দূরদেশের লোকগল্প— ১৩৩
সর্পরাজের সর্বনাশ—উগাণ্ডা (আফ্রিকা)
চিন্ময় দাশ
সবুজে মোড়া একটা গ্রাম। সুন্দর ছবির মত সাজানো। একটা পাহাড়ের একেবারে পায়ের তলাটিতে, বিশাল একটা হ্রদ। তার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে গ্রামটা।
বাড়িঘরগুলো গড়ে উঠেছে কলাবাগানের ফাঁকে ফাঁকে। প্রত্যেকটা বাড়ির উঠোন জুড়ে ফলের গাছ । কমলালেবু, পেয়ারা, পেঁপে কী নাই বাগানে? শুধু গাছ নয়। ফলে ভর্তি সব গাছ। ছাগলের পাল নিয়ে পাহাড়তলিতে যায় ছেলের দল। ভারি নিরাপদ এলাকা। বিপদ বা ভয়ের কোন কারণই নাই। সুখে শান্তিতেই জীবন কেটে যায় এখানে।
এমনটা কিন্তু চিরকাল ছিল না। বরং ভারি বিপদের এলাকাই হয়ে উঠেছিল জায়গাটা। কোথা থেকে একটা সাপের উদয় হয়েছিল পাহাড়ে। বিশাল এক অজগর। প্রতিদিন নেমে আসবে পাহাড় থেকে। ছাগল, ভেড়া, এমনকি ছেলেপুলে—সামনে যা পাবে, গিলে ফেলে, তবে ফিরবে।
কত দিন আর এমন চলতে পারে? কতো আর সহ্য করা যায়? নিরুপায় হয়ে, লোকজন তল্পিতল্পা গুটিয়ে, গ্রাম ছেড়েই পালিয়ে গেল একদিন। পাহাড়তলি, হ্রদ, সবুজে মোড়া গ্রাম সব খাঁ-খাঁ করতে লাগল।
রাজার কানে গিয়ে উঠল কথাটা। ঘরবাড়ি ফেলে পালিয়ে যেতে হবে প্রজাদের—মোটেই ভালো কথা নয় এটা। রাজা মাথা চুলকাতে লাগল। কিছু একটা তো করতেই হবে। কিন্তু কী করা যায়?
চিরকালের দুটো অভ্যাস আছে রাজার। প্রথমে নিজের মাথা চুলকাবে। যদি কিছু উপায় বের করা যায়। আর, মাথা থেকে কিছু বের না হলে, তখন? তখন দ্বিতীয় অভ্যাস—দরবারে সভা ডেকে দেওয়া।
সভা মানে অনেক লোকের জমায়েত। অনেক বুদ্ধি। অনেক পরামর্শ। একটা না একটা উপায়ে বেরোবেই।
সাপের ব্যাপারে সেটাই হোল। অনেক চুলকিয়েও, মাথা থেকে বেরুলো না কিছুই। তখন দ্বিতীয় পন্থা। সভা ডেকে দিল রাজা।
এবারের সভায় কেবল রাজার মন্ত্রী-সান্ত্রী আর পাত্র-মিত্র নয়। আরও বহু লোককে ডাকা হয়েছে। বেছে বেছে বেশ কিছু পণ্ডিত, বুদ্ধিমান, বলবান, সাহসী লোককেও হাজির করা হয়েছে সভায়।
ভরা দরবার। গমগম করছে সভা। নানা জনের নানান পরামর্শ। একজন একটা বুদ্ধি বাতলায়, তো আর একজন তার ঠিক উল্টোটা। কে কাকে টেক্কা দেবে, তার প্রতিযোগিতা চলেছে। রাজা দেখল, পরামর্শ দিতে সবাই ওস্তাদ। কিন্তু একজনও এগিয়ে এসে বলল না—রাজামশাই, চিন্তা করবেন না। আমি যাচ্ছি, সাপটাকে নিকেশ করে আসব।
সভা যখন শেষ হবার মুখে, তখনই একজন বলল কথাটা। রাজা যেমন অবাক, তেমনি ভারি খুশি। রাজ্যে তাহলে একজন অন্তত সাহসী লোক আছে।
ভীড়ের একেবারে পিছনে ছিল লোকটা। রাজার হুকুমে, সেপাই গিয়ে একেবারে রাজার সামনে নিয়ে এলো লোকটাকে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে, রাজা হতাশ। নেহাতই একটা চাষীবাসি মানুষ। রোগা প্যাটকা চেহারা। সাধারণ উলিঝুলি পোষাক। সাহস কতটা আছে কে জানে। শক্তি বলে যে কিছু নাই, সেটা বলে দিতে হয় না।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
সত্যি বলতে কী, একটু ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে গেছে রাজামশাই। বলল—তুমি মারবে ভয়ানক সাপটাকে?
লোকটা কিছু বলবার আগেই, রাজার সেনাপতি উপহাস করে বলল—তাহলে তীর-ধনুক, লাঠি-সোটা, বল্লম-তরোয়াল যা লাগবে দিয়ে দেওয়া হোক এই বীরপুরুষকে। যুদ্ধযাত্রা করুক।
খোঁচাটা গায়ে না মেখে, লোকটা বলল—অস্ত্র-শস্ত্র কিছুই চাই না আমার।
--সাপটাকে কি হাতে ধরে, আছড়ে মারবে না কি? সেনাপতি আবার বলে উঠল।
লোকটা বলল—বড় মাপের একটা জালাহাঁড়ি চাই আমার। শক্ত দড়ি একটা। আর চাই কিছু সোনার গয়না। তবে, কাজ শেহ করে, সোনাদানা সবই আমি ফেরত দিয়ে যাব। জিনিষগুলো পেয়ে গেলে, সাপের ভাবনা আমার ঘাড়ে।
সবই এনে দেওয়া হোল। হাসি মুখে জিনিষপত্র ঘাড়ে করে, রওণা হয়ে গেল লোকটা। ছোট একটা ছেলে ছিল ঘরে। তাকেও সাথে নিয়েছে সে। ছেলেটার হাতে একটা বাঁশের বাঁশি। সেটাতে ফুঁ দিতে দিতে চলেছে বাবার পেছন পেছন।
পাহাড়তলিতে এসে হাজির বাবা ছেলে। চারদিক শুনশান। খাঁ-খাঁ করছে ফাঁকা গ্রামখানা।
বেশ জোরে জোরেই বাঁশি বাজাচ্ছে ছেলে। সাপটা তো ছিল তার ডেরায়, পাহাড়ের ফাটলে। সাপের কানে গিয়েছে বাঁশির সুর। সুর তো চিরকালই সাপেদের ভারি প্রিয়। তাই বেশ পছন্দও হয়েছে তার। কিন্তু দুটো উটকো মানুষ সাহস করে তার এলাকায় চলে এসেছে, দেখে, একটু অবাকও হয়েছে সাপ।
কিছুক্ষণ বাঁশি বাজিয়ে, ছেলেটা গেয়ে উঠল—
সাপের রাজা সাপের রাজা
কোথায় আছো, বেরিয়ে এসো।
দেশের রাজা তোমার জন্যে
ভেট পাঠালো, দেখবে এসো।।
সাপ তো অবাক। দেশের রাজা ভেট পাঠিয়েছে তার জন্য? শুনে, বেশ গুমোর হোল মনে। ভাবল, দেখাই যাক, ব্যাপারখানা কী?
ছেলেটা বাঁশি বাজিয়েই চলেছে। তার বিরাম নাই। এমন সময় জোর হিসহিস শব্দ। সাপ নেমে এল পাহাড় থেকে। একেবারে বাবা ছেলের সামনে হাজির। রাগ দেখানো নাই, ভয় দেখানো নাই। কামড়াতে যাওয়া তো দূরের কথা। বরং সেও কথার জবাব দিয়ে বলল--
এই তো ঘরের বাইরে এলাম,
আমি হোলাম সর্পরাজা।
দেখাও আগে, কী এনেছো--
নইলে পাবে ভীষণ সাজা।।
চাষি লোকটার চোখে মুখে আনন্দ ধরে না। মাথা খাটিয়ে যেমন ছক কষেছিল, একেবারে সে ভাবেই এগোচ্ছে ব্যাপারটা।
মওকা বুঝে, ছেলে গেয়ে উঠল--
জালায় আছে খাবার দাবার
জালায় আছে গয়নাগাটি।
নাক ডাকিয়ে শুয়ে পড়ো
বিছানা পাতা পরিপাটি।।
ছেলে গাইছে, বাবা লেগে গেল সাপকে জিনিষপত্র দেখাতে। দেখাচ্ছে আর বোঝাচ্ছে—জালাটা বেশ বড় মাপের। কোন অসুবিধা হবে না তোমার। খাবার দাবার যা লাগবে, বলো। আমরা এনে দেব সব। আর তোমার উপহার হোল এইসব গয়নাগাটি।
এক এক করে গলার হার, হাতের আংটি, মাথার মুকুট—সব দেখাতে লাগল। সোনার জিনিষ। ঝলমল করছে সাপের সামনে। আনন্দে সাপের মন নেচে উঠল। এখন আর সন্দেহের কিছু নাই।
লোকটা বলল—তোমাকে নিয়ে কেবল একটাই চিন্তা আমাদের রাজামশাইয়ের।
--কেন? চিন্তা আবার কিসের? সাপ বলল।
লোকটা বলল—আসলে, তোমার চেহারাখানা কতোটা বড়, তা তো রাজামশাইর জানা নাই। এই জালায় তোমার আঁটবে তো? সমস্যা বলতে এটুকুই।
--খুব আঁটবে। এটা কোন সমস্যাই নয়। সাপ বলে উঠল—এই দ্যাখো। নিজের চোখে দেখে নাও, আঁটে কি না।
আসলে সাপের মনে বেশ খুশি। এমন খাতিরদারি কখনও জোটেনি তার কপালে। হিলহিলিয়ে জালার ভিতর ঢুকে পড়ল সাপটা। কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে, ঠিক সেঁটে গেলে জালাটাতে।
লোকটা দেখল এই মওকা। তাড়াতাড়ি বলে উঠল—সর্পরাজ! একটা কথা বলি, শোন। এমন সুন্দর নাদুস নুদুস চেহারা তোমার। পাহাড় থেকে এতখানি রাস্তা নেমে, কিছু তো খাটুনি হয়েছেই। জালায় যখন ঢুকেই পড়েছ, একটু খানি জিরিয়ে নাও বরং।তাতে বিশ্রাম হোল, জালাটা জুতসই কি না, পরখ করে নেওয়াও হোল। দু’দিকেই লাভ।
সাপের বেশ মনে ধরল কথাটা। বলল—ভালোই বলেছিস। জিরিয়েই নিই একটু।
সাপের উত্তর শুনে, লোকটা তো আহ্লাদে ডগমগ। ছেলেকে বলল—রাজামশাই শুয়েছে। ভালো দেখে একটা সুর বাজা তো বাবা বাঁশিতে। আমিও হাত বুলিয়ে দিচ্ছি গায়ে মাথায়। যদি একটু ঘুমও এসে যায়।
ছেলে তো বুঝে গিয়েছে। মিষ্টি মিষ্টি সুর তুলতে লাগল বাঁশিতে। লোকটা করল কী, জালায় হাত ঢুকিয়ে সাপের গায়ে চাপড় মারতে লাগল আলতো করে।
খানিক বাদেই কেল্লা ফতে। সাপের আর সাড়া নাই। ঠিক ঘুমিয়ে পড়েছে। অমনি জালার মুখে ঢাকনা চাপিয়ে দেওয়া হোল। দড়ি বেরোল ঝোলা থাকে। ঢাকনাটাকে জব্বর করে বাঁধা হোল জালার মুখে। এবার নিশ্চিন্ত। কাজ শেষ। সর্পরাজের কেরামতি খতম।
জালা মাথায় চাপিয়ে, রাজবাড়ির রাস্তা ধরল লোকটা। ছেলে চলেছে পাশে পাশে। একবার বাঁশি বাজায়। একবার ছড়া কাটে। আবার বাঁশি বাজায়। আবার ছড়া কাটে--
দেশের রাজার জালার ভিতর,
বন্দী হোল সাপের রাজা।
ভয়ডর সব ঘুচল এবার
বাদ্যি বাজা বাদ্যি বাজা।।
রাজার বাড়ি তো কম দূরের পথ নয়। একটা একটা করে গ্রাম পার হচ্ছে বাবা ছেলে। ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসছে লোকজন। পিছন পিছন চলেছে দল বেঁধে। সবাই ছড়া কাটতে লেগেছে। ড্রাম বাজাচ্ছে। বিউগল বাজাচ্ছে। আনন্দে গড়াগড়ি যাচ্ছে মানুষজন।
পুরো শোভাযাত্রা এসে হাজির হোল রাজবাড়ির মাঠে। রাজা বেরোল, রানি বেরোল। মন্ত্রী বেরোল, সান্ত্রী বেরোল। উজির বেরোল, নাজির বেরোল। ভিড়ে ভিড়াক্কার। রাজা সব দেখল। সব শুনল। আনন্দ ধরে না আজ তার।
রাজার পায়ের কাছে জালা নামিয়ে রাখল লোকটা। গয়নাগাটি যা নিয়ে গিয়েছিল ফেরত দিয়ে দিল সব। রাজা পারলে বুকে জড়িয়ে ধরে চাষি মানুষটাকে।
রাজার কানের কাছে মুখ নিয়ে,মন্ত্রী বলল—রাজামশাই, এমন বুদ্ধিমান লোক রাজ্যে আর দুটি নাই। লোকটাকে বেঁধে রাখুন। ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কথা নয়।
কথাটা বেশ মনে ধরল রাজার। ঘোষণা করে দিল—এমন বুদ্ধি আর এমন সাহসের কাজ করেছে এই লোকটা। এর পুরষ্কার পাওয়া উচিত। পুরো একখানা গ্রাম দেওয়া হোল একে। বংশ বংশ ধরে এর নাতিপুতি সবাই ভোগ করবে এই জমিজমা। তবে, ডাক পেলেই, দরবারে এসে হাজির হতে হবে এদের। বুদ্ধি পরামর্শ দেবে দরকার মতো।
রাজা বলল—আর একটা কাজ হবে এখানেই। আগুনের কুণ্ড জালা হোক এই মাঠে। সাপশুদ্ধ হাঁড়ি চড়িয়ে দাও আগুনে। সাপের মাংস দিয়ে ভোজ হবে আজ আমাদের।
উল্লাসে হইহই করে উঠল মানুষজন।
আগুন জ্বালার জন্য কাঠকুটো জড়ো করা হচ্ছে। বাঁশি থামিয়ে, ছড়া কাটতে লাগল ছেলেটা—
সাপের রাজা খতম হোল
ভয়ডর সব গেল সবার।
ড্রাম বাজিয়ে নেচে গেয়ে
নিজের ঘরে ফেরো এবার।।
1 Comments
এই বিদেশি উপকথাগুলো ভালো লাগছে।
ReplyDelete