জ্বলদর্চি

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে-৩/ মলয় সরকার

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে 

মলয় সরকার

পর্ব-৩(তৃতীয় পর্ব)

তার পর সে নিজেই দরজা খুলে ঢুকে পড়ল আমাদের গাড়িতে। স্টার্ট দিয়ে চালাতে চেষ্টা করল। উদ্দেশ্য, পিছিয়ে গিয়ে গাড়ী বের করে আনবে।নাঃ, এবারেও হল না।সুক্ষ্ম সাদা বালিরা যেন মজা পেয়েছে। তারা যেন বলছে, যেমন আমাদের গায়ে হাত দিয়েছিস, মজা দেখাচ্ছি! সে বেটিও ছাড়বার পাত্রী নয়। তখন একটু চিন্তা করেই ,ফোনে কাকে কি বলল। একটু পরেই দেখি আর একটি গাড়ি হুটার বাজিয়ে চলে এল সেই অন্ধকার ফুঁড়ে।এসে, তার ড্রাইভার চট করে গাড়ী থেকে অন্য গাড়ি টানার মোটা তার বের করল। তারপর আমাদের গাড়ীর পিছনের দিকে বেঁধে ফেলল চটপট। আমরা তো কাণ্ডকারখানা দেখে থ’।কি কুক্ষণে যে এই সাদা বালির খপ্পরে পড়েছিলাম কে জানে!
ব্যস, সে মেয়ে বসল , আমাদের গাড়ীর স্টিয়ারিং ধরে।টান পড়ল পিছনে।’বাপ বাপ’ বলে সাদা বালির দল গাড়ি ছেড়ে দিতে পথ পায় না। গাড়ি উঠে এল আবার রাস্তায়, বালির খপ্পর থেকে মুক্ত হয়ে। নিজের বুকে হাত দিয়ে দেখলাম, নিঃশ্বাসটা যেন একটু জোরেই পড়ছে। স্বস্তির নিঃশ্বাসটা বেশ আরাম করেই ছাড়লাম।

মেয়েটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমার ছেলেকে হেসে বলল, এখন তোমার গাড়ি মুক্ত , তুমি যেতে পার। সে তো, কি বলে যে ধন্যবাদ দেবে, বুঝে পায় না। আমাদের সবার মুখে হাসি, চোখে আনন্দাশ্রু। ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা হারিয়ে গেছে। ফাইনের তো কোন কথাই নেই।রেঞ্জার বলল, না না, এটা কোন ব্যাপার নয়। ঠিক আছে। তোমাদের অসুবিধা হয়েছে, হঠাৎ বিপদে পড়েছ, এটুকু না করলে আর সরকার আমাদের টাকা দিয়ে রেখেছে কেন। সবার সুবিধা অসুবিধা দেখার জন্যই তো আমরা আছি।বুঝতেই পারছি, তোমরা তো আর ইচ্ছা করে কিছু কর নি, হঠাৎ বেকায়দায় হয়ে গেছে।
তার এই কথা শুনে আমার ছেলে আর আমরা তো স্তব্ধ। হঠাৎ বুদ্ধি করে ছেলে বলল, তোমাকে কিছু দেওয়ার বা কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। তুমি আমার মায়ের হাতে বানানো এই কেকের টুকরো ক’টা নিলে খুশি হব।
সে তো খুব খুশী হয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, দাও।

আমরা তাকে আর একবার ধন্যবাদ দিয়ে আর বিপদতারণ মদুসূদনকে স্মরণ করে এগোলাম মরুভূমি ছেড়ে গেটের দিকে।বুকটা তখন দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে অনেক হাল্কা হয়ে গেছে।মনে মনে ভাবছি, এটা না হলে কি হত!

আমি তখন নিজের মনের গভীরে ডুব দিয়ে ভাবছি, এই বিদেশে অপরিচিত জায়গায়, ততোধিক অপরিচিত একটি অল্পবয়সী মেয়ে যে মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এসে এক বিপদগ্রস্ত পরিবারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল, এবং শুধু এগিয়ে এল বলে নয়, আপ্রাণ চেষ্টা করে বিপন্মুক্ত করে স্বস্তির আলো দেখাল, তা হয়ত পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও লেখা থাকবে না, কিন্তু আমার মনের মণিকোঠায় সেটা যে চিরকাল ঊজ্বল হয়েই থাকবে, এটা হলফ করেই বলতে পারি।ভাবছিলাম, আমার দেশের মেয়ে হলে এরকম করে কি করত? কে জানে–

গাড়ী এগোল তীব্র গতিতে অন্ধকারের মধ্যে দুটি চোখ জ্বেলে তার পরবর্তী লক্ষ্যে।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



রাস্তায় যখন যাচ্ছি। চারিদিক তো নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে। এর মধ্যে দেখি রাস্তাময় চতুর্দিকে দৌড়োদৌড়ি করছে অসংখ্য আলোর বিন্দু। গাড়ি চলেছে প্রচণ্ড গতিতে, হবেই, ফাঁকা হাইওয়ে। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওই আলোর ফুটকি গুলো কি? ও নিরুত্তাপ ভাবে জবাব দিল বুনো খরগোশ, এখানে বলে Bunny. আমরা চমকে উঠলাম, আহা, যদি গাড়ির তলায় মারা পড়ে? ও বলল, পড়তেই পারে, কিছু করার নেই।মারা পড়েও এখানে। কত হরিণ , বুনো শুয়োর , স্কাংক ইত্যাদি যে মারা পড়ে গাড়ির চাকায়, তার ঠিকানা নেই। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। 

 বেশ রাতে এসে পৌঁছালাম হোটেলে। আজ পৌঁছালাম সান্তা ফে তে (Santa Fe)

আমেরিকার আদিম মানুষের সন্ধানে এসে আগের দুটি দর্শনীয় হল আমার বাড়তি পাওনা।এবার এখান থেকেই হবে আমার আসল খোঁজের শুরু।

আসলে এই যে আদিম মানুষেরা, যারা বাস করত আমেরিকার মূল ভুখণ্ডে, আলাস্কায় বা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ গুলিতে, তাদের কখনও বলা হয় নেটিভ আমেরিকান, কখনও আমেরিকান ইণ্ডিয়ান, কখনও শুধুই ইণ্ডিয়ান।  এই ইণ্ডিয়ান শব্দটি এদের সাথে জুড়েছে প্রথম ইউরোপিয়ান, ১৪৯২ সালে যিনি এখানে এসেছিলেন, সেই কলম্বাসের ভুলের ফলে।তিনি ভেবেছিলেন ভুল করে যে, ভারতে পৌঁছেছেন।আর এ ভুল চলেছিল যতদিন না আমেরিগো ভেসপুচি( এখানে পৌঁছেছিলেন ৭ই আগষ্ট ১৫০১) এই ভুলটা ভেঙ্গে দিলেন।তবে ততদিনে এদের নামের সাথে ইণ্ডিয়ান শব্দটি জুড়ে গেছে।

এদের বিভিন্ন উপজাতিদের ধারাগুলো যদি আলাদা ভাবে ধরা যায়, তাহলে না কি বর্তমানে স্বীকৃত ধারার সংখ্যা ৫৭৪ এর কাছাকাছি। 

এরা ইংরাজী ছাড়াও যে যে ভাষায় কথা বলে সেগুলি হল,নাভাহো, ডাকোটা, সেনেকা,কেরেস, তেয়া, এপাচে, যুনি, মোডোক,ক্রীক ইত্যাদি

ধর্মের দিক থেকে বেশিরভাগই এরা হয় প্রোটেস্ট্যান্ট বা ক্যাথলিক খ্রীষ্টান।তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের নিজস্ব আদিম আচার বিচার মিশে গিয়ে এক জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে।


এই সেই সান্তা ফে, যা হল নিউ মেক্সিকোর রাজধানী ।এখানে বিশেষ করে দুটি সংস্কৃতি যেন অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে। তা হল, স্প্যানিশ ও এখানকার আদিবাসীদের যে প্রাচীন সংস্কৃতি।এই শহরটি স্থাপিত হয়েছিল ১৬১০ সালে এবং স্প্যানিশরাই এটি তৈরী করে।এটিই আবার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম রাজধানী শহর।এই  Santa Fe শব্দটি হল স্প্যানিশ , যার অর্থ পবিত্র বিশ্বাস বা Holy faith।এখানে ইংরাজী ও স্প্যানিশ দুটি ভাষাই চলে।

পরদিন ঘুম থেকে ওঠা হল একটু বেলা করে। কারণ আগের দু দিন রাতে শোওয়ার একটু ধকল গেছে ঘুমের উপর। প্রথম দিন শোওয়া প্রায় হয় নি আর দ্বিতীয় দিন সাদা বালির কামড় থেকে বেঁচে বাড়ি ফিরে তার উদবেগের ধকল সামলাতেই সময় গেছে।

তাই স্থির হয়েছিল আজ আর বেশি দূর যাব না।কাছাকাছিই থাকব। সকালে উঠেই গেলাম বিখ্যাত Canyon Roadএ। এরকম যে একটা রাস্তা হয় জানাই ছিল না।তার থেকেও যা কষ্টদায়ক তা হচ্ছিল, আন্দাজ করে জামাকাপড় গাড়ীতে সঙ্গে আনলেও বেশি পরে বের হই নি। রাস্তায় ,শেষ নভেম্বরের সকালের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হাত পা জমে যাওয়ার অবস্থা।হবে না-ই বা কেন! এখানে নভেম্বরে সাধারণতঃ -৪ ডিগ্রী থেকে + ১১ ডিগ্রীর মধ্যে তাপমাত্রা ঘোরাঘুরি করে। তা আমাদের মত বোকারা যদি সব জেনেও গরমের জামাকাপড় গায়ে না চাপিয়ে বের হয়, শীত তাহলে ছেড়ে দেবেই বা কেন! অবশ্য, সঙ্গে সঙ্গেই,  গাড়ী থেকে, যত শীতের জামা কাপড় ছিল ,আগে টেনে নামানো হল। এবার খুঁজতে হচ্ছে, কোথায় একটু আড়াল পাওয়া যায়, যেখানে এই বেশ পরিবর্তন করা যায়। রাস্তায় লোকজনের মাঝে দাঁড়িয়ে তো আর তা করা যায় না। সৌভাগ্যবশতঃ কাছেই একটা ‘রেস্ট রুম’ পাওয়া গেল। সেখানেই  ঢুকে একেবারে ‘মঙ্গলগ্রহের নভশ্চর’ হয়ে বেরোলাম এক এক করে সবাই।এবার একটু আরাম করে ঘোরা যাবে।
এই Canyon Road এর বিশেষত্ব হল এখানে সমস্ত নামী আর্টিস্ট এবং ভাস্কররা রাস্তার দুপাশে তাঁদের বাড়ি বা গ্যালারী বানিয়েছেন। তাঁরা নিজেদের ঘরের ভিতর , রাস্তায় , বাগানে সুন্দর সুন্দর মূর্তি, নানা রকম ভাস্কর্য বানিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য। 

এই জায়গাটায় ,অনেকদিন আগে আদিবাসীরা এই সান্তা ফে নদীর  আশেপাশে চাষবাসই করতেন।বিশেষ করে ভুট্টা এবং গমই ফলত।অবশ্য এখানে চাষ এত সহজ ছিল না। আসলে এই অঞ্চল টা একটা উঁচু মরুভূমির মত তো।তবু পাহাড়ের উপরের বৃষ্টিপাতই এদের ভরসা ছিল।

এরকম চলেছিল অনেকদিন। পরবর্তী কালে ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দের পর কিছু শিল্পী চিত্রকর এখানকার প্রকৃতির রূপে, নৈসর্গিক দৃশ্যে আকৃষ্ট হয়ে এখানে বাস করার সিদ্ধান্ত নেন।ক্রমে সবাই লক্ষ্য করেন যে, এখানকার শুষ্ক আবহাওয়া, পরিষ্কার বাতাস সর্দি কাশি ও অন্যান্য নানা শ্বাস সম্পর্কিত অসুখ বিসুখে খুব ভাল উপকার দিচ্ছে। তখন আরও বেশি মানুষ এখানে আসতে শুরু করেন। তার মধ্যে ১৯০৪ সালে Carlos Vierra নামে একজন শিল্পী ব্যবসায়িক  ভাবে এখানে স্থায়ীভাবে আসেন শিল্পের গোড়াপত্তন করতে। অবশ্য সঙ্গে তাঁর শ্বাসের সমস্যাও ছিল। এর পর ধীরে ধীরে আসতে থাকেন ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অনেক শিল্পী বিভিন্ন দেশ থেকে। এর ফলে এখানে একটি স্থায়ী শিল্পী গোষ্ঠীর আড্ডা তৈরী হয়।এঁরা স্থানীয় যে চিরন্তন অঙ্কন বা শিল্প ধারা চলে আসছে, তাকেও অস্বীকার না করে, তা আত্মস্থ করে এক মিশ্র শিল্পধারার জন্ম দিলেন।তাঁরা স্প্যানিশ ভাষায় এই গ্রামকে বলতেন পুয়েব্লো (Pueblo) ফলে এর নাম হল Spanish-Pueblo Style।শুধু যে স্প্যানিশ শিল্পীরাই এর মধ্যে ছিলেন তা নয়, ইউরোপের বিভিন্ন জায়গার শিল্পীরাই হাজির হয়েছিলেন এখানে। এইবার তাঁদের দেখাদেখি এবং অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে হাজির হলেন হোটেল, বার রেস্তোরাঁ, মুদিখানা ফটোগ্রাফার, জুয়েলারী, মৃৎশিল্প ইত্যদি নানা শ্রেণীর মানুষ তাদের নানা ব্যবসায় নিয়ে। ফলে Canyon Road হয়ে উঠল জমজমাট। আর এদের এই শিল্প কলা এবং বিচিত্র ধর্মের এই রাস্তার সৌন্দর্য্যের জন্য ভিড় জমাতে লাগল সারাদেশের শুধু নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ।
আমরা সত্যিই এই রাস্তায় খানিকক্ষণ হেঁটে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।কত যে স্টুডিও রয়েছে গুনে শেষ করা যাবে না। অনেকেই বলছে কিনুন আর না কিনুন, দেখে যান। আমরা তাদের আহ্বানে গেলাম অনেক 
স্টুডিওর ভিতরে। বিচিত্র রকমের জিনিস ও তার শিল্পনৈপুণ্য দেখে সত্যি মন ভরে গেল।

শিল্পীদের অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তাও হল। তাঁরাও দেখলাম, বেশ ভাল করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, শিল্পের গুণ বা অর্থ। এরকম যে একটি শিল্পকলোনী থাকতে পারে, তা জানা ছিল না। 
চলুন এগিয়ে যাই পরের পর্বে–
ক্রমশঃ–

Post a Comment

0 Comments