ে আমাদের এই হিমালয় রেঞ্জ। 
ওরা সবাই হালকা মাফলার বা কেউ টুপি পরে গাড়ি থেকে নামলে ড্রাইভার ওদেরকে নিয়ে যায় গুমটির কাছে। বড়মামা, বাবা গুমটিতে কিছু স্ন্যাক্স বড় বোতলে জল ভরে নেবার জন্য এগিয়ে গেলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। 
-- গাড়িটাকে দেখেছিস? শাদুলমামা বলে।
--প্রাইভেট ! নেপালের। নাম্বার প্লেটে ছোট করে  NEP লেখা ছিল। কিন্তু ... 
--কিন্তু আবার কি! আসতেই পারে। প্রতিবেশী দেশ বলে কথা। একটু হামদর্দি থাকবে না? 
--না মানে আমি শুনেছি এখানে প্রাইভেট গাড়ি নট অ্যালাও। .
-- ঠিক শুনেছিস। কিন্তু ওন কারে ট্রাভেল করতে হলে স্পেশাল পারমিশন লাগে। ওরা সেটা করেছে। 
--তবে  আমদেরটা নিয়ে এলেই হত। 
--এখানে SUV মার্কা  হতে হবে। নইলে না। তোদেরটা হুন্ডাই আই টোয়েন্টি অ্যাক্টিভ। 
--কিন্তু ফিল অফ SUV 
--ইয়েশ! বাট ডোন্ট কুয়ালিফাই টু বি কল্ড অ্যান SUV–স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যালস ! অত্যাধুনিক সিস্টেম সব । প্রোটেকশন, হাই ড্রাইভিং পজিশন , টোইং ক্যাপাসিটি গ্রেট  
--আমেরিকান টার্ম ! রামসি বলে।
--গুড! চালিয়ে যা,তোর হবে।--ওই দ্যাখ আরেকটা সিক্কিমের বাইরের কার। তবে এবারেরটা ভুটানের।নাম্বারটা খেয়াল কর-BG- রয়্যাল গভর্নমেন্ট অব ভুটান। আমাদের যেমন WB। তবে সব গাড়িতে কিন্তু এই অ্যালফ্যাবট থাকে না। BP, RBP,BT,BP এ সব হতে পারে। 
--কিন্তু মামা আদার্স স্টেটের প্রাইভেট কার তো এখানে চলে না।
--চলে চলে। 
--আসলে এখানে এই ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সংঘটিত চাপে এই নিয়ম হয়ে গেছে। ওরা ওদের নিজের গাড়ি ছাড়া ট্রাভেল করতে দিতে চায় না। ট্র্যাভেলারদের থেকেই তো ওদের সারা বছরের লিক্যুইড মানীটা আসে। 
--পর্যটন শিল্পটাই এখানে বড়ো। তাই না ছোটমামা? 
এর পর পরই দুটো ঘটনা ঘটে। যেটা রামসি বা ওর ছোট মামা কেউই পূর্ব থেকে আন্দাজ করতে বা ভাবতেও পারে নি। এমনকি লোকাল লোক গ্যাটসেও না। 
একটা সিকিমপুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ায়।   
--ছোটমামা পুলিশ ! 
আপন মনেই নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল—হুঁ। 
গুমটির কাছে যারা গেছিল তাদের সবাইকে আর ওখানে দাঁড়াতে দিল না। এক প্রকার খেদিয়ে দিল। তাতে ড্রাইভার গ্যাটসোকে মাথা গরম করে দু একটা জোরে কথা বলতে দেখা গেল। কিন্তু ওই পর্যন্ত। তবে বড়মামাকে বেশ গজগজ করতে দেখা গেল।--বড় বড় সাহবেরা বেড়াতে আসবে আর সাধারণ মানুষের হ্যাপা সামলাতে হবে। 
গ্যাটসো বলে, জলদি করবেন স্যার। হেভি টাইট ই লোগ। বলেই গাড়িতে এক লাফে উঠে বসে। 
-- নেপাল ভুটান অ্যাম্বেসি একসঙ্গে! ছোটমামা রামসির দিকে আরচোখে দেখে নেয়। 
-- আজকে স্পেশাল ব্যাপার কিছু কি !  রামসি ওর ছোটামামাকে শুধোয়। 
--এমনিতে সিকিমের প্রশাসন অত্যন্ত দক্ষ। সহজে এঁদেরকে দেখা যায় না। তবে কেউকেটা কেউ এসেছেন। হয়তো দেখগে সিকিম নেপাল ভুটানের তিন বন্ধু এক সঙ্গে নাথুলা চলল বরফ দেখতে। বলেই একটু বাকা হাসি হেসে ফেলল ছোটমামা । 
এখন কি বরফ থাকবে! রামসি ভাবে। সবে অক্টোবর।  
ওরা গাড়িতে ফিরে আসতে না আসতেই অদূরে যেখানে গোটা তিনেক ভাড়া গাড়ি,আর তাদেরই গুটি কয়েক প্যাসেঞ্জার যারা এই নর্থ সিকিমে বেড়াতে এসেছে, ঠিক সেখান থেকেই হঠাৎ জোরে কান্নার শব্দ ভেসে এলো।  
রামসি অত্যন্ত চমকে ওঠে। হয়তো বেশ অবাকই হয়। 
পাহাড়ে এমন শান্ত পরিবেশে একটু ঝর্ণা বা পাখির ডাক কানে এলে তীব্রভাবে জানান দেয়। গাড়ির হর্ণ তেমন কেউ বাজায়ই না। তাই হঠাৎ এমন আর্ত চিৎকারে উপস্থিত সকলেই আঁতকে ওঠে। 
অদূরে দাঁড়ানো দুটো পুলিশ ছুটে আসে ছোট চারসিটের ভাড়াগাড়িটার দিকে। সেখানেই কিছু একটা ঘটেছে। চকিতে দেখা গেল বাঁকটার কাছে রাস্তার গায়ে একটা শিশু অচেতন হয়ে পড়ে। 
তৎক্ষণাৎ--ফগি, ফগি কাঁহা? ঐ গাড়ির ভেতর থেকে প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে বেড়িয়ে আসে এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা।  
(ক্রমশ)



ভ্রমণ
সাদা বালির খপ্পরে
শেষ পর্ব

মলয় সরকার

গাড়ী এর পর, একটু বেলা বাড়তেই ছুটল অন্য এক লক্ষ্যের দিকে।প্রায় ২৫০ কিমি দূরে এবং পৌনে তিন ঘণ্টার রাস্তা।
রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত ফাঁকা জমি, আর মাঝে মাঝে পড়ছে কিছু কিছু জঙ্গল, দু চারটে বাড়ি।
একসময় শেষে পথও ফুরালো।যখন এসে পৌছালাম, তখন বেলা দুপুর।

চারপাশটা বেশ ফাঁকা ধূ ধূ মরুভূমির মতই।সামনে যে ভিজিটর সেন্টার রয়েছে তা- ও একটু অন্যরকমের দেখতে।এখানকার অনেককিছুই কেমন যেন গ্রাম্য মাটির বাড়ির মত দেখতে।রংটাও সেই রকমই। সাধারণ,  ঝাঁ চকচকে যেমন আমেরিকার বাড়ি হয়,মোটেই সে রকম নয়।কাঠের কড়িবরগা দেওয়া মাটির একটা বেশ বড়সড় একতলা বাড়ির মত, যদিও তার ভিতরে গিফট শপ থেকে শুরু করে রেস্টরুম পর্যন্ত সবই আছে।একটা ছোট ডকুমেন্টারি ফিল্মও দেখানো হয় আগ্রহী পর্যটকদের।এর সামনে বেশ বড় বড় কিছু ঘাসের ঝোপ ছাড়া গাছপালা বিশেষ কিছু দেখতে পেলাম না।কেমন যেন শুকনো মরুভূমির পরিবেশ।

এখানে আমরা আর বেশি সময় নষ্ট করলাম না।এটাই সেই বিখ্যাত সাদা বালির মরুভূমি বা White Sands National Park, যা দেখতে আমাদের আসা।
দূরে দেখতে পেলাম, ঘন নীল আকাশের নীচে ঊজ্বল সূর্যের ঝকঝকে আলোয় সাদা ধবধবে বালির পাহাড়ের সারি। সাদা দুধসাগরের ঢেউ যেন হঠাৎ কোন মন্ত্রবলে স্থির হয়ে জমে রয়েছে।তাদের গায়ে আলো পড়ে চিকচিক করছে।
পার্কের ভিতরে টিকিট কেটে ঢোকা গেল।বালি দুপাশে সরিয়ে মাঝে গাড়ি যাওয়ার মত রাস্তা করা আছে। অনেক গাড়িই এসেছে।তবে গাড়ির চাকা যেন রাস্তা ছেড়ে বালির উপরে না যায় তার জন্য সতর্কতা বাণীও আছে।
আমাদের গাড়ি ধীরে ধীরে ঢুকল পার্কে।
এই সাদা বালির বালিয়াড়ি পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বড় এই ধরণের বালিয়াড়ি যা ২৭৫ বর্গ কি মি জুড়ে বিস্তৃত।
এরকম একটা আশ্চর্য জিনিস যে পৃথিবীর বুকেই জলজ্যান্ত ভাবে রয়েছে ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে।চোখে দেখে তো নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না।

এটা কিন্তু সাধারণ বালি নয়।সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।এটা হল জিপসাম নামে একটি রাসায়নিক। এর আসল রাসায়নিক নাম হল CaSO4,2H2O।অর্থাৎ ক্যালসিয়ামের একটি যৌগ, ক্যালসিয়াম সালফেট।প্রাকৃতিক ভাবে তৈরী এত বড় একটা জিপসামের একত্র ক্ষেত্র হিসাবে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়।এই মরুভূমির নাম চিহুয়াহুয়ান মরুভূমি। 

অস্ত সূর্যের রক্তিম আলোয় এবং দিনের বিভিন্ন সময়ে আকাশের আলোর বিভিন্ন অবস্থায় এর উপরে নানা মোহময় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, হাওয়া দিলেই এই সাদা বালি উড়ে গিয়ে এই ক্ষেত্রের উপরে নানা সুন্দর নক্সার সৃষ্টি করে।এই হাওয়ার জন্য এটি উত্তরপূর্বে অল্প সরে সরে যাচ্ছে, যে সরণ প্রায় বছরে ৩০ ফুট মত।
আমরা এগোলাম। যত দূর চোখ যাচ্ছে দেখি সাদায় সাদা পাহাড় চোখ ঝলসে যাচ্ছে।বহু ছেলে মেয়ে এবং সঙ্গে বয়স্করাও এই ঝুরঝুরে বালি্র পাহাড়ে মেতে উঠেছে নানা খেলায়। অনেকে গড়া গড়ি খাচ্ছে, কেউ কেউ গড়িয়ে নামছে পাহাড়ের উপর থেকে। কেউ আবার, দেখলাম একটা গামলার মত জিনিসের মধ্যে বসে উপর থেকে পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে গড়িয়ে আসছে।এইটা নাকি ভিজিটিং সেন্টার থেকে ভাড়া নেওয়া যায় বা কেনা যায়।

এখানে একটা কথা বলে রাখি, এর পাশেই কিন্তু রয়েছে আমেরিকার একটি মিলিটারী ঘাঁটি। সেখানে কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।এই মিলিটারী ঘাঁটি তৈরী হয় ১৯৪৫ সালে। এখানেই ১৬ই জুলাই ১৯৪৫ এ প্রথম এটম বোমা ফাটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল।এই জায়গাটা নাকি মহাকাশ থেকেও দেখা যায় এবং মহাকাশযান কলম্বিয়া এখানেই অবতরণ করেছিল।

সে যাক, আমরাও মনে মনে ছটফট করছি এই বালিতে গড়াগড়ি খাওয়ার জন্য। এখানে লেখা আছে এই বালির মধ্যে কেউ গাড়ি চালাবেন না বা কোনরকম ক্ষতির চেষ্টা করবেন না। নির্দিষ্ট জায়গা দিয়েই গাড়ি চালাতে হবে।
হঠাৎ চোখে পড়ল, দূরে এক ভদ্রলোক কিছু বলতে চাইছেন। কাছে গিয়ে দেখি উনি পার্কের গাইড। দর্শকদের এই সাদা বালির মরুভূমির সম্বন্ধে বলবেন।আমরা গিয়েছি চারজনে। আমি আমার স্ত্রী ছেলে আর মেয়ে।ভাবলাম , শুনেই নিই কি বলছেন।

উনি বোঝাচ্ছিলেন,কি করে এই সাদা বালির মরুভূমির উৎপত্তি হল।
অতীতে প্রায় ১২০০০ বছর ধরে বৃষ্টির জলে ধুয়ে এই টুলারোসা উপত্যকায় এই জিপসাম জমা হয়েছে। এখানকার ঊষ্ণতা ও শুষ্কতাই এখানে এই মরুভূমির সৃষ্টি করেছে। এই জিপসাম, সার, প্লাস্টার, শ্যাম্পু তৈরী ইত্যাদি নানা কাজে লাগে।
এখানে যে আদিম মানবের অস্তিত্বের ছাপ পাওয়া গেছে তা প্রায় ২৩০০০ বছর আগেকার।
এর ভিতর দিয়ে যে রাস্তাটা আছে তা প্রায় ৮ মাইল মত লম্বা।এর ভিতর পিকনিক করার জায়গাও আছে।
এর ভিতর যথেচ্ছ হেঁটে বেড়ানো যায়।পায়ে চলা পথও রয়েছে এখানে।এই বালিগুলো হাতে নিয়ে দেখলাম, ঠিক বালির মত নয়। এটি খুব গুঁড়ো গুঁড়ো নুনের দানার মত।

এখানে রয়েছে, শুকনো বড় বড় ঘাসের ঝোপের মত টুকরো টুকরো, এখানে ওখানে, অল্প স্বল্প ঝোপ।সবই যেন কেমন শুকনো।এগুলি আবার সাদা বালিকে ধরে রাখতে খুব সাহায্য করে।এর মাঝে কোথাও কোথাও কাঠের পাটাতন বসিয়ে হাঁটার জন্য Boardwalk Trail ও করা আছে।

এর মধ্যেও কিন্তু কিছু প্রাণী থাকে শুনলাম । আমি তো ভেবেছিলাম, এর মধ্যে কোন প্রাণীই বাঁচতে পারে না। কিন্তু দেখেছি এর আগে মরুভূমিতে,কঠিন পাথরের মাঝেও কোন না কোন তৃণ জাতীয় প্রাণের আগে জন্ম হয়। পরে পরে আসে বড় প্রাণ। এখানে এই মরুভূমিতে তৃণজাতীয়  প্রাণের সাথে সৃষ্টি হয়েছে বেশ কিছু প্রাণীর, যারা এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে দিব্যি বেঁচে রয়েছে এবং বংশাবলীর ধারা বজায় রেখেছে।এখানে পাওয়া যায়  মাছ, পাখী ,সাপ বা কিছু সরীসৃপ , কিছু উভচর শ্রেণীর এবং ইঁদুর জাতীয় কিছু প্রাণী।বেশ কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণীও এখানে পাওয়া যায়।এখানে যে একমাত্র মাছটি পাওয়া যায় তা হল White Sands Pupfish।এটি ১.৫-২.৫ ইঞ্চি মত লম্বা হতে পারে। এর চোখ ঘন কালো এবং গায়ে চকচকে রুপোলী আঁশ আছে।অল্প বৃষ্টির অগভীরজলেই এরা খেলা করে বেড়ায়।এরা বিগত ১২০০০ বছর ধরে বিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে আছে এবং এই মাছ পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। 

রেঞ্জার গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন কিছু বড় ঝোপ ধরণের গাছের কাছে এবং দেখালেন সেই সব গাছেও ছোট ছোট ফল রয়েছে। এই সমস্ত কাঠবিড়ালী বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণীগুলো নাকি এই ফল এবং গাছের পাতা শিকড় খেয়েই বেঁচে থাকে।এই অঞ্চলের আশে পাশে খুব বেশি না হলেও অল্প মনুষ্য বসতি আছে, প্রায় হাজার দেড়েকের মত।
এখানে বৃষ্টি হয় জুনের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের প্রায় শেষ পর্যন্ত।তবে তা খুব বেশি নয়, বার্ষিক গড়ে ১০ ইঞ্চির মত।বৃষ্টি হলে এই সমস্ত নুনের কেলাস বা দানা গলে যায় এবং আবার পরে রোদ উঠলে বা বাতাস শুকনো হলে শুকিয়ে দানা দানা হয়ে যায়।
সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে গোল করে ঘিরে গাইডের কথা শুনছিলাম আর আশ্চর্য হচ্ছিলাম।এখানে তাপমাত্রাও যেমন বেশি তেমনই কম।সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩.৯ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে সর্বনিম্ন -৩১.৭ডিগ্রী পর্যন্তও হতে পারে। রোদের সময় রোদের তেজও প্রচণ্ড, এমনকি অন্য সময়েও। মরুভূমির রঙ সাদা হওয়ার জন্য রোদের তেজও বেশি লাগে , ফলে চামড়ার উপরেও তা বিক্রিয়া করতে পারে। তাই আমরা সতর্ক হয়ে বড় টুপি এবং রোদের ক্রিম মেখেই গিয়েছিলাম।

এখানে এসে আমাদের যেন বয়স কমে গেল। মনে হচ্ছে,হুড়োহুড়ি করি ছোটদের মতই। সাদা বালির উপর গড়া গড়ি দিলাম। হাঁটলাম এখান থেকে ওখান। এত ফাঁকা জায়গায় হঠাৎ এসে মন যেন একেবারে উন্মুক্ত হয়ে গেল।
আকাশে তখন মেঘ আর রোদের খেলা চলেছে। দেখতে দেখতে দিন কাবার হয়ে সূর্য পৌঁছে গেল পশ্চিম আকাশে। পড়ন্ত রোদে সত্যিই এই সাদা বালির মরুভূমির অদ্ভুত এক রূপ চোখে পড়ল, যা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না।
এই সব দেখতে দেখতে আচ্ছন্ন হয়ে আছি এমন সময় ঘণ্টা পড়ল ,সময় শেষ ,এবার বেরোতে হবে। গাড়ীতে মাইকে এনাউন্স করছে।বালির পাহাড় থেকে নেমে যেতে যেতে যেন বড় তাড়াতাড়িই অন্ধকার হয়ে এল চারিপাশ। এখানে তো কোন আলোর ব্যবস্থা নেই।খুব খারাপ লাগছিল চলে আসতে।

 আমরা গাড়িতে উঠে ফিরে আসতে যাব, এমন সময় হল বিপত্তি। আবছা অন্ধকারে , যদিও গাড়ির আলো ছিল, তবু বেকায়দায় গাড়ির চাকা গিয়ে পড়ল সেই সাদা নুনের মত বালির মধ্যে। হঠাৎ এই বালির উপর চাকা চলে যাওয়াতে , আমার ছেলে গেল ঘাবড়ে। কি জানি, আমেরিকার অনেক জায়গারই নিয়ম খুব কড়া তো, আর চার ধারে সব সময় রেঞ্জারের গাড়ীর পাহারা। যদি কারোর চোখে পড়ে যায়, নির্ঘাৎ করবে ‘ফাইন’।তাই ও তাড়াতাড়ি গেল গাড়িকে এর থেকে বের করে আনতে। 

কিন্তু কিছুতেই আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না, যতই এগোতে পিছোতে যায় ততই ঝুর ঝুর করে আরও বালি এসে জড়িয়ে ধরে চাকাকে। ঢালু পাহাড়ের দিক থেকে গুঁড়ো বালি আরও এগিয়ে আসে।বালিও যেন বাচ্চা ছেলের মত মজার খেলায় মেতেছে।এই দেখে ও তো আরও চেষ্টা করে। এদিকে চারদিক থেকে সমস্ত গাড়ি বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যের অন্ধকার যেন গভীর হয়ে ভূতের মত জড়িয়ে ধরছে। এমন হল যে, এক হাত তফাতে লোকের মুখ দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। দূরে টিম টিম করে কোন আলো দেখা যাচ্ছে চলে যাওয়া গাড়ীর। 
এমন অবস্থা, একসময়। অত বড় অন্ধকার মরুভূমিতে আমরা মাত্র চারজন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মানুষ আর একটি আটকে যাওয়া গাড়ি ছাড়া আর কেউ নেই। ছেলের মুখ চোখ ঘেমে নেয়ে একাকার, আমাদেরও। ভাবছি এই অন্ধকারে সারা রাত কাটাতে হবে না কি। খাবার দাবারও বেশি কিছু নেই। আমার স্ত্রীর হাতে তৈরী কেক কিছু রয়েছে আর অল্প জল। তাই দিয়ে কি আর চলবে! কি করা হবে ভাবছি।

হঠাৎ দেখি, শেষবারের মত রেঞ্জারের গাড়ি টহল দিতে এসেছে অন্ধকারের মধ্যে। যা থাকে কপালে, বলে, ফাইনের তোয়াক্কা না করেই তাকে ধরতে হল, যে আমরা আটকে গেছি।ভয়ে বুক দুরু দুরু, কি হয় কি হয়! কি জানি কি শাস্তি হয়, এই বালিতে গাড়ি তোলার অপরাধে!

 ও মা! সবাই কে চমকে দিয়ে, সেই টহলদার গাড়ি থেকে তড়াক করে লাফিয়ে নামল এক লম্বা চওড়া দীর্ঘদেহী রেঞ্জারের পোষাক পরা মহিলা। বয়স বেশ অল্প বলেই মনে হল। নেমেই সব শুনে নিল প্রথমে। তার পর খুঁটিয়ে দেখল গাড়ির চারপাশ ঘুরে। তারপর বলা নেই কওয়া নেই, আমাদের একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে ধড়াস করে মাটিতে শুয়ে পড়ে গাড়ির চাকায় আটকে যাওয়া বালির স্তুপ প্রথমে হাত দিয়েই সরাতে আরম্ভ করল।আমরা তো তার কাণ্ড দেখে হতভম্ব।
 কিন্তু কিছুক্ষণেই বুঝল, এ তার দু হাতের ‘কম্মো’ নয়।তখন নিজের গাড়ি থেকে নামিয়ে আনল একটা বেলচা। সেটা দিয়েই সব বালি সরাতে চেষ্টা করল।চারি দিকে তখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, আমরাই কেবল অন্ধকারে কটি প্রাণী।অতবড় জনপূর্ণ মরুভূমি ধু ধূ অন্ধকারের কালো চাদরে মুড়ে ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে। 
তার পর সে নিজেই দরজা খুলে ঢুকে পড়ল আমাদের গাড়িতে। স্টার্ট দিয়ে চালাতে চেষ্টা করল। উদ্দেশ্য, পিছিয়ে গিয়ে গাড়ী বের করে আনবে।নাঃ এবারেও হল না।সুক্ষ্ম সাদা বালিরা যেন মজা পেয়েছে। তারা যেন বলছে, যেমন আমাদের গায়ে হাত দিয়েছিস, মজা দেখাচ্ছি! সে বেটিও ছাড়বার পাত্রী নয়। তখন একটু চিন্তা করেই ফোনে কাকে কি বলল। একটু পরেই দেখি আর একটি গাড়ি হুটার বাজিয়ে চলে এল সেই অন্ধকার ফুঁড়ে।এসে, তার ড্রাইভার চট করে গাড়ী থেকে অন্য গাড়ি টানার মোটা তার বের করল। তারপর আমাদের গাড়ীর পিছনের দিকে বেঁধে ফেলল চটপট। আমরা তো কাণ্ডকারখানা দেখে থ’।কি কুক্ষণে যে এই সাদা বালির খপ্পরে পড়েছিলাম কে জানে!

ব্যস, সে মেয়ে বসল , আমাদের গাড়ীর স্টিয়ারিং ধরে।টান পড়ল পিছনে।’বাপ বাপ’ বলে সাদা বালির দল গাড়ি ছেড়ে দিতে পথ পায় না।গাড়ি উঠে এল আবার রাস্তায়, বালির খপ্পর থেকে মুক্ত হয়ে। নিজের বুকে হাত দিয়ে দেখলাম, নিঃশ্বাসটা যেন একটু জোরেই পড়ছে। স্বস্তির নিঃশ্বাসটা বেশ আরাম করেই ছাড়লাম।

মেয়েটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমার ছেলেকে হেসে বলল, এখন তোমার গাড়ি মুক্ত , তুমি যেতে পার। সে তো কি বলে যে ধন্যবাদ দেবে বুঝে পায় না। আমাদের সবার মুখে হাসি, চোখে আনন্দাশ্রু।, ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা হারিয়ে গেছে। ফাইনের তো কোন কথাই নেই।রেঞ্জার বলল, না না , এটা কোন ব্যাপার নয়। ঠিক আছে। তোমাদের অসুবিধা হয়েছ, হঠাৎ বিপদে পড়েছ, এটুকু না করলে আর সরকার আমাদের টাকা দিয়ে রেখেছে কেন। সবার সুবিধা অসুবিধা দেখার জন্যই তো আমরা আছি।বুঝতেই পারছি তোমরা তো আর ইচ্ছা করে কিছু কর নি, হঠাৎ বেকায়দায় হয়ে গেছে।
তার এই কথা শুনে আমার ছেলে আর আমরা তো স্তব্ধ। হঠাৎ বুদ্ধি করে ছেলে বলল, তোমাকে কিছু দেওয়ার বা কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। তুমি আমার মায়ের হাতে বানানো এই কেকের টুকরো ক’টা নিলে খুশি হব।
সে তো খুব খুশী হয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, দাও।

আমরা তাকে আর একবার ধন্যবাদ দিয়ে আর বিপদতারণ মদুসূদনকে স্মরণ করে এগোলাম মরুভূমি ছেড়ে গেটের দিকে।বুকটা তখন দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে অনেক হাল্কা হয়ে গেছে।্মনে মনে ভাবছি, এটা না হলে কি হত!

গাড়ী এগোল তীব্র গতিতে অন্ধকারের মধ্যে দুটি চোখ জ্বেলে তার পরবর্তী লক্ষ্যে। 
(শেষ)
রুদ্রাংশ দাস
অষ্টম শ্রেণী,সোদপুর চন্দ্রচূড় বিদ্যাপীঠ, উত্তর ২৪ পরগণা


একটু দে ভাই ঠাঁই                            
আসরফী খাতুন  

চারটে চড়াই বললো সেদিন 
খাইনি খুকু আমরা ক'দিন 
তাই তো করে ঝগড়া,
মা আমাদের চলে গেছে
কাল সকালেই মগরা।

দিন কে দিন বাড়ছে কেবল
বড়ো বড়ো বাড়ি, 
থাকার ঠাঁই নেই কো তাই
মা গিয়েছে ছাড়ি।

মায়ের কোল বাবার  আদর
আমরাও তো চাই
ভাবরে তোরা সবার কথা
একটু দে ভাই ঠাঁই।

সঙ্গীতা রানা
নবম শ্রেণি,কেশপুর গার্লস হাই স্কুল,কেশপুর , পশ্চিম মেদিনীপুর


মনরাঙানো দোল
প্রবাহনীল দাস
বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন,অষ্টম শ্রেণী, পশ্চিম মেদিনীপুর

রংয়ের খেলায় মাততে কাটাই সময় যে দিন গুনে,
দোল উৎসব দরজা নাড়ে রঙিন এ ফাল্গুনে।
পলাশ শিমুল রক্তিমাভায় মাতাল করে তোলে,
রংয়ের খেলায় সবাই মাতে বসন্তেরই কোলে।
আবির মেখে বছর বছর দোল লাগে একঘেয়ে?
সেরা দোলের অভিজ্ঞতাই শোনাই এসো গেয়ে।
পূর্ণিমাতে সবাই মিলে এসছি দেবালয়ে
দেখতে পেলাম পথশিশুরা ঘুরছে কিছু, ভয়ে।
এগিয়ে গিয়ে করলে জিজ্ঞেস, সেই খুদেরা বলে
'রংয়ের টাকা কোথায় পাবো? কী মাখাবো দোলে?'
তাদের সাথে ভাগ করে সব, খেলে দারুণ হোলি,
খুশি দিয়ে পূর্ণ করে ফিরি মনের থলি।
ভাগের মাঝেই প্রাপ্তি আছে, নেই তো খুশির সীমা,
নতুন করে বুঝিয়ে গেল ফাল্গুনী পূর্ণিমা।



স্মরণীয় দিবস
বিশ্ব কবিতা দিবস
(২১শে মার্চ) 
 দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১শে মার্চ তারিখটিকে বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো বিশ্ব ব্যাপি কবিতা পাঠ, রচনা , প্রকাশনা ও শিক্ষাকে উৎসাহিত করা। ইউনেস্কোর অধিবেশনে এই দিবস ঘোষণা করার সময় বলা হয়েছিল এই দিবস বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কবিতা আন্দোলনগুলিকে নতুন করে স্বীকৃতি ও গতি দান করবে। দিনটি বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কবি, কবিতা ও পাঠকের দিন। কবিতার  ভাবনায় ফুটে সুন্দর রূপ। কবিতার বিমুর্ততার মতো অনুভূতি ও আবেগের আধিক্য আর কোন সাহিত্যে তৈরি হয় না।
যদিও এর আগে ৫ই অক্টোবর দিনটিকে বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে পালন করা হতো। পরবর্তী সময়ে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে রোমান মহাকাব্য রচয়িতা ও সম্রাট অগাস্টাসের রাজ কবি ভার্জিলের জন্মদিন স্মরণে ৫ই অক্টোবর দিনটিকে আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস হিসেবে পালনের প্রথা শুরু হয়। ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস হিসেবে ২১ শে মার্চ দিনটিকে বাদ দিয়ে এখন কোথাও কোথাও অক্টোবর মাসে পালিত হয় কবিতা দিবস। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এই দিবসটি পালিত হয় এপ্রিল মাসে।
কবিতার সাহিত্যের একটি প্রাচীন মধুরতম শাখা। কবিতা আবেগ ও পাঠকের কল্পনাকে প্রকাশ করার জন্য ছন্দ, অলংকারে মিশ্রিত এক তরঙ্গের মতো পাঠকের মনে   এক চিত্রকল্প তৈরি হয়। মানব মননের ধ্যান ও অনবদ্য মানসিক বহিঃ প্রকাশই হলো কবিতা যা অক্ষরের  মাধ্যমে গড়ে ওঠে। ভাবনার অনুসরণ থেকে গড়ে ওঠা পঙতি মালাই হল কবিতা। কবিতা ভাব প্রকাশের ভাষা। প্রোগ্রাম মানসিক নান্দনিক প্রতিচ্ছবি। কবিতা ভালোবাসার ভাষা, কবিতা প্রতিবাদের ভাষা, কবিতা অধিকারের ভাষা, কবিতা স্বধিকারের ভাষা। কবিতা হৃদয়ের সুখানুভূতি এনে দেয়। কবিতা কালের সাথি, কবিতা সমকালের মুখপাত্র। কখনো দপ্তর হৃদয়ের আর্তনাদ কখনো ভালোবাসা অনুভূতি। কবিতা মানব জাতির অস্তিত্বগত দ্বিধাগুলির সাথে অনুরনিত হয়।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇





পাঠপ্রতিক্রিয়া
(ছোটোবেলা ১২৪ পড়ে সব্যসাচী ধর যা লিখলেন)

রবি প্রভাতে জ্বলদর্চির বার্তা এলেই মনে পড়ে যায় ঈশোপনিষদের সেই প্রথম আলোকবার্তার কথা। -- জগৎসংসার সৃষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু সূর্যালোক আসছে না। চারিদিকে অজ্ঞানের অন্ধকার। কল্যাণকামী ঋষি জগৎপোষক পূষনকে বলছেন--" হিরণ্ময়েন  পাত্রেণ সত্যসাপিহিতং মুখম্ । তৎ ত্বং পুষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।"--- হে পূষণ্, সরিয়ে নাও তোমার কুহেলির আচ্ছাদন। আমি সত্যসন্ধ্য-- সত্যকে উপলব্ধি করতে চাই। 
   সাহিত্যও  ব্রহ্মস্বরূপ। সদা সত্যের পথে, আনন্দের পথে-- তা এগিয়ে চলে। 'জ্বলদর্চি' নিষ্ঠার সঙ্গে সে কাজ করে চলেছে। সম্পাদিকা মৌসুমী ঘোষ বড় যত্ন করে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন শিশু কিশোর এবং বড়দের মনকে। সম্পাদকীয় কলমে তিনি এমন এক লেখ্যসার তৈরি করে দেন যা বর্তমানে অন্য কোথাও তেমন আর দেখা যায় না। আর এখন তো তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রঙের উৎসব আর বসন্তের ফোটা ফুলের হাতছানি। 
    জ্বলদর্চির এই সংখ্যার(১২৪) প্রথমেই শ্রীকান্ত অধিকারীর ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস--' লাচুঙের
নেকড়ে' পড়তে গিয়ে বোঝা যাচ্ছে কাহিনি ক্রমশ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। রহস্য পথের পথিকেরা গ্যাংটক শহর ছাড়িয়ে ক্রমশ লাচুঙের পথে ধাবমান। আর মাত্র ঘন্টা সাতেকের পাহাড়ি পথ। তারপরেই নেকড়ের সাক্ষাৎ নাকি? এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গান-বাজনার মধ্যে মজার এক জার্নি।
লেখকের মুন্সিয়ানাতে দারুন এক চিত্রকল্প তৈরি হচ্ছে। 
    আরো একটা মন ভালো করা লেখা মলয় সরকারের-- 'সাদা বালির খপ্পরে' ভ্রমণ কাহিনী। 
 কত অজানারে জানানোর জন্যই তিনি কলম ধরেছেন। তাঁর কলমে আমরা চলে যাচ্ছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রদেশ নিউ মেক্সিকোর দিকে। ভোর বেলায় উঠে এক বিশাল জলাভূমির দিকে যাত্রা। নিভৃত বাস্তুতন্ত্রে  কত পাখি কত বন্যপ্রাণ। লক্ষ লক্ষ পাখির ডানা ভোরের সূর্যের 'হিরণ্ময়' পাত্রকে যেন ঢেকে দিতে চায়। আবার যেন সত্যদ্রষ্টা ঋষির মতো বলতে ইচ্ছে করে-- অপাবৃণু, অপাবৃণু -- সরিয়ে নাও সরিয়ে নাও। তোমরা লক্ষ ডানা সরিয়ে নাও। চমৎকার বর্ণনা করেছেন মলয়বাবু। পরের রবিবার আমরা মনে হয় সাদা বালির খপ্পরে   পড়তে চলেছি। 
   সুখপাঠ্য , প্রাসঙ্গিক এবং স্বাস্থ্যকর আরেকটি লেখা দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে'র --"স্মরণীয় দিবস"। 
জাতীয় টিকাকরণ দিবস(১৬ই মার্চ) উপলক্ষে লেখিকা টিকাকরণের গুরুত্ব এবং আমাদের দেশ
ভ্যাক্সিনেশনের ক্ষেত্রে কিভাবে দ্রুত এগিয়ে চলেছে তার উপর তথ্যমূলক আলোকপাত করেছেন। 
   মুরলীধরের  পাশে বসে  শ্রীরাধিকা ।  এ ছবি এঁকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সোদপুরের শুভঙ্কর সেন। ক্লাস সিক্সের শুভঙ্করের ছবি পশু পাখি গাছপালাময়  প্রকৃতির সামগ্রিক চিত্রায়ন। একেবারেই শিশুশিল্পি
শ্রীজাতর ছবি দেখে মনেই হয় না সে এখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে! লুকোচুরির নিখুঁত ছবি এঁকেছে সে। তোমাদের দুজনেই বড় শিল্পির সম্ভবনা নিয়ে জন্মেছ। 
  সমাদৃতা রায়ের কবিতা -'নারী'  আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সময়কালে আবেগঘন এক বার্তা বয়ে এনেছে।  রবীন্দ্রনাথ সেই কবে লিখেছিলেন-- নারীরে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার ? " সমাদৃতা  যেন বলতে চায়-- মুক্ত করো ভয় , আপনা মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়। 
  রূপা চক্রবর্তীর  পলাশের মধুমাসের নিরিখে -- 'পলাশ'  কবিতাটি দুর্দান্ত। -- "ভুলটি করে অচেনাতে
দিও না কেউ আড়ি।" আহা। মনে রাখার মতো, মনে রাখার মতো। 
   চলো, সবাই মিলে জ্বলদর্চির আড়িবিহীন সাহিত্য আড্ডায় প্রাণ খুলে মনের কথা লিখে চলি, পড়ে চলি।


Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর হয়েছে

    ReplyDelete