জ্বলদর্চি

বিপত্তারিণী পূজা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৭৪
বিপত্তারিণী পূজা

ভাস্করব্রত পতি

"মাসি পূণ্যতমেবিপ্রমাধবে মাধবপ্রিয়ে।
ন বম্যাং শুক্লপক্ষে চবাসরে মঙ্গল শুভে। 
সর্পঋক্ষে চ মধ্যাহ্নেজানকী জনকালয়ে। 
আবির্ভূতা স্বয়ং দেবীযোগেষু শোভনেষুচ। 
নমঃ সর্ব মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে 
শরণ্যে ত্রম্বক্যে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে"। --
আষাঢ় মাসে হয় রথযাত্রা। সেই রথ থেকে উল্টোরথের মধ্যেকার মঙ্গলবার ও শনিবারের যেকোনো একদিন হিন্দু মহিলাদের দ্বারা পালিত হয় বিপত্তারিণী পূজা। নামকরণের মধ্যেই পরিস্কার যে, যাবতীয় বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য এই ব্রত বা পূজা। বিপত্তারিণী হলেন দেবী সঙ্কটনাশিনী এবং দেবী দুর্গা তথা পার্বতীর ১০৮ অবতারের এক অবতার। অর্থাৎ দেবী দুর্গাই আসলে 'বিপত্তারিনী'। পুরাণ মতে তিনি 'কৌশিকীদেবী'। আবার 'জয়দুর্গা' নামেও তাঁকেই চিনি। 
বিপত্তারিণী পুজোর আগের দিন থেকেই নিরামিষ ভোজন করতে হয়। পূজোর সময় কোনও কথা বলা চলে না। এইদিন কোনও মহিলার সাথে অপমানজনক কথা বা অপ্রীতিকর আচরণ করা উচিত নয়। পূজোর শেষে লাল সুতো বা লাল উল দিয়ে বানানো ১৩ টি গাঁট যুক্ত ডুরি পরতে হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে বাম হাতে এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ডান হাতে বেঁধে দিতে হয়। এই ডুরিতে দূর্বা দেওয়া থাকে গিঁট বেঁধে। বিশ্বাস যে, এই লাল রঙা ডুরি হাতে থাকলে কোনও বিপদ স্পর্শ করতে পারে না। সার্বিক মঙ্গলের স্বার্থে এইদিন কাউকে চিনি ধার দিতে নেই। 

বিপত্তারিণী পূজাতে দরকার হয় মঙ্গলঘট, শিকডাব, আমপাতা, ১৩ রকমের ফুল, ১৩ রকমের ফল (অর্ধেক করে কাটা), চালের পিঠা ১৩ খানা, লাল সুতোর ডুরি ১৩ টি গিঁটযুক্ত, খিলি করা ১ টি পান (এলাচ যুক্ত) এবং ১৩ টি ভোজ্য নৈবেদ্য। এগুলো একটি পেতলের রেকাবিতে সাজিয়ে বাড়ির সামনে কোনো দুর্গা মন্দিরে পূজা দিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই রেকাবিকে বলে 'বাটা সাজানো'। নৈবেদ্য হিসেবে লুচি পটল ভাজা, সুজি, আলুভাজা করা হয়। চূড়ান্ত সংযম পালন করতে হয়। এরপর সকালে স্নান করে শুচিশুভ্র বস্ত্রে বিপত্তারিণী মায়ের পুজো করতে হয়। ব্রত পালনের পরে ব্রতকথা শুনে ব্রতীনীকে ঐ নৈবেদ্য গুলো খেতে হয়। চিঁড়া, দই ইত্যাদিও খাওয়া যায়। এই প্রসাদ খাওয়ার পর আর সারাদিন কিছু খাওয়া চলবে না। যদিও পূজা শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে যায়। তবে বাড়ির অন্যদের খাওয়ার জন্য আলাদা করে খাবার তৈরি করা থাকে। যে সধবা নারী এই ব্রত পালন করে, দেবী বিপত্তারিণী তাঁকে সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেন বলে প্রচলিত বিশ্বাস। তাই নারীরা সমস্ত বিপদ থেকে মুক্তি লাভ, বৈধব্যযন্ত্রণা ভোগ না করা এবং স্বামী সন্তানের মঙ্গলকামনায় এই ব্রত পালন করেন। তবে একবার বিপত্তারিণীর পূজা করা চালু করলে প্রতি বছর চালিয়ে যেতে হবেই। বিপত্তারিণী পূজার ধ্যানমন্ত্র হল ---
"ওঁ কালাভ্রাভাং কটাক্ষৈররিকুলভয়দাং মৌলীবন্ধেন্দুরেখাম্। 
শঙ্খং চক্রং কৃপাণং ত্রিশিখমপি করৈরুদ্বহন্তীং ত্রিনেত্রাম্। সিংহাস্কন্ধাধিরুঢ়াং ত্রিভুবনমখিলং তেজসা পুরয়ন্তীম্। ধ্যায়েদ্দুর্গাং জয়াখ্যাং ত্রিদশপরিবৃতাং সেবিতাং সিদ্ধিকামৈঃ"।। 

বিপত্তারিণী পূজার একটি ব্রতকাহিনী মেলে 'মার্কণ্ডেয় পুরাণ'তে। তা হল নিম্নরূপ -
একদা নারদ ঋষি পরানুগ্রহ কামনায় সমস্ত ভুবন ভ্রমণ করিতে করিতে কৈলাসে আসিয়া উপস্থিত হইয়া শিবের সহিত দুর্গাদেবীকে দেখিয়া প্রণাম পূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “কি ব্রতের দ্বারা বিপদ্ হইতে ত্রাণ পাওয়া যায়? হে পঞ্চানন, কৃপাপূর্ব্বক আমাকে বলিতে আজ্ঞা হউক"। 
মহাদেব বলিলেন, “বিপত্তারিণী দুর্গার ব্রত যে সকল স্ত্রীলোক করেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই অতি শীঘ্র বিপদ হইতে ত্রাণ পাইবেন”। নারদ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেই বা এই ব্রত করিরাছিল এবং মৰ্ত্তে কেই বা প্রকাশ করিয়াছিল"? 
মহাদেব বলিতে লাগিলেন, পূর্ব্বে বিদর্ভদেশে এক সত্যপরাক্রম রাজা ছিলেন। তাঁহার পত্নী ও সর্ব্ব প্রাণি হিতে রতা ও অত্যন্ত গুণবতী ছিলেন। একদা বনে এক চর্ম্মকার পত্নীর সহিত তাঁহার নির্জ্জনে বন্ধুত্ব হয়। রাজপত্নী তাঁহাকে নানাবিধ দ্রব্য এবং চর্ম্মকার পত্নী নানাবিধ ফল পরস্পর আদান প্রদান করিল।
একদিন যখন চৰ্ম্মকার পত্নী রাজবাটীতে উপস্থিত হইল, উভয় সখীতে পরস্পর কথাবার্তা হইতে লাগিল, এমন সময় রাজপত্নী বলিলেন, “ভাই, আমি কখনও গো মাংস দেখি নাই, তাহা কিরূপ তুমি গোপনে উহা আমার বাটীতে আনয়ন কর”। রাজপত্নীর বাক্যে অতি যত্নপূর্ব্বক গোপনে ঐ চর্ম্মকার পত্নী চুপড়ী করিয়া বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদনপূর্ব্বক গো মাংস রাজবাটীতে আনয়ন করিল। রাজপত্নী উহা গোপনে নিজগৃহে রাখিয়া দিলেন। রাজভৃত্য দেখিতে পাইয়া রাজাকে বলিয়া দিল। রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বাটীতে আসিলেন এবং রাজপত্নীকে আহ্বান পূর্ব্বক বলিলেন, 'তোমার গৃহে কি লুকাইয়া রাখিয়াছ, শীঘ্র আন! কি রাখিয়াছ তাহা যদি সত্য না বল, তাহা হইলে অদ্যই তোমাকে যম ভবনে পাঠাইব'।রাজ্ঞী অত্যন্ত ভীতা হইয়া বলিতে লাগিলেন, 'রাজন, আমার গৃহে নানাবিধ ফল পুষ্পাদি রহিয়াছে, ইহা ব্যতীত তো আর কিছু নাই'। এই কথা বলিয়া মনে মনে দুর্গাদেবীর স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন। রাজ্ঞী বলিলেন, “মা বিপত্তারিণী দুর্গে। আমি ঘোর বিপদে পতিতা হইয়া তোমার শরণাপন্ন হইলাম৷ মা, আমি ভক্তিহীনা বালা, আমি অন্যায় কার্য্য করিয়াছি, আজ আমাকে এই বিপদ্ হইতে উদ্ধার কর। আমি যাবজ্জীবন তোমার ব্রত করিব"। 

দেবী প্রীতা হইয়া প্রত্যক্ষ বলিলেন, 'বালিকা তোমার স্তবে আমি তুষ্ট হইয়াছি। তোমার ইচ্ছামত বর দিলাম, দেখ গিয়া যাহা গৃহে রাখিয়াছ উহা নানাবিধ ফল হইয়া রহিয়াছে। উহা মহারাজকে দিলে তিনি বিশেষ সন্তুষ্ট হইবেন'। দেবীবাক্যে আশ্বস্ত হইয়া তিনি গৃহে গিয়া বহুবিধ রম্য ফল পুষ্প রাজসমীপে আনয়ন করিলেন। রাজাও দেখিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন এবং রাজ্ঞীকে প্রশংসা করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই রাজ্ঞী উক্ত ব্রত করিয়া ইহলোকে নানা সুখ সম্ভোগ করিয়া অন্তে স্বর্গে গমন করিয়াছিলেন।
 
নারদ বলিলেন, “হে শঙ্কর ! ইহার বিধান কি, বলিতে আজ্ঞা হউক”। মহাদেব বলিলেন, “সমাহিত হইয়া শ্রবণ কর, ইহার বিধান বলিতেছি — আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষে দ্বিতীয়ার পর দশমীমধ্যে শনিভৌম দিনে এই ব্রত করিতে হয়। ব্রতের পূর্ব্বদিনে হবিষ্য করিয়া পরদিন ঘট পাতিয়া তাহাতে আম্রশাখা ও নানাবিধ ফল দিয়া নৈবেদ্য দ্বারা দেবী দুর্গার পূজা করিতে হয়। ত্রয়োদশ সংখ্যক ফল ও পূষ্প এবং পিষ্টক দিতে হয়। ব্রতীর জন্য ১৩ টি ফল কাটিয়া দুইভাগ করিয়া দিবে ও পান সুপারি দিবে। এক ভাগ ব্রাহ্মণকে দিবে, আর এক ভাগ ব্রতী পাইবে। একটি ভোজ্য উপবীত সহিত দান করিবে এবং কৰ্ম্মান্তে ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দিয়া ত্রয়োদশ গ্রন্থিযুক্ত রক্ত ডোর, নারী বাম হস্তে ও পুরুষ দক্ষিণ হস্তে ধারণ করিবে। এই ব্রত যিনি করিবেন, তিনি কখনও বিপদে গতিত হইবেন না, বিধবা হইবেন না। অধিকন্তু স্বামী সৌভাগ্য লাভ করিয়া পুত্র পৌত্র সমাযুক্তা হইয়া ইহলোকে নানা সুখভোগ করিয়া স্বর্গে গমন করিবেন” (সূত্র -- আশুতোষ মজুমদার)। 

দেবী বিপত্তারিণীর সৃষ্টিতত্ব নিয়ে দুটি কাহিনীর সন্ধান পাওয়া যায়। একবার দেবাদিদেব মহাদেব দেবী পার্বতীকে ‘কালী’ বলে সম্বোধন করেন। কিন্তু দেবী এই কথা শুনে ক্রুদ্ধ হলেন খুব। কঠোর তপস্যায় তিনি তাঁর নিজের কালো রূপ পরিত্যাগ করলেন। সেই কৃষ্ণবর্ণা দেবীই হলেন জয়দুর্গা তথা কৌশিকীদেবী তথা বিপত্তারিনী। আরেকটি মতানুসারে, বিপত্তারিনী দেবীর উৎপত্তি হয়েছিল দেবী পার্বতীর কৃষ্ণ কোষ থেকে। তাই তিনি 'কৌশিকী'। যখন শুম্ভ ও নিশুম্ভ দৈত্যদ্বয়ের আক্রমণে পরাজিত হয়ে দেবতারা হিমালয়ে গিয়ে দেবী মহামায়ার স্তব করছিলেন, তখন পার্বতীর শরীর থেকে হুবহু তাঁর মতন দেখতে এক দেবী আবির্ভূত হন। যিনি ঐ দৈত্যদ্বয়ের সংহারকর্তা হয়েছিলেন। এই দেবীই ছিলেন 'বিপত্তারিনী'।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇



Post a Comment

0 Comments