জ্বলদর্চি

শিশুতোষ ধাওয়া (আঞ্চলিক গবেষক, খাকুড়দা, এগরা)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৫৩
শিশুতোষ ধাওয়া (আঞ্চলিক গবেষক, খাকুড়দা, এগরা) 

ভাস্করব্রত পতি

ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে একসময় প্রখ্যাত গবেষক তারাপদ সাঁতরা আশ্রয় নিতেন তাঁর বাড়িতে। বলা যায় লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার উৎসাহ শুরু হয় ঠিক তখন থেকেই। শিশুতোষ ধাওয়ার লৌকিক অনুসন্ধান চর্চার গতিমুখ গতি পায় তখনই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন লোকসংস্কৃতি চর্চায়। ১৯৩৭-এর ২৩ শে ফেব্রুয়ারি হাওড়ার উলুবেড়িয়া মহকুমার আমতা থানার রানাপাড়া গ্রামে জন্ম হলেও তিনি আদপে পশ্চিম মেদিনীপুরের খাকুড়দার স্থায়ী বাসিন্দা।

যদিও বান বন্যার কারনেই হাওড়ায় যাওয়া। আদি বাসস্থান ঘাটালের গম্ভীরনগরে। কিন্তু ব্যাবসার কারণে খড়গপুরের কোঁতাইগড়, খাকুড়দা এবং বাখরাবাদে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন পরিবারের লোকজন। বাখরাবাদের পাঠশালায় হাতেখড়ি শিশু শিশুতোষের। এরপর নানা পথ প্রান্তর পার হতে হয়েছে তাঁকে। কখনও তমলুকের চকশিমুলিয়া কামাক্ষ্যা বিদ্যাপীঠে, কখনও শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজ (১৯৫৯) কিংবা মৌলানা আজাদ কলেজে (১৯৬২) যেতে হয়েছে। পড়াশুনা থেমে থাকেনি এই মানুষটির। বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বাংলা স্পেশাল অনার্স পাশ করেন(১৯৬৩)। 

নিজের চোখে দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের সামাজিক টানাপোড়েন। কিন্তু লক্ষ্য ছিল বড় হওয়ার। অবশেষে কর্মজীবন শুরু আমতা রসপুর মালটিপারপাস উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানে ছিলেন এক বছর। এরপর আমতার সোনামুই  হাইস্কুলে তিন মাস। হুগলীর সাড়োখানা হাইস্কুলে তিন বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৬৭ থেকে স্থায়ী হন পশ্চিম মেদিনীপুরের আসন্দা শিক্ষা নিকেতনে। এখানে ছিলেন ৩১ বছর। এর মধ্যেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেন এম. এ. (১৯৮০)। অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনি ছিলেন এক সফল এবং ছাত্রপ্রিয় শিক্ষকের তকমাধারী মানুষ।

শ্রদ্ধা ও স্মরণ 👇
ইতিহাস মানেই তো শুধু পথঘাট, পাহাড় বন, নদী নালা, প্রচীর আকারের ইতিবৃত্ত নয়। জড়িয়ে আছে স্থানীয় জনজীবনের গতিপ্রকৃতি, আচার সংস্কৃতি, সমাজ ধর্মের গতি প্রকৃতি। এই বিশ্বাস এবং ধারণা থেকেই ৭১ বছর বয়সে শুরু করলেন পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা মহকুমার ইতিহাস রচনা। মেদিনীপুরের ইতিহাস লেখক শিশুতোষ ধাওয়া। 

ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই তাঁর লেখালেখি শুরু। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম ছাপার হরফে লেখা প্রকাশ। ধীরে ধীরে তাঁর লেখনী হয়ে ওঠে মুখর। তিনি হয়ে ওঠেন সাহিত্যজীবী এক সাহিত্যসেবক। হাওড়ার লোক গবেষক ড. শিবেন্দু মান্নার সংস্পর্শে এসে বদলে গিয়েছিল জীবন। এ প্রসঙ্গে শিশুতোষের মন্তব্য, - “এঁদের সঙ্গে আমি বহু স্থানে তথ্য সংগ্রহে যেতাম। ক্ষেত্রটা এভাবে প্রস্তুত হয়। অবসর নেওয়ার পর শিবেন্দু আমাকে আমার চারপাশের আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ে লিখতে উৎসাহিত করে। সেই সূত্রেই এইসব বিষয়ে আমার ক্ষেত্রসমীক্ষা ও লেখালেখি"। পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদার আসন্দা শিক্ষা নিকেতনের শিক্ষকতা পদে অবসরের পর গল্প লেখা শুরু করেন। প্রথমে ইতিহাস লেখার তেমন ইচ্ছা ছিলো না। শিবেন্দু মান্নার অনুপ্রেরণায় শুরু করেন দাঁতন এবং এগরার ইতিহাস লেখার কাজ। দাঁতনের ইতিহাস লিখতে না পারলেও প্রকাশ করে ফেলেছেন ‘এগরার ইতিহাস'। বয়স কখনও বাধা হতে পারে না। তা শিশুতোষ ধাওয়া প্রমাণ করে দিয়েছেন জীবদ্দশায়। 

প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, ছড়া রচনার পাশাপাশি মন্দির, মসজিদ, লৌকিক দেবদেবী, পুষ্করিণী, প্রাচীন পণ্ডিত সমাজ, স্থানীয় মৌখিক ভাষা, গ্রাম থানার ক্ষেত্রসমীক্ষা মূলক অসংখ্য প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছেন মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে। সমৃদ্ধ হয়েছে মেদিনীপুরের ইতিহাস। গর্বিত করেছেন মেদিনীপুরকে। ইতিমধ্যে তিনি রচনা করেছেন ‘শ্রী শ্রী হটনাগর মহাদেবের মহিমা ও মন্দির বৃত্তান্ত' (৪ঠা ফাল্গুন, ১৪১০), ‘এগরার ইতিহাস' (মহালয়া ২০০৭), ‘বঙ্গে বিপ্লব ও বিপ্লবী হেমচন্দ্র' বইগুলি। আঞ্চলিক ইতিহাস এবং লোকসংস্কৃতি বিষয়ক অসামান্য সংগ্রহের মূল্যবান দলিল। লিখেছেন কাব্যগ্রন্থ 'কবিতার দেশ।
রাধানগর গ্রামের বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগোকে নিয়ে বিস্তৃত ক্ষেত্রসমীক্ষামূলক গ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেছেন। খাকুড়দা সিভিল ইংলিশ স্কুলের ছাত্র ছিলেন হেমচন্দ্র। সেখানেই একসময় পড়েছেন শিশুতোষবাবু। তাই হেমচন্দ্রকে নিয়ে জীবনী লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি। আজ তাঁর 'এগরার ইতিহাস' বই নিঃশেষিত।

একজন মানুষ অবসর গ্রহণের পরেও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছেন। পেয়েছেন গুণীজনের শ্রদ্ধা এবং মর্যাদা। বয়সের ভারে আক্রান্ত এবং অসুস্থতা সত্ত্বেও স্মরণে মননে তিনি চাইতেন কাজ। অজানা মানুষ, অবহেলিত জনজাতির জীবনধারা সম্পর্কে জানবার প্রবল আগ্রহ। ক্ষেত্র সমীক্ষা করতে গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় চলে যেতেন। বিকেলে বাড়িতে ফিরে পড়ার টেবিলে বসে সেইসব তথ্যগুলি লিখে ফেলতেন নিজের মতো করে। এভাবেই চালিয়ে গিয়েছেন বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চা। যুক্ত ছিলেন বাংলা একাডেমি সহ নানা সংস্থার সাথে। জীবনের শেষ দিনগুলিতে (মৃত্যু - জানুয়ারি, ২০১৪) এলাকার ইতিহাস রচনাতেই ব্যাপৃত ছিলেন শিশুতোষ। মেদিনীপুরের বর্তমান ইতিহাস গবেষকদের কাছে তিনি পথপ্রদর্শক।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇




Post a Comment

0 Comments