অ-কৃত্রিম
মিলি ঘোষ
সিনেমার নেশা খুব বেশি কোনোদিনই ছিল না। তবু বহু ভালো ছবি দেখে নিয়েছি। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি। কাজেই সিনেমা দেখা নিয়ে কিছু বলতে যাওয়া মানে তো ইতিহাস।
তবু, কেউ যদি জানতে চায় সবচেয়ে প্রিয় সিনেমা কোনটি ? প্রথম 'পথের পাঁচালী'র কথাই মনে আসবে। এবার ভাবতে গেলে আরও প্রচুর সিনেমার নাম মনে পড়বে। কোনটার কত ওজন বলা মুশকিল। শুধু বাংলাতেই বহু ভালো পরিচালকের ভালো ভালো সিনেমা রয়েছে। যেখানে দক্ষ শিল্পীদের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতে হয়। এই সব ছবি চিরকালীন। যা দেখেছি, কোনওদিন মন থেকে মুছে যাবে না।
এখন একটু আনন্দদায়ক সিনেমাতে ঢুকে পড়ি।
'সমাপ্তি' সেরকমই একটি সিনেমা। কাহিনীকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরিচালক সত্যজিৎ রায়। নাম উল্লেখ না করলেও চলত।
সিনেমার প্রয়োজনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কাদায় আছাড় খেতে হলো। সে তো আমরা যেটুকু দেখলাম, তাতেই পুলকিত। পরিচালককে সন্তুষ্ট করতে ক্যামেরার সামনে আরও যে কতবার তাঁকে কাদায় পড়তে হয়েছে, তা তো আমরা জানি না। কাদায় পড়ার দৃশ্য মৃন্ময়ীরও ( অপর্ণা সেন ) আছে। এবং সেটা অসাধারণ ( নিতান্তই আমার মত )। অপূর্বর হাত ছাড়িয়ে পালাতে গিয়ে মৃন্ময়ীর দুবার করে কাদার মধ্যে পা পিছলে পড়ার দৃশ্য মনে আছে নিশ্চয়ই।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
অপূর্বর মা ছেলের জন্য যে পাত্রী ঠিক করেছিলেন, তার নাম পুঁটি। নাম শুনে আঁতকে ওঠে অপূর্ব।
তখন তাঁর মায়ের যুক্তি ছিল, "আমার নাম যে খেঁদি!"
অর্থাৎ মায়ের নাম যদি খেঁদি হতে পারে, স্ত্রীর নাম পুঁটি হতে অসুবিধা কোথায় ? কত ছোটো ছোটো কথা। সিনেমার মূল বিষয় মনে রাখতে গিয়ে এ'সব আমরা ভুলেই যাই। অথচ ভোলা উচিত না। এই ধরনের ছোটখাট কথোপকথন ছবিটির সূক্ষ্ম অলংকার।
তবে সমাপ্তি দেখে থাকলে যে দৃশ্য কেউ ভুলবে বলে মনে হয় না, তা হলো পাত্রী দেখতে গিয়ে অপূর্বর নাস্তানাবুদ হওয়ার ঘটনা। পুঁটিকে কথা বলানোর জন্য পেছন থেকে ঠাকুমার আঙুলের খোঁচা, জানলা দিয়ে মৃন্ময়ীর রাখালকে ডাকা এবং তারপরে চড়কি চড়কি করে ঘরের মধ্যে ঢুকে মৃন্ময়ীর তাণ্ডব বাঁধিয়ে দেওয়া এবং পরিণতি স্বরূপ পুঁটির ঠাকুরদার টাকে অপূর্বর মুখের চর্বিত মিষ্টি-বর্ষণ। এই সম্পূর্ণ ঘটনায় কোথাও কি অস্বাভাবিক লেগেছে ? এতটাই সাবলীল, অভিনয় বলে মনেই হয়নি। সামান্যতম পদস্খলনে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা জোলো হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি।
এরপরের জুতোর কাহিনী সকলেরই মনে আছে, আশা করা যায়। সে দৃশ্য ব্যাখ্যার অতীত।
পাত্রী পছন্দ হয়নি শুনে অপূর্বর মা জানতে চেয়েছিলেন মেয়ের দোষটা কোথায় ?
অপূর্ব তৎক্ষণাৎ কী বলেছিল, মনে পরে ?
বলেছিল, "গুণটা কোথায় ?"
এগুলোই আমরা ভুলে যাই। একটা সিনেমাকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করতে হলে ফাঁক ফোকর রাখলে তো চলবে না।
তারপর তো বিবাহ, বিবাহ পরবর্তী অধ্যায় সকলেরই জানা।
মৃন্ময়ীকে লোকে পাগলী বলে। আসলে সে একটি স্বাধীনচেতা মেয়ে। প্রতিবাদীও।
প্রতিবাদী বলেই বিয়ের রাতে অপূর্বকে বলতে পেরেছে, " আমার ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই ?"
"জোর করবে কেন ?"
কতগুলো দৃশ্য অভূতপূর্ব! গভীর রাতে শ্বশুর বাড়ি থেকে ছাদ দিয়ে গাছ বেয়ে পালিয়ে গিয়ে দোলনায় চড়া। আর ঠিক সেই সময় 'রানার চলেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে'।
এই ধরনের কাহিনী নিয়ে সিনেমা করা অত্যন্ত কঠিন। ছবিটিতে দর্শককে আনন্দ দিতে গিয়ে স্থূল হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। কিন্তু তা হয়নি। একেবারে পরিপূর্ণ অনাবিল আনন্দের একটি সিনেমা আমরা উপভোগ করেছি।
এবার আসি আর একটি সিনেমার কথায়। টেলিফিল্ম কি না জানি না। টিভিতে দেখেছিলাম অনেক বছর আগে।
তপন সিংহ পরিচালিত, দীপ্তি নাভাল অভিনীত 'দিদি'। হিন্দি সিনেমা হলেও পরিচালক নিজে বাঙালি এবং জ্ঞানেশ মুখার্জি, ভীষ্ম গুহ ঠাকুরতা সহ আরও বেশ কিছু বাঙালি সু-অভিনেতার উপস্থিতি ছবিটিকে অন্য মাত্রা দেয়। তবে, মুখ্য চরিত্রে দিদি'র ( চপলা ) ভূমিকায় দীপ্তি নাভাল। এই ছবিটিতে তাঁর অভিনয় ব্যাখ্যার ঊর্ধে।
ছবিটিতে যন্ত্রণা বারেবারে এসেছে। নানারকম যন্ত্রণা। কখনও রাগ হবে। কখনও এটাই বাস্তব ভেবে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হবে। আবার কখনও বা চোখের জলই যন্ত্রণা লাঘবের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়াবে।
সহ্য করা যায় না, আবার না শেষ করে ওঠাও যায় না।
এই ছবির দুটো অংশ। যা ছোটো করে বলা সম্ভব নয়।
প্রথম অংশ --
----------
মৎস্যজীবী পরিবারে মাতৃহীন ছোটো ভাই রতন, দিদিকেই মায়ের মতো আঁকড়ে ধরেছিল। চপলা রান্না করছে, জল আনতে যাচ্ছে, রতন গায়ের সঙ্গে লেগে।
চপলা শ্বশুর বাড়ি যাবার সময় রতনকে খুঁজে পায় না। নৌকো ছেড়ে দেবার সময় চপলার বরের ( ভীষ্ম গুহ ঠাকুরতা ) টোপরে একটা ইট এসে লাগে। কেউ তো একজন ছুঁড়েছেই। সেই প্রথম প্রতিবাদ রতনের।
বাবা ( জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় ) রান্না করে ডাকলেও রতন খেতে আসে না। রোজই বলে, খিদে নেই। বাবা বোঝান, সব মেয়েকেই এভাবে আপনজনদের ফেলে রেখে শ্বশুরবাড়িতে চলে যেতে হয় একদিন।
চার মাইল পথ হেঁটে ব্যাগের মধ্যে দিদির জন্য কী সব খাবার দাবার নিয়ে রতন একাই চলে যায় চপলার বাড়িতে।
দিদির বরটি কিন্তু খুব ভালো। সে চপলাকেও ভালোবাসে, রতনকেও স্নেহ করে।
চপলা নদীতে স্নান করে বাগানের মধ্য দিয়ে ফেরে রোজই। একদিন তিনজন শহুরে বাবু তার পথ আটকেছিল। চপলা ওদের কথার উত্তর না দিয়ে পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু ওরা তক্কে তক্কে ছিল। সুযোগ বুঝে একদিন চপলার বরের মাথায় পেছন থেকে আঘাত করে চপলাকে নিয়ে পালিয়ে গেছিল ওই মহা পুরুষের দল।
এক সাধুবাবা একটা খালি নৌকোয় চপলাকে একা ভেসে যেতে দেখে সাহায্যের হাত বাড়ান। নৌকোয় চপলা চোখ বন্ধ করে গোঙাচ্ছিল।
এরপর যা যা ঘটার ঠিক তা'ই তা'ই ঘটল।
পুলিশ কেস হলো। সমাজের ভয়ে চপলার বাবা, বর মুখ ঘুরিয়ে নিল। আর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেও কিছুই বুঝল না রতন।
সাধুবাবা চপলাকে বোঝালেন, "আমার নিজেরই তো কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। কখন কোথায় থাকি। তোমাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব!"
চপলা বিশ্বাস করেছিল সাধুবাবাকে। বোধহয় শেষবারের মতো।
নিরুপায় হয়ে সাধুবাবা এক ভদ্র মহিলার হাতে চপলাকে তুলে দিলেন।
কিন্তু আড়াল থেকে চপলা শুনেছিল, সাধুবাবা ওই মহিলার থেকে টাকা চাইছিল চপলাকে এনে দেবার জন্য।
রতন, বাবাকে দিদির কথা জিজ্ঞেস করে উত্তর পায়, "ওই নাম মুখে আনবি না। দিদি মরে গেছে।"
কিন্তু রতন নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে শুনেছে, নৌকোর আরোহীদের কথা। তারা বলছিল, চপলা এখন কলকাতার বউবাজারে থাকে।
ছোট্ট রতন বুঝে উঠতে পারে না, কেন দিদিকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না।
বাবা বলেন, "তুই বড়ো হ। তারপর বুঝবি।"
দাদার ( দিদির বর ) কাছে ছুটে যায় রতন।
সে'ও একই কথা বলে, "তুমি বড়ো হও। তখন বুঝবে।"
রতনের বাবা এবার নৌকো ভেরাবেন কলকাতার ঘাটে। এই সুযোগ রতন ছাড়ে না। জোর করে ও বাবার সঙ্গে কলকাতায় যায়। নৌকো ঘাটে ভেড়া মাত্র রতন সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে দৌড়তে শুরু করে। বৌবাজার কোনদিকে জানতে চায় পথচারিদের কাছে। রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে হাঁটতে থাকে, গাড়ির হর্ন উপেক্ষা করে।
রতন যে কলকাতার রাস্তায় নতুন পা ফেলেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না অনেকেরই। নানারকম লোকের খপ্পরে পড়তে থাকে। তারপরেও ওর চলা থামে না। অচেনা অজানা শহরে একা হেঁটে চলে রতন দিদির ঠিকানা খুঁজতে।
প্রথম অংশ এখানেই শেষ।
এরপর একটা লেখা আসে, সঙ্গে কণ্ঠস্বর--
এইভাবে কলকাতা শহরে একটি বাচ্চার পক্ষে দিদিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের কাহিনী এটা নয়। আমাদের কাহিনী হলো, যদি রতন ওর দিদিকে খুঁজে পায়, তখন কী করবে ?
পরবর্তী অংশ --
------------
রতন এক মতলববাজের হাত ছাড়িয়ে প্রাণপণ ছুটতে থাকে। রাজপথ ছেড়ে সে তখন শহরের অলিতে গলিতে।
গল্পের প্রয়োজনে সে তখন বউবাজারের নিষিদ্ধপল্লি দিয়ে দৌড়ে চলেছে। হঠাৎ সামনেই ওর দিদির মতো একটি মেয়েকে দেখতে পায়। শাড়ি পরে চুল ছেড়ে হেঁটে যাচ্ছে সে।
রতন ডাকে, "দিদি!"
মেয়েটি ঘুরে দাঁড়ালে ভুল ভাঙে রতনের।
মেয়েটি জানতে চায় ওর দিদির নাম কী ?
সে সত্যিই চপলা নামের একজনকে চেনে এবং তার কাছেই নিয়ে যায় রতনকে।
দরজা খুলে স্তম্ভিত চপলা। এ কাকে দেখছে ?
উগ্র সাজে হারিয়ে গেছে চপলার লাবণ্য। রতনের চিনতে সময় লাগে। হাঁ করে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মুখে হাসি আনে রতন।
ভাইকে ভেতরে নিয়ে এসে বিছানার ওপরে পড়ে থাকা মদের বোতল তুলে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় চপলা।
এক প্লেট মিষ্টি এনে ভাইকে পরম আদরে খাওয়াতে থাকে দিদি। রতন বলতে থাকে ও কীভাবে এখানে এল। দিদিকে ছাড়া ও যে এতটুকুও ভালো নেই, সব বলতে থাকে রতন।
দুপুরে পঞ্চ ব্যাঞ্জন রান্না করে সযত্নে খাওয়ায় চপলা, ভাইকে।
রতন বলে, "এত খাবার আমি কোনওদিন খাইনি।"
দিদির কাছেই থেকে যেতে চায় সে। কিন্তু চপলা বোঝায় রতন যেন গ্রামে ফিরে গিয়ে ঠিক মতো পড়াশুনা করে। লেখাপড়া জানাটা খুব জরুরি।
তারপর জানতে চায় রতনের কাছে, "এবার একটা কথা বল তো, তোর দাদা আমার কথা কিছু বলে ?"
রতনের কাছে শোনে চপলা, কেউ ওকে গ্রামে ফিরিয়ে নিতে চায় না। সবাই রতনকে বলে, তুমি বড়ো হও, তখন বুঝবে।
ভাইকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে চপলার স্মৃতি তোলপাড় হতে থাকে।
এদিকে বিকেল হতে চপলার ডাক পরে। যে ডাক ফেরানোর সাধ্য চপলার নেই। গোটা দুনিয়া ওর থেকে মুখ ফিরিয়েছে। জীবন ওকে ঠিক এইখানেই দাঁড় করিয়েছে। বাধ্য হলো চপলা ভাইকে ফিরে যেতে বলতে।
তবু বলেছিল দরজায় দাঁড়ানো ব্যক্তিকে, "ঘরে আমার ছোট ভাই রয়েছে।"
চপলার কাতর মিনতি কার কানে কবে পৌঁছেছে ? এ এমন জায়গা, যেখানে ভাই বোনের সম্পর্ক মূল্যহীন। স্নেহ, মায়ার কোনও স্থান এখানে নেই। তাই রতনকেই ফিরতে হলো।
ঘুমন্ত ভাইকে ডেকে তুলে বাড়ি যেতে বলল চপলা। রতন যেতে চায়নি।
দিদিকে জাপটে ধরে বারবার বলেছে, "আমি তোমার সঙ্গেই থাকব।"
চপলা হাঁটু গেড়ে বসে অঝোর কান্নায় ভেঙে পরে ভাইকে বুঝিয়েছে, "এ জায়গা তোর পক্ষে ঠিক নয়। তুই বাড়ি চলে যা।"
রতনের গলায় অভিমান ঝরে পড়ে, "আমি আর কোনওদিন তোমার কাছে আসব না।"
রতনের পকেটে কিছু টাকা দিয়ে চপলা বলল, "গলি পার হলেই ট্রাম লাইন। ট্রামে করে চলে যা। বাবু চিন্তা করছে।"
রতন জানতে চায়, "তুমি কেন যাবে না ?"
চপলা ধীরে ধীরে বলে, "তুই বড়ো হ। তখন বুঝবি।"
রতন দৌড়ে বেরিয়ে যায়।
আবার ফিরে আসে।
বলে, "আমি বড়ো হয়ে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাব। তখন কারোর কথা শুনব না।"
তারপর যেমন এসেছিল, তেমনই দৌড়ে চলে গেল রতন।
সেদিকে তাকিয়ে থেকে অসহায় চপলা চোখের জলে ভেসে যেতে লাগল।
চপলার সে কান্না ফিরেও দেখল না ভদ্রলোকের পৃথিবী। ছোটো ভাইয়ের জন্য দিদির চোখের জলের গভীরতা মাপার কোনও যন্ত্রই তো আবিষ্কার হয়নি। তাই দিদিকে খুঁজে পেয়েও রতনকে ফিরে যেতে হয়। আর চপলাকে থেকে যেতে হয় ওই 'নরক-কুন্ডে'।
1 Comments
দুটি লেখাই সুলিখিত।
ReplyDelete