সবুজ দ্বীপ আন্দামান
তৃতীয় পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ
আন্দামানে মানুষের পদসঞ্চার -
মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকেরা বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় আদিম মানুষদের আদি পরিচয় বিশ্লেষণ করেছেন, যদিও সে খুবই কঠিন কাজ। জারোয়াদের আদি পরিচয়ের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আরো তিনটি নেগ্রিটো আদিম জনজাতির উল্লেখ করা প্রয়োজন। এরা হ'ল - গ্রেট আন্দামানীজ, ওঙ্গি ও সেন্টিনেলিজ। গ্রেট আন্দামানিজেরা আজ থেকে প্রায় ১৬০ বৎসর পূর্বে সভ্য জগতের সংস্পর্শে আসে, ওঙ্গিরা ১১০ বছর আগে এবং জারোয়ারা মাত্র পঁচিশ বৎসর আগে সভ্য জগতের সংস্পর্শে আসে। সেন্টিনেলিজেরা এখনও পর্যন্ত সভ্য জগতের সংস্পর্শে আসে নি। আন্দামানের উত্তরে সেন্টিনেলিজ দ্বীপে তারা সভ্যজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জন্ম অনেক বিশেষজ্ঞের মতে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ফলে। আবার আধুনিক মানুষের বিবর্তনবাদের নীতি অনুযায়ী প্রকাশিত 'Out of Africa Theory'তে বলা হয়েছে আদিম মানব আজ থেকে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে পায়ে হেঁটে পূর্ব উপকূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে কয়েক হাজার বৎসর পরে এশিয়া মহাদেশে এসে পৌঁছায় এবং আজ থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার বৎসর পূর্বে তারা আন্দামানে এসে পৌঁছায়। 'Out of Africa Theory'-এর বিভিন্ন সংস্করণে আদিম জনজাতিদের আন্দামানে প্রবেশ সম্বন্ধে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে কোন একসময়ে ব্রম্ভদেশের আরাকান পর্বতমালা, মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে আন্দামান যুক্ত ছিল পরে জলোচ্ছ্বাসের ফলে ভূমিখন্ডের অনেকাংশ জলের তলায় চলে যায় এবং যে অংশ জলের উপরে থাকে তা বর্তমানে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। সর্বশেষ তুষার যুগের শেষে আজ থেকে ৪০ হাজার বৎসর পূর্বে সমুদ্রের জলস্তর ১০০ থেকে ১২০ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই জলোচ্ছ্বাসের ফলে মূল ভূখন্ড থেকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে 'গন্ডোয়ানা' মহাদেশ ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়ার পরেও বহু যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত ৪০ হাজার বৎসর পূর্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ থেকে ১২০ ফুট কম থাকায় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ মালয় উপদ্বীপ হয়ে ইন্দোনেশিয়া বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে যুক্ত ছিল। ভূপৃষ্ঠের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত আদিম মানবের দল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে আসার পরে মালয় বা ইন্দোনেশিয়া হয়ে পদব্রজে ৪০ হাজার বৎসর পূর্বে আন্দামানে প্রবেশ করেছিল। আবার অনেকের মতে ব্রহ্মদেশ হয়ে তারা আন্দামানে প্রবেশ করে। পরবর্তীকালে সমুদ্রের জলোচ্ছাসের ফলে সেই পথ সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ সিপ্রিয়ানির মতে আন্দামানের নেগ্রিটো মানুষেরা সুমাত্রা থেকে নিকোবর হয়ে এসেছে, কিন্তু গবেষকদের মতে, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে নেগ্রিটো মানুষদের অতীতে অবস্থান সম্পর্কে কোনো প্রমাণ নেই। সিপ্রিয়ানি দাবি করেন নেগ্রিটোরা প্রথমে লিটিল আন্দামানে আসে। নেগ্রিটো জারোয়া ওঙ্গি এবং সেন্টিনেলিজেরা একসঙ্গে লিটল্ আন্দামানে বসবাস করত। পরবর্তীকালে খাদ্য সংকট ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য জারোয়া ও সেন্টিনেলিজেরা ডিঙি করে যথাক্রমে আন্দামান দ্বীপ সেন্টিনেলিজ দ্বীপে চলে যায়। সিপ্রিয়ানি ঝড়ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সামুদ্রিক আবহাওয়াকে জারোয়া ও সেন্টিনেলিজদের লিটল্ আন্দামান থেকে গ্রেট আন্দামান ও নর্থ সেন্টিনেলিজ দ্বীপে স্থানান্তরের সম্ভাব্য কারণ হিসাবে ব্যক্ত করেন। তিনি আরো বলেন জারোয়া ও সেন্টিনেলিজ দুটি নেগ্রিটো সম্প্রদায়ই ডিঙি করে সমুদ্রে শিকার করার সময় ঐরূপ দুর্ঘটনায় পড়ে। জারোয়াদের আসল নাম অঙ্গ্। লিটল্ আন্দামানের ওঙ্গি (অঙ্গী) দের নামের কাছাকাছি। ওঙ্গি ও জারোয়াদের ভাষার মধ্যে বহু মিল আছে। 'তুমি' বাংলা কথাটি জারোয়ারা বলে 'নি', ওঙ্গিরাও বলে 'নি'। যেমন 'আমি' বাংলা কথাটি জারোয়ারা বলে 'মি,' ওঙ্গিরাও বলে 'মি'। বাংলায় 'ডেকচি' কথাটি জারোয়ারা বলে 'বুচু', ওঙ্গিরাও বলে 'বুচু' ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে আরও একটি জিনিস প্রশ্নের মুখে এসেছে। জারোয়ারা কি কাঠের বা বাঁশের ভেলায় লিটল্ আন্দামান থেকে গ্রেট আন্দামানে এসেছিল না সিপ্রিয়ানির মতবাদ অনুযায়ী ডিঙিতে এসেছিল। কারণ জারোয়ারা ডিঙির ব্যবহার জানত না এবং অতীতে ডিঙির ব্যবহার সম্পর্কিত কোন চিহ্ন বা প্রমাণ জারোয়া এলাকায় পাওয়া যায়নি।
অনেক নৃতত্ত্ববিদ বা মনোবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে নেগ্রিটো মানুষেরা প্রাচীনকালে দক্ষিণ চীন এলাকা থেকে দক্ষিণ এলাকার দিকে যাযাবর জীবন যাপন করে বেড়াতে থাকে। ডঃ রেডক্লিফ ব্রাউন ও ডঃ পি দত্ত দাবি করেন নেগ্রিটো মানুষেরা ফিলিপাইনস থেকে সেলেবস্ ও বোর্নিও হয়ে মালয় উপদ্বীপে পৌঁছায় এবং পরে নিম্ন বার্মা এলাকায় আসে। তাঁরা আরো দাবি করেন অতীতে নেগ্রিটো মানুষেরা নিম্ন বার্মা এলাকার মরগুই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থান করতেন। গবেষকেরা নেগ্রিটোদের ওই এলাকায় অবস্থান সম্পর্কিত প্রমাণ আবিষ্কার করেছেন। মতবাদ অনুযায়ী নেগ্রিটোরা নিম্ন বার্মা এলাকার মরগুই দ্বীপপুঞ্জ থেকে ডিঙির সাহায্যে সমুদ্রপথে আন্দামানে এসেছে। সম্ভবতঃ শিকারের সময়ে প্রতিকূল সামুদ্রিক পরিবেশ তাদের অনিচ্ছাকৃত অভিবাসনকে কার্যকর করে।
তাই আমাদের স্বীকার করতেই হয় 'Indo-european migration theory' অনুযায়ী আফ্রিকা থেকে আগত নেগ্রিটোরাই আজকের আন্দামানের আদিম জনজাতি জারোয়া, গ্রেট আন্দামানিজ, সেন্টিনেলিজ ও ওঙ্গি।
আন্দামানের আদিম জনজাতি জারোয়া ও আরও তিনটি আদিম জনজাতিকে আজও প্রস্তর যুগের মানুষ বলা হয়, কিন্তু তাদের কাছে কোন পাথরে খোদাই ছবি বা নথি নেই। পাওয়া গেলে আদি পরিচয় আবিষ্কার করা সহজ হত।
D.N.A পরীক্ষা আদি পরিচয় আবিষ্কারে সহযোগিতা করেছে। এরা যে আফ্রিকা থেকে এসেছে তা পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক রেডক্লিফ ব্রাউন ১৯০৭ সালে গ্রেট আন্দামানিজদের মাথার চুল নিয়ে প্রমাণ করেছেন তারা আফ্রিকান নেগ্রিটো পিগমি গোষ্ঠীর সরাসরি বংশধর। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে জারোয়াদের সঙ্গে আফ্রিকার বুশম্যানদের সম্পর্ক আছে। তারা এই দ্বীপের প্রস্তর যুগের বাসিন্দা। হাজার হাজার বৎসর ধরে তাদের বাসস্থান এই দ্বীপভূমি। বর্তমানে জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের পরে আদিম জনজাতি জারোয়া ও আন্দামানের আরও তিনটি নেগ্রিটো আদিম জনজাতির আদি পরিচয় আবিষ্কার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এক লক্ষ মানুষের জিনগত নমুনা সংগ্রহের পরে ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে 'ওয়াই' ক্রোমোজোম বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয় আদি মানবেরা মধ্য আফ্রিকায় বাস করত। প্রায় এক লক্ষ বৎসর আগে আদি মানবের বংশধরেরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। জেনোগ্রাফিক প্রোজেক্ট দলের নেতা স্পেন্সার ওয়েলের মতে কম করে ৫০ হাজার বছর আগে আদি মানবের সন্তান দল আন্দামান দ্বীপে এসেছিল। স্পেন্সার ওয়েল ও তার সহযোগীরা আদি মানবের সন্তানদের যাত্রাপথ ও সময়কাল নির্ণয় করতে সচেষ্ট হয়েছেন।
পরবর্তী অংশ চতুর্থ পর্বে
0 Comments