ফেরা
বিজয় চক্রবর্তী
গল্পকে গল্প বলা খুব অন্যায় কাজ আর আমি খুব একটা গল্প লিখতেও পারি না। তবে লিখতে খুব ইচ্ছা করে। পাঠক কি চায়, সে দায়ও নেই। এদিক সেদিক পোষ্টও করা হয় না। তবে লিখে রাখি। পরে পড়লে বেশ রোমাঞ্চ হই। ওই দিনের বা দিনগুলির কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। ছবি দেখলেও হয়। মোবাইলে তো কম ছবি তোলা হয় না! তবে ছবি হারিয়ে যায়। হার্ডডিস্ক ঠিক ভরসার নয়। সাজিয়ে না রাখলে কোনটা যে কোথায় থাকে ! ডায়েরিটা বেশ ভরসার, নিজের বলে মনে হয়। লিখে রাখি....
এই যেমন পুরী স্টেশনে পৌঁছানোর সময় একটি টোটো ভাড়া করা হলো। মন্দিরের পাশের গলির পাশে সাতটি ঘর নিয়ে তৈরি লজের চুল লম্বা (না কাটা) ছেলেদের ডেকে দেওয়া টোটো। মনোজ, সুজয় এদের নাম। টোটো চালকের তোবড়ানো মুখে আর কঠিন দৃষ্টিতে তার জীবন সংগ্রামের কাহিনি ধরা আছে। শীত আজ বেশ অনুভূত হচ্ছে। দু বছরের ছেলেকে মাঝে চেপে বসিয়ে পুরী স্টেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। লোকজন দেখলেই দু চার কথা বলে নিই। পেশাগত পুরোনো অভ্যাস। সবাই যে সব কথার উত্তর দেয় তা নয়, তবে মাঝে মাঝে বেশ ভালো উত্তর পাওয়া যায়। কোনও কোনও উত্তর নিতান্ত মজার, কোনটা বিশেষজ্ঞের মতামত, আর কোনও কোনও উত্তরের সামঞ্জস্য থাকে না।বুঝতে পারি না তিনি কী বললেন। অবশ্য আমি কী জানতে চাইলাম সেটি তিনি বুঝতে পেরেছেন কিনা, সেটাও বিবেচ্য! আজ কিছুটা যাবার পর মুখ খুলতে ইচ্ছা হল। গিন্নী আর ছেলে বেশ চারিদিক দেখতে দেখতে চলেছে। খাবারের ছোট ছোট দোকানে রুটি সেঁকার কাজ চলছে। এক বালতি ছানা সাদা কাপড়ে বেঁধে দোকানের মধ্যে ঝুলিয়ে দিল দোকানি। সারারাত ছানা থেকে জল চুঁইয়ে পড়বে। পরদিন ছানার জিলিপি কিংবা রসগুল্লা হবে। গলির রাস্তায় বেশ ভিড় এখনও। গলির মুখে অন্ধকার। অটো স্ট্যান্ডের পাশের লস্যির দোকানদার এখনও কর্মব্যস্ত। সকালের লস্যি এখনকার লস্যির কোনো পার্থক্য আছে কিনা চেখে দেখা হল না। বড় গলিতে বেশ ভিড় এখনও। মন্দিরের দিকে দল বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছে এখনও। পিছনের দিকে মন্দিরের সিংহদরজার দিকে চলে গেছে এই রাস্তা। ঘিয়ে ভাজা খাজার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে এখনও। হয়তো পাশে অন্য কোথাযও ভাজা হচ্ছে ।
টোটো চালককে বললাম, বেনারস গেছেন? বারানসি? কাশী?
কাশী বিশ্বনাথ।
নেহি।
এক কথায় উত্তর শেষ। বেশ গম্ভীর টাইপের লোক মনে হচ্ছে। গিন্নী এখনো আমাদের কথাবার্তায় মনোযোগ দেয়নি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, না মানে, আপনাদের পুরীর গলি, এই গলিটা অনেকটা কাশীর গলির মতো। লোকটা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, এখানে নতুন করে আর কিছু হবে না। ভোটের সময় রাস্তা বড় করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু কাজ হয় না।
বুঝলাম আমার গলিতে মিল খুঁজে পাওয়াতে অন্য কিছুর আভাস পেয়েছেন উনি।
সত্যি বলতে কী আমি এই সব ছোট ছোট গলির ভিতর জীবনের গতি দেখতে পাই,সে মেদিনীপুরের কোনও গলি আর বিষ্ণুপুরের গলি কিংবা উত্তর কলকাতার একাকী দুপুরের সরু গলি বা লখনৌ পুরোনো মহল্লা। সুযোগ পেলেই এসব জায়গায় একবার ঢুঁ মারি। কাউকে না চিনলেও কেমন চেনা চেনা মনে হয়। কোনও কথা না বললেও মনে হয় ওদের সব কথা জানি....
টোটো চালককে বললাম বিচের দিকে বেশ বড় বড় হোটেল হয়েছে। উন্নতি তো হচ্ছে!
হ্যাঁ, আমি এল অ্যান্ড টি এর ষাট মহলার বিল্ডিং-এ কাজ করেছি। মুম্বাই এ।
বুঝলাম তিনি বলতে চাইছেন এ আর কী উন্নতি!
ফিরলেন কেন? কাম কিউ ছোড় দিয়া?
সবহি কো একদিন ঘর ওয়াপাস আনা ... হামরা তবিয়াত থোড়া বিগর গয়া থা।
শরীর অসুস্থ ছিল, সেটা বোঝা গেল। অসুস্থ শরীরে, বাইরে কে আর সেবা যত্ন করবে? কিন্তু প্রথম বাক্যটা মনের মধ্যে গেঁথে গেল ... সবাইকে একদিন ঘরে ফিরতে হবে। কী এক অমোঘ উচ্চরণ! কী এক চরম সত্য!
সারা রাস্তা একটিও কথা বললাম না। ঘড়িতে ন'টা আঠারো। ন'টা পঞ্চান্নতে ট্রেন। পুরী নিউ দিল্লি এক্সপ্রেস।
---
0 Comments