জ্বলদর্চি

দেশান্তরী -১০/হিল্লোল রায়


দেশান্তরী -১০

হিল্লোল রায় 

আসামী হাজিরকান্ডারী হুঁশিয়ার

স্পনসরশিপ সার্টিফিকেটের আশায় তখন দিন গুনছি। নিয়মিত অফিস যাওয়া -আসা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। হঠাৎ ৫ই সেপ্টেমবর ১৯৭৪ বৃহস্পতিবার অফিস থেকে বাড়ী ফিরে এসে মেজমামার পাঠানো স্পনসরশিপ সার্টিফিকেট (এফিডেভিট অব সাপোর্ট সার্টিফিকেট ফ্রম হিজ প্রেজেন্ট এমপ্লয়ারপেয়ে ভীষণ আনন্দ হল। এ দিকে কনসাল অফিস থেকে কোন সাড়াশব্দ অবশ্য তখনও পাইনি । অফিস যাওয়ার ফাঁকে ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ মংগলবার মিঃ সিনহার আয়োনা ট্র্যাভেলস অফিসে আমার পাসপোর্ট সংক্রান্ত ব্যাপারে খোঁজ নিলাম। কিন্তু তিনি কোন খোঁজই করেন নিআমার পাসপোর্ট রেডি হয়েছে কি নানিজেও মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম মিঃ সিনহার নিষ্ক্রিয়তায়। ঠিক করলাম পাসপোর্ট এ্যাপ্লিকেশান ফি জমা দেবার টোকেন (TOKEN) খানা নিয়ে আমি নিজেই পাসপোর্ট অফিসে খোঁজ করব। বেশ মনে আছে১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সোমবার হাবড়া থেকে ৮-০৮ মিঃ এর ট্রেনে করে এসে পাসপোর্ট অফিসচার নং ব্র্যাবোর্ন রোডকলকাতা -১ এর দ্বিতীয় তলে জনৈক “বিশ্বাস” বাবুর নাম করে হাজির হলাম। বিশ্বাস বাবুর নাম জোগাড়ের ঘটনাটাও মজার।

আমার হাবড়া হাই স্কুলের ছাত্রাবস্থার ৮ম শ্রেণীর বন্ধু শ্রীমান সমীর রায়-যিনি বর্ত্তমানে কলকাতা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনে কর্মরত -এর দূর সম্পর্কের আত্মীয় হলেন এই বিশ্বাস বাবু। খোঁজ নিয়ে জানলাম পাসপোর্ট রেডি। টোকেন নিয়ে হাজির হলেই পাস্পোর্ট পেয়ে যাব। ভিষণ আনন্দ হচ্ছিল। সিনহার উপরে মনে মনে রাগ হচ্ছিল ওর নিষ্ক্রিয়তার জন্য।

পাস্পোর্ট অফিস থেকে সোজা চলে গেলাম আমার কর্মস্থলে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভারতীয় মানক সংস্থা কঙ্কাতা শাখার সঞ্চয় ঘোষকে জানিয়ে দিলাম “পাসপোর্ট রেডি।” এদিকে মিঃ সিনহার সন্ধানে আমি তখন ঘুরছি। কারণ ওঁর আয়োনা ট্র্যাভেলস অফিসে দেখা পাওয়া দুষ্কর। এ ছাড়া ওঁর বাড়ীতে টেলিফোনে (নং-৩৫-৮৭৪৩ও না পেয়ে বেশ বিরক্ত লাগত। সেপ্টেম্বর ২৪ ১৯৭৪ মহালয়ার দুপুর ২-৩০ মিঃনাগাদ ওঁর বাড়ীতে ফোন করতেই মিঃ সিনহা জানালেন সেপ্টেম্বর ২৬ ১৯৭৪ বৃহস্পতিবার। উনি আমার পাসপোর্ট ডেলিভারী দেবেন । আমিও ২৬ সেপ্টেম্বর '৭৪ বেলা ১০-১৫ মিঃ নাগাদ আয়োনা ট্র্যাভেলস অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু মিঃ সিনহার দেখা পেলাম না। আমার টোকেনটাও পেলাম না সিনহার সংগে দেখা না হওয়ায়। এর পরদিন অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর '৭৪ আমেরিকান কন্সাল অফিসে বেলা ১১টা নাগাদ ফোন করলাম। উত্তর পেলাম, “ ওয়েট ফর ওয়ান মান্থ স্টিল।” নিরূপায় হয়ে তখন ধৈর্য্যের পরীক্ষাই দিচ্ছি। সিনহার দর্শন লাভ তখন মনে হচ্ছিল যেন দেবদর্শন তূল্য। টেলিফোনে ওর বাড়ীতেও খবর পাই না। মুস্কিলে পড়লাম। বেশ বিরক্তি বোধ জন্মাল মিঃ সিনহার উপর কর্তব্যজ্ঞান হীনতার জন্য। মাঝে মাঝে অফিস আসবার আগে মিঃ সিনহার অফিসে ঢুঁ মারি। কিন্তু দেখা পাই না। অবশেষে দেখা পেলাম ৯ অক্টোবর১৯৭৪ বুধবার । কিন্তু আয়োনা ট্র্যাভেলস এর আভ্যন্তরীণ মেরামত কাজ চলার জন্য সমস্ত কিছু অগোছালো থাকায় আমার টোকেন সেদিন পেলাম না। আবার অপেক্ষা দুদিনের।


দৌড়ঝাঁপ করে অনেক কষ্ট করে সিনহার দেখা পেলাম ১২ অক্টোবর ১৯৭৪ শনিবার। ঐ দিনই টোকেন নিয়ে ছুটলাম রিজিয়ন্যাল পাসপোর্ট অফিস৪ ব্র্যাবোর্ন রোডকলকাতা-১ এ। কিন্তু “সেকেন্ড স্যাটার্ডে”র জন্য সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের সমস্ত অফিস ছুটি। কাজেই আমার পরিশ্রমটুকু পন্ড হল। পাসপোর্ট পেলাম না সেদিন। এদিকে আমি একটু ব্যস্ত হচ্ছিলাম কারণ অক্টোবর মাসে পূজার ছুটি ও আনুষঙ্গিক অনেক ছুটি থাকে। পাসপোর্ট না পাওয়া পর্য্যন্ত মনের শান্তিও হচ্ছিল না।

বেশ মনে আছে১৬ই অক্টোবর ১৯৭৪ বুধবার নিজে ব্র্যাবোর্ণ রোডের অফিসে গিয়ে পাসপোর্ট জোগাড় করেছিলাম। মনে তখন ভিষণ আনন্দ। আমেরিকা যাবার পথে ভারত সরকারের ছাড়পত্র অর্থাৎ পাসপোর্ট পেয়ে গিয়েছি। এখন শুধু ভিসা পাবার চিন্তা। মনের আনন্দে এক জোড়া হাওয়াই চটিও কিনে ফেললাম ১৬ই অক্টোবর ১৯৭৪।

অন্য আর একটা দিক নিয়ে তখন আমার চিন্তাধারা বাঁক নিয়েছে। আমেরিকান কনস্যুলেট অফিসে চলে গেলাম ৩১ অক্টোবর ১৯৭৪ বৃহস্পতিবার । রিসেপশনিস্ট এর অনুমতি নিয়ে টপ ফ্লোরে চলে গেলাম মিঃ হিতব্রত রায়ের সংগে দেখা করতে। মিনিট পনেরো আলোচনা করলাম 7-50A ফর্ম জমা দেবার পরবর্তী অধ্যায় প্রসংগে। ওখান থেকে বেলা ১১-১৫ মিঃ নাগাদ রওনা হলাম আমার অফিস। নিত্যনৈ্মিত্তিক অফিস যাওয়া ও বন্ধু সঞ্চয় ঘোষের সংগে যোগাযোগ রেখেই আমার দিন কাটে।

অফিস যাওয়া আসাটা এর মধ্যেই বেশ বিরক্তিজনক হয়ে উঠেছেবিশেষ করে কন্সাল অফিস থেকে ভিসার ব্যাপারে কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায়। রোজই বাড়ী এসে উত্তর পাই, “আজও কোন চিঠি আসে নি।” মনটা বিষিয়ে যায়। এর মধ্যে আবার নতুন চিন্তা শুরু হল ডাকের গোলমাল অর্থাৎ পোস্ট্যাল ইরেগুলারিটিজ। ভাবছি চিঠিপত্র তো হারিয়েও যেতে পারেকিংবা যদি না পেয়ে থাকি-ইত্যাদি ধারণাগুলো মনে আসছে।

শেষ পর্য্যন্ত সমস্ত ধারণাকে ভুল প্রতিপন্ন করে কনস্যুলেট অফিসের সাড়া পেলাম নভেম্বর ৭১৯৭৪ বৃহস্পতিবার । পৈ্টিক গোলোযোগ থাকায় এদিন অফিস যেতে পারি নি। আর্গোসির চার দেওয়ালের মধ্যেই শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছিলাম। দুপুর একটা নাগাদ আমাদের হিজলপুকুরিয়া ডাকঘরের মেলম্যানপ্রফুল্ল চন্দ্র চক্রবর্ত্তীএকটা হলুদ রঙের খাম এনে হাজির করল র্গোসিতে। একপ্রান্তে কন্স্যুলেট অফিসের ঠিকানাঅন্যা প্রান্তে আমার । সেলোটেপ মোড়া খামখানা সযন্তে খুললাম। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম আমার ঈপ্সিত জিনিষকে পেয়ে। অর্থাৎ এতদিন পরে 7-50A ফর্মের উত্তর ৭ নভেম্বর১৯৭৪ পেলাম। এই খামের মধ্যে হল 'DSL 869(approval of U.S. Govt. for Labor Certification) এবং DSP 70 (Biographical Data For Visa Purposes) ফর্মগুলো পেলাম। ঠিক এদিনেই G.O.I.(Govt. Of India), ট্রেনিংয়ের ইন্টারভিউ কলও পেলাম।

বসে আছি পথ চেয়ে

শারীরিক অসুস্থতায় শীতের দুপুরে আমেজ করে ঘুমাবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঐ ফর্ম দুখানা পেয়ে নিদ্রাদেবী সসম্মানে তখন পলায়ন করেছেন। কিছুতেই ঘুম আসছে না। মনটা তখন উড়ুউড়ু।

G.O.I.অর্থাৎ Govt. Of India, B.E. পাশ করার পর ২৫০ টাকার(প্রতি মাসেযে ট্রেনিং এক বছরের জন্য ব্যবস্থা করে থাকেন-তার ইন্টারভিউ লেটারও পেয়েছিলাম একই দিনে অর্থাৎ নভেম্বর ৭১৯৭৪ বৃহস্পতিবার। G.O.T ইন্টারভিউ দিন স্থির হল নভেম্বর ২৬১৯৭৪ কিন্তু DSL 869 ফর্ম পাবার পর ভিসা পাবার ব্যাপারে এত বেশী সুনিশ্চিত হয়ে গেলাম যে G.O.I এর জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেলাম না।


DSL 869 এবং DSP-70 ফর্ম দুটো পাবার সংগে সংগেই আমার কর্মব্যস্ততা আবার শুরু হল। কন্সালেট অফিস ঐ ফর্ম দুটো পোস্ট করেছে ৭ অক্টোবর '৭৪ কিন্তু ডাকের গোলামালে আমি প্রায় এক মাস বাদে পেলামযেখানে ৩ দিনে পাওয়ার কথা।

একেই অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে তাই আর এক মুহূর্ত্ সময় নষ্ট না করে আদাজল খেয়ে লাগলাম। ঐদিনই অর্থাৎ নভেম্বর ৭১৯৭৪ সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ হাবড়া অঞ্চল পঞ্চায়েতের অঞ্চল প্রধান শ্রীযুক্ত প্রভাত রায়ের বাড়ীতে গিয়ে হাজির হলাম শীতের সন্ধ্যা সাতটা মানে নিঝুম নিস্তব্ধতা চারিদিকে বিরাজমান অর্থাৎ লোকজন নেহাৎ খুব প্রয়োজন না থাকলে বাইরে বেরোয় না।

আমিও প্রয়োজনের তাগিদে প্রভাতবাবুর বাড়ী গেলাম। বুঝিয়ে বলতেই তিনি সানন্দে রাজী হলেন বার্থ সার্টিফিকেট দিতে।

এই সমস্ত সেরে আর্গোসিতে ফিরতে বেলা প্রায় ১২টা । ক্ষিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে। কিন্তু আমার পণ তখন “শরীর মাদ্যং খলু ধর্মসাধনম।” দুপুরে স্নানাহার সেরে মিনিট পনেরো বিশ্রাম নিয়ে DSP 70 ফর্ম পূরণের কাজে লেগে গেলাম। শীতের দুপুর দেখতে দেখতেই কেটে যায়। DSL 869 ফর্ম জমা দেবার সময় আনুসঙ্গিক একগাদা সার্টিফিকেট প্র্য়োজন হবে। বিশেষ করে পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট এবং এর জন্য আবার বিকালে ছুটলাম প্রভাত বাবুর বাড়ীতে। সুরাপানে মত্ত থাকায় প্রভাতবাবুর সংগে কথা বলবার সুযোগটুকু পর্য্যন্ত পেলাম না। ওর সাঁকরেদ সুনীল মিত্রের পরামর্শ অনুযায়ী ৯ই নভেম্বর '৭৪ শনিবার সকালে আবার প্রভাতবাবুর সংগে এ্যাপয়েন্টমেন্ট রইল। সুরার নেশা ততক্ষণে হ্রাস পেয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

কিন্তু আমার নিজের প্রয়োজনটা এত বেশী যেসময় নষ্ট করবার কোনই ফুরসৎ আমার নেই। কাজেই বিকল্প পথের সন্ধানী হলাম। বাল্যবন্ধু সঞ্চয় ঘোষের সংগে পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিয়ে আলোচনা করেছিলাম আর্গোসিতে বসে সান্ধ্য মজলিশে। সিংগাড়াচপমসলামুড়ি ও চা এর সৎ্কারও হচ্ছিল আমাদের তিনজনের সান্ধ্য আড্ডায়। এই তিন মক্কেল হলেন তুষার নিয়োগীসঞ্চয় ঘোষ ও 'শ্রীমান'। বিকল্প পথ ঠিক করেই রেখেছিলাম-প্রভাতবাবুর সহায়তা না পেলে হাবড়া শ্রীচৈতন্য কলেজের বাংলা সাহিত্যের প্রধান অধ্যাপক ডঃ সুবোধ চন্দ্র চৌধুরীর (প্রামাণিকসংগে যোগাযোগ করবার।

যেমন কথা তেমনি কাজ। শুক্রবার ৮ নভেম্বর'৭৪ সন্ধ্যা ৬-৩০ টা নাগাদ প্রভাতবাবুর কাছ থেকে নিরুৎসাহ হয়ে একা ফিরে আসছি। ফেরার পথে ডঃ সুবোধ চৌধুরীর(ভদ্রলোক আগে 'প্রামাণিকছিলেনসম্প্রতি এফিডেভিট করে 'চৌধুরীহয়েছেনবাড়ীতে পদার্পণ করলাম। ভদ্রলোক বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হলেও হাবড়া শ্রীচৈতন্য কলেজের এন.সি.সি.(ন্যাশন্যাল ক্যাকেড কোরসশাখার ক্যাপ্টেন। সেই সূত্রেই ডঃ চৌধুরীর হাবড়া থানার অফিসার মহলে দহরম-মহরম। ডঃ চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসবার সুযোগ আমার এই প্রথম এবং নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদেই। ভদ্রলোক আমার পাড়া-প্রতিবেশী এবং আমি ওঁর সম্পর্কে খুব একটা ধারণা না থাকলেও উনি আমার নাড়ী-নক্ষত্রের খবর জানেন শুনে আবাক হয়ে গেলাম। জানি নাআমার হাঁড়ির গতিবিধি কেমন করে ওঁর নখদর্পণে। পড়াশোনায় ভাল থাকায় ও সাহিত্যিক মহলে আমার অল্পবিস্তর আসাযাওয়া থাকায় ডঃ চৌধুরীর সুনজরেই পড়লাম। কাজেই আমাকে নিজের পরিচয় দেওয়ার আগেই ডঃ চৌধুরী সস্নেহে আলিংগন করলেন। আমার তখন আনন্দাশ্রু বইছে চোখে।

দুচারটে কথা হওয়ার পরই আমার আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম সুবোধ বাবুর কাছে। পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেটের ব্যাপারে উনি যথাসাধ্য সাহায্য করবেন-আশ্বাস দিলেন।

বেশ মনে আছেনভেম্বর ৮১৯৭৪ শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ সুবোধ বাবুর সংগে হাবড়া থানায় গেলাম সার্টিফিকেটের ব্যাপারে। থানার বড় বাবু তখন ছিলেন না। কাজেই আমরা দুজনে বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। শীতের কাঁপুনি বিরক্তিকর লাগলে সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছিলাম।

আধ ঘণ্টা অপেক্ষার পর বড়বাবুর দর্শন মিলল। হাবড়া থানার বড়বাবু সম্প্রতি বদলী হয়ে এসেছেন এবং ভদ্রলোক একটু রগচটা ধরণের। তা ছাড়া এন.সি.সিক্যাপ্টেন সূত্রে ডঃ চৌধুরীর সংগে থানার মেজবাবুর পরিচয় ও খাতির বেশী। ডঃ চৌধুরী ও তাই কিছুটা সন্দিহান ছিলেন সার্টিফিকেট প্রাপ্তি সম্পর্কে।

দলিত কুসুমে বহিল বসন্তসমীরণ

কথায় বলে “স্বদেশে পুজ্যতে রাজাবিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে,” রগচটা হলে কি হবেহাবড়া থানার বড়বাবু ঘরে ঢুকতেই বল্লেন,

-গুড ইভনিংডঃ চৌধুরী। মে আই হেল্প ইউ?

বাংলার অধ্যাপক হওয়ায় ডঃ চৌধু্রী ও যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে থানায় পদাপর্ণের উদ্দেশ্য বল্লেন পরিস্কার বাংলাভাষায় (আমাকে দেখিয়ে)-

-আমার ছাত্র শ্রীহিল্লোল রায় সিভিল ইঞ্জিনীয়ারউচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকায় যাবার সুযোগ পেয়েছে। ওর ভিসা পাওয়ার আগে আমেরিকান কন্সাল অফিসে একটা পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট চাইএ জন্য আপনার কাছে আমরা এসেছি।

-আচ্ছাআপনি হায়ার স্টাডিজ এর জন্যই আমেরিকা যাচ্ছেন?

থানার বড়বাবু আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ।

-খুবই আনন্দের কথাসন্দেহ নেই।

-হ্যাঁ।

ডঃ চৌধুরী আমার সম্পর্কে কিছুটা 'ইমেজতুলে ধরলেন বড়বাবুর কাছে ।

-জানেন তোআজকালকার এই পড়াশোনার ডামাডোলের বাজারে ভাল ছাত্র পাওয়া খুবই মুস্কিল। তবুও এর মধ্যে দু-চারজন ভাল ছাত্র আমরা পাই-যারা সত্যিকারের ভাল ছেলে। আমাদের সরকার এঁদের সম্পর্কে নিতান্তই উদাসীন। তা না হলে কেউ নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে চায়সুবোধ বাবুর কথা শুনে হাবড়া থানার বড়বাবু বেশ কিছুটা “ইম্প্রেসড” হলেনমনে হল। আমিও ভাবছিলাম সার্টিফিকেট আজকেই পাব নিশ্চয়ই।

আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিলযখন আমার পরিচয় প্রসংগে ডঃ চৌধুরী বড়বাবুর কাছে আমাকে ওঁর ছাত্র হিসাবে তুলে ধরলেন। কস্মিনকালেও আমি ডঃ চৌধুরীর ছাত্র নই কারণ হাবড়া হাই স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করার পর সোজা শিবপুর বেংগল ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ভর্ত্তি হয়েছিলাম। শ্রীচৈতন্য কলেজে আমি পড়াশোনাই করিনি। তাই অতিকষ্টে সৌজন্যের খাতিরে হাসিটাকে দমন করছিলাম। অবশ্য একটা কথা মনের কোণে উঁকি দিচ্ছিল। সম্ভবতঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা কোনো এক কবিতার শেষ দুটি লাইনঃ

এই পৃ্থিবীর বিরাট খাতায়পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায়শিখছি সে সব কৌ্তূহলেনেই দ্বি্ধালেশ মাত্র। শিখতে হবে অনেক কিছুই কারণ সবার আমি ছাত্র।”

ডঃ চৌধুরীর সান্নিধ্য পেয়েছি-এটাই আমার সৌভাগ্য। সার্টিফিকেট প্রসংগে আলোচনা তখন ডঃ চৌধুরী ও বড়বাবুর মধ্যে চলছে। আমি শ্রোতা হয়ে রইলাম।

আলোচনার বিষয় বস্তু গিয়ে দাঁড়ালো-হাবড়া থানা থেকে সোজাসুজি কোনো সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষমতা বড়বাবুর নেই। এই সম্পর্কে পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেট আলিপুর ২৪ পরগণা থেকে ডিস্ট্রিক্ট ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ(আন্দুল রাজ রোডঅফিসে অনুরোধ যাবে এবং ডি.আইবিঅফিস থেকে হাবড়া থানায় খবর এলেই তবে এনকোয়ারী হবে-তার আগে নয়। অর্থাৎ মাস খানেকের ধাক্কা। তবে হাবড়া থানার বড়বাবু যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি এনকোয়ারীর ব্যবস্থা করবেন বলে আমাদের আশ্বাস দিলেন।

আশ্বাসের উপর ভিত্তি করা ছাড়া আমার কোনো উপায়ান্তর নেই। আমাদের সার্টিফিকেট সংক্রান্ত আলোচনাকালীন হাবড়া থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসের আই.বি অর্থাৎ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ ইন চার্জ মিঃ অনিল জোয়ারদার উপস্থিত। ভদ্রলোক ও আমাকে যথেষ্ট আশ্বাস দিলেন সার্টিফিকেটের ব্যাপারে যথাসাধ্য সাহায্য করবেন বলে। মিঃ জোয়ারদারের সংগে আমার আলোচনার আংশিক বিবরণঃ-

-আচ্ছাআপনাদের কোন বাড়ীটা বলুন তো?

-হিজলপুকুরে ডঃ নিয়োগীর বাড়ী। ডঃ নিয়োগীআমার দাদামশায় হন।

-আচ্ছা। আমি তো ঐ বাড়ীতে বেশ কয়েকবার ইন্সপেকশনে গিয়েছি। আপনাদের বাড়ীর সবার তো ইন্টারন্যাশ্নাল পাস্পোর্ট আছে।

-হ্যাঁ।

-ঠিক আছে। আপনার কোন চিন্তা নেই। আলিপুর থেকে এঙ্কোয়ারীর খবর এলে আমি হাবড়া থানায় বসেই আপনার সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেবো। আপনার বাড়িতে এনকোয়ারী করার কোনই প্রয়োজন নেই। আপনি একটা এ্যাপ্লিকেশন লিখে আলিপুর পুলিশ সুপার মিঃ অমল দত্তর কাছে জমা দিন এবং আপনার আর্জেন্সিটা ওঁকে বুঝিয়ে বলুন। তা হলে তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবেন সার্টিফিকেটটা।

আমরাও তথাস্তু বলে হাবড়া থানা থেকে বেরুলাম রাত ৮-৩০ নাগাদ । ডঃ চৌধুরী ও আমি তখন বাড়ীর পথে । আলোচনার সফলতা নিয়ে কথা বলছি।

ক্রমশ

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments