জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মনি-মালা: ৩ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মনি-মালা: ৩ 
সালেহা খাতুন 

১৯৭৮ এর বন্যার সময় আমার বয়স বছর পাঁচেক হবে। ভাই তখনো জন্মায়নি। আমাদের দুই বোন এবং মাকে নিয়ে আর এক বস্তা চাল নিয়ে বাবা আমাদের নিরাপদ স্থানে রেখে আসেন। সেই নিরাপদ স্থানটা ছিল আমার আমান মামার নিউ মিলের কোয়ার্টার। জল না নামা পর্যন্ত বেশ কিছুদিন এই কোয়ার্টারে ছিলাম। সুন্দর একটা পরিবেশ। ছবি মতো সেই দিনগুলোর কথা এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। 
পরবর্তীতে প্রায় কুড়ি বছর(১৯৯৭-২০১৭) আমার কোয়ার্টার জীবন কেটেছিল তার সূত্রপাত বুঝি এখানেই হলো।আমান মামা ও মামিমা আকলিমার  দুই ছেলে- আলোদা ও বাপ্পাদা এবং মেয়ে জাসমিন আমাদের অত্যন্ত কাছের হয়ে উঠল তখন। এখনো আলোদার সঙ্গে মজবুত যোগাযোগ আছে। আলোদা বোটানির অধ্যাপক।মামিমার নামে একটা গাছের নামকরণ করেছে - Dioscorea Aklimia। বাপ্পাদা হয়েছে ডাক্তার। 
কিন্তু জাসমিন আর ফিরে আসবে না কোনোদিন।এই তো দেখলাম আলমারির মাথায় ফোটোতে রয়েছে। ও যেন বলছে "মামনি এসেছিস চল না আমরা বেড়িয়ে আসি ওই চুনোর পোতা মাঠ থেকে। কিরে শুনতে পাচ্ছিস না? জানিস মামনি তুই আমায় কত ভালবাসিস বলতো কিন্তু ওই তুলি আমাকে একদম দেখতে পারে না। জামিলার সঙ্গে বিকালে একটু বেড়াতে বেরোবো সেটা যেন ওর কিছুতে সহ্য হয়না।"
 হায় রে! আমি কী  ভাবছি! ও যে আমাদের ফেলে অনেক দূরে চলে গেছে। শুধু স্মৃতিটুকু ফেলে রেখে। অনেকক্ষণ তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ফোটোর তলায়। কখন মোতি মাসি এসে হাজির হয়েছেন খেয়াল নেই।রান্নাঘরে মা কে রান্না করতে দেখে এসেছি। চুপচাপ দাঁড়িয়েই আছি দুচোখ জলে ভেসে চলেছে। ঘরের মধ্যে ওর হাতের কাজ গুলো দেখছি হঠাৎ দেখি মোতি মাসি বলছেন "বিশ্বাস হয় মামনি জাসমিন মারা গেছে? যেন কোথাও বেড়াতে গেছে মনে হয়। ও মা রে, তুই তোর মায়ের চেহারা দেখে যা একবার। অস্থি কঙ্কালসার  এক মূর্তি হয়েছে।"  ছেলে দুটোর কথা ভেবে একটু শান্ত হয়েছেন।
 ও সাবানের বাক্স ফেলেনি সেগুলো দিয়ে ছোটো ছোটো ঘর বানিয়েছে,  ডিমের খোলা দিয়ে মানুষের মূর্তি,কাপড় দিয়ে সুন্দর সুন্দর পুতুল, ফুলের গাছ আরো  কত কী তার ইয়ত্তা নেই। ওর ঘরটা পুরো এখন ওর জিনিসে ভর্তি, কত অর্ধসমাপ্ত কাজ রয়েছে।  কতক্ষণ ওর ঘরের মধ্যে ছিলাম জানিনা। বেরিয়ে দেখলাম মামিমার রান্না সব হয়ে গেছে।

 চলে গেলাম দাদুর কাছে। বসে বসে স্মৃতিতে এলো  পূর্বদিনের সব কথা। মামার বাড়ি গেলে জাসমিন আর আমি সারাদিন একসঙ্গে। শুধু রাত্রিটুকু মায়ের কাছে। দুজনে কত কী  গল্প করতাম। ও বলতো "দেখ মামনি আমার তো হার্টের দোষ কিন্তু মনে হয় আমি অনেকদিন বাঁচবো। ডাক্তারবাবুরা যাই বলুক কী বল?" ওই রকম কথা বললে মাঝে মাঝে আমার রাগ হতো। ৭৮ এর বন্যার সময় ওদের অফিস কোয়ার্টারে যখন আমরা থাকতাম তখন কী  আনন্দে দিন কাটিয়েছি, জাসমিনের  দাদারা আমার বোনকে নিয়ে সব সময় তার আধো আধো  কথা শুনতো। আর আমরা দুজনেই কোয়ার্টারের সমস্ত লোকদের জ্বালিয়ে মারতাম। দোতলার দালানে এ মাথা ও মাথা করতাম । সামনের কোয়ার্টারের ছেলে মেয়েদের মুখ ভ্যাংচানো। দালানে বসে বসে দেখতাম নীচের দড়ির কাপড় ও চটগুলোকে মহিষরা  কেমন নিয়ে চলে যাচ্ছে।  বিকেলে পাঁচ ভাই বোন এক জায়গায় বসে বন্যা নিয়ে আলোচনা হতো। 
দাদারা  পড়তে বসলে,একেবারে দালানের দক্ষিণে সোমাদির কাছে চলে যেতাম জিমন্যাস্টিক শিখবো বলে। সোমাদি চক্রাসনে আছে, হঠাৎ দুষ্টুমি বুদ্ধি হল আমি সোমাদির পেটের উপর উঠে বসলাম আর জাসমিন চক্রের মাঝখানে বসে রইল। সোমাদির অবস্থা চরম সে সোজা হয়ে উঠলে আমি পড়ে যাব আর শুয়ে পড়লে জাসমিন থেঁতো হয়ে যাবে। আধঘন্টা বেচারীর দম বন্ধ অবস্থা। সেই সময় সোমাদির বাবা অফিস থেকে ফিরে সোমাদিকে উদ্ধার করেন। সোমাদির প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। আর আমরা ছাড়া পাইনি। সোমাদির বাবা আমাদের আটকে রেখেছিলেন অনেকক্ষণ। এদিকে মায়েরা তো কিছুই জানেন না। জানেন সোমাদির কাছে আছে। সোমাদিকে বিপদে ফেলেছি এ তাঁরা জানেন না পরে আটটার সময় মা বাবা সব জানতে পেরে আমাদের খুব ধমকালেন। খাটের উপরে এই ঘরে ও ঘরে ঘুমাতে আমাদের যতই বলা হোক আমরা দুজনেই জায়গা থাকতেও খাটের তলায় বিছানা পেতে শোবো। এক সপ্তাহ পরে যখন বন্যার প্রকোপ কম হলো আমরা বিদায় নিলাম। ও আমাদের বিদায় জানাতে সিঁড়ির তলা পর্যন্ত এলো।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
 আবার মামার বাড়িতে গিয়ে আমরা মিলিত হলাম। একদিন কেউ আমাদের খুঁজে পাচ্ছে না আমরা তখন উল বুনছি। আমি কিছুই জানতাম না তাই বড়ো  মামার ছাতার শিক ভেঙ্গে আমার উল কাঁটা তৈরি হলো। আর দাদুর পুরোনো সোয়েটার খুলে নিয়ে উল পেলাম। কিন্তু সারাদিন লেগে গেল কিছুই শিখতে পারলাম না। দুপুরের সময় মা আমাদের আবিষ্কার করলেন একটা জঙ্গলাকীর্ণ  পুকুরপাড় থেকে। দুই পাগলের কীর্তি ধরা পড়ে গেলে, মা কে খুব খাটিয়েছি বলে আমার উপর মা অসন্তুষ্ট। তবুও শাস্তি কিছুই হলো না। খুব কষ্ট হচ্ছিল পরের দিন সকালে মা আমাকে নিয়ে বুঁজ গাছের তলায় বসালেন। উল্টো সোজা আগের দিন শিখিনি ঠিকই কিন্তু ঐদিন মায়ের হাতে এক চড় খেয়ে উল বোনা শিখে গেলাম। খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু মনে মনে আনন্দ হচ্ছিল মাকে দাদু দিদা মামিমারা  প্রচন্ড বকেছিলেন। 
ব্যাস আমরা আবার দুজনে এক সঙ্গে। বছরে একবার করে মামার বাড়ি যেতাম যেন জীবনে যত মজা আমরা দুজনে ওই সময় ভোগ করতাম। ওর শরীর অসুস্থ বেশি কথা বললে, দ্রুত হাঁটলে হাঁপিয়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যেত। এই শরীর নিয়েও চন্দ্রভাগ গার্লস স্কুলে ও নাইনে পড়ে আর আমি উলুবেড়িয়া কলেজে ইলেভেনে পড়ি। ও পাখি খুব ভালবাসত বাড়িতে বিড়ালও ছিল। একদিন ও বিকেলে ঘুরছে একটা শালিক পাখি ওর কাঁধে এসে বসলো। ও যত চলে যেতে বলছে পাখিটি কিছুতেই শুনছে না। বাধ্য হয়ে বাড়িতে আনলো। শালিক পাখিটি ওর দারুণ  সঙ্গী ছিল। সব কথা বলতে পারত। ওকে জাসমিন বলে ডাকতো। আমেরিকায় ওর হার্ট অপারেশনের কথা হল কিন্তু মামিমা বাধ সাধলেন। বললেন আমার মেয়ে যতদিন বাঁচবে এমনি এমনি বাঁচবে। অপারেশন করতে হবে না। এর কিছুদিন পর দিল্লিতে ওরা অপারেশনের জন্য গেল। বাড়িতে ওর অপারেশন নিয়ে মামা মামিমার মধ্যে মনোমালিন্য চলতে লাগলো। কিন্তু একানব্বই সালের প্রথম দিকে ওর মা অপারেশনে মত দিলেন। কলকাতাতেই ওর অপারেশনের কথা হলো। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হল। ডাক্তারবাবুরা সবাই ওকে ভালোবাসতেন ওর মিষ্টি ব্যবহারের জন্য। ডাক্তারদের বলতো "ডাক্তার বাবু আমি ভালো হয়ে যাবো তো? হ্যাঁ আপনারা নাকি আমায় ভালো করতে পারবেন! আমার দাদা এখন ডাক্তারি পড়ে সে বড়ো  হয়ে আপনাদের থেকে বিরাট বড় ডাক্তার হবে।" আরো কত কিছু বলতো। ডাক্তারদের কাছ থেকে ও কতকগুলো ইনজেকশনের সিরিঞ্জ নিয়েছিল বলেছিল আমার দাদা ডাক্তার হবে তার কাজে লাগবে। অপারেশনের দিনে ডাক্তারবাবুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল "ডাক্তারবাবু আপনি আমাকে ভালো করে দিতে পারবেন তো? আমি বাঁচবো তো? আপনারা চেষ্টা করবেন কিন্তু আমি না বাঁচলে আমার মা খুব কষ্ট পাবে।" হায় রে! ডাক্তারবাবুরা ওর মিনতি পূরণ করতে পারলেন না। কেঁদে ফেলেছিলেন কাঁদতে কাঁদতে মামাকে এসব কথা জানিয়েছিলেন। জাসমিনকে শেষযাত্রার জন্য  বাড়িতে আনা হলো আর সেই শালিক পাখি মামিমাকে অস্থির করে তুলল "মা জাসমিন কোথায়? মা জাসমিন কোথায়?" ঘুরতে লাগলো। ওকে নিয়ে কবরস্থানে চলে যাওয়ার পর পাখিটা ঘরের ছাদে গিয়ে বসলো। কেউ তাকে নামাতে পারল না। খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করল আর মাঝে মাঝে বলতে লাগলো মা "জাসমিন কোথায়? জাসমিন কোথায়?" কয়েকদিন পরে পাখিটাও মারা গেল।
 জাসমিনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ৯০ সালের আগস্ট মাসে। ওর ডায়েরিতে ও লিখেছিল "হে ভগবান আমার মত মেয়ে যেন এই বাংলাতে না জন্মায়। আমার জন্য সংসারে এত অশান্তি। অপারেশন নিয়ে বাবা মার মধ্যে মনোমালিন্য। প্রভু হে আমার মত প্রাণকে তুমি পৃথিবীতে পাঠিয়ো না প্রভু।"

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments