জ্বলদর্চি

বাদুড় কেন দিনে ঘুমোয় রাতে বেরোয়—উগাণ্ডা (আফ্রিকা)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প--
বাদুড় কেন দিনে ঘুমোয় রাতে বেরোয়—উগাণ্ডা (আফ্রিকা)

চিন্ময় দাশ


একটিই মেয়ে বিধাতা পুরুষের। বাপের দু’চোখের মণি। মেয়ের কোন আবদার পড়তে পায় না। মুখের কথা খসবার আগেই, তা পূরণ করে দেন বিধাতা। 
একদিন মেয়ে ধরে পড়ল—বাবা আমি কিছুদিন মাটির পৃথিবীতে গিয়ে থাকব। এই একঘেয়ে আকাশ, এই মেঘের দেশ আমার মোটেই ভালো লাগছে না। 
মেয়ের আবদার বলে কথা! বাবা মাথা নেড়ে দিল সাথে সাথেই। তাতে মেয়ে যতো না খুশি, বাবার খুশি তার চেয়েও বেশি। 
সেই খুশির চোটে একটা ভোজসভা ডেকে দিলেন বিধাতা। কাছে পিঠে যে যেখানে আছে, ডাক পাঠানো হোল সবাইকে। সবাই যেন সময়মতো ভোজসভায় চলে আসে। শুধু নেমন্তন্ন খাওয়া নয়, উপহারও দেওয়া হবে সবাইকে। 
সবচেয়ে দূরে থাকে সূজ্জিঠাকুর, আর চাঁদমামা। দুজনকে বাছা হোল দূত হিসাবে। বাদুড়ের বড় ডানা। বাদুড় যাবে সূজ্জিঠাকুরের বাড়ি। চাঁদমামার বাড়ি খানিকটা কাছে। সেখানে যাবে ছোট্ট পাখি ঘুঘু। 
দুজনেই রওণা হয়ে গেল হুকুম পেয়ে। বিধাতা তো হুকুম দিয়েই খালাস। তার তো জানা নাই, বাদুড় কতো আলসে। কত দায়িত্বজ্ঞান হীন। যাকে বলে, একেবারে অকম্মার ধাড়ি। তাকে কিনা দেওয়া হয়েছে, সবচেয়ে দূর দেশে যাওয়ার ভার!
এদিকে চেহারায় ছোট্টটি হলে কী হবে, ভারি মিষ্টি স্বভাব ঘুঘুপাখির। তেমনি তার দায়িত্বজ্ঞান। যে কোন কাজের ভার দিয়ে, নিশ্চিন্তে থাকা যায়। ঠিকঠাক কাজ সেরে আসতে, ভারি ওস্তাদ সে। 
আকাশে ডানা দুটো মেলে দিয়ে, একবারও কোত্থাও থামলো না ঘুঘু। থামল একেবারে চাঁদের বাড়ি পৌঁছে। নেম্নতন্ন সেরে, ফিরেও এলো ঠিক সময়ে। 
এদিকে রওণা দিয়েছে বাদুড়ও। কিন্তু আসলে তো জ্ঞানগম্যি বলতে কিছুই নাই হতভাগার। সে চলেছে এদিক ওদিক উঁকিঝূঁকি মারতে মারতে। কোথায় নতুন কোন গাছ চোখে পড়ে। কোন গাছের ফল কতো মিষ্টি। সব তার চেখে দেখা চাই। 
কতো দূরের দেশ সূজ্জিঠাকুরের বাড়ি। কতো রকমের গাছগাছালি কতো রকমের সুস্বাদু ফলপাকুড়। খেয়ে আর ফেলে, বাদুড়ের আনন্দ আর ধরে না। হোল কী, এতো আনন্দের ঠেলায়, কাজের কথাটা বেমালুম ভুলেই গেল বাদুড়।  নেমন্তন্নের কথাটা মাথা থেকেই উড়ে গেল তার। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
সূর্য আর চাঁদ হোল বিশেষ অতিথি। তারা দুজনে হাজির না হলে, ভোজ শুরু করা যায় না কি? চাঁদ চলে এসেছে সময় মতোই। কিন্তু সূর্যের আর দেখাই নাই। এদিকে সবাই অধৈর্য হয়ে উঠছে। আর কতোক্ষণ হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায়? ফিসফাস গুজগাজ শুরু হয়েছে সভায়। 
অগত্যা আর দেরি করা যায় না। ভোজের আসর শুরু করে দেওয়া হোল। বিধাতা ঘুঘুকে ডাকলেন—আর একবার কষ্ট করে যাও, বাছা। তুমি একবার খোঁজ নিয়ে এসো। সূর্যের এতো দেরি হচ্ছে কেন?
সবার সামনে এতো বড় কাজের ভার পেয়ে, ঘুঘু দারুণ খুশি। সে বেরিয়ে গেল চটপট করে। ডেকেও নিয়ে এলো সূজ্জিঠাকুরকে। 
ভোজের আসর শুরু হয়ে গিয়েছে। দেখে ভারি লজ্জা হোল সূর্যের। সূর্য জানালো—বাদুড় তার কাছে যায়ইনি। নইলে এতো দেরি হোত না আসতে। 
যাই হোক, সূজ্জিঠাকুরও আহারে বসে পড়ল। উপাদেয় সব খাবার। মিষ্টি গন্ধে,ম-ম করছে আসর। ভুরিভোজ চলছে সকলের। ভোজসভা শেষ হবার মুখে, বাদুড় এসে একটেরে সেঁধিয়ে গেল।
কিন্তু সূজ্জিঠাকুর ঠিক দেখে ফেলেছে তাকে। তার চোখ এড়ানো সোজা কথা নয়। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠল সূর্যের। 
সভার শেষে উপহার দেবার পালা। যারা ভোজসভায় এসেছে, উপহার পাবে তারা সকলেই। মহার্ঘ সব উপহার। ঝলমলে পোষাক দেওয়া হচ্ছে সকলকে। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
 উপহার পেতে কার না ভালো লাগে? এমন কেউ আছে না কি দুনিয়ায়? হঠাৎই একটা খটকা লাগল সূজ্জিঠাকুরের মনে। একটা ভাবনা চিড়িক করে উঠল মাথার ভিতর। ভোজ সভায় না এলে তো, উপহারটা পাওয়া হোত না। ফস্কে যেত জিনিষটা!
অমনি মেজাজ গেলো খিঁচড়ে। বাদুড়ের দিকে তাকিয়ে, রাগে গনগন করে উঠল মুখচোখ। সূজ্জিঠাকুর চেঁচিয়ে উঠল—দাঁড়া, হতভাগা! দেখাচ্ছি মজা। পুড়িয়ে মেরেই ফেলব তোকে। 
সভাশুদ্ধ লোক চমকে উঠল তা শুনে। কথাগুলো কানে গিয়েছে বাদুড়েরও। বেদম ঘাবড়ে গেল বেচারা। রইলো পড়ে ভোজ খাওয়া। ফরর ফরর—পড়ি মরি করে, উড়ে পালালো আসর ছেড়ে।
আসর শেষ হয়েছে। উপহার দেওয়া শুরু হোল। বড়সড় একটা চাদর দেওয়া হোল চাঁদকে। আহা, কী বাহার চাদরখানার। চোখ জুড়িয়ে যায় দেখলে। রূপোর মতো মিষ্টি কোমল রঙ। নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে সভা জুড়ে। বিধাতা বললেন—এবার থেকে পৃথিবীতে আলো দেবে তুমি। যখনই আমার মেয়ের মন চাইবে, রাতের নরম আলোয় বাইরে বেরোবে বেড়াতে। ছেলেপুলে হবে যখন আমার মেয়ের, তারাও খুব পছন্দ করের তোমার আলো। 
চাঁদকে চাদরখানা দিয়ে, বিধাতা স্বয়ং আনন্দে ডগমগ। বলে চললেন— রূপোলী জ্যোৎস্নার রাতে, ঘর ছেড়ে বাইরে আসবে সবাই। ড্রাম বাজিয়ে নাচবে। গান গাইবে মনের আনন্দে। পৃথিবী শুদ্ধ লোক জ্যোৎস্না রাতে গান গেয়ে শোনাবে তোমাকে।
সূজ্জিঠাকুরের পালা এবার। তার জন্যও একটা চাদরই রেখেছেন বিধাতা। তবে, উজ্বল সোনালী রঙ এই চাদরখানার। 
নিজের হাতে চাদরখানা জড়িয়ে দিয়ে, বিধাতা বললেন—গা থেকে এটা খুলবে না কখনও। খেয়াল রাখবে, আমার মেয়ে আর নাতিপুতিদের গায়ে যেন বেশি তাত না লাগে। তবে, প্রতিদিন রোদ্দুর লাগে যেন পৃথিবীর মাটিতে। রোদ লাগলে, গাছপালা গজাবে মাটিতে। ফুলে ফলে ভরে উঠবে পৃথিবী। গায়ে মিষ্টি রোদ লাগাবে শিশুরা। স্বাস্থ্যবান হবে তাতে। বলবান হয়ে উঠবে শিশুর দল।
সূজ্জিঠাকুরের ভারি পছন্দ হয়েছে চাদরটা। মনে বেশ খুশি। তখনই আবার বাদুড়ের ব্যাপারটা চিড়িক করে উঠল মাথায়। আর একটু হলে চাদরটা ফসকে যাচ্ছিল। সবই ঐ হতভাগার জন্য।   
সূজ্জিঠাকুর কানে শুনছে বিধাতা পুরুষের কথাগুলো। কিন্তু মাথায় নিচ্ছে না কিছুই। একটাই ভাবনা এখন তার মাথায়—হতভাগা বাদুড়টাকে নাগালে পেতে হবে। যে করেই হোক। ফল খাবার বড্ড লোভ, না? একবার বাগে পাই, ভালো মতন বুঝিয়ে দেব, কোন ফলে কতো মিষ্টি। ফল খাবার সাধ মিটে যাবে জন্মের মতো। 
কিন্তু ভাবলেই তো আর আসামীকে পাকড়াও করা যায় না। বাদুড় তো বুঝে গিয়েছে, দুঃখ আছে কপালে। সে যে কোথায়, কোন অন্ধকারে গিয়ে সেঁধিয়েছে, টিকিটিরও দেখা মিলল না। রাগে গরগর করতে করতে, সূজ্জিঠাকুর বলে গেল—যেখানেই ঘাপটি মেরে থাক না কেন, আমার রোদ সবখানেই ছড়িয়ে থাকল। বেরুলেই গায়ে লাগবে। চোখমুখ পুড়িয়ে দেব তোর। 
কাছেই আড়ালে ঘাপটি মেরে বসেছিল বাদুড়। সবই কানে গিয়েছে তার। সেও সাবধান হয়ে গেল সাথেসাথেই। রোদ্দুরে না বেরুলেই হোল। ল্যাঠা চুকে গেল সব। 
সেদিন থেকে দিনের আলোয় বাইরে বেরোয় না বাদুড়। পূবের আকাশে সূজ্জিঠাকুর দেখা দিল, তো বাদুড় বেপাত্তা। 
বাদুড় পুরো ব্যাপারটা গল্প করে শুনিয়েছিল তার নাতিনাতনিদের। তারা শুনিয়েছিল তাদের নাতিনাতনিদের। তাতেই দুনিয়ার সব বাদুড় জেনে গিয়েছে, সূর্যের আলোয় বেরোলেই তাদের বিপদ। তাই তো দিনের আলো এড়িয়ে চলে বাদুড়ের দল। বাইরে বেরোয় না।
বন-পাহাড়ের আড়ালে সূজ্জিঠাকুর ঘুমোতে গেলে, তবেই বের হয় বাদুড়েরা। তার পর রাত পুইয়ে এলে, যখন আলো ফুটতে শুরু করে, তারা বুঝে যায়, রথ আসছে সূজ্জিঠাকুরের। অমনি খাওয়া-দাওয়া ফেলে, নিজের নিজের ডেরায় ফিরে যায় বাদুড়ের দল। তখন চার প্রহর জুড়ে, লুকিয়ে বিশ্রামের সময় তাদের।

Post a Comment

0 Comments