জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী/উপপর্ব — ১২/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৭৭

এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী

উপপর্ব — ১২

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

(১)
১৯৬৬ সাল। জানুয়ারি মাস।‌ সবে মাত্র শুরু হয়েছে ইংরেজি নতুন বছর। হঠাৎ একদিন হাতে এসে পৌঁছল পদোন্নতির নোটিশ। পদোন্নতি সিনিয়র বৈজ্ঞানিকের পোস্টে। স্বভাবতই খুশির খবর। কিন্তু যার প্রোমোশন হয়েছে, তার মনে সুখ নেই। নেই আনন্দ। কেন? কী এমন ঘটনা ঘটল যে উচ্চতর পদে নিয়োগে এত অনীহা? ঘটনাক্রম হল আগের চাকরিতে গবেষণা করে প্রাপ্ত তথ্য! ব্যাপারটা কী? 

রামচন্দ্র বাবুর পুরনো কর্মস্থল কোয়েমবাটুরে। PIRCOM (Project for Intensification of Research on Cotton Oilseeds & Millets)-এ বিগত তিন তিনটে বছর কেটেছে নিবিড় গবেষণা করে। রিসার্চের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল হাইব্রিড জোয়ার (Hybrid Sorghum)। রিসার্চের ফলাফল বেশ অত্যাশ্চর্য। একবার ফসল বুনে দুবার শস্য উৎপাদনের এ হেন আইডিয়া বেশ মৌলিক ও অভিনব। মাত্র একশো সত্তর দিন! এত স্বল্প সময়ে ছয় হাজার কেজি ফসল উৎপাদনের দিশা তৎকালীন ভারতবাসীর কাছে আশীর্বাদ স্বরুপ। ভারতবর্ষ জুড়ে সেসময় তীব্র খাদ্য সংকট। খাদ্য সংকট দূর করতে অল্প সময়ে দ্বিগুণ শস্য উৎপাদনের ফর্মুলা দক্ষিণ ভারতে রামচন্দ্র বাবুর সুনাম বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তিন বছরের অমানুষিক পরিশ্রম ইতিমধ্যে অযথা বিফলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কারণ উঁচু পদে নিয়োগের যে বিজ্ঞপ্তি বের হয়েছে, তাতে জলের মতো পরিস্কার উল্লেখ রয়েছে আলাদা বিভাগের কথা। এতদিন যে জোয়ার শস্য নিয়ে গবেষণায় তাঁর আগ্রহ তুঙ্গে ছিল, সেখান থেকে সরে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বিষয়ে তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট, আদতে তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্তির বাসনায় অন্তরায়। ইতিমধ্যে ICAR (Indian Council of Agricultural Research)-এর মুখ্য এগ্রিকালচারাল কমিশনার নতুন দিল্লি থেকে তামিলনাড়ু এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি কোয়েমবাটুর পরিদর্শনে আসেন। এ হেন গুণী মানুষের সঙ্গে দেখা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির রামচন্দ্র বাবু। সঙ্গে হাইব্রিড জোয়ার নিয়ে গবেষণাকৃত তাঁর নোটবুক। হাইব্রিড জোয়ার গাছের উপর সমস্ত কাজ পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থাপন করেছিলেন মুখ্য এগ্রিকালচারাল কমিশনারকে। তাঁর কাজের খুব প্রশংসাও করলেন সাহেব। কিন্তু কোনো লাভ নেই। সাক্ষাৎ ফলপ্রসূ হল না। আটকানো গেল না বদলির নোটিশ।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
১৯৬৬ সাল। জানুয়ারি মাস। বাতাসে কনকনে ঠাণ্ডা। খুব শীত পড়েছে। চিঠি চলে এল রামচন্দ্র বাবুর ঠিকানায়। বদলির নির্দেশ। সিনিয়র বৈজ্ঞানিকের চেয়ার। পোস্টিং ত্রিবেন্দ্রাম-এ মূলজ শস্যের রিসার্চ ইনস্টিটিউটে — Central Tuber Crops Research Institute। নতুন চাকরিতে কাজ সম্পূর্ণ আলাদা; আলু ব্যতিত নানান রকম মূলজ শস্যের হাইব্রিডাইজেশন ঘটানো। মূলজ শস্যের হাজার একটা ঘরানা। টেপিওকা, রাঙালু, ওল, কচু, খামালু, কোলিয়াস আরও কত কী নাম! ওই সকল শস্যের বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড বীজ উৎপাদন হেতু গবেষণার পুরো দায়িত্ব পড়ল তাঁর চওড়া কাঁধে। 
      শুধু গবেষণার ক্ষেত্রে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে চলবে না। চাই রিসার্চ ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং। গবেষণার বাইরে সিনিয়র বৈজ্ঞানিক আর ডিরেক্টরদের এ ধরনের ট্রেনিং থাকা আশু দরকার। সে-উদ্দেশ্যে রাজস্থানের যোধপুরে ন্যাশনাল একাডেমি অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ম্যানেজমেন্ট (NAARM) ক্যাম্পাসের মধ্যে একটি ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (ICAR) ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। ১৯৬৭ সালে যোধপুরে রওনা হলেন রামচন্দ্র বাবু। লক্ষ্য লিডারশিপ ট্রেনিং নেওয়া। এ হেন ট্রেনিং-এ শেখানো হয় ICAR-এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলে একজন লিডারের কী কী আবশ্যিক গুণাবলী থাকা একান্ত প্রয়োজন। গুণাবলীর লিস্ট বেশ লম্বা। বাহ্যিক চেহারা। সামাজিক স্টেটাস ও দক্ষতা। ব্যক্তিত্ব, সতর্কতা ও আত্মবিশ্বাস। বুদ্ধিমত্তা ও নির্ণায়কতা। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা — স্মার্ট ও শৃঙ্খলা, বাহ্যিক লক্ষ্য মাত্রা। অতীত অভিজ্ঞতা। শুধু এগুলোই না, আরও আছে। ম্যানেজমেন্ট প্রসেস অর্থাৎ প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকলে আরও কিছু গুরু দায়িত্ব বর্তায়। প্ল্যানিং, সংগঠন, আদেশ, সমন্বয় এবং নিয়ন্ত্রণ — বিষয়গুলোর দিকে ধ্যান বা দৃষ্টি দেওয়া দরকার। এই গুণগুলি একজন লিডারকে বিশেষ করে তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের চোখে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। একজন নেতার গুণাগুণ নেতাসুলভ না হলে‌ মুসকিল। মহান দার্শনিক স্বামী বিবেকানন্দ-এর কথায় — 
সবারই নেতি নেতি ভাব অর্থাৎ নেতাগিরি করার উদগ্র বাসনা, কিন্তু লিডার হতে গেলে যে গুণগুলির প্রয়োজন, তা কয়জনের আছে?

ট্রেনিং থেকে ফিরে আসা অব্দি নিস্তার নেই। রামচন্দ্র বাবুর ওপর অতিরিক্ত দায়িত্ব বর্তাল। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ বছর কাল মূলজ শস্যের উপর সারা ভারত সমন্বিত গবেষণা (All India Coordinated Research on Tuber Crops)-য় বিভিন্ন সমন্বয়কারী কেন্দ্রগুলোতে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব সামাল দিতে হয়েছে তাঁকে। বার্ষিক কর্মশালা সংগঠন করতে হয়েছে। 

(২)
টেপিওকা সাগুসদৃশ একধরনের শস্য। টেপিওকা স্টার্চে চর্বি বা কোলেস্টেরল জাতীয় খাবার নেই বললেই চলে। কিন্তু কাঁচা টেপিওকার মূলে কম-বেশি পরিমাণে হাইড্রো-সায়ানিক অ্যাসিড (হাইড্রোজেন সায়ানাইড যার সংকেত HCN) থাকে। সায়ানাইড জাতীয় পদার্থ খুব বিষাক্ত। শরীরে প্রবেশ করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। একবার টেপিওকার মূল চিবিয়ে চরম বিপত্তির মুখে পড়েছিলেন রামচন্দ্র বাবু। ঘটনাটা কী?

ক্রুড মেথড (Crude method)-এ তিক্ততার একটি পরীক্ষা অরগ্যানো-লিপটিক টেস্ট (Organo-lyptic taste)। গোদা বাংলায় বললে — মুখে চিবিয়ে তিক্ততা পরীক্ষা করা। চর্বিত রস সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দিতে হয়। এটাই নিয়ম। এ হেন পদ্ধতিতে টেপিওকার মূল চিবিয়ে তিক্ততা পরীক্ষা করা দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ একটা কাজ। হাউড্রোজেন সায়ানাইড যুক্ত চর্বিত মূলের রস পেটের মধ্যে বেশি পরিমাণে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। সেদিন দুপুরবেলার ঘটনা। ফার্মে মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি চলছে। কাজের ফাঁকে এই টুকু সময় সবাই রিলাক্সে কাটায়। রামচন্দ্র বাবুও একা একা বসে রয়েছেন। নির্জনে একাকি বসে থাকার মজাই আলাদা। কথায় আছে — অলস সময় শয়তানের ধাড়ি। বসে বসে কয়েকটি নতুন হাইব্রিড টেপিওকার মূল অনায়াসে চিবাতে শুরু করলেন তিনি। চিবিয়ে তুলনামূলক তিক্ততা যাচাই করতে গিয়ে ঘটল যত বিপত্তি! অসাবধানতাবশত কখন যে অল্প পরিমাণ চর্বিত রস সোজা পেটে চালান হয়ে গেছে, সে খেয়াল নেই। অমনি মাথা ঝিমঝিম শুরু। গোটা শরীর চক্কর কাটতে শুরু করেছে। বাহ্য জ্ঞান হারিয়ে অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়। দূর থেকে একজন ওয়াচম্যান দৃশ্যটা লক্ষ্য করে তড়িঘড়ি কাছে ছুটে আসে। কাছে এসেই সঙ্গে সঙ্গে মাথায় জল ঢালতে শুরু করল। ইতিমধ্যে ভিড় বেড়েছে। ফার্মের সবাই জড়ো হয়েছে। ভীড়ের মধ্যে নীচু স্বরে অনাগত বিপদের আগাম ফিসফাস চলছে। শেষমেশ প্রায় আধ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন রামচন্দ্র বাবু। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন এ যাত্রায়। তা না হলে হয়তো কবেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত! প্রাণে বেঁচে ফেরার ঘটনায় কি অদৃশ শক্তির হাত রয়েছে? সেই অদৃশ অসীম শক্তি যাকে আমরা 'ভগবান' বলি! নাস্তিকরা যার অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না!
        ত্রিবেন্দ্রমে কাজের ব্যস্ততায় বেমালুম বিস্মৃত হয়ে গেছে অধরা পিএইচডির স্বপ্ন। কোয়েমবাটুরে PIRCOM-এর গবেষণালব্ধ সংগৃহীত তথ্য বাক্সবন্দী হয়ে রয়েছে দীর্ঘ সময়। অ্যানালিসিস করার অবকাশ মেলেনি। তাই পিএইচডি থিসিস হিসেবে জমা করার সুযোগ ঘটেনি। পাক্কা এক বছর পার। দিনের পর দিন ধুলো জমেছে তথ্যপঞ্জির উপর। ধুলোর মোটা স্তরের সাফাই পর্ব সেরে ডেটা বিশ্লেষণের কাজে হাত লাগানোর জন্য সচেষ্ট হতেই আর এক বিপত্তি! বিপত্তি বলে বিপত্তি! এ যেন সর্ষের মধ্যেই ভূত! ফিল্ডম্যানকে দিয়ে ক্যালকুলেটরের সাহায্যে পুনরায় ডেটা বিশ্লেষণের কাজে ব্রতী হতেই আকস্মিক বাধার মুখোমুখি রামচন্দ্র বাবু। খবর রটে গেল অফিসের ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে তাঁর ডেটা বিশ্লেষণের কথা। পেছন থেকে কাঠি করার লোকের অভাব নেই। পেছন থেকে কলকাঠি নাড়া শুরু করে দিয়েছে অফিসের হেড ক্লার্ক। মূলত কুচুটে ক্লার্ক মি. কে. পি. কে. নায়ারের আপত্তিতে ডিরেক্টর ড. মাগুন (Dr. Magoon) ব্যক্তিগত কাজে অফিসের হ্যান্ড ক্যালকুলেটর ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন। ব্যাস! আর একবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। এত শারীরিক আর মানসিক পরিশ্রমের ফসল গবেষণার কাজ শেষমেশ পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে? অদৃষ্টের কী পরিহাস! এভাবে কেটে গেল আরও কিছু দিন। রামচন্দ্র বাবুর কথাবার্তায় হতাশা গ্রাস করে। তাঁর হতাশার কথা মাঝে মধ্যে প্রকাশ পেত প্যাথোলজি বিভাগের প্রধান ড. সি. আই. চাকো (Dr. C. I. Chacko)-র কাছে। কিন্তু ড. চাকো শুধুই নীরব শ্রোতা। মন দিয়ে শোনেন সব কথা। ন্যূনতম মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। কোনও আলোচনায় নিজেকে জড়ান না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। এমন সময় দিল্লী থেকে এলেন IARI-এর বিশিষ্ট ফিজিওলজিস্ট ড. এস. কে. সিনহা। তিনি ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দিলেন ত্রিবেন্দ্রমের টিউবার ক্রপস ইনস্টিটিউটে। ড. সিনহার যোগদানে রামচন্দ্র বাবু মনের মতো একজন বন্ধু পেলেন। সত্যিকারের পরমহিতৈষী বন্ধু। বন্ধুর কাছে একদিন উজাড় করে দিলেন নিজের দুঃখ কষ্ট ব্যথা বেদনা হতাশা। সকল কথা শুনে সমবেদনা জ্ঞাপন করলেন বন্ধু। একটা যুতসই বিহিত করতে উঠে পড়ে লাগলেন ড. সিনহা। একদিন ড. চাকো'কে সঙ্গে নিয়ে সটান উপস্থিত হলেন ডিরেক্টর ড. মাগুন-এর ঘরে। অফিসের ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা নিয়ে তাঁর নিষেধাজ্ঞার তীব্র সমালোচনা করে ড. সিনহা ভর্ৎসনার সুরে বললেন —
একটা গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর হয়ে আপনার সহযোগিতা ও সুপরামর্শ দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

কেটে গেল মেঘ। নিমেষে সরে গেল সব ছায়া। রোদ ঝলমলে সাফল্যের সূর্য উঁকি দিচ্ছে এখন। মিলল অনুমতি। হাত ক্যালকুলেটর ব্যবহারের বিরুদ্ধে উঠে গেল আপত্তির সব বাধা। পুনরায় ক্যালকুলেটর সহযোগে শুরু হল রামচন্দ্র বাবুর তথ্য বিশ্লেষণের কাজ। অবশ্যই ড. সিনহার সুপরামর্শে। দিনরাত এক করে থিসিস লেখা শেষ হল ১৯৬৯ সালে। আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা পড়ল তাঁর থিসিস। মিলল তাঁর চির সাধনার পিএইচডি। এখন থেকে তিনি কৃষিতে ডক্টরেট। নামের আগে বসবে ডক্টরেট উপাধি। ড. রামচন্দ্র মণ্ডল। অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম আর অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফসল তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি প্রাপ্তি। এ ডিগ্রি দারিদ্র্যতার মুখে মস্ত বড় ঝামা ঘষে দেওয়া এক সাফল্য। দায়বদ্ধতার বাস্তব দলিল। আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। অনাবিল শান্তির নতুন ঠিকানা।

(৩)
পথেঘাটে অফিসে যেতে-আসতে প্রায়ই দেখা হয়ে যায় ড. এম. এল. মাগুন-এর সঙ্গে। সমাজ বিধির পথ খুলে যেত। গুড মর্নিং। শরীর ভালো আছে? কেমন আছেন, স্যার? ইত্যাদি। ড. মাগুন একজন চেইন স্মোকার। ধূমপানের তীব্র নেশা। প্রচণ্ড অ্যালকোহল আসক্ত। মুখোমুখি দেখা হলেই ড. রামচন্দ্র মণ্ডল সাবধান বাণী আউড়ে বলতেন—
সিগারেট সেবন ও অ্যালকোহল গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন, স্যার। দুটোই স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। দুটোই প্রাণঘাতী নেশা।

কিন্তু কে শোনে কার কথা? হাসিমুখে উড়িয়ে দিতেন সব উপদেশ-আদেশ। ফলে যা হবার, তা-ই ঘটল। অকালে ঝরে গেল একটি ফুল। ড. মাগুন-এর অকালমৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এল ইনস্টিটিউটে। অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানের হাল ধরলেন ড. রামচন্দ্র মণ্ডল। অন্তর্বতীকালীন ডিরেক্টর নির্বাচিত হলেন তিনি। তাঁর ডিরেক্টর ইন-চার্জের মেয়াদকাল ছিল মাত্র দুটি বছর। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে।
          সেসময় দেশের পার্লামেন্টের বিরোধী দলনেতা ছিলেন চির অকৃতদার সম্মাননীয় অটল বিহারী বাজপেয়ী মহাশয়। অটলজী তখন পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি (Public Accounts Committee)-এর প্রধান। ভারতীয় সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির মাথায় সবসময় পার্লামেন্টের বিরোধী দলনেতা বসেন। কতিপয় বিজেপি সদস্য সঙ্গে নিয়ে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির প্রধান হিসেবে অটলজী ত্রিবেন্দ্রামে কেন্দ্রীয় মূলজ শস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান (Central Tuber Crops Research Institute বা CTCRI) পরিদর্শনে আসেন। আলোচনায় CTCRI-এর ভুয়সী প্রশংসা করেছিলেন তিনি। সেসময় কেন্দ্রীয় পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির সম্মানার্থে ত্রিবেন্দ্রামের আর্চ বিশপ একটি চা পানের ব্যবস্থা আয়োজন করেছিলেন। এ হেন চা-চক্রে একটু ভিন্ন স্বাদের খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল। টেপিওকা পাতা ও নারকেল কোরা সহযোগে প্রোটিন সমৃদ্ধ সুস্বাদু শাক তৈরি করে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এছাড়াও, যে-টেপিওকা গাছ অল্প পরিমাণে হাইড্রোজেন সায়ানাইড ঘটিত বিষাক্ত পদার্থের আধার, সেই টেপিওকা গাছ সেদ্ধ করে জল ফেলে দিলে সম্পূর্ণ বিষ মুক্ত। তখন তা চাল ও গমের বিকল্প সুস্বাদু খাবার বনে যায়। সস্তায় কেরলবাসীর কার্বোহাইড্রেট যুক্ত আহার। গরীবের পেট ভরাতে এতদাঞ্চলের প্রধান খাবার। সেই চা-চক্রে অতিথি অভ্যাগতদের টেপিওকা সেদ্ধ পরিবেশন করা হয়েছিল। অটলজীর পাশে একই টেবিলে বসে ছিলেন রামচন্দ্র বাবু। অটলজীকে প্রতিটি খাবারের খাদ্যগুণ বর্ণনা করছিলেন তিনি। খুশি মনে বিদায় নিয়েছিল ভিজিটিং টিম। ত্রিবেন্দ্রামে থাকাকালীন একখানি বই প্রকাশিত হয়েছিল। 'Tropical Roots and Tuber Crops' ক্রান্তীয় অঞ্চলের মূলজ শস্যের উপর তাঁর লেখা বই।

ভালো কাজের কখনও বিকল্প হয় না। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। শর্টকাট উপায়ে আর যাই হোক, সম্মান-নামডাক-খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছানো যায় না। এর জলজ্যান্ত প্রমাণ ড. রামচন্দ্র মণ্ডল। আজ তিনি সকলের প্রিয় কৃষিবিজ্ঞানী। কৃষিতে উন্নত মানের বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে তাঁর গবেষণা তাঁকে ভারত সরকারের চোখে একজন স্পেশাল মানুষে পরিনত করে। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কেরালায় অতিবাহিত করার পর তাঁর ডাক আসে আরও বড় ক্ষেত্রে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এবার তাঁর ডাক এল সুদূর বিদেশ থেকে। কোন সে-দেশ? কেনই বা তাঁর ডাক পড়ল? এবার তাঁর কী সিদ্ধান্ত? বিদেশে পাড়ি দেবেন? নাকি, দেশের মধ্যে থেকে দশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করবেন? (ক্রমশ...)

তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি



Post a Comment

0 Comments