বিস্মৃতপ্রায় কবি আনন্দ বাগচী
নির্মল বর্মন
অধুনা বাংলাদেশের পাবনার স্বাগতা গ্রামে ১লা জুলাই ১৯৩২ সালে, পিতা শ্রীচন্দ্র বাগচী ও মা সজলবালা'র সন্তান আনন্দ বাগচী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। পড়াশোনা-- স্কটিশ চার্চ কলেজ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এম.এ পাস করেন। কর্মজীবনের শুরুতে বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। দীর্ঘ ষোল বছর ধরে দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে অধ্যাপনার কাজের ছেদ ঘটিয়ে সাগরময় ঘোষের আহ্বানে 'দেশ' পত্রিকায় যোগদান করেন। 'হর্ষবর্ধন' ও 'ত্রিলোচন কলমচি' ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন। শেষ জীবনে বিশাল আর্থিক অনটনের মধ্যে ছিলেন, এমতাবস্থায় কল্যাণীর বেসরকারি নার্সিংহোমে ৯ই জুন ২০১২ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আনন্দ বাগচি "পারাবত",' কৃত্তিবাস' ও "দেশ" পত্রিকায় কৃতিত্বের সঙ্গে লিখেছিলেন। ১৯৫০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রলাপ' প্রকাশিত হয়। কবি আনন্দ বাগচী কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্যরচনা , ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনায় বিশাল পারদর্শী ছিলেন। কবি আনন্দ বাগচী'র উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গুলি হল ঃ-
"স্বগত সন্ধ্যা" , ১৯৫২ ; "তেপান্তর" ১৯৫৬; " উজ্জ্বল ছবির নিচে" ১৯৭৭ ; "বিস্মরণ" ১৯৮২; "শ্রেষ্ঠ কবিতা" ১৯৮৯ ও "স্বকাল পুরুষ" নামে একটি কাব্যোপন্যাস রচনা করেন।
১৩৬০ সালে শ্রাবণ মাসে কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় "একটি ব্যক্তিগত পত্র" নামে কবিতা প্রকাশিত হয়। এই কবিতাটি বর্তমান সময় ও সমাজের প্রেম ভাব ভালোবাসা সম্পর্কিত রহস্যময় ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে----
"সুচরিতাসু,
এ চিঠি যখন পাবে তখন সকাল সাড়ে দশ
কিংবা তার কাছাকাছি। আর তুমি স্নানান্তে অলস
কেশগুচ্ছ পিঠে ফেলে ভিজে কাঁপা হাতের আঙ্গুলে
পড়ছ আমার চিঠি জানালার কাছে গিয়ে খাম থেকে খুলে"।
কবি আনন্দ বাগচী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা র সোমরস পান করে প্রেমিকার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। তার নিজস্ব অভিলাষ প্রেমিকার কাছে অকপটে বলতে কুন্ঠা বোধ করেনি--
"তাই আজ চাই দ্রাক্ষা- দিনের শুধু অকারণ পুলকে
ক্ষণিকের গান গেয়ে যেতে মন, উচ্চারণেই ভরাব
তনু - তৃষ্ণার দ্রাবিড় ওষ্ঠ ঃ জীবন পাত্র পলকে
উপুড় উজাড় করে যাব। ধু ধু রৈতিকতাকে সরাব।
বন্ধনহীন গ্রন্থি পরায়ে আশাবরী বাঁধি এসো না
কাব্য - মদির কথাগুলো শুনে আপাতত আজ হেসো না"
কবি আনন্দ বাগচি ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমকে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল কিনা জানিনা। প্রেম ভালবাসার মধ্যে একটা ঘাটতি ছিল ,তাই প্রথম স্ত্রী মানসী পালের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় স্ত্রী মীরা বাগচী কে নিয়েই বাকি জীবন তার সুন্দরভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। তাই প্রেমের মর্মান্তিক ধারণা তা বেশ তিক্ত, তবে কবির নৈরাশ্যবোধ শেষ অবধি আশাবাদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়। কবি আনন্দ বাগচী "মানুষের ঘরে" কবিতা এ প্রসঙ্গে প্রাণেধানযোগ্য-----
"এখনো রয়েছে কিছু পুষ্পগুচ্ছ, পৃথিবী
শেষ অপরাহ্নের রোদ্দুরে
মানুষের ভালোবাসা, মানুষের বুকের ভিতরে
এখনো নদীর মত সুবাতাস প্রবাহিত হয়
এখনো পাখীর বাসা রূপসী নারীর দুই চোখে
মমতায় গারো প্রতিবিম্ব হয়, এখনো সময়
পৃথিবীর আঙিনায় শিশুর নিকটে খেলা করে"।
কবি আনন্দ বাগচি 'সেতু' ও "বৃশ্চিক" নামক দুটি পত্রিকার সম্পাদনা করে বর্তমান সময় ও সমাজের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আজ বিস্মিতপ্রায় কবি হলেও আনন্দ বাগচীর কবিতা আগামী পরম্পরায় পৌঁছে দিতে পারলে কাল সমাজ সম্পর্কে ধারণা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সুদৃঢ় হবে।
2 Comments
চমৎকার লেখা
ReplyDeleteআনন্দ বাগচী কে তো হালিশহরে অপমানিত করা হয়েছিল ।।
ReplyDelete