বিস্মৃতপ্রায় কবি জয়দেব বসু
নির্মল বর্মন
"ওরা চিকিৎসা - বীমা করে
ওরা বীমা করে শিক্ষার
ওরা নিজের কফিন কিনতেও
বীমা মনে করে দরকার"।
( আপনি কি আদর্শ মার্কিন নাগরিক হতে চান?
- জয়দেব বসু)
কালজয়ী ভাবনার কবি জয়দেব বসু সাধারণ মানুষের আঁতের কথা, যন্ত্রণার কথা , হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতিতে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি একজন নব্বইয়ের দশকের প্রতিভাবান কবি ছিলেন। বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের প্রতি মুহূর্তে বীমার প্রয়োজন সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী অতিরিক্ত রাজনৈতিক সচেতন কবি জয়দেব বসু।
কবি জয়দেব বসু'র কবিতায় রোমান্টিক মনোভাব এ ঐতিহ্যসচেতনাতার ব্যঞ্জনাবহ হয়ে উঠতে পেরেছিল। তাঁর কবিতায় মাঝেমধ্যে সুস্বাদুতা ব্যাহত হলেও গম্ভীর ও সিরিয়াস ভাবনা প্রতিফলিত। নিছক সত্য কথা ও সত্য ঘটনা তাঁর কবিতার মূল থিম বললেও ভুল হবেনা।
কবি জয়দেব বসু বারোই মে উনিশো বাষট্টি কলকাতাতেই জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল দার্জিলিং ও শান্তিনিকেতনে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাস করেছিলেন ।তারপর কলকাতার দমদম মতিঝিল কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেছিলেন, সাফল্য ও দক্ষতার সঙ্গে কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন অতিবাহিত করার সময় হঠাৎই ছন্দপতন ঘটল। কবিতা ও জয়দেব বসু চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তেইশে ফেব্রুয়ারি দু হাজার বারো। নাগেরবাজারের বাড়িতে মস্তিষ্কে প্রবল রক্তকরণের কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন । জনদরদি মানুষ হিসেবে ও কাছের মানুষের কবি হিসেবে তার দেহ দান করেছিলেন কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে।
জনগণের কবি , জনজাগরণের কবি জয়দেব বসু তাঁর "আমার ভাগবত গীতা" কবিতায় জনদরদি ভাবনা পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন,-- যেমন
"নিরীহ লোকের গায়ে কালশিটে চাঁদার জুলুম,
শনি মন্দিরের পাশে চোলাই আর সাট্টার ধুম"!
কবি জয়দেব বসু'র প্রিয় কবি ছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী ও উৎপল কুমার বসু। বিশিষ্ট সমালোচক শ্রদ্ধেয় অরুন সেন কবি জয়দেব বসু 'র কবিতার মূল্যায়ন প্রসঙ্গ প্রণিধানযোগ্য----
"আসলে মনে - মনে তিনি রোমান্টিক, হতে চান সেকেলে, গম্ভীর, সিরিয়াস । কিন্তু বাইরে বেরিয়ে পড়ে ঠাট্টার ব্যাঙ্গের , ইয়ার্কির ভঙ্গি । কিন্তু সেটা তাঁর ভেতরের কথা নয় । বলতে চান স্মার্ট চতুর বাকভঙ্গি আমার অপছন্দ, কিন্তু তাঁর কবিতার ফর্মসচেতন ঝকঝকে আধুনিকতাই আমাদের আকৃষ্ট করে"। (কবিতা/ এই সময়ের পাঠ)।
কবি জয়দেব বসু'র বর্তমান পারিবারিক সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আধুনিক সময় ও সমাজের চিত্রকল্পময় ও প্রতীকবাদের কবি রেবা সরকার মহোদয়া ,তাঁর মন্তব্য স্মরণযোগ্য--
"কবি জয়দেব বসু শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সেবন্তী ঘোষের সঙ্গে আলাপ , পরে বিখ্যাত কবি কৃষ্ণা বসু'র সহযোগিতায় জয়দেব বসু ও শ্রাবন্তী ঘোষ দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ । তাঁদের একমাত্র পুত্র সন্তান সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস 'জুরা'। কালের অমোঘ নিয়মে তাঁদের দাম্পত্য কলহের স্বীকার হয়ে শেষ অবধি সংসার জীবন টেকেনি । জয়দেব বসু ও সেবন্তী ঘোষের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। পরবর্তীকালে অবশ্য কবি সেবন্তী ঘোষ জয়দেব বসু'র কাব্য ভাবনাকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। আমি জয়দেব বসু'র কাব্য ভাবনা ও কবি সেবন্তী ও জুরা'র সার্বিক সাফল্য কামনা করি"।
কবি জয়দেব বসু'র কাব্যগ্রন্থ গুলি হল ঃ "মেঘদূত" ১৯৯০; " ভ্রমণকাহিনী" ১৯৯০ ; "ভবিষ্যৎ" ১৯৯২ ; "জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়" ১৯৯৩ ও "শ্রেষ্ঠ কবিতা"। এছাড়াও অন্যান্য রচনা সামগ্রী হল ঃ
উত্তর যুগ , "সাইকোপ্যাথ" , লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ" ।
কবি জয়দেব বসুর "মেঘদূত" নামক দীর্ঘ কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল "প্রতিক্ষণ" পত্রিকায় ১৯৮৮ সালে, যা কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ বহু বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।
কবি জয়দেব বসু'র "মে দিবসের কবিতা' য় রাজনৈতিক বক্তব্য পাকাপোক্তভাবে থাকলেও নিরন্ন অসহায় মানুষের জীবনালেখ্য প্রতিফলিত----
" এখন অলস দিনে দূরে - কাছে
নিদাঘ আর্দ্র করে ও কার মোহন বেণু বাজে ?
মূষিক উজাড় করে দিনশেষে সুপ্রচুর ধান
এসো তৃণদল, হাতে হাতে হয়ে ওঠো মুষল প্রমাণ"।
কবি জয়দেব বসু প্রাচীন বাংলা ও মধ্য বাংলা সাহিত্যের প্রতি নিরপেক্ষ গভীর দৃষ্টিশক্তি থাকার ফলে তাঁর বিখ্যাত "মাথুর" কবিতায় বৈষ্ণব সাহিত্যের অনুসঙ্গ ও ভনিতাতেও প্রবল সাদৃশ্য প্রতিফলিত---
"আমার কন্ঠ পোড়ে তরল শিশার আঁচে
বুকের আরও কাছে
ও দুঃখ, নীলকান্তমণি, বহন করো ঋত
অঙ্গে নামুক অনঙ্গ সম্বৃত
অচিন ঘাটে চন্দ্রাবলীর অস্তি পুড়ে খাক
গায় জয়দেব, নন্দদুলাল বহ্নিতে লুকাক"।
"ওষুধের মত উগ্র নয়, বরং মৃদু,
দীর্ঘকাল একসঙ্গে কাটাবার পর দর্জি যেমন গন্ধ পায় সুচের
স্বামী গন্ধ পায় স্ত্রী'র,
যেমন আমি গন্ধ পেতাম রাস্তার, গন্ধ পেতাম
কোলাহলের,ফেস্টুনের, ফিউচারিস্ট জ্যাকেটের
গন্ধ পেতাম চুলের ফিতের----
কতদিন কতদিন আগে"?
কবি জয়দেব বসু'র "আমার পুরসভা অঞ্চল" কবিতায় বর্তমান সময় ও সমাজের নিরলস ভাবনা ও প্রচেষ্টাকে মেলানোর চেষ্টা করেছেন-----
"যে ঝলকে দেখি রাস্তার দুই ধারে
গোপন এবং নিষিদ্ধ বেচা কেনা,
কার বিক্রেতা ? তারা আমাদের লোক
খদ্দের ডেকে বলছে 'কী নিবি, নে না"?
অধ্যাপক ও কবি জয়দেব বসু আঙ্গিক সচেতন , শব্দ চয়ন ও ছন্দের চমৎকারিত্বে কবিতায় প্রাণস্পন্দন চালু করে গেছেন। তাঁর "অশক্ত পদ" কবিতা পাঠকের দরবারে---
"মা তোর ভঙ্গি দেখে অঙ্গ জ্বলে, চক্ষে লাগে ঘোর
আমার স্বল্প পুঁজি আঁকড়ে খুঁজি কল্পনা রাতভোর
আকাশে ঠিক চাঁদ এঁকেছিস, মেঘ দিয়েছিস পাশে
'চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে' ------ গানটিও, আর ঘাসে
শেষ শ্রাবণের বুনোগন্ধী আরক , প্রেক্ষাপট
আদ্যন্তই এইভাবে মা বাড়াল সংকট"।
অধ্যাপক ও কবি জয়দেব বসু মাত্র পঞ্চাশ বছর পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন, কিছুকাল লেখালেখি করেছিলেন। কিন্তু পারিবারিক জীবনে অশান্তি নেমে আসার ফলে জীবনের শেষের দিকে অপ্রকৃস্থিত জীবন যাপন করতেন। জনৈক সমালোচক বলেছেন-----
"বলাগড় বইমেলায় নিমন্ত্রণ করেছিলাম। কবি জয়দেব বসু'কে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন বিখ্যাত কবি কৃষ্ণা বসু , এমনকি কৃষ্ণা বসু'র গাড়িতেও জয়দেব বসু যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু কবির কলেজে গিয়ে দেখি , শারীরিক অবস্থা মারাত্মক সিরিকাশ অবস্থায় পৌঁছে গেছেন। এবং জয়দেব বসু বলেছিলেন "বেঁচে থাকলে পরের বছর যাব" তার দশ দিন পরেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন কিছুদিনের মধ্যে বাড়ি ফিরে এলেন , বাড়িতেই মস্তিষ্কে প্রবল রক্তক্ষরণের মাধ্যমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, শেষ যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন কবি কৃষ্ণা বসু"। ষাট বছরের ঐতিহ্যমন্ডিত 'প্রসাদ' পত্রিকায় 'জয়দেব বসু' লিখেছিলেন।দু' হাজার তেইশ সালে প্রসাদ পত্রিকার সম্পাদক, কার্যনির্বাহী সম্পাদক ও উপদেষ্টা মন্ডলীর বদান্যতায় "কবি জয়দেব বসু স্মারক সম্মান"- এ সম্মানিত করা হয়েছে, হলদিয়ার নব্বই বছরের প্রবীণ কবি চতুর্ভূজ মন্ডল মহোদয়কে। উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা সুসাহিত্যিক গৌতম গুহরায় মহোদয় কবি জয়দেব বসু সম্পর্কের মন্তব্য প্রাণিধানযোগ্য-----
" জয়দেব বসু শুধু আমার বন্ধু ছিল না, তাঁর থেকে অনেকটা বেশি। 'জুরা' তাই বন্ধুপুত্র নয়, তার থেকে অনেকটা বেশি । সেবন্তীকে বলেছিলাম- জুরার চোখের দিকে তাকালে দেখি জয়দেব তাকিয়ে আছে"--।!
2 Comments
খুব ভালো লাগলো জেনে। এরকম তথ্য জেনে উপকৃত হই
ReplyDeleteClassic Congratulations
ReplyDelete