মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৫৪
বাদল পড়্যা ( আতসবাজি শিল্পী, আড়ং কিয়ারানা, ময়না)
ভাস্করব্রত পতি
বারুদ দিয়ে যাঁরা বানান রঙিন আতসবাজি, তাঁরা বাজিকর। আকাশ আলোময় করা এইসব বাজিকরদের জীবন অবশ্য অন্ধকারেই ঢাকা। পদে পদে বিপদ। জীবন মৃত্যুর দোলাচলতায় তাঁদের বিড়ম্বিত জীবন। ‘প্রদীপের তলায় অন্ধকার'- এ সত্যতা তাঁদের জীবনের সাথেই লেপ্টে। এমনই এক বাজিকর বাদল পড়্যা। ময়নার আড়ং কিয়ারানা গ্রামের বাসিন্দা, কংসাবতী ক্ষীরাইয়ের পাড় বরাবর সোজা এগুলেই মিলবে এই গ্রাম। আরেকটু এগুলেই কেলেঘাই নদী। সেখানেই বাজিকর বাদলের গ্রাম।
'জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য' করেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। মেঠো বাড়ি। সামনে খড়ের চাল দেওয়া দালান। সেখানেই বাজি তৈরির কর্মযজ্ঞ। হরেকরকম বাজি আর হরেকরকম পদ্ধতি। পূর্ব মেদিনীপুরের চিল্কা, পুলশিটা, পয়াগ, সুবদি, বাঁশগোড়া, বাহারপুর, পাউশি, কামারদা বাজার এর মতো আড়ং কিয়ারানাও বাজিকরদের আস্তানা। বর্ষিয়ান বাদল পড়্যা সেইসব বাজিকরদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম এক কারিগর। মেদিনীপুরের বুকে আতসবাজিকে পাথেয় করে এক অভিনব যুগের সূচনা করেছিলেন এই প্রান্তিক মানুষটি। যেকোনো উৎসব অনুষ্ঠানে দর্শক মাতাতে ডাক পড়ত তাঁর। কিন্তু দর্শক জানতেও পারতেন না এই রোশনাইয়ের পেছনের মানুষের অবদানের কথা।
বাদলবাবু বিখ্যাত ছিলেন চাররকমের বাজির জন্য। ইলেকট্রিক বাতি, সানলাইট বাতি, লালনীল বাতি এবং ঝিকমিক বাতি। প্রথমটি বৈদ্যুতিক আলো, দ্বিতীয়টি সূর্যের আলো, তৃতীয়টি পালা করে লালনীল রঙ এবং শেষেরটি দপদপ করে জ্বলতে থাকে। সেই সঙ্গে তিন ধরনের তুবড়িও বানাতেন তিনি। ঝিকমিক তুবড়ি, ইলেকট্রিক তুবড়ি এবং সাদা আলোর ফুলকি ওয়ালা তুবড়ি তৈরিতে তিনি ছিলেন পাকা। মেদিনীপুরের মানুষদের তিনি উপহার দিয়েছিলেন মালাবাজি, গাছ বোম, চকোলেট বোম, ফুলঝুরি, পাট বোম, আলু পটকা, দোদমা, তারাবাজি, লঙ্কা পটকা থেকে শুরু করে নানা ধরনের আকাশপ্রেমী আতসবাজি।
বলতে গেলে বাদল পড়্যাই একসময় হয়ে উঠেছিলেন জেলার আতসবাজি শিল্পের মুখ। কিন্তু বাদল পড়্যার পরিচিতি 'আতসবাজির গাছ' তৈরির মুখ্য কারিগর হিসেবে। আতসবাজির গাছ! কেমন ধরনের সেই গাছ? শব্দযুক্ত গাছের মধ্যে পড়বে ফুলবোম গাছ, কদম গাছ (লীল, নীল), সিটি কদম (পুলিশের সাইরেনের মতো শব্দ হয়) ইত্যাদি। বাজির সালতামামিতে রয়েছে আগুন গাছের অস্তিত্ব। এই আগুন গাছে আগুন দিলে সৃষ্টি হবে জলপ্রপাত, রৌপ্য বৃষ্টি, স্বর্ণবৃষ্টি, উল্কা বৃষ্টি, ঝাউ গাছ, অপরাজিতা (বেগুলি রঙের ফুলের মতো আগুনের ফুলকি মাটিতে পড়বে আর জ্বলবে) ফুলের মতো। এছাড়া আরও নানা রকমের ‘গাছ’-এর দেখা মিলবে। হাইব্রিড, ফানুস, গোলা, নৌকাকাণ্ড, সুদর্শনচক্র, সাধারণ চক্র, মালা, ম্যাজিক গাছ, উড়ন চরকি ইত্যাদি।
দীপাবলী এলেই মনে পড়ে বাদল পড়্যাদের। যদিও আতসবাজির গাছের চাহিদা সারা বছর। রাস মেলা, দুর্গোৎসব, পুজো পরব, বিড়ে বাড়ি, হলদিয়া উৎসব — বাদল বাবুর ডাক পড়ে। বারুদের সঙ্গে সখ্যতা করতে করতে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাঁকে।
বারুদের সাথে সখ্যতা যাঁদের, বারুদকে তাঁরা ভয় পাননা। বারুদ নিয়েই নিত্যদিনের জীবনচর্চা। বারুদ মাখা হাতেই খাবার মুখে পুরে দিতে কুণ্ঠা হয়না তাঁদের। আসলে বাদল পড়্যারা বারুদের সাথে ঘুমোয়। বারুদের গন্ধে ভোর হয়। ভোর শুরু হয় বারুদ নিয়ে নাড়াচাড়া। হাতে চোখে মুখে লেগে থাকে বারুদের মোলায়েম পরশ। কিন্তু সেই পরশেই থাকে মৃত্যুর শীতল আলিঙ্গন। জীবনকে বাজি রেখে তাঁর পথচলা। তাঁর বেঁচে থাকা। তাঁর মৃত্যু। উৎসবের আঙিনাকে রঙিন করার বাসনায় মেদিনীপুরের আতসবাজি শিল্পী বাদল পড়্যাদের কুর্ণিশ না করে উপায় কি!
0 Comments