জ্বলদর্চি

তেলকুপি: দামোদর গর্ভে ডুবে যাওয়া মন্দির নগরীর ইতিহাস(২য় পর্ব) /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব- ৬৮

তেলকুপি: দামোদর গর্ভে ডুবে যাওয়া মন্দির নগরীর ইতিহাস(২য় পর্ব)

সূর্যকান্ত মাহাতো


এই হল সেই দামোদর নদ,যা আদিবাসী সমাজের পবিত্র তীর্থভূমি। 'দ্বাপর গঙ্গা' নামেই তাদের কাছে পরিচিত।(তেলকুপি মন্দিরনগরী সেকাল একাল, সুভাষ রায়, পৃষ্ঠা- ১০২) সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তেলকুপি হল সেই পবিত্র ঘাট। যেখানে তারা প্রতি বছর মৃত ব্যক্তিদের অস্থি বিসর্জন দিতে আসেন। আর সেই দামোদরই একসময় একাধিক দেবালয়কে গ্রাস করে নিয়েছে। একটা দীর্ঘ ইতিহাসের সলিল সমাধি ঘটিয়ে আজও কেমন নির্বাক স্থির।

তেলকুপিতে জে. ডি. বেগলার সাহেব মোট ২২ টি মন্দিরকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করেছিলেন। প্রথম গ্রুপে ১৩ টি, দ্বিতীয় গ্রুপে ছটি, এবং তৃতীয় গ্রুপে তিনটি(মতান্তরে চারটি)। এই তিনটি গ্রুপে বিভক্ত মন্দির গুলোর মধ্যে নদীর একেবারে তীরে বেগলার যে ১৩ টি মন্দির সমূহের কথা উল্লেখ করেছেন তার রিপোর্টে (Report of A Tour through the Bengal Provinces, VOL-VIII, 1878) সেই মন্দিরসমূহের স্থানকে দেবলা মিত্র "ভৈরব স্থান" বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি তার গ্রন্থে(Telkupi a submerged temple site of West Bengal, পৃষ্ঠা- ১৬) মোট ২৬ টি মন্দিরের কথা ধারাবাহিক ভাবে বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে ১ থেকে ১৩নং পর্যন্ত  (বেগলার বর্ণিত) মন্দিরকে 'ভৈরব' স্থানের মন্দির বলে উল্লেখ করেছেন। বেগলার সাহেবের 'তেলকুপি' পরিদর্শনের ২৭ বছর পর ১৯৫৯ সালে 'দেবলা মিত্র' তেলকুপি যান। এই ২৭ বছরে দামোদর দিয়ে অনেক ইতিহাস বয়ে গেছে। অনেকগুলো মন্দির দামোদরের পেটে চলে গিয়েছিল। সুতরাং বেগলার বর্ণিত মন্দিরগুলোকে পুনরায় সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারাটা তার কাছে বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। 'ভৈরবথানের' মন্দিরগুলো এবং তার বাইরের মন্দিরগুলো দুটোকেই চেনা ছিল খুব কঠিন একটা কাজ।

১৯৫৯ সালে তেলকুপি পরিদর্শনে এসে দেবলা মিত্র কেবল পাঁচটি মন্দিরকে (বেগলার বর্ণিত ৬, ৮, ৯, ১০ এবং ১৩ নম্বর মন্দির) দাঁড়িয়ে থাকতে তিনি দেখেছিলেন। তার মধ্যে নয় ও দশ নম্বর মন্দির দুটিকে দেখার জন্য তাকে একটি সমতল রান্নাঘরের উপরে পর্যন্ত উঠতে হয়েছিল। তারপরেও উপরের অংশটুকুই কেবলমাত্র দেখতে পেয়েছিলেন (Telkupi a submerged temple site of West Bengal, page 16)। আর বাকি মন্দিরগুলোর কেবল ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলেন।

জিজ্ঞেস করলাম," দেবলা মিত্র মন্দিরগুলোকে "ভৈরবথান" নাম দিতে গেলেন কেন? যেখানে বেগলার সাহেব সেরকম ভাবে কোন নামকরণ যখন করেননি?"

"এ সম্পর্কে একটি কথা বলে নিই। দেবলা মিত্রের অনেক আগেই 'হান্টার'(W.W. Hunter) তার "Statistical Account of Bengal", vol-XVII, P-299 তে তেল কুপির ওই মন্দিরে মহাবীরের একটি মূর্তির কথা বলেছিলেন। তার নাম 'বিরুপ'। কিন্তু পরবর্তীকালে দেবলা মিত্র সেটা অস্বীকার করে বলেছেন, যে ওই 'বিরুপ' হলেন 'ভৈরব'। এবং তাই ওই মন্দিরকে তিনি 'ভৈরবনাথের মন্দির' বলে উল্লেখ করেছেন।(Telkupi a submerged temple site of West Bengal, P- 16) তাছাড়া প্রথম গ্রুপের এই ১০ নম্বর মন্দিরটির সঙ্গে আট নম্বর মন্দিরেও 'কালভৈরব' নামে একটি দেবতা বা লিঙ্গ মূর্তির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। সেই থেকেই স্থানটিকে তিনি 'ভৈরব থান' নামকরণ করেছেন।"

"মন্দিরগুলো কি হিন্দুদের তৈরি? না কি জৈনদের তৈরি?"

"চলো, এ ব্যাপারে লেখক 'সুভাষ রায়' কী বলছেন আগে দেখে নিই। তার মতে ৯০০ থেকে ১২০০ শতাব্দীতে জৈন বণিকদের উদ্যোগেই এই দেব দেউলগুলো গড়ে উঠেছিল। (মন্দিরনগরী তেলকুপি সেকাল একাল, পৃষ্ঠা ১০২)। আবার 'দীপকরঞ্জন দাস' 'অনুমান' কথাটা উল্লেখ করে বলেছেন, মন্দিরগুলো জৈন প্রচারক এবং শরাকশ্রেণীর পূর্বপুরুষদের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল (পুরুলিয়ার মন্দির স্থাপত্য, অহল্যাভূমি পুরুলিয়া, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৩২)। আবার ১৮৯৬ সালে 'পূর্ত বিভাগ' থেকে একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই সংকলনে তেলকুপির মন্দিরগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, মন্দিরগুলো মোঘল আমলের পরে শুরু হয়েছিল (Public Works Department 1896, List of ancient monuments of Bengal, Revised and corrected up to 31st August 1895, Kolkata, government of West Bengal)"
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇

"তাহলে বিষ্ণু, শিব, গণেশ ও লক্ষ্মীর মতো হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তিগুলো এলো কীভাবে?"

"জৈন বণিকরা এখান থেকে সরে যাওয়ার পরেই তো হিন্দুরা মন্দিরগুলো অধিকার করেছিলেন। (মন্দিরনগরী তেলকুপি সেকাল একাল, ডঃ সুভাষ রায়, পৃষ্ঠা ১০২)"

"এমন কোন প্রমাণ আছে কি যে মন্দিরগুলো জৈন বনিকরাই তৈরি করেছিলেন?"

"আসলে কী জানো, পূর্ববর্তী গবেষক বেগলার সাহেব বা দেবলা মিত্র এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কিছু বলেননি। তবে সুভাষ রায়ের মতো পরবর্তীকালের লেখকেরা তাদের বইয়ে এর স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তবে আমার মতে এ ব্যাপারে 'নির্মলকুমার বসু'র কথাটাই অনেকটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন যে, মানভূম জেলার দামোদর সুবর্ণরেখা ও কাঁসাই নদীর তীরে যেভাবে একসময় শহর গড়ে উঠেছিল এবং সে শহরগুলোতে যে রাজা ও বণিক মহাজনদের যাওয়া আশা ছিল তাদের সহযোগিতা এবং উৎসাহেই একাধিক মন্দির গড়ে উঠেছিল। এবং তেলকুপিও ঠিক সেরকমভাবেই মন্দির নগরী হয়ে উঠেছিল।(প্রবাসী পত্রিকা, ১৩৪০, ভাদ্র সংখ্যা, মানভূম জেলার মন্দির)"

"দেবলা মিত্র কী হিন্দু মন্দির রূপেই এগুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন নাকি জৈনদের কথা সেরকম ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন?"

"দেখো, দেবলা মিত্র তেলকুপি পরিদর্শনে এসে তার গবেষণায় বিশেষ করে ধর্মস্থান বা দেব-দেবীদের মূর্তি সম্পর্কে যতটুকু জেনেছেন সেখানে কোথাও জৈন মূর্তি বা মন্দিরের কথা সেরকম ভাবে তিনি উল্লেখ করেননি। তার চেয়ে বরং তিনি এখানকার যে পবিত্র স্থানগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন চলো সেগুলো সম্পর্কে একটু জেনে নিই তাতে ব্যাখ্যা করতে সুবিধা হবে। তার দেখা পবিত্র দেবস্থান গুলোর মধ্যে অন্যতম হল---
নিড়ানি থান: দেবলা মিত্রের বর্ণিত ১৮ নম্বর মন্দিরটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এটি অবস্থিত। এখানে তিনি চতুর্ভুজ এক দেবী মূর্তি দেখেছেন। তার নাম তিনি 'ইন্দ্রানী' বলে উল্লেখ করলেও একটা প্রশ্ন চিহ্ন রেখে দিয়েছেন। কেন তিনি এই প্রশ্ন চিহ্ন রেখে দিলেন? তবে কি মূর্তিটি ইন্দ্রানীর নয়? যাই হোক, এই দেবী হাতির উপর উপবিষ্ট।বেগলার সাহেব একে 'গজলক্ষ্মী' বলে উল্লেখ করেছিলেন। নিচের ডান হাতে ধরা একটি তরোয়াল এবং উপরের বাম দিকের হাতে একটি কাপ প্রকৃতির বস্তু। দেবীর নিকট ছাগল বলি দেওয়া হয়। আবার 'ষষ্ঠী' পূজা উপলক্ষে মহিলারা তার পুজো করেন। ছাগল বলি যে দেওয়া হয় এবং দেবীকে দুধের পায়েস উৎসর্গ করা হয় এবং জৈষ্ঠ মাসে ষষ্ঠী পুজোও হয় সে কথা সুভাষ রায়ও পরবর্তীকালে সেটা উল্লেখ করেছেন (মন্দিরনগরী তেলকুপি সেকাল একাল, সুভাষ রায়, পৃষ্ঠা ৫০।)
দুর্গাথান: একটি ছোট ঢিবি তবে চাষযুক্ত জমি নয়। সেখানে নাকি কয়েক প্রজন্ম আগেও দুর্গাপূজা হত।
চড়কথান: চড়কের খুঁটি লাগানো একটি স্থান। যেখানে চৈত্র মাসের শেষ দিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনে মেলা বসে।
শিবথান: চড়কথানের কাছেই  'কমলেশ্বর শিবথান'। ছোট মাটির  মন্দির।কমলেশ্বর শিব মন্দিরে শিবলিঙ্গ, বিষ্ণু সহ একাধিক লিঙ্গ রয়েছে। এখানকার মূর্তিগুলো গুরুডিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
দুটি কালীথান: একটিতে কার্তিকের অমাবসায় পূজা হত। অন্যটিতে বৈশাখের অমাবস্যায়। 
জামকুকদাথান: গাছের ছায়ায় ঘেরা কিছু গোলাকার পাথরকে গ্রামদেবী বা গ্রামদেবতার রূপে পূজা করা হত। তবে কোন দেবতা বা মন্দির এখানে নেই।
চলো এবার দেখে নিই এখানে কোন কোন দেব-দেবীর মূর্তি গবেষকেরা দেখেছিলেন। বর্তমানে সেই মূর্তিগুলো কোথায় কীভাবে আছে।

"বেগলার সাহেব শিবলিঙ্গ, গণেশের মূর্তি, বিষ্ণুর মূর্তি, গজলক্ষী এবং একটি মঠের মতো ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলেন। আর এই মূর্তিগুলো পরবর্তীকালে প্রায় সকলেই প্রত্যক্ষ করেছেন। তবে হান্টার 'বিরুপ' (শেষ জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর) বলে একটি মূর্তির কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও তিনি তা চোখে দেখেননি।(Statistical account of Bengal, volume- xvii)
দেবলা মিত্র ভৈরবস্থানের 'খেলাইচন্ডী' ঘরের ভিতরে 'পাল' যুগের কিছু ভাস্কর্য দেখেছিলেন। যেমন 'মহিষাসুর মর্দিনী' মূর্তি, 'উমা মহেশ্বর, এবং গনেশের মূর্তি। নয় নম্বর মন্দিরে 'বিষ্ণু' মূর্তি এবং ১০ নম্বর মন্দিরে 'অম্বিকা' মূর্তিকে তিনি যেমন দেখেছিলেন তেমনি তাদের রক্ষা করার জন্য অন্যত্র তুলে আনার কথাও ভেবেছিলেন। যদিও সেটা সম্ভব হয়নি। ওখানকার নৌকার মাঝিরাই সেটা করতে দেয়নি (Telkupi a submereged temple site of West Bengal, page- 47)। আবার 1896 সালে পূর্ত বিভাগের মতেও তেলকুপিতে শিবলিঙ্গ, গণেশের মূর্তি এবং বিষ্ণুর মূর্তি ছড়িয়ে থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

"চলো এবার মূর্তিগুলো সম্পর্কে একটু জেনে নিই। দেবলা মিত্র মূর্তিগুলোর পরিচয় দিয়েছেন তার "Telkupi a submerged temple site of West Bengal গ্রন্থের ৪৮ ও ৪৯ পৃষ্ঠায়  এইভাবে,
বিষ্ণু: ক্লোরাইডের এই বিষ্ণু মূর্তি তেলকুপির কমলেশ্বর মন্দিরে রাখা আছে। মূর্তিটি ৩ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা এবং ১ ফুট ৮ ইঞ্চি চওড়া। বেশ অলঙ্করণে সুসজ্জিত। বৈজয়ন্তী মালা, উপবীত,কব্জিতে মোটা চুড়ি, আংটি, মাথায় মুকুট সবই আছে। চার হাতে ধরা আছে শঙ্খ, চক্র, গদা, এবং পদ্ম। তবে দেবলা মিত্র এই মূর্তিকে বিষ্ণুর 'জনার্দন' রূপ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার 'অগ্নি পুরাণ' ও 'পদ্মপুরাণ' মতে মূর্তিটির সঙ্গে নাকি 'বাসুদেবের' কিছু মিল রয়েছে। 
লিঙ্গ: বিষ্ণু মূর্তির পাশেই পাঁচটি যে লিঙ্গ পাওয়া গেছে তাদের উপরের অংশ গোলাকার মাঝের অংশটুকু অষ্টভুজাকার এবং একেবারে গোড়ার অংশটি বর্গাকার।
পার্বতী: বেলে পাথরের একটি ভাস্কর্য জোড়া পদ্মের উপর দন্ডায়মান এক মহিলা। পার্বতীর এই মূর্তি ললিতাসনে উপবিষ্টা।
ডিভাইন মাদার: দেবলা মিত্র কতকগুলো ধ্বংসস্তূপের পাথরের মধ্যে এই মূর্তিটিকে দেখেছিলেন।। কোন রকম ছাউনি ছাড়াই গত পঞ্চাশ বছর ধরে শুয়ে আছে একটি খাটিয়ায়। এবং এটি 'গণেশ জননী' রূপেই নাকি বেশি পরিচিত। শাড়ি ও বিভিন্ন অলংকারে সুসজ্জিতা। আনুমানিক নবম শতাব্দীর ভাস্কর্য বলেই তার মনে হয়েছে। তিন ফুট দীর্ঘ এবং ১ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চ এই মূর্তিটি। এর খাটিয়ার নিচে একটি সিংহ মূর্তি আছে। যা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় মূর্তিটি দেবী 'পার্বতী', শিশু কার্তিকের মা।
গণেশ: ২ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চ এবং ১ ফুট ৭ ইঞ্চি চওড়া বেলে পাথরের চতুর্ভুজ এই গণেশ মূর্তি। একাধিক অলংকারে সুসজ্জিত। তবে অলংকারের বেশিরভাগটাই ক্ষতিগ্রস্ত।"

"বর্তমানে এই ধরনের কোন মূর্তি কি এখন আছে?"

"'গুরুডি' গ্রামের এক শিব মন্দিরে শিবলিঙ্গ, বিষ্ণু মূর্তি যেমন রয়েছে, সে রকম কিছু অপরিচিত মূর্তিও রয়েছে। তার মধ্যে জৈন নেমিনাথের মূর্তি রয়েছে। আবার 'জামাডি' গ্রামে একটি মাতৃকামূর্তি রয়েছে। যিনি হাতির উপর বসে আছেন। স্থানীয় মহিলারা একে 'লিরলা দেবী' নামেও ডাকেন। (তেলকুপি এক লুপ্তপ্রায় মন্দির নগরী, রাহুল নাগ, ইতিহাস অনুসন্ধান ২৯ সম্পা: মঞ্জু চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা- ১৮০) এছাড়াও নদী তীরবর্তী পাথরবাড়ী গ্রামে, 'নীলকণ্ঠ বাসিনীর মূর্তি', 'ঋষভদেব', 'বিষ্ণু' মূর্তি, জয়পুরে 'ত্রিশলা', 'মহাবীর', 'গণেশ' মূর্তি, লালপুরে 'অম্বিকা' দেবী সহ কিছু ভগ্ন জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি যেমন রয়েছে তেমনি নদীর অন্য পাড়ের কিছু গ্রাম যেমন খাড়াপাথরে তীর্থঙ্কর 'ঋষভনাথ', 'বিমলনাথ' ও 'অম্বিকা' দেবীর মূর্তি রয়েছে। পাশাপাশি শিবপুরে 'অরুড়া দেবী' এবং 'গণেশ' মূর্তিও আছে।"


"মন্দিরগুলোর সঠিক সময়কাল জানা গেছে কি?"

"আসলে মন্দিরগুলোর গায়ে কোথাও কোন রচনাকাল উল্লেখ নেই। কেবল নানান ঐতিহাসিক ঘটনা ও ভৌগোলিক অবস্থানের পরম্পরায় বিচার করে ধারণা করা হয়েছে মন্দিরগুলো ৯০০ থেকে ১২ শতাব্দীতে রচিত। দীপকরঞ্জন দাসও এই সময় কালের কথায় উল্লেখ করেছেন (পুরুলিয়ার মন্দির স্থাপত্য, অহল্যাভূমি পুরুলিয়া, প্রথম পর্ব, পৃষ্ঠা- ১৪২)।"

"মন্দিরগুলোর নির্মাণ বা গঠনশৈলী শুনেছি উড়িষ্যার রেখ দেউলের মতো। এটা কতখানি সত্য?"

"এখানে একটা সমস্যা আছে। সমস্যা হল সরাসরি উড়িষ্যার দেউলের যা রীতি তা তেলকুপির মন্দিরগুলোতে অনুসৃত হয়নি। আবার বেশ কিছু জায়গাতে সাদৃশ্যও রয়েছে। তবে অমিলটাই যেন বেশি।"

"কী রকম?"

"তেলকুপির মন্দিরগুলোতে ভদ্রের পিঢ়াগুলিকে বেশ বড় করা হয়েছে। গন্ডির উপর ঘন্টা না বসিয়ে সোজা রেখ মস্তক বসানো হয়েছে। (মানভূম জেলার মন্দির, নির্মলকুমার বসু, প্রবাসী, ১৩৪০, ভাদ্র সংখ্যা) এরকমই বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। তেলকুপির এই মন্দিরগুলোর সঙ্গে বরং উত্তর ভারতের গয়ার মন্দিরগুলোর বেশ কিছু মিল পাওয়া গেছে।"

"গয়ার মন্দিরের সঙ্গে মিল কীভাবে?"

"নির্মলকুমার বসু এ নিয়ে কী বলেছেন দেখুন, তিনি বলেছেন, তেলকুপির মন্দিরগুলো উড়িষ্যার রেখ দেউলের মতো তিনটি অংশ 'পা ভাগ', 'জাংঘ', এবং 'বরণ্ড' থাকলেও মন্দিরগুলোর উচ্চতা এত বেশি যে উচ্চতার কারণে গয়ার মন্দিরগুলোর সঙ্গে এক গোত্রে মিলে যায় (মানভূম জেলার মন্দির, নির্মলকুমার বসু, প্রবাসী, ১৩৪০, ভাদ্র সংখ্যা) তবে গয়া ও উড়িষ্যার সঙ্গে সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য থাকলেও তেল কুপির মন্দিরগুলোর যে একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল সে কথা অস্বীকার করা যায় না।"

দামোদরের জলে আমি একটু হাত ডুবিয়ে সেই ইতিহাসের একটু স্পর্শ নিয়ে কত কিছুই না ভাবতে লাগলাম।

তথ্যসূত্র: ১) Telkupi- a submerged temple site in West Bengal/ Kebala Mitra
২) Report of a Tour through the Bengal provinces, 1878, Voll- viii/ J. D. Belar
৩) 'Statistical Account of Bengal, Voll- xvii/ W.W. Hunter
৪) An Report arch. surv. Bengal Circle for the year ending with April (1903)/ T. Bloch
৫) পুরুলিয়া/ তরুণদেব ভট্টাচার্য
৬) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি ১ম খন্ড/ বিনয় ঘোষ
৭) তেলকুপি মহানগরী সেকাল একাল/ ড: সুভাষ রায়
৮) অহল্যাভূমি পুরুলিয়া/ সম্পা. দেবপ্রসাদ জানা
৯) ইতিহাস অনুসন্ধান/ সম্পা.  মঞ্জু চট্টোপাধ্যায়
১০) প্রবাসী পত্রিকা, ১৩৪০, ভাদ্র সংখ্যা
১১) বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস(রাজন্য  কান্ড)/ নগেন্দ্র নাথ বসু

🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ  হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪




Post a Comment

0 Comments