জ্বলদর্চি

দেবালয় /মিলি ঘোষ

দেবালয়  

মিলি ঘোষ 


    "নেহাত তুই ছোটোবেলার বন্ধু, তাই তোকে হিংসা করি না।"
ঋষভ তাকাল তনুর দিকে।
   বলল, "এ আর নতুন কী! রোজই তো প্রায় বলিস।" 
   তনু ওপর দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল, "ওই লোকটার ওপর যত রাগ আমার।"
   "পড়াশুনায় ফাঁকিও মারবি, লোকটা তোকে সুখেও রাখবে, তা তো হয় না।" 
   তনু গলার স্বর একটু নামিয়ে বলল, "দেখ না, তোর অফিসে যদি একটা কিছু ব্যবস্থা করতে পারিস।"
   গলা তোলে ঋষভ, "আরে আমি আইটিতে আছি। ওখানে আমি তোর জন্য কী করতে পারব ?"
   একটু চুপ করে থেকে আবার বলল ঋষভ, "এইচ.এস'টা পর্যন্ত কমপ্লিট করিসনি।" 

সম্পূর্ণ বিপরীত আর্থিক পরিকাঠামোয় বড়ো হওয়া দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, ঋষভ ও তনুময়। একই পাড়ায় বেড়ে ওঠা, একই স্কুলে পড়াশুনা। শুধু পরীক্ষার রেজাল্টে যোজন মাইল তফাৎ। 
ঋষভের ছুটিছাটা থাকলে অনেক সময় তনু আসে ওর বাড়িতে, ছাদে বসে গল্প টল্প করে। 
আজ তনু একটু চুপচাপ। মাথা নিচু করে ঋষভের মায়ের দিয়ে যাওয়া চা শেষ করছিল।
   ব্যপারটা লক্ষ্য করে ঋষভ জানতে চাইল, "কেসটা কী?"
   "সংসারটা আর চলছে না। রেগুলার মা'র সঙ্গে ঝামেলা। জানি ভদ্রমহিলা উদয়-অস্ত খাটে, কিন্তু এমন এক একটা কথা বলে না মাইরি।"
   "ভাই-বোন দু'টো পড়াশুনা করে ? না কি তোরই মতো?"
   "হ্যাঁ, তা করে।"
   "ভাগ্যিস!" 
   ক্ষেপে যায় তনু, "খোঁচা মারিস না তো! নিজে একটা ভালো জায়গায় আছিস। কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারিস না, উল্টে ..."
   হাসতে হাসতেই বলল ঋষভ , "শুধু মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে তো এতদূর আসিনি। মগজে নিশ্চয়ই কিছু আছে, যা তোর নেই।"
   তারপর তনুর দিকে তাকিয়ে বলল, "একটা বুদ্ধি দিতে পারি, তুই যদি নিস। এতে তোর উপকার কতটা হবে জানি না। তবে, আমাদের হবে।"
   "খুলে বল, খুলে বল।" তনু অস্থির হলো।
   "যা বলছি মন দিয়ে শোন। আমার ঠাম্মি, তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর পূজারী ছিলেন। একটা ট্রাংক ভর্তি, শুধু হাজারো ঠাকুর দেবতার মূর্তি আর ফটোতে। আমাদের ঠাকুর ঘরে একটাই বড়ো সিংহাসন, তাতে যা আছে, আছে। বাকিরা ট্রাংকে বন্দী।" 
এই পর্যন্ত বলে ঋষভ থামল।
   তনু ব্যস্ত হয়ে বলল, " তা, আমাকে কী করতে হবে বল।"
   ঋষভ কাপের চা শেষ করে বলল, "ঠাম্মির ইচ্ছা ছিল বাড়িতে একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করার। করলেই তো হলো না। দেখা শোনা করবে কে ? মা পারবে না। পা নিয়ে ভুগছে।"
   তনু হাসল, "তোর মতো নাস্তিক হঠাৎ মন্দির নিয়ে পড়লি!"
   "আমি নাস্তিক, আস্তিক কিছুই নই। ঠাম্মির ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে করা আর কী।"
   "আমার কাজটা কী, সেটা বল।"
   "তুই দায়িত্ব নিলে আমরা নিশ্চিন্ত হই। সে জন্য মাসে মাসে টাকা পাবি। এমনি করিয়ে নেব না। আপাতত কর। অন্য কোনও কাজ পেলে ছেড়ে দিস।"
   "তখন কাকে দিয়ে করাবি ?"
   "লোক রাখতে হবে। তবে, শুরুটা বিশ্বাসী কাউকে দিয়ে করানোই ভালো।" 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
ঋষভদের বাগানের পেছনের দরজা লাগোয়া রাস্তার দিকে মুখ করে মন্দির বানিয়ে একেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে দিল ঋষভ।

মাস গেলে ঋষভ, তনুকে যা দেয়, অভাবের সংসারে হাতে চাঁদ পাওয়া বলা যায়। 
ঋষভ তনুকে বুদ্ধিও দিয়েছে, শর্তও দিয়েছে।
   বলেছে, "মন্দিরের পাশে টুল নিয়ে বসে, তুই ফুল, মালা, ধূপকাঠি বিক্রি করবি। এটা একটা বাড়তি ইনকাম হবে তোর। আর প্রণামীর বাক্সে যা পড়বে সারাদিনে, তার টুয়েন্টি পার্সেন্ট আমাকে দিয়ে বাকিটা তোর।"
এতটাও আশা করেনি তনু। 
   ইতস্তত করে বলেছে, "প্রণামীর টাকা আমাকে দিবি কেন ? রোজ পুজো হয়, তার খরচা আছে না। আর মন্দির তোদের।"
   "ঠিক আছে। পুজোর জিনিস পত্র কিনে, ঠাকুর মশাইকে দিয়ে যা থাকবে, তার কুড়ি শতাংশ আমার,  বাকিটা তোর।"
তনু তবু রাজি নয়। শেষমেষ ফিফটি ফিফটি বলাতে রাজি হলো।
আনন্দে তনু বিরিয়ানি খাইয়েছে ঋষভকে। 

পুজোর জিনিসপত্র কেনা থেকে শুরু করে মন্দিরের যাবতীয় কাজ তনু দায়িত্ব নিয়েই করে। ভিড়ভাট্টা বেশি হলে তনুর মা'ও এসে হাত লাগান। 
   জোর হাত করে প্রণাম করেন আর বলেন, "ঠাকুর, এতদিনে তুমি মুখ তুলে চেয়েছ।" 

যখন টাকা ছিল না, তখন ছিল এক জ্বালা। আর এখন টাকা হয়ে তনুর আর এক জ্বালা হলো। দিনরাত মন খচখচ করে।
   একদিন বলেও ফেলল ঋষভকে , "তোদের ঠকাচ্ছি। প্রণামীর অর্ধেক টাকা আমার ঘরে যাচ্ছে।"
   ওপর দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, "ওই লোকটা ছেড়ে দেবে না আমাকে।" 
   ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই বলল ঋষভ , "লোকটাই করাচ্ছে তোকে দিয়ে।" 
   "তোর জন্য সংসারটার হাল ফিরে গেল। বাবার ওষুধগুলোও সময় মতো আনতে পারি। দুটো ভাই বোনের লেখাপড়া, সবই তো টানছি।"
   "কাকিমাকে এবার বল, ব্লাউজ তৈরির চাপটা কম নিতে।"
   হঠাৎ কী মনে পড়াতে তনু বলল, "আচ্ছা, তুই কি সত্যিই নাস্তিক ?"
ঋষভ হাসল। 
   বলল, "বাড়িতে মন্দির বানালাম, আমাকেই এই প্রশ্ন করছিস ?"
   "বল না। তোকে দেখে আমি ঠিক বুঝতে পারি না।"
এবার ঋষভ জোরেই হাসল। 
ঋষভ উত্তর দিচ্ছে না দেখে, তনু প্রসঙ্গ পাল্টাল।
   বলল, "তুই তো বিশাল স্যালারি পাস। প্রণামীর ওই ক'টা টাকা তোর কোন কাজে লাগে ? সিগেরেটের খরচা তুলিস ?"
   "অত সিগেরেট আমি খাই না। তা ছাড়া এই ফিফটি পার্সেন্ট নেহাত কম নয়। আমার আর একটা মন্দির আছে। সেখানে লাগে এই টাকা।"
   "বলিসনি তো কোনওদিন।"
   "সব তোকে বলতে হবে না কি ?"
   "কোথায় তোর মন্দির ?"
   "অত বলতে পারব না। যদি যেতে চাস, সামনের রবিবার আমার সঙ্গে যেতে পারিস। কাকিমাকে বলিস, ওই দিন একটু মন্দিরে সময় দিতে।"
তনু রাজি হলো। 

রবিবার সকালে শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে বগুলার  উদ্দ্যশ্যে রওনা হলো দুই বন্ধু। 
   যেতে যেতে তনু বলল, "তুই আমাকে লোভ দেখালি। মন্দিরের কাজ করে তোর থেকে টাকা নিচ্ছি, ফুল মালা বিক্রি করে পয়সা পাচ্ছি। তারপরও, আমার চোখ থাকে প্রণামীর বাক্সের দিকে। কাজটা কি ঠিক করছি ?"
   ঋষভ বলল, "ভাব। ভাবতে থাক। যদি মনে করিস, ভুল করছিস, অকপটে বলবি। আমি অন্য কোনও গরিব লোককে মন্দিরের দায়িত্ব দেব, যার সত্যি টাকার প্রয়োজন। আর তুই না চাইলেও মন্দির এখন তার আপন নিয়মে চলবে। বন্ধ করতে চাইলেও আমরা পারব না। ওটা এখন ভক্তের মন্দির।" 
   "আরে আমি তা বলিনি। প্রণামীর টাকা আমাকে না দিলে এই সমস্যাগুলোই আসত না।" 

চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে মাঠ, ক্ষেত, গাছপালা। ট্রেনের ঝিকিঝিকি শব্দে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খায় তনুর মনে। 
   জানলা থেকে মুখ ঘুরিয়ে ঋষভের পাশে রাখা বড়ো ব্যাগটা দেখিয়ে তনু জানতে চাইল, "ওতে কী নিয়েছিস ?"  
    ঋষভর দৃষ্টি তখন বহু দূরে। সেদিকে চোখ রেখেই  বলল, "পুজোর সামগ্রী।"

বগুলা স্টেশনে নেমে ভ্যানে করে বেশ খানিকটা ভেতরে গিয়ে ভ্যান দাঁড় করাল ঋষভ। 
ঋষভকে দেখে ছুটে এল একগুচ্ছ ছেলেমেয়ে। এই ফুলেদের নিয়েই গড়ে উঠেছে ঋষভের মন্দির, 'কানন'। আপাতত ত্রিশটি অনাথ বাচ্চার দায়িত্ব নিয়েছে ঋষভ। একা নয়, কিছু সুহৃদের সহায়তা আছে। গাছগাছালির মধ্যে এক মনোরম পরিবেশে বেড়ে উঠছে বাচ্চাগুলো। প্রকৃতির কোলেই ওদের দিন যাপন।
এখানে ভোরের রবির প্রথম আলোয় মিশে থাকে  শিশুদের হৃদয়ের কানাকানি। ওরা বেড়ে ওঠে গাছের  শাখায় শাখায়, পাখিদের কলতানের মধ্যে। এই আশ্রমিক পরিবেশে ঋষভ যেন ওদের গুরু। যেখানে গুরু শিষ্যের আত্মিক সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে আছে এক আকাশ সহজতা। ঋষভের মধ্যেকার ছেলেমানুষিটা বাঁচিয়ে রেখেছে এই কচিকাচার দলই। 

কাননের বাচ্চাদের মধ্যে একটি মেয়ে কথা বলতে পারে না। ঋষভ ওর নাম দিয়েছে 'সুভা'। রবীন্দ্রনাথের 'সুভা'। সেও তো এক বোবা মেয়ের যাপন কথা।
ঋষভ ওর জন্য আলাদা শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। শুধু তাই নয়, সেই শিক্ষক মহাশয়ের থেকে নিজেও শিখেছে ওদের সাংকেতিক ভাষা। আজ সুভা'র সঙ্গে তাই অনর্গল ওই ভাষায় কথা বলতে পারে ঋষভ।

ঋষভকে দেখে ছুটে এলো সুভা। ঘাড় নেড়ে, হাত নেড়ে মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত সমস্ত কথায় নিজেকে উজাড় করে দিল সুভা। 
গ্রীষ্মের প্রগাঢ় নির্জনতায় একটি বোবা দুপুর আর একটি বোবা মেয়ে মুখোমুখি বসে থাকুক, ঋষভ তা চায়নি। 
রবীন্দ্রনাথের প্রতাপ যদিও পুকুরে মাছ ধরতে এসে সুভাকে আদর করে 'সু' বলে ডাকত। তবুও, আজকের সুভাকে কোনও প্রতাপ যেন বলতে না পারে, 'কী রে সু, তোর না কি বর পাওয়া গেছে ?'
কথাটার মধ্যে যে অপমান যে অবহেলা লুকিয়ে আছে, তা বোঝেনি সেদিনের সুভা। বুঝবে না আজকের সুভাও। বোবা, সে বোবাই। আবহমানকাল ধরে সে বোবা। তাই যুগে যুগে সে অপমানের যোগ্য। 'তোর না কি বিয়ে ঠিক হয়েছে' আর 'তোর না কি বর পাওয়া গেছে' দুটো বাক্যের মধ্যে চরম অপমানের এক সূক্ষ্ম সীমারেখা টেনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
ঋষভ ঠিক এইখানেই দাড়ি টানতে চেয়েছে। তাই আজকের সুভা'কে সে পড়াশুনা করিয়ে নিজের মতো বাঁচতে শেখাচ্ছে। 

ঋষভ ব্যাগ থেকে সবার জন্য নানারকম উপহার, খাদ্য সামগ্রী বার করল। বাচ্চাদের আনন্দের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলল ঋষভ। 
সমস্ত কর্মকান্ড দেখে তনু স্তম্ভিত।
গোটা একটা দিন শুধু ভালোবাসায় ভালোবাসায় কেটে গেল। 

ফেরার সময় ট্রেনে উঠে একটাও কথা বলেনি তনু। ঋষভ লক্ষ্য করেছে, কিছু বলেনি। শিয়ালদায় নেমেও চুপ ছিল তনু। 
রাতে প্রণামীর টাকা ভাগ করতে এসে পুরোটাই দিয়ে দিল তনু, ঋষভকে। 
   ঋষভ বলল, "বেশি দিচ্ছিস কেন ? অঙ্কে বরাবরই কাঁচা তুই।"
   "এর চেয়ে বেশি অঙ্ক শেখার দরকার নেই রে আমার, ঋষভ। এখন থেকে পুজোর খরচ বাদে বাকি সবটাই যাবে 'কানন'-এর ফুলেদের জন্য।" 
কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না তনু। ধীর পায়ে হেঁটে বাড়ির পথ ধরল।

Post a Comment

0 Comments