জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (দশম পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত (দশম পর্ব)

শ্রীজিৎ  জানা

অভিরাম মাঝেসাঝে গ্রামে আসে। বিশেষ করে গাঁয়ের কালীপূজার সময়। সপরিবারে এলেও রাতটুকু কাটিয়ে ফিরে যায়। পুরানো মাটির ঘরটা এখনো আছে। তারই একটা কামরা অভিরামের ভাগের। আগেকার মাটির বারান্দা ঘর। অভিরামের বাপ গর্ব করে বলত,
—গজেন বাগদি গতর খেটে ই ছপর টাঙিছে। গটা গেরাম ঘুরে দেখা দিখি এই বাক্সবারন্দা ঘর কারো আছে নাকি!
গল্পে এখানেই ছেদ পড়ত না। মহারাজপুরের কোচন মিস্ত্রির কথা আসত। কোচন দোলই নাম করা ঘরামি। তার হাতে মাটির ঘর করা মানে নিশ্চিন্ত। চার হাতের চওড়া দেয়াল দেওয়া গজেনের ঘর। ঝড় হলে গজেন চোখ নাচিয়ে কালিতলায় সকলকে শুনাত,
—মোর ঘরের চার হাতের পানা। লড়াও দিখি ঝড়ের কত বেগ। মোর ছপর পড়া মানে  জানবি,ঢোলে কারো ছপর থাকবেনি। ধূলিস্যাৎ হই যাবে। 
ভিটার উত্তরে ছিল বিশাল বড় অর্জুন গাছ। গজেন ফেনিয়ে তার গল্প দিতে গিয়ে বলত,
—ছোট বেলায় দেকতম কলাইকুন্ডা থিকে উড়াজাহাজ গেলে গাছের টঙের পাতা লড়ত। লাঙল দড়ি বেড় দিতে কুলাত নি,এত মটা!
গজেনের ঠাকুরদা নফরের হাতে লাগানো সেই অর্জুন গাছ। ঘর করার সময় গজেন সেই গাছ কাটে। বাসদেবপুরের শওকত আলির ডাক পড়ে গাছ কাটতে। গায়ে যেমন তার শক্তি,তেমন তার সাহস। মুসলমান হলে কি হবে অমন ব্যবহার কারো ভুলবার নয়। একমাস ধরে কাটাইয়ের কাজ চলে। যেদিন গাছে প্রথম করাত বসায় শওকত, গজেনের চোখ ছলছল করে উঠে। শওকতকে তার বাপের কথা শোনায়। বলে,
—জান শওকতদা,বিসনায় শুয়ে বাপ মোকে বোল্লে,শুন বড়কোচা,মোর জীবনটা কুঁড়ায় কেটে গেল, তুই একটা ঘর করবি।  অর্জুন গাছটা কেটে সাঙা,মধুন,পাড়,দাঁড়া-লাতখারা,পাল্লা যা লাগে সব করবি।
গাছ কাটার সময় গজেনের মনে হয় শওকত তার ঠাকুর্দার অর্জুন গাছে নয়,যেন তার বাপের বুকে করাত বসাচ্ছে। গামছার খুঁটে চোখ মুছে সরে যায় সেই মুহূর্তে। 
সেই কাঠে বারান্দা ঘরের  সব সাজসরঞ্জাম তৈরি করে ব্যাঙরালের পুন্য কোটাল। পুন্য কোটালের মতো কেঠা মিস্ত্রি সহজে পাওয়া যায় না। প্রথম দিকে ঘরের মাথায় খড়ের ছাউনি থাকলেও,পরে টালি আর টিন চাপে। গজেন বেঁচে থাকা অবস্থায় ছেলেদের অনেক করে ঘর ভাঙতে নিষেধ করে। লোখাও তার বাপের স্মৃতি স্বরূপ ঘরটাকে আগলে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালায়।  
লোখার সেজদাদা জয়রাম আজ কত বছর হয়ে গেল নিরুদ্দেশ। জয়রামের ছেলের বয়স তখন তিন বছর। রামনবমী তিথিতে নাড়াজোলে রথ হয়। খান রাজাদের আমল থেকে চলে আসছে এই রথযাত্রা। সাত দিনের জমজমাট মেলা। নাড়াজোল রথের মেলা যাবে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জয়রাম। তারপর আর ফেরেনি। কতদিন ধরে সবাই খোঁজখবর চালায় চতুর্দিকে। কিন্তু কেউই কোন হদিশ দিতে পারে না জয়রামের। এতদিন ধরে পাড়াঘর থেকে গ্রাম সবাই যেটা অনুমান করেছিল,সেটাই নিশ্চিত বলে ধরে নেয় সকলে।
সংসারে জয়রামের কোনদিনই মন ছিল না। ঠাকুরদেবতা নিয়েই তার দিন কাটত। গাঁয়ের কালীমন্দিরে পড়ে থাকত রাতদিন। মুখে তার সারাক্ষণ লেগে থাকত হাসি। কোনদিন কাউকে উচ্চবাচ্য করেনি। স্কুলে যাইনি সে কোনদিন। কিন্তু তার মতো শ্রুতিধর কাউকে পাওয়া যাবে না। দূরদূরান্তে হরিবাসর,ভগবতপাঠ,রামায়ণ গান,কবিগান, যাত্রা, কীর্তন হলেই জয়রাম সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। জয়রামের আবভাবে অন্য দাদা-ভাইরা রাগেনি কখনো। বিরক্তির বদলে সহজ মনেই সবাই মেনে নিত। ভগী খুড়া কতবার কথার মাঝে লোখাকে বলেছে,
—--জয়রাম দেবখনে জন্মেছে, বুজতে পারুনু। উ দেব অংশের ছ্যানা। সংসার অকে বাঁধতে পারবেনি। বাগদির ঘরে নাইলে অমন ছ্যানা কি করে জন্মায়, বল দিখি! দেখবি উ ছ্যানা ঠিক কুনু মঠমন্দিরে আছে। মন খারাপ করিসুনু, ঠাকুর যাকে টেনেছে তাকে তুই আমি আটকি রাখতে পারবনি কুনুদিন। বাগদির উপরে ঠাকুর কৃপা করেছে। কজনের এমন ভাগ্য হয় বল দিখি!
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇https://play.google.com/store/apps/details?id=com.littlemag.jaladarchi
যত কথা শুনে তত লোখার গায়ে কাঁটা দ্যায়। দাদাকে আর সবাই ভুলে গ্যাছে কিনা জানে না। সে কোনদিন ভুলতে পারবেনা তার দাদাকে। কত ঠাকুর থানের প্রসাদ,হরিলুটের বাতাসা জয়রাম এনে দিত তার ছোট ভাইকে। কত জায়গার অষ্টমপ্রহরে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে তাকে। ভাইয়ের প্রতি দাদার স্নেহ ভালবাসা সহজে ভুলবার নয়। সেবার গাঁয়ের কালিীপূজার দিন।  হঠাৎ দাদার কথায় লোখার মন উদাস হয়ে যায়। তখন খগেন মাস্টার তাকে যেসব কথা  বলেছিল, তা কোনদিন ভুলবেনা সে
—--মন খারাপ করবি ক্যানে বল দিখি! মোদের জাতটা ত জন্ম থিকেই খাল বিলের মাছ ধরে,পাখি মেরে আর লোকের দয়রে বাগাল খেটে কাটাল। কুঁদুল করে, লাঠালাঠি করে নিজেদের নিজেদের মাথা ফাটাল। তারপর তাড়ি হেড়া মদ গিলে পঞ্চাশ বয়স পেরানার আগেই মরে গেল। দেখুনু দেশি মদ খেয়ে পেট লাউপারা,হাতপা লাউডগা আর পঁদপাছা নারকেল মালার মত করে ঘুরেঠে।কানপাটি ফুলে গুড়পিঠার মত হইচে। সেখিনে রামাদ্দা যে পথে গেছে বলে মনে করিঠি সবাই, সে কি কম গর্বের! যেদি সত্যিই রামাদ্দা কুনু মঠমন্দিরে থাকে সব থিকে খুশি হব আমি। যে জাতকে ছোট জাত বলে ঘেন্না করে অন্য জাতরা,তাদের কাছে গর্ব করে ত বলতে পারব ভগমান জাত দেখে কৃপা করে নি,মন দেখে করে।
সেদিন লোখা চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। কতবার মনে মনে সে ভেবেছে,কেন তাকে ভগবান এমন একটা  মন দিয়েছে। ময়না তাকে বলে সে নাকি মেয়ের মতো কথায় কথায় কাঁদে। কিন্তু মেয়েরা কবে বুঝবে পুরুষের চোখের জল শ্রাবণের বৃষ্টি নয়, কালবৈশাখীর ঘনকালো মেঘের অন্তর্দাহের ধারাপাত। বুকের খাঁচার ভিতর ব্যথার দুর্বিসহ ঝড়ঝাপটা দুমড়েমুচড়ে দ্যায় মনের ঘরবাহির। দেখার চোখ ভগবান সকলকে দেয় না। তাকানো আর দেখার মাঝে শিলাইয়ের উঁচু বাঁধের মতো ফারাক আছে। ফারাক থাকে। যত হোক জয়রাম তার মায়ের পেটের দাদা। রক্তের সম্পর্ক। তার দুঃখেও চোখে ভিজবে আর সুখেও। খগেন মাস্টারের কথা তখনো থামেনা,,
—-জানু,,যদি বলি দধীচি মুনি বর্গক্ষত্রিয় রে রে করে উঠবে পন্ডিতরা। বলবে কুন শাস্ত্রে লেখা আছে শুনি? উত্তর আছে। মুখের উপর বলতে পারি লিখেছে রায় বাবু তার বইয়ে। কিন্তু কেন বলতে যাব?  পয়োজনে তরা খুঁজ। মোদের দাবী নস্যাৎ কর।বাগদিরা বলে তাদের নাকি একটা হাড় বেশি।  শুধু কি তারা পরিশ্রমী জাতি বলে, যুদ্ধবাজ জাতি বলে! যদি বলি বর্গক্ষত্তিয় মুনি দধীচির হাড়ে বজ্র নামক অস্ত্র তৈরী হইছিল। অস্ত্র তৈরীর কৌশলটা সেই জানত। কিন্ত তাকে হত্যা করে ছলে বলে উচ্চবংশজাত ইন্দ্রর হাতি লেয়। অম্নি প্রমাণ দাখিলের প্রশ্ন উঠবে। বলবে ইসব মনগড়া,গাঁজাখুরি গল্প। আসলে মেনে নিতে বুকে বাজবে রে লোখা। নীচু জাত বলে তাকে তুমি বলির পাঁঠা করতে পার। কিন্তু সুনাম কল্লে নিজেদের ছোট করা হবে। তার বদলে জাত লুকিয়ে দধীচিকে উচ্চশ্রেণী দেখিয়ে দাও। থাইলে সব গৌরব নিজেদের সম্পত্তি করে রাখা যাবে আর কি। আমি থেমে নেই রে লোখা এই লড়াই আমি থামাবো না।  তাই রামাদ্দার গৃহত্যাগে আমি গর্বিত,তুইও গর্ব কর,দুঃখ করবিনি কুনুদিন।
মাস পেরিয়ে বছর গড়ায়। জয়রামের ঘরে ফেরার আশা একবারে মরে যায়। একসময় আরতির মুখের দিকে তাকাতে পারা যেত না। ছেলেকে কোলে নিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকত পথের দিকে। লোখা অনুভব করতে পারত তার বৌদির কষ্ট। জয়রামের ঘর ছাড়ার জন্য বাখুলে,পাড়ায় অনেকেই আরতিকে ঠেস মেরে কথা বলত। কেন সে তার আঁচলে স্বামীকে বেঁধে রাখতে পারেনি। আরতি বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের। বাগদি ঘরের মুখরা মেয়েদের ভীড়ে আরতি আলাদা। বাপের বাড়ি তার মশরপুর।  পন্ডিত বংশের ঝিউড়ি আরতি। বাগদি জাতের মধ্যে তারা ব্রাহ্মণ। লোকে বলে বেগদা-বামুন। বামুনদের মতো এদেরও ছেলেদের উপনয়ন হয়। পরে উপবীত খুলে দক্ষিণ হস্তে ধারণ করতে হয় তামার বালা। পন্ডিত বংশের লোকেরা পূজো করে। বাগদির হাতে পূজা নেয় চন্ডী,দূর্গা,মনসা,ধর্মঠাকুর। মশরপুরের জাগ্রত মা বাটুলবুড়ির সেবাইত হলেন পন্ডিতরা। প্রায় পাঁচশ বছরের প্রাচীন দেবী। মন্দিরের সামনে দিয়ে বয়ে গেছে বাটুলবুড়ি খাল। সেই খাল মিশেছে কেঠিয়ার বুকে। খালের জল নিয়ে কেঠিয়া নদী আবার শিলাবতীর স্রোতে হারিয়ে গেছে। বাটুলবুড়ির খালের ধারে মন্দিরের সামনে বিশালাকায় অর্জুন গাছ। লোকে বলে বহুকাল আগে এই খাল দিয়ে স্টীমার চলত। অর্জুন গাছে বাঁধা থাকত স্টিমারের  শিকল। শিকলের দাগ আঁকাছিল গাছের গায়ে। কালে সেই চিহ্ন মুছে গেছে। গাছটা আজও দাঁড়িয়ে আছে অবিকল।

Post a Comment

0 Comments