জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি অশোকবিজয় রাহা /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি অশোকবিজয় রাহা

নির্মল বর্মন

                   "মনকে বলি, মন,
                 আমার কথা শোন,
                 সামনে যে  - দুর্দিন
            হাসপাতালে কোথায় পাবি ঋণ"?
                   অশোকবিজয় রাহা

 বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা'র শ্রীহট্টে উক্ত বাস্তবনিষ্ঠ কবি অশোকবিজয় রাহা, ১৯১০ সালে ১৪ ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শ্রীহট্টের মুরারিচাঁদ কলেজে আই.  এ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীন কবিতা চর্চা শুরু করেছিলেন, পরে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে বি.এ ও এম.এ পাস করেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫১-- ১৯৭৪ অবধি অধ্যাপনার চাকরি করেছেন, একসময় রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে  সোভিয়েত রাশিয়ায় গিয়ে "রবীন্দ্রনাথ ও আন্তর্জাতিকতা" বিষয়ে সুচিন্তিত ভাষণ পরিবেশন করেন। শান্তিনিকেতনে ১৯শে অক্টোবর ১৯৯০ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মূলত কবি হলেও মননশীল প্রাবন্ধিক ও  সমালোচক হিসাবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন । কবি অশোকবিজয় রাহা'র "জীবনানন্দের জগ্ৎ", " রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা" ,  "গীতিকাব্যে রবীন্দ্র প্রতিভার বৈশিষ্ট্য" ,  "বাণীসাধক দ্বিজেন্দ্রনাথ" ও  "বাণীশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ" নামক প্রবন্ধের বইগুলো বাংলা সাহিত্যের আকর গ্রন্থ হিসাবে সুপরিচিত। কবি অশোকবিজয় রাহা, তার পত্র সংকলন "পত্রাষ্টক" নামক সংকলনে আত্মপরিচয় সুনিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন--
"একটি আদিম আরণ্যক, একটি প্রাকৃত গ্রামীণ , আর একটি বিদগ্ধ নাগরিক।  এর মধ্যে আমার আরণ্যক সত্তার প্রভাবটিই বোধ করি প্রবলতম"।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
কবি অশোকবিজয় রাহা মহোদয়ের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গুলি হলঃ-
"ডিহাং নদীর বাঁকে" ১৩৪৮ ; "রুদ্রবসন্ত" ১৩৪৮ ;  "ভানুমতীর মাঠ"১৩৪৯ ; "শেষচূড়া"১৩৫১;  "রক্তসন্ধ্যা" ১৩৫১;  "জলডম্বরু " ১৩৫১; উড়ো চিঠির ঝাঁক"১৩৫৮ ; "যেথা এই চৈত্রের শালবন"১৩৬৮ ; "ঘন্টা বাজে ঃ পর্দা সরে যায়"১৩৮৮;  "পৌষ ফসল" ১৩৯০  ।
কবি অশোকবিজয় রাহা 'রাখাল ও রাজবালা' কবিতা লিখে প্রথমে রবীন্দ্রনাথ কে দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মন্বন্তর বিশ্বযুদ্ধ কে পাথেয় করে "ভানুমতির মাঠ" কবিতাটি কবিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল--

" চালে একটি খড় গোঁজা নেই, ভাঁড়ারটাও ফাঁকা।
একটু বসে ধ্যান কর তুই- টাকা।
মন বললে, ঠিক বলেছ ঠিক,
বলতে পারো এ-দিকটা কোন দিক?
একটু যেন শরৎকালের হাওয়া
হঠাৎ গেল পাওয়া"
অধ্যাপক ও কবি অশোকবিজয় রাহা'র রোমান্টিক মন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে স্বপ্ন মায়াময়ে অপূর্ব নৈসর্গিক চিত্রের পরিবেশে পাহাড়ী সৌন্দর্য ও পাহাড়ী মেয়ের হৃদয়কে "শিলং" কবিতার মাধ্যমে বাস্তবায়িত করেছেন --
   "পথের পাশেই লাল বাড়িটার সিঁড়ি,
চোখ পড়ে যায় কোণের বারান্দায়----
বার - কোট গায়ে, বিলাতি- বিড়াল কোলে,
চেয়ে আছে এক পেন্সিলে - আঁকা পরী।
-----+------+------------------------------
লাল পথখানি আগে আগে পথ চলে,
ছোট্ট ঝরণাটি খিলখিল হেসে ওঠে,
চারিদিকে চেয়ে হাসি পায় আর ভাবি
শিলং পাহাড় কৌতুক জানে বেশ"।

কবি অশোকবিজয় রাহা'র "রুদ্রবসন্ত" কাব্যে প্রকৃতি দৃষ্টির মধ্যে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি সচেতন ভাবে উপলব্ধি করেছেন , প্রকৃতি চেতনার বিশিষ্ট রূপ "রাত্রি" কবিতায় উপলব্ধ--
    "বাগান বাড়ির পিছে পেয়ারার ডালে
পাখসাট  মেরে উড়ে যায়,
শহরের প্রান্তে এসে মুহূর্তে হঠাৎ
চক্ষের পলকে ধরে কুহকিনী নর্তকীর  রূপ।
এইবার উপরে তাকাও,
অন্ধকার মহাশূন্য উড়ে যায় রাত্রি জটায়ু"---।
কবি ও অধ্যাপক অশোকবিজয় রাহা'র তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ "ভানুমতীর মাঠ" এর  মায়াতরু  কবিতাটি রূপ রসগন্ধ,শিশুমনকে আত্মভোলা করে দেয় ,যেমন--
"বনের মাথায় ঝিলিক মেরে মেঘ উঠত যখন
ভালুক হয়ে ঘাড় ফুলিয়ে করত সে গরগর
বৃষ্টি হলেই আসত আবার কম্প দিয়ে জ্বর"।

কবি অশোকবিজয় রাহা শান্ত শান্তিনিকেতনের জীবন সাধনা, আশ্রমভাবনা এবং আশ্রমিক জীবনের সকালবেলা কবি "যেথা এই চৈত্রের শালবন" কাব্যগ্রন্থে আমরা পাই---
"চেয়ে দেখি ঢিবির চূড়ায়
মেতেছে সে নতুন খেলায়
মুঠো - মুঠো কাশফুল ছিঁড়ে
দুই হাতে হাওয়ায় ওড়ায়"।
কবি "পৌষফসল" কাব্যগ্রন্থে "খাঁটি মানুষ" কবিতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বাসহীনতা যত্ন সহকারে ফুটিয়ে তুলেছেন।
যেমন
"দিদিঠাকুরণ
আমার বাপ খুড়ো আপনাদের খেয়ে - পরে মানুষ
মিছে কথা বলবো না আপনাকে
আজকাল নিজেকেও বিশ্বাস করিনে আমি"।
কবি অশোকবিজয় রাহা'র শব্দ চয়নে শব্দকুশলী শিল্পী হিসাবে সুযষ অর্জন করেছেন, তার "দৃশ্যান্তর" কবিতাটিতে---
"দেখি দাঁড়িয়ে আছি এক চড়াই- পথের পাকদন্ডীতে
বাঁয়ে খাড়াই, ডাইনে খাদ, সামনে ধস
ধসের উপর - দিকটাতে আগাছার জঙ্গল
নিচে মাটি ফুঁড়ে  বেরিয়ে এসেছে এক করোটি
চোখের গর্ত দুটো তাকাচ্ছে কটমট করে
নাকের ফুটোয় লকলক করছে দুটো ঘাসের শিস"।

অধ্যাপক অশোকবিজয় রাহা , মিশ্রকলাবৃত্ত, কলাবৃত্ত ও দলবৃত্ত ছন্দের ছন্দনৈপূণ্য ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তাঁর কবিতায় --
"শতাব্দীর বনস্পতি
ভুলে যাও সেকাল তোমার
এ- যুগের চোখে তুমি
আজ শুধু কাঠের পাহাড়"।
              (  মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দ )
অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য মহোদয় কবি ও অধ্যাপক অশোকবিজয় রাহা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে মূল্যবান মন্তব্য করেছেন--
"অশোকবিজয়ের ভাস্কর্যধর্মী শিল্পকৃতি শুধু নিসর্গালোককে নিয়েই নয়-- মানুষের হৃদয়াবেগকে নিয়েও তিনি নব নব মূর্তি রচনা করে চলেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানী সামরিক শক্তি যখন প্রশান্ত মহাসাগরে ব্রিটেনের প্রতিরোধ শক্তিকে অতলান্ত গভীরে ডুবিয়ে দিয়ে সিঙ্গাপুর ব্রহ্মদেশ পেরিয়ে এসে ভারতের পূর্বসীমান্তে পদার্পণ করেছে , তখনকার অসহায় ও ভীতত্রস্ত মানসিকতাকে ভাষা দিয়েছেন কবি"। তাই বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বকে আশাবাদে দীক্ষিত করেছেন কবি।

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousMay 04, 2023

    খুব ভালো লেখা। অনেক কিছু জানতে পেরে আরো ভালো লাগছে। অসংখ্য ধন্যবাদ

    ReplyDelete