জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী/উপপর্ব — ১৩/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৭৮
এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী

উপপর্ব — ১৩

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

টিউবার ক্রপস রিসার্চে ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর সাফল্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। মূলজ শস্য গবেষণায় তাঁর কার্যকারিতা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (ICAR) তথা ভারত সরকারের সুনজরে ছিল। তারপর একদিন হঠাৎ এসে গেল অভাবিত সুযোগ। সুযোগ বিদেশ ভ্রমণের। প্রবাসে গবেষণা লব্ধ জ্ঞানের সফল ব্যবহারিক প্রয়োগের সুযোগ।

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত একটি স্বাধীন দ্বীপরাষ্ট্র ফিজি (Fiji)। সরকারি নাম প্রজাতন্ত্রী ফিজি দ্বীপপুঞ্জ। কমবেশি তিন শতাধিক দ্বীপ নিয়ে তৈরি। এর মধ্যে মাত্র ১০৬ টি দ্বীপে লোকজনের বসবাস। দুটি প্রধান দ্বীপ ভিট্টি লেভু (Vitti Levu) আর ভেনুয়া লেভু (Vanua Levu)-তে অধিকাংশ মানুষের বাস। অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্বে প্রায় ৩১০০ কিলোমিটার এবং হাওয়াইয়ের দক্ষিণে ৫০০০ কিমি দূরে ফিজির অবস্থান। ফিজির দক্ষিণ দিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড। ফিজিয়ানদের ভাষা মূলত ইংরেজি, ফিজিয়ান ও ফিজি হিন্দি। প্রথম দুটি ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। ফিজি মূলত কৃষি প্রধান রাষ্ট্র। কলা, ধান, আখ ও আখজাত শস্যের ভাণ্ডার দ্বীপরাষ্ট্রটি। 

১৯৭৩ সালের গোড়ার কথা। সেবছর ফিজি সরকার দারুণ সংকটে। মূলজ শস্য উৎপাদনের লক্ষ্যে ভীষণ সমস্যার সম্মুখে তারা। হাইব্রিড টিউবার ক্রপস বিষয়ে তাদের প্রয়োজন একজন এক্সপার্ট। চাই গবেষক কাম অ্যাডভাইজার (Advisor)। এ ব্যাপারে তারা সাহায্য চাইল ভারত সরকারের কাছে। ভারত সরকারও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে উদগ্রীব। কিন্তু কে যাবে সুদূর ফিজি দ্বীপপুঞ্জে? সেখানে কাকে পাঠানো যুক্তিযুক্ত হবে? এত বড় দেশে কোনো একজনকে নির্বাচন করা খুব ঝক্কির কাজ। তবে সেসময় মূলজ শস্য উৎপাদনের জন্য একজন গবেষকের চাহিদা মেটাতে এক ও অদ্বিতীয় চয়েস ড. রামচন্দ্র মণ্ডল।

আগস্ট মাস। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ডেপুটেশনে ফিজি রওনা হয়ে গেলেন রামচন্দ্র বাবু। মাদ্রাজ বিমানবন্দর থেকে রামচন্দ্র বাবুর বিমান যখন অস্ট্রেলিয়ার পারথ বিমানবন্দরের মাটিতে পৌঁছয়, তখন মধ্যরাত্রি। ভারতীয় বিমান পারথ-এ পৌঁছানো মাত্র সমস্ত যাত্রীকে এরোপ্লেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তারপর প্লেনের ভিতরে ভালোভাবে রাসায়নিক স্প্রে করা হয়। কোনও পোকামাকড় যেন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য এমন ব্যবস্থা। অস্ট্রেলিয়ার এ হেন প্ল্যান্ট কোয়ারেনটাইন ব্যবস্থাপনায় যারপরনাই বিস্মিত রামচন্দ্র বাবু। কারণ ভারতের মতো গরীব একটা দেশে কোয়ারেনটাইন বিভাগ আছে বটে। তবে তা এতটা সক্রিয় নয়। কীটনাশক স্প্রে শেষ হলে পারথ থেকে ফিজির উদ্দেশ্যে ছাড়ল বিমান। পরের দিন দিনের বেলা ফিজির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল ভারতীয় বিমানের চাকা। সেখান থেকে ছোট্ট এয়ারক্রাফটে সোজা ফিজির রাজধানী সুভা (Suva)-র সন্নিকটে কোরোনোভিয়া এয়ারপোর্ট। সেখানকার কোরোনোভিয়া রিসার্চ স্টেশন (Koronovia Research Station)-এ দেশের বাইরে রামচন্দ্র বাবুর প্রথম পোস্টিং ছিল। এয়ারপোর্টে পৌঁছনো মাত্র মিলল রাজকীয় সম্মাননা। সেখানকার লিয়াসন অফিসার (Liaison Officer) ভিআইপির সম্মান দিয়ে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রাজধানী সুভা-তে নিয়ে গেল রামচন্দ্র বাবুকে। কৃষি দফতরের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী, কৃষি ডিরেক্টর, প্রিন্সিপল সেক্রেটারি এবং কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে পরিচিতি পর্ব সারা হল। কোনও কাজের দায়িত্ব পালনের আগে প্রধান দুটি দ্বীপ ভিট্টি লেভু ও ভেনুয়া লেভু পরিদর্শনে গেলেন রামচন্দ্র বাবু। দুই দ্বীপের বিভিন্ন কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক ও কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব শেষে সপ্তাহ খানেক কোনো কাজ নয়। প্রথম সাতদিন ধরে চলে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা। কার্যকর পরিকল্পনার খসড়া তৈরি। চলল ঘোরাঘুরি। দ্বীপরাষ্ট্রের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তারপর রামচন্দ্র বাবুর ওপর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব বর্তায়। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। প্রয়োজন পরিকাঠামোর সার্বিক উন্নয়ন। প্রশাসনিক সহযোগিতা। পরিকল্পনার সার্থক প্রয়োগের দিশা খুঁজে পাওয়ার আশায় ফিজির সায়েন্টিফিক বডির কাছে উপস্থাপন করা হল তাঁর পরিকল্পনা। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! অযাচিত এক ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত। 
        
রামচন্দ্র বাবুর ডেপুটেশন ব্যবস্থাপনায় দেরি হওয়ায় সাউথ পেসিফিক (South Pacific) অঞ্চল থেকে একজন এক্সপার্ট ইতিমধ্যে মূলজ শস্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফিজি-তে। স্বভাবতই দুজন বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি বিপত্তির মূল কারণ।‌ ফলত দায়িত্ব ভাগ করা হয় দুজনের মধ্যে। রামচন্দ্র বাবুর দায়িত্ব ছিল ফিজির প্রধান রপ্তানিকৃত পণ্য কলা উৎপাদন, ধান চাষে আগাছা নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি দ্রব্য আদা চাষের ফলন বৃদ্ধি এবং ভেনুয়া লেভু দ্বীপে শুষ্ক এলাকার ফসল (Dry Zone Crops) উৎপাদন এবং বিকল্প চাষ পদ্ধতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে নজর দেওয়া। উন্নত জাতের কলা ভেইমামা (Veimana) ও আদা বেশি পরিমাণে উৎপন্ন করে নিউজিল্যান্ডে রপ্তানি করা। ফসল দুটি অত্যন্ত লাভজনক। তাই লক্ষ্য মাত্রা অধিক ফলন। গবেষণা লব্ধ দৃষ্টান্ত স্থাপন। তা করতে গিয়ে দ্বীপরাষ্ট্রে বিস্তীর্ণ এক জলাভূমির সন্ধান মিলল। জলে ভেজা কাদা মাটি। চাষবাসের অযোগ্য। নীচু পতিত জায়গা। দীর্ঘ দিন অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

এ হেন পরিত্যক্ত জায়গায় শুরু হল রামচন্দ্র বাবুর পরিকল্পনা মাফিক কাজকর্ম। প্রথমে পরিত্যক্ত জলা জমিটিকে কোম্বা সিস্টেমে (Comba System) উঁচু করা দরকার। দুটি কোম্বার মধ্যিখানে নালা তৈরি করে অতিরিক্ত জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়। ফিজির মূল্যবান রপ্তানি যোগ্য ফসল কলা। উঁচু জৈব রসে উর্বর সরস জমিতে উন্নত মানের কলা চারা (Veimama Variety) বসানো হয়। কয়েক মাসের ব্যবধানে ফসল ফলে কলা গাছ। সারিবদ্ধ বড় বড় কলা কাঁদি ঝুলছে গাছ গুলোতে। তা দেখে পথের ধারের লোকজন ও কৃষি বিভাগের চক্ষু চড়কগাছ! সবাই অবাক। পতিতা জমিতে ফিজির সোনার ফসল কলা ফলছে দেখে সবাই বিস্মিত। 

ধানক্ষেতে প্রচুর আগাছা ফিজির আর একটা উল্লেখযোগ্য সমস্যা। জমিতে অত্যাধিক আগাছা জন্মানোর জন্য শস্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। ব্যাহত হয় উৎপাদন হার। তাহলে উপায় কী? ধানের জমিতে হরেক রকমের আগাছা নাশক ঔষধ পরীক্ষা করে দেখা হল প্রথমে। শেষমেশ একটি আগাছা নাশক চিহ্নিত করা গেল। ধান গাছের কোনো রকম ক্ষতি না করে সমস্ত ধরনের আগাছা বিনাশ করতে সক্ষম ঔষধখানি। নিষ্কৃতি পেল ধান চাষীরা। বাড়ল ফলন। বাড়ল মুনাফা। 
      
ফিজির বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সমস্যার সমাধান করার পুরস্কার মিলল হাতেনাতে। মিলল সরকারি স্বীকৃতি। সুনাম ছড়িয়ে পড়ল রামচন্দ্র বাবুর। কিন্তু সেখানে কীভাবে কাজ সারতেন তিনি? ৩৩২ টি দ্বীপ। একটা দ্বীপ থেকে আরেকটি দ্বীপের মাঝখানে বিস্তর দূরত্ব। মধ্যিখানে দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি। যদিও রামচন্দ্র বাবুর বেশিরভাগ আনাগোনা সীমাবদ্ধ ছিল দুটি দ্বীপের মধ্যে। ঘন ঘন যাতায়াত লেগেই থাকত ভিট্টি লেভু ও ভেনুয়া লেভু দ্বীপে। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ছোট ছোট এরোপ্লেন। ফিজিতে নিরামিষ ভোজী জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। কোনও রকম ড্রিংকস পানে অনভ্যস্ত। চা পানেও অনীহা। অগত্যা নিরামিষাশী ব্যক্তির মতোই তাঁর দিন গুজরান হত। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
একদিন বিশেষ এক ঘটনা ঘটে। বার্ধক্যের বারানসিতে পৌঁছে এখনও সে-ঘটনা তাঁর স্মৃতিপটে উঁকি মারে। রসায়ন বিভাগের প্রধান ছিলেন ড. সিং। মি. সিং তাঁর নিজের কাজে ভেনুয়া লেভু দ্বীপে পৌঁছে গিয়েছেন আগের ফ্লাইটে। সেদিন রামচন্দ্র বাবুর ফ্লাইট ভেনুয়া লেভু দ্বীপে পৌঁছায় দুপুরে লাঞ্চের সময়। মি. সিং লাঞ্চের টেবিলে বসে রয়েছেন। টেবিল আলো করে রয়েছে দামী হুইস্কি। তিনি তাঁর লাঞ্চের টেবিলে আহ্বান করলেন রাম বাবুকে। রামচন্দ্র বাবুর সপ্রতিভ জবাব—
'এক্সট্রিমলি সরি, মিঃ সিং।'
একটা চেয়ার দখল করে বসে পড়লেন রামচন্দ্র বাবু। একটা সফট ড্রিংকস অর্ডার দিয়েছেন। ঘুণাক্ষরেও ছুঁয়ে দেখলেন না দামী মদের বোতল। মিঃ সিং ঈষৎ ক্ষুন্ন। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন —
'যদি আপনি আমার সঙ্গে ড্রিংক না করেন, তাহলে কোনোদিন আপনার কোয়ার্টারের বাসায় আসব না।'
ব্যাস! কেটে গেল তাল। নষ্ট হয়ে গেল বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন। অথচ, রামচন্দ্র বাবুর বন্ধুত্ব এত ঠুনকো নয় যে তুচ্ছ ব্যাপারে তা ভেঙে যায়। কিন্তু যে-বন্ধুত্ব সামান্য ঘটনায় ভেঙে চৌচির হয়ে যায়, সেরকম বন্ধুত্ব থাকার চাইতে না থাকাই শ্রেয় বলে তাঁর অভিমত। সেই থেকে দুজনের বাক্যালাপ একপ্রকার বন্ধ। ট্যুর থেকে যে যার বাসায় ফিরে গেল। মাসাধিককাল যোগাযোগ নেই। এরপর একদিন একটা মজার ঘটনা ঘটল। সেদিন মিঃ সিং খানিক বেশি মাত্রায় মদ্য সেবন করে ফেলেছেন। তাঁর বেজায় বেহাল অবস্থা। মাতাল হয়ে গাড়িতে একাকী ফিরছেন। নিজের বাড়ির চারপাশে সারা রাত যাবৎ গাড়িতে চক্কর কেটে চলেছেন। কিন্তু বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না। আসলে নেশা এত বেশি মাত্রায় মাথায় চড়েছে যে নিজের বাড়ি নিজেই চিনতে পারছেন না। শেষমেশ ভোরের আলো ফুটতেই অনেক কষ্টে ঘরটা চিনে বাড়ি ঢুকলেন মিঃ সিং। এই ঘটনার দুই-চার দিন পরের ঘটনা। রামচন্দ্র বাবুর বাসায় হঠাৎই হাজির তিনি। পূর্বে করা প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত। অকপটে বিগত রাত্রির কথাগুলো বলে চললেন একটানা। তারপর একটু বিরতি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ল। নিজের ভুল নিজে স্বীকার করে প্রতিজ্ঞা করলেন —
'আর কখনও আমি ড্রিংক করব না।'
এ এক অভাবনীয় পরিবর্তন। একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে মদ বর্জণের এমন হাতেগরম উদাহরণ সচরাচর দেখা যায় না। (ক্রমশ...)

তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি


Post a Comment

0 Comments