জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৭২/রোশেনারা খান

কলকাতায় নার্সিংহোমে অপেক্ষা।

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান

পর্ব ৭২

বার বার অনুরোধ করায়, ডাক্তার খান সাহেবকে এক সপ্তাহের আগেই রিলিজ করে দেন। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে আবার চেকআপে নিয়ে আসতে হবে। খান সাহেবের সঙ্গে আমারও এক নতুন যন্ত্রণা শুরু হল। ওনার তো কষ্ট হচ্ছেই, আমার কষ্টও কিছু কম হচ্ছে না। আপনজনের কষ্ট দেখা যে কতখানি যন্ত্রণার তা ভুক্তভোগীরায় বোঝেন। মনে হয় আমি যদি একটুখানি ওনার কষ্টের ভাগ নিতে পারতাম! কিন্তু তা তো হওয়ার নয়, কত কই-ই তো দিতে নিতে চেয়েছি। কেউ দেয়নি, নেয়নিও।

    আজ ইংরেজি নববর্ষ। ২০১৮ সাল শুরু হল। এই মাসটা আমার একদম পছন্দ নয়, ভাল লাগে না। তবুও এই মাসের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। আমার বাঁচা তো শুধু নিজের জন্য নয়। আমার বাঁচা ঘরেবাইরে অনেকের জন্যই। ঘরে অসুস্থ স্বামী, সন্তান, বৃদ্ধামা যেমন রয়েছেন, তেমন বাইরে রয়েছে আমার অজস্র দিদি, বোন, ভাই। আমি তেমন কোনো পোষ্ট করলে অনেকেই রে রে করে ওঠে, আপনাকে দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হই, মনে সাহস পাই, দুঃখ ভুলতে পারি। আপনি এরকম কথা বলবেন না। আপনার মুখে এসব মানায় না। ওরা আমাকে নিয়ে বাঁচে না আমি ওদের নিয়ে বাঁচি, তা বুঝে উঠতে পারি না। তবে সবসময় চেষ্টা করি বেঁধে বেঁধে থাকার। এদিকে ২৩ ডিসেম্বরের এই সময় খবরের কাগজে প্রকাশ তনভির বিজেপির একটি মিটিং এ থাকবে। হওয়াটস আপ এ মহিলাদের একটি গ্রুপে বীরভূমের এক সমাজকর্মী আয়েশা খাতুনের সঙ্গে তনভিরের বেশ কিছুক্ষণ কাদা ছোড়াছুড়ি চলল। এটা মোটেও কাম্য ছিল না।

    এখন আর কাউকে তেমন  কার্ড পাঠিয়ে  নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে দেখা ও শোনা যায় না। শুভেচ্ছা দেওয়া নেওয়া হয় সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে। গতকাল  বিকেলে ‘পিঠে মেলা’ ছিল। অন্যান্য বছরের মত এবারেও বিচারকের দায়িত্ব পালন  করতে হল। এক এক টেবিলে তিনজন করে বিচারক ছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন মেদিনীপুর কলেজের দুজন অধ্যাপক, সুস্নাত জানা ও আরও একজন অল্পবয়সী ছেলে।নামটা মনে পরছে না। আজকাল ভীষণ ভুলে যায়।

    সকালে মেজদা ও বউদি এসেছিল , বিকেলে গড়বেতা ফিরে গেছে। সুহানা  আগেই আসেছে। ওর বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ও আমার ভাইঝি, একটি বখাটে ছেলের হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করার জন্য আমার বাড়ি ছাড়া আর কোথাও নিরাপদ জায়গা ওরা খুঁজে পায়নি। গত জুনমাসে বাবা, কাকারা মিলে আমার  কাছে রেখে গেছে। খান সাহেব অসুস্থ, রানী থাকে, তার ওপর আমার পক্ষে আর কারো দায়িত্ব নেওয়া যে সম্ভব নয়, এটা ওরা কেউ ভাবল না। টাকা দেখাল আমাকে, মেজদা বলল, রান্নার লোক রেখে দে আমি টাকা দিয়ে দেব। টাকার বিনিময়ে এই অবস্থায় কারো দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়, আমার উকিলদাদা তা একবারও ভাবল না। খান সাহেব বিরক্ত হলেন। তারচেয়ে বড় কথা উনি আমাকে ভুল  বুঝলেন।  আমার অনুমতি ছাড়া ওরা মেয়েকে দিয়ে যেতেই পারে না। রানী থাকে বাড়ির মেয়ের মতই, আমারই মত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলে। সুহানা বড় লোকের মেয়ে। সকালে পরটা বা বাটার টোস্ট ছাড়া টিফিন করতে পারেনা। রানীর মুড়ি, পান্তা, রুটি কোনো একটা হলেই হল। তাই খেয়েই কলেজে চলে যায়। কিন্তু সুহানার জন্য আমার রান্নার ঝামেলা বেড়েছে। কিছু করার নেই।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
কয়েকদিন আগেই শুনেছি বাংলাদেশ থেকে ছোটকাকার বড়ছেলে বাবলুদা ও মেজছেলে রমুদা সপরিবারে এদেশে এসেছে। আজ ওরা  এবং ছোটপিসির ছেলে স্বপন ও তার বৌ আমাদের বাড়ি দেখা করতে এসেছিল। দুপুরে পাপুর বাড়িতে খেয়ে বিকেলে খড়গপুর ফিরে যাবে। ওখানে সেজকাকার ছেলে খোকনের(ডাক্তার এফ আর খান) বাড়িতে কিসের যেন পার্টি আছে। আমার ওসবে কোনো কৌতূহল  আগেও ছিল না, এখনও নেই।

   ডাঃ সুচন্দ দাস মঙ্গলবার আর শনিবার ডায়ালিসিসের ডেট করে দিয়েছিলেন,  স্পন্দন সেটা বুধ আর শনি করেছে। আমি সকালে চেয়ে ছিলাম। সেই মতই হচ্ছিল। আজ মঙ্গলবার সকালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি, নার্সিংহোম থেকে বলা হল, ইমারজেন্সি পেসেন্ট এসে যাওয়াতে ওনার  ডায়ালিসিস দুপুর ২ টোর পর হবে। সময় নির্দিষ্ট না করার জন্য এক এক দিন এক এক রকম সময় জানাচ্ছে। অসুবিধা হলেও নিয়ে যেতে হচ্ছে। আজ ১২টায় সময় দিয়েছিল, তৈরি হয়ে বেরচ্ছি  ফোন করে জানাল ২টোর পরে যেতে।

      খোকন এসেছিল খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে, আমাদের নার্সিংহোমে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল, আমি না করলাম। কারণ আমাদের টোটো এসে গিয়েছিল। আজ ওনার প্রেসার ফল করেছিল, এটা নাকি হয়। রাতের খাবার চন্দ্রিমা দিয়ে গেছল। এভাবেই জীবন চলছে। রানী আছে বলে মাঝে মধ্যে শহরের মধ্যে ও আশেপাশের অনুষ্ঠানগুলিতে যেতে পারি। লেখার কাজটিও চালিয়ে যেতে পারছি। সারাদিনে বিশ্রাম হয় না বললেই হয়। আমি এসব কষ্টকে কষ্ট ভাবি না, শুধু এই মানুষটা একটু ভাল থাকে যেন। ওঁকে একা রেখে কোথাও যাই না। রহিমা(কাজের মেয়ে) থাকলে তাকেই রেখে যাই। আজ সেজভাই মনি মাছ  এনেছিল, ও প্রতি রবিবারই আসে। রানী বাড়ি গেছে, তাই মনিকে ওনার কাছে রেখে এ টি এম এ টাকা তুলতে গেছলাম।

    সকালে খান সাহেবকে সার্জেনের কাছে নিয়ে গেছলাম হাতের সেলাই কাটার জন্য। ডাক্তারের সহকারি কাজটা করে দিতে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, কত দিতে হবে? বললান, ওকে ১০০টাকা দিয়ে দিন। সৌনক সকালে ডাক্তারের চেম্বারে এসে খোঁজ নিয়ে গেছল। সৌনক সুদীপ চন্দ্রিমা খুব হেলফ করছে। চন্দ্রিমার তো তুলনা নেই। তবে আমি জানি আমার কাজ আমাকেই করতে হবে। তাই কারও সাহায্য আশা করি না। পেলে ভাল, না পেলেও দুঃখ নেই (এই শিক্ষাটা আমি বেশ কয়েকবার বিদেশ গিয়ে লাভ করেছি)। আমি ওনার সুস্থতার জন্য সব ধরণের কষ্ট সহ্য করতে রাজি।  
গান্ধীঘাটে খিচুড়ি বিতরণ।

    দিন ও রাতের ফারাক বোঝার সময় পাই না, নানারকম কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয় যে কাঁদার ও সময় মেলে না। এরমধ্যে অনেকেই আসেন তাঁদের  সমস্যা নিয়ে। সাংসারিক কাজের মধ্যে সময় বের করে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। ওঁরা অবশ্য জানিয়েই আসেন। তাতে আমার সুবিধা হয়। এই কাজকে আমি আমার সামাজিক দায়িত্ব ও মানবিক কর্তব্য বলেই মনে করি। অনেকেই বলেন, দিদি আপনি এতদিক সামাল দেন কী করে? পারতে তো আমাকে হবেই। হার মানার কোনও প্রশ্নই নেই। তবুও মানুষ তো, তারও সহ্যের সীমা আছে জানি। কিন্তু ওসব নিয়ে ভাবব কখন? আজই ওনাকে হ্যাপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে গেছলাম। কাল  ডায়ালিসিস করার দিন, কিন্তু করানো যাবে না। এমনিতে আগের তুলনায় কিছুটা ভাল মনে হচ্ছে। গলার কাছের চ্যানেলটা বন্ধ করে দিলে কিছুটা আরাম পাবে।

     নিজের কাজ করার সেভাবে সময় পাচ্ছি না। ক্লান্তও হয়ে পড়ি। তবুও  আমার থামলে চলবে না। ছেলে মেয়ে কাছে থাকলে হয়ত কিছুটা সাহায্য হত। কিন্তু যা হওয়ার নয়, তা নিয়ে ভেবে কী হবে? আজ সকাল ৮টাতে ডায়ালিসিস  শুরু হয়েছে। সৌনক এসেছিল, ওর সঙ্গে বাড়ি ফিরে রান্না করলাম।১০টায় একটা টোটো ধরে স্পন্দন পৌঁছালাম। ওনাকে বিস্কুট খাওয়ালাম।তার পরেই বললেন, ওদের ডাকো, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। প্রেসার ফল করে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে আবার চালু করা হল। আজ ৩০মিনিট কম চালানো গেল। রাতে ভেবেছিলাম লিখতে বসব। কিন্তু পারলাম না, খুব মাথাব্যথ্যা করছে। মনে হয় চশমার পাওয়ার বেড়েছে। এবার শীতও খুব পড়েছে। টেম্পারেচার ৮ডিগ্রী থেকে  উঠছেই না।
পৌষসংক্রান্তির দিন গান্ধীঘাটে

    দেখতে দেখতে পৌষ সংক্রান্তি এসে গেল। আজ (১৫ জানুয়ারি)খান সাহেবের প্রমাণিত জন্মদিন। শাশুড়িমা ভুলে গেছেন কবে তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছিল।যাইহোক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হওয়ার জন্য মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্রের সঙ্গে আজ গান্ধিঘাট গেছলাম। কত মানুষ লাইন দিয়ে বসে আছে।প্রচুর মানুষ নতুন ও পুরনো জামাকাপড়, কম্বল, চালডাল, বিস্কুট, খুচরো পয়সা বিতরণ করছে। অনেক সংস্থা খিচুড়ি বিতরণ করছে। তারমধ্যে কুইজ কেন্দ্রও রয়েছে।  আমিও কিছু বিস্কুটের প্যাকেট আর খুচরো টাকা নিয়ে গাছলাম। চন্দ্রিমাও নিয়ে গাছল। মাড়োয়ারিদের একটি সংস্থার এক ভদ্রলোক আমাকে সৌনককে ডেকে নিয়ে গিয়ে টেবিল-চেয়ারে বসিয়ে খিচুড়ি খাওয়েলেন।সঙ্গে পায়েস মিষ্টি ও পাঁপড় ছিল।

                                       ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments