জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী/উপপর্ব — ০৯ /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৭৪

এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী

উপপর্ব — ০৯

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

(১)
ও গো সুন্দর, সুন্দর হে...। সুন্দর একখান রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল কিশোরী মেয়ে। নাম শেফালী। শ্যামবর্ণা। ষোড়শী। আজানুলম্বিত ঘন কেশরাশি। শান্ত স্বভাব। স্বাস্থ্যবতী। তার গানের গলা বেশ ভালো। সুন্দর পরিপাটি করে শাড়ি পরিহিতা মেয়েটিকে এক নজরে পছন্দ হয়ে গেল কৈশোর পেরোনো রামের। উত্তাল সমুদ্রে যে-রূপে ঢেউয়ের উপর ঢেউ ভেঙে পড়ে, চূর্ণবিচূর্ণ হয় লক্ষ নিযুত কোটি জলরাশি; ঠিক সে রূপে রামের শান্ত হৃদয়ে উথাল পাথাল ঢেউয়ের আকস্মিক আঘাতে শরীরে অতিরিক্ত অ্যাড্রিনালীন নিঃসরণ হয়। পারিপার্শ্বিক জগতটা ক্ষণিকের জন্য রঙিন মনে হয়। এ কি নিছক ভালো লাগা! নাকি, হৃদয়ের গোপন কোণে সঞ্চিত প্রথম প্রেমের সুন্দর অনুভূতি যা কল্পনাতীত! নাকি, জন্ম-জন্মান্তরের অদৃশ্য টান!

অনন্তদার পরামর্শে মেয়ে দেখতে তার বানেশ্বরচক গ্রামে আসা। বানেশ্বরচকে অনন্তদার শ্বশুর বাড়ি। পার্বতীপুর পতিতপাবনী হাইস্কুলের অঙ্কের মাস্টার সীতানাথ বাবু অনন্তদার শ্বশুর মশাই। সীতানাথ বাবু রামেরও অঙ্কের টিচার। প্রিয় স্যারের ছোট মেয়ের নাম শেফালী। সম্পর্কে অনন্তদার শ্যালিকা। ওদিকে, অনন্তদার স্ত্রী বাপের বাড়ি আসা ইস্তক বেজায় শরীর খারাপ। তাই বাসায় ফেরা হয়ে ওঠেনি। সেই থেকে ক'টা দিন বৌদির ঠিকানা বাপের বাড়ি। এদিকে, অনন্তদার 'তার' পেয়ে আপন কনিষ্ঠা বোনকে দেখানোর সমস্ত বন্দোবস্ত তোড়জোড় বৌদির সারা। অবশ্য বৌদির উপস্থিতি রামের আড়ষ্টতা অনেকাংশে হালকা করে দিয়েছে। এ কথা ও কথা সে কথার পর শুরু হল গান। গান গাইল লাজুক মেয়ে। গানের ভাষার প্রতিটি ছন্দে সুন্দরের প্রতি টান রামকে আকৃষ্ট করে তুলছিলো। এই ক্ষণ, এই মুহূর্ত এক অদ্ভূত ভালোলাগায় ভরে দিয়েছিল রামের হৃদয়। আহা! এই সুন্দরের আবেশ অপরিসীম শান্তি বয়ে আনে সারা দেহ ও মনে। কল্পনায় বুঁদ হয় রাম। এ যেন কল্পলোকের রাজপুত্রের বাস্তবের রোমান্টিক গল্প। একঝলকে রামের পছন্দ হয়ে গেল শেফালীকে।

রামের সম্মতি আছে জানা পর মাস্টার মশাই শীঘ্রই রামের বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার কথা দিলেন। তারপর কয়েক দিনের ব্যবধান। সীতানাথ বাবু যথারীতি কশাড়িয়া গ্রামে পৌঁছলেন। রামের বাবা প্রহ্লাদবাবুর সঙ্গে অনেক ক্ষণ আলাপ আলোচনা চলল। ছেলে ও মেয়ের কোষ্ঠি বিচার হল। রাজ্যোটক মিল। দুজনের গ্রহ-নক্ষত্র-রাশি হুবহু মিলেও গেল। কোষ্ঠি বিচারের পর আরও এক প্রস্থ আলোচনা। দুপক্ষের সম্মতিতে বিয়ের চূড়ান্ত দিনক্ষণ নির্ধারণ করা। মাদুর পেতে সবাই গোল হয়ে বসল। চরম আগ্রহভরে সকলের অধীর অপেক্ষা। বেনীমাধব শিলের একখান পঞ্জিকার ওপর সবার উৎসাহী দৃষ্টি। শেষমেশ বিয়ের যুতসই একটা দিন ক্ষণ পাওয়া গেল। ওই ক্ষণেই দুই হাত চার হাতে পরিণত করার মনস্থ করল সকলে। বেজে উঠল শাঁখ। বাজল বিয়ের সানাই। উলুধ্বনি। এ হেন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের গ্রাম্য রীতি অনুযায়ী দুটি সাদা কাগজের উপর বিয়ের আনুষঙ্গিক দিনক্ষণ লাল কালিতে লেখা থাকে। কাগজের উপর হলুদের স্পর্শে এবং উলুধ্বনিতে অনুষ্ঠানের সূচনা ঘোষিত হয়। গেরস্থ বাড়িতে শাঁখ প্রতিদিন দুবার বাজানোর নিয়ম। সকালে সূর্যোদয়ের অব্যাহত পূর্বে আর সূর্যাস্তের খানিক পরে। পূজো পার্বণ থাকলে অবশ্য আলাদা কথা। আজ প্রহ্লাদবাবুর বাড়িতে অসময়ের শঙ্খধ্বনিতে পাড়াপড়শি ঈষৎ ইতস্তত। তাদের চোখে মুখে অনন্ত কৌতূহল কেন এই শঙ্খধ্বনি! তারপর আসল কারণ জানতে পেরে তারাও যারপরনাই আনন্দিত। 
    
আজ শুভ বিবাহ। বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে। সকলের ব্যস্ততা চরমে ওঠে। প্রহ্লাদবাবুর নিঃশ্বাস ফেলবার ফুরসৎ নেই। ছেলের বিয়ে বলে কথা। একদণ্ড স্থির হয়ে বসে থাকবার জো নেই। ইতিমধ্যে বড় মামা হরিপদ করণ ভাগ্নের বিয়েতে হাজির হয়েছেন কশাড়িয়ায়। মামা অত্যন্ত রাশভারী লোক। সিপিআই কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য। দলের তেভাগা আন্দোলনের সংগঠক এবং প্রচারক। বিয়ের সময় কনেকে নিদেনপক্ষে একটি আংটি দেওয়া আবশ্যক। বড় মামা হরিপদ বাবু আংটির ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও তিনি প্রায় নিঃস্ব ব্যক্তি। হঠাৎ মনে পড়ল বরের হাতে একটা হাতঘড়ি থাকলে ভালো হতো। বিদ্যাপীঠের ভূগোলের শিক্ষক ছিলেন সুনীল কুমার মণ্ডল। রামচকের বাসিন্দা। তাঁর হাতঘড়ি চেয়ে নিয়ে হাতে পরল রাম। সবকিছু প্রায় প্রস্তুত। জনা কয়েক বরযাত্রী। অনেক ক্রোশ হাঁটাপথ। কনের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা দ্বিপ্রহর গড়িয়ে যাবে। হাতে সময় নিয়ে রওনা হয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। মাঝ রাস্তায় টুকটাক কেনাকাটার জন্য সময় ব্যয় হবে। দিনের আলো থাকতে থাকতেই পৌঁছে গেলে নিশ্চিন্ত।

দুপুরের পরে বর নিয়ে পায়ে হেঁটে বরযাত্রীর দল রওনা দিল বিয়েবাড়ির উদ্দেশ্যে। মামা হরিপদ করণও সঙ্গী হলেন। হাঁটাপথে সুতাহাটা যাওয়ার পথে পড়ে তেখালী বাজার। তেখালী বাজারে ছোট্ট একটা ব্রিজ পেরোলেই ওপারে সুতাহাটা থানা। যা কিছু কেনাকাটা, এখানেই সারতে হবে। যাত্রাপথে ভালো বাজার আর একটিও নেই। নববধূর জন্য সোনার আংটি কেনা হল তেখালী বাজারে। দাম মাত্র পঞ্চাশ টাকা। আংটি কিনে সুতাহাটা পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় চকচক করছে চরাচর। বিলের জলে সূর্যের আলোয় যেন লক্ষ তারার ঝিকিমিকি। রাঙা আলোয় বর বেশে রামকে এখন খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। দীর্ঘ রাস্তা হাঁটাহাঁটিতে সকলে অল্প বিস্তর ক্লান্ত। সুতাহাটা পৌঁছে সকলের একটু বিশ্রাম দরকার। সবাই খানিক জিরিয়ে নেয়। সাঁকো পেরিয়ে বরের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ফুল আর জরি বসানো রঙিন চাদর দিয়ে সুন্দর সাজানো পাল্কী। সঙ্গে গোটা আষ্টেক বাহক। প্রত্যেকের শক্ত সমর্থ পেশীবহুল গড়ন। পেটানো দশাসই চেহারা। মেয়ের বাড়ি থেকে বন্দোবস্ত করা পাল্কীতে উঠে বসল রাম। 'হুন হুঁ না, হুন হুঁ না, হুন হুঁ না রে হুন হুঁ না।' পাল্কী চলে। দুলকি চালে। নৃত্যের তালে। সুতাহাটা থেকে বানেশ্বরচকে ভাগ্নে রাম চলেছে পাল্কীতে চড়ে আর অন্যান্যদের সঙ্গে মামা হরিপদ বাবু পায়ে হেঁটে। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার মুখে বানেশ্বরচক পৌঁছয় পাল্কী।

বিয়ের লগ্ন শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। জোরকদমে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। পুরুত মশাই রেডি। অল্প কিছু ক্ষণের মধ্যে বরের ডাক পড়বে। বিয়ের পিঁড়িতে বসতে গেলে আগেভাগে মিটিয়ে ফেলতে হয় সব দেনাপাওনা। এমন সময় 'গ্রাম্য বাব' হিসাবে গ্রামের মোড়লরা বরপক্ষের কাছে একগাদা টাকা চেয়ে বসলেন। 'গ্রাম্য বাব' হল গ্রামের মোড়লদের বিবাহের অনুমতি প্রদান হেতু দেয় অর্থ। এটা এক ধরণের আবদার আদতে যা নিয়মে পরিণত। আবদার বরের কাছে, বরপক্ষের নিকট। গ্রামে ঘরে এই টাকা দেওয়া-নেওয়া নিয়ে খুব শোরগোল ওঠে। কথা কাটাকাটি চলে। অনেক সময় অর্থের পরিমাণ আকাশ ছোঁয়। গ্রামবাসীরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। অযথা গণ্ডগোল তৈরি হয়। তখন বিয়ে বাড়ি ভণ্ডুল কতক্ষণ! 
     
রামের হয়েছে মহা জ্বালা! পকেটের অবস্থা ভাঁড়ে মা ভবানী দশা। একটা কানাকড়িও নেই। 'গ্রাম্য বাব' বাবদ দু'শ টাকা! চোখ কপালে ওঠবার জোগাড়। এতটাকা এখন পায় কোথায়? বরকর্তা নিরূপায়। এগিয়ে এলেন রামের হবু জ্যেঠশ্বশুর। তিনি ধার দিয়েছিলেন দুই শত টাকা। এ যাত্রায় মান সম্মান অটুট থাকল এই রক্ষে! গ্রাম্য বাব মিটিয়ে শুরু হল বিয়ের মন্ত্রোচ্চারণ। 'যদিদং হৃদয়ং মম, তদিদং হৃদয়ং তব।' নির্বিঘ্নে শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হল। দুপক্ষ বেজায় খুশি।

(২)
নতুন বউ সঙ্গে নিয়ে রামের আর বাড়ি ফেরা হল না। বর্তমান পরিস্থিতির চাপে কশাড়িয়ায় বৌভাতের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়নি। আসলে রামের উচ্চতর বিদ্যার্জনের জন্য অনেক টাকা দরকার। তার সংকুলান হওয়া অতি আবশ্যক। অতিরিক্ত খরচ সেখানে বিলাসিতা মনে হয়। তাই বাড়ির কারও সায় নেই বৌভাতের অনুষ্ঠানে। যদিও এ আক্ষেপ রামের চিরকালের সঙ্গী বনে গেল। এ আফসোস কোনো দিন যাবার নয়। বিয়ের পরে দিন দুই-তিন পর্যন্ত শ্বশুর বাড়িতে রয়ে গেল রাম। হাতে খুব বেশি সময় নেই। মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর তাকে রওনা হতে হবে আগ্রার উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে সব বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলা জরুরি। অনন্তদার নিদান — নববধূ কশাড়িয়ায় শ্বশুর বাড়ির পরিবর্তে বাপের বাড়িতে থাকবে, যতদিন না রামের লেখাপড়া শেষ হচ্ছে। লেখাপড়ার শেষে রাম যখন বাড়ি ফিরবে, সেসময় কশাড়িয়ায়‌ যাবে শেফালী।

প্রবাদ আছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। রামের অভিমত – বাড়িতে চুপচাপ বসে না থেকে হাতের কাজ শিখুক শেফালী, যে-কাজ জীবনে স্বাবলম্বী করে তুলবে। সুতাহাটায় রয়েছে সুতা কাটার চরকা কেন্দ্র। নাম অম্বর চরকা কেন্দ্র। স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা ছিলেন কুমার চন্দ্র জানা। তাঁরই নামানুসারে সুতাহাটায় গড়ে উঠেছিল এক আধুনিক অম্বর চরকা কেন্দ্র। মূলত সুতা কাটার ট্রেনিং দেওয়া হতো। ট্রেনিং সম্পূর্ণ হলে জীবনে স্বাবলম্বী হতে অসুবিধা হবে না। এ হেন ভাবনা থেকে চরকা কেন্দ্রে শেফালীকে ভর্তির সকল ব্যবস্থা সেরে ফেলল রাম। প্রথম প্রথম বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে চরকা কেন্দ্রে পৌঁছত শেফালী। বাড়ি থেকে চরকা কেন্দ্রের দূরত্ব বেশি। রোজ রোজ হেঁটে যেতে কষ্ট হয়। হলদিয়ায় এক আত্মীয়ের বাড়ি। সেখান থেকে চরকা কেন্দ্রে যাতায়াত করা অধিকতর শ্রেয়। সময় সাশ্রয় হয়। জার্নির ধকল কমে। সুতরাং হলদিয়ায় তার থাকার বন্দোবস্ত পাকা হল। সেখান থেকে প্রতিদিন সুতাহাটা পৌঁছত সে। এই ছিল রোজকার রুটিন।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
বিয়ের পরে ক'টা দিন শ্বশুর বাড়িতে দারুণ আনন্দে কাটল রামের। ঘর ভর্তি আত্মীয় পরিজন। অনবরত হাসি ঠাট্টা মসকরা চলছে। সমষ্টির চিৎকারে গমগম করছে ঘর। এরই ফাঁকে পড়াশুনার যাবতীয় খরচাপাতি মিটিয়ে দিয়ে সীতানাথ বাবু জানতে চাইলেন —
'মাসে মাসে কত টাকা খরচ পড়বে?'
'মাসে ষাট - সত্তর টাকা মতো খরচ হবে'— রামের সংকোচ পূর্ণ জবাব। যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকু তার দাবি। প্রয়োজনের বেশি তার লোভ নেই এবং তা নিয়মিত পৌঁছে যেত দূর দেশে রামের ঠিকানায়। এ যাত্রায় আর্থিক সমস্যার সুষ্ঠু সুরাহা হল। শ্বশুর বাড়ির টাটকা স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে এল রাম। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে আগ্রা রওনা হতে হবে। ওদিকে, এমএসসির দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হবে।
      
এ যেন রূপকথার বিয়ে। স্বপ্নলোকের এক রাজপুত্তুর সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে নেমে এল। নেমে এসে পার্থিব এক রাজকন্যাকে ভালোবাসার রসে রাঙিয়ে পুনরায় ফিরে গেল তার আপন দেশে। তারপর দীর্ঘ অপেক্ষা! অপেক্ষা ভালোবাসার মানুষের ফেরার জন্য। অপেক্ষা প্রতিটি ক্ষণের। প্রতিটি মূহুর্ত কল্পনায় উদ্ভাসিত হয়। উল্টোদিকে, অপেক্ষার প্রতিটি ক্ষণ যেন এক যুগের সমান প্রতিপন্ন হয়।

আধুনিক সমাজে এমন ঘটনা হয়তো অনভিপ্রেত। ভিন্ন আঙ্গিকের প্রসঙ্গ উত্থাপন হবে। যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে! হয়তো এমন ভ্রান্ত ভাবনা-চিন্তায় আচ্ছন্ন হবে মন। সন্দেহের উদ্রেক ঘটাবে। কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর। সে অন্য কথা বলে। বর্তমানের চোখে অতীতের ঘটনা অসাধু বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু বর্তমান যে বড্ড বেশি অসহায়, বাবু মশাই! আর্থিক প্রয়োজন কোনো নৈতিকতা মানে না। দুহাত পেতে আর্থিক সাহায্য গ্রহণের সময় কোনো অন্যায় নেই বলে রামের ধারণা। তার আরও দাবি এটা বিয়ের যৌতুক নয়। উচ্চতর শিক্ষার শিখায় নিজেকে আলোকিত করার নিরূপায় প্রয়াস মাত্র। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। আগ্রা পৌঁছে ঠিক মতন পড়াশুনার প্রতি তার মনোসংযোগ করা কঠিন প্রতিপন্ন ঠেকছে। মন অস্থির হয়ে আছে। লেখাপড়ায় ক্ষণিকের অস্বস্তি। কারণ সম্ভবত সাংসারিক বন্ধন। নববধূর জন্য মনখারাপ। কীভাবে সে কাটিয়ে উঠবে আপাত সকল জড়তা? চিঠি লেখা শুরু করল দুজনে। অধিকাংশ চিঠিপত্রের বিষয় ছিল— চৈতন্য বোধের উদয়। পার্থিব সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের উর্ধ্বে অস্থির মনকে শান্ত রাখার অব্যর্থ ওষুধ। এ এক কঠিন সংযম, অচিরেই যা অতিক্রম করতে পেরেছিল তারা। এভাবে কেটে গেল পুরো এক বছর। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন আপাতত কমপ্লিট। কলেজের শেষ পরীক্ষা শেষ করে ট্রেনে চড়ে বসল রাম। পৌনে দুদিনের ট্রেন জার্নি। তারপর দীর্ঘ বাস যাত্রা। গোধূলির স্বল্প আলোয় ঘর পৌঁছল সে। শরীর বেশ ক্লান্ত। দীর্ঘ রাস্তার ধকল পড়েছে দেহের উপর। আবার এ-ও ঠিক 'শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাইবে তাহা সয়'।

রাতটুকু নিরুপদ্রবে কাটবার জো নেই। সবেমাত্র ভোরের আকাশ একটু ফর্সা হয়েছে কি হয়নি! বাসা ছেড়ে পাখিরা সবে ডাকতে শুরু করেছে। মুরগির লম্বা শ্বাসের সুরেলা ডাকে গৃহস্থের ঘুম ভাঙছে। এমন সময় এ কী বিড়ম্বনা! বলা নেই, কওয়া নেই, অপরিচিত এক যুবক কোত্থেকে এসে হাজির? সটান ঢুকে পড়েছে একদম বাড়ির বারান্দায়। আগন্তুককে আগে কখনও এতদাঞ্চলে দেখা যায়নি। ঘুম ঘুম চোখে বাইরে বেরিয়ে আসে রাম। আরে! এ তো তার সহপাঠী। ঝাড়গ্রাম কলেজের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু। কিন্তু তার এ কী হাল! রোগা হাভাতে চেহারা! এত ভোরে হঠাৎ তার আগমনের হেতু কী? কোনো দুঃসংবাদ নাকি দুর্ঘটনা! বালাই ষাট! নাকি, অন্য কিছু? (ক্রমশ...)

তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি

🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ  হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪




Post a Comment

1 Comments