শব্দে গাঁথা মনি-মালা : ৪ / সালেহা খাতুন
আমারও বেশ কয়েকখানা ডায়েরি আছে। ওগুলোর একটিতে বিভিন্ন দিনের বিভিন্ন প্রার্থনা ও কিছু প্রতিজ্ঞাও রয়েছে। প্রথম ডায়েরিটি বাবা দিয়েছিলেন, নিজে দু-এক পৃষ্ঠা ব্যবহার করে।তারপর আরো অনেকগুলো দেন। এরপর পড়াশোনার কাজে ব্যবহারের জন্য আমার স্যার অধ্যাপক শ্যামল সেনগুপ্ত আমাকে দু তিনখানা ডায়েরি দেন। এমনকি আমার শ্বশুরমশাইও হজ্ব যাত্রার প্রাক্কালে সবাইকে বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস উপহার দেওয়ার সময় আমাকে দেন একখানি ডায়েরি। সেদিন আমার ছাত্রী শিউলি জিজ্ঞেস করছিল “ম্যাডাম আমরা চলে যাওয়ার পর আপনার এমন ডায়েরি কতগুলো হলো?” ওদের ক্লাসে আমি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্বলিত বেশ কিছু ডায়েরি নিয়ে যেতাম। যে গুরুজনরা আমাকে ডায়েরি উপহার দিয়েছিলেন তাঁরা সকলেই শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত ছিলেন। তাঁরা হয়তো তাঁদের ঐতিহ্যকে আমার মধ্যে রোপণ করে দিতে চেয়েছিলেন।
শব্দ দিয়ে মালা গাঁথতে গিয়ে বলা ভালো শব্দের ভেতর দিয়ে নিজেকে দেখতে গিয়ে দেখছি অহরহ অজস্র ন্যারেটিভ এর জন্ম হচ্ছে। শত শত মানুষ উঠে আসছেন যাঁরা আমার জীবনের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন।ধন্দে পড়েছি কার কথা আগে বলবো?
আমার ডায়েরির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে শৈশবের একজন। বিশেষভাবে সক্ষম সে। তার কথাই বলি। ওর যন্ত্রণা, জীবনযুদ্ধ সেই ছোটো বয়সেই আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মানুষের জন্য ভাবতে শিখিয়েছিল। আমার বাড়ির পাশেই খোকন থাকতো। খোকন জন্ম থেকেই ওর মামার বাড়িতে ছিল। নিজেদের বাড়িতে খুব কমই যেতো। ওর বাবা ওকে চায় না। বাড়িতে গিয়ে দু-তিন দিন থাকলেই ওর বাবা ওকে তাড়িয়ে দিত। কাঁদতে কাঁদতে আবার মামার বাড়ি ফিরে আসতো। তখন বয়স বড়ো জোর ১২ বছর। বাবা-মার প্রথম সন্তান। কিন্তু প্রথম সন্তানের মর্যাদা ও পায়নি। ওর ঘাড় থেকে মাথাটা একেবারে স্থির থাকে না। একবার সামনের দিকে হেলে পড়ে তা সামলাতে গেলে এদিক ওদিক ঘাড়টা ঘুরে যায়।মুখ দিয়ে অনবরত লালা ঝরছে। হাত-পা খুব সরু। ওর জন্মদাত্রী মা ওকে ফেলে গেছে। মামার বাড়িতেই ওকে থাকতে হলো। যতদিন মিরু ও ফিরু ছিল ততদিন একটু আধটু আদর পেতো। কিন্তু ওদের বিয়ে হয়ে যেতে দারুণ দুরবস্থা। মামিমা প্রথম প্রথম ভালোই বাসতো ওর শারীরিক অবস্থা দেখে। কিন্তু যখন বুঝল যে তাদের গলগ্রহ এই ঘাড় ভাঙা ছেলেটা, তখন থেকে ওর উপর শাসন শুরু হলো। ওর মাসি ও দিদা অনেক ডাক্তার দেখিয়েছিলেন কিন্তু কিছুতেই ওকে ভালো করতে পারলেন না। অযথা আর টাকা পয়সা খরচ না করে ভবিতব্য মেনে নিলেন । আর কিই বা করার আছে! ওকে যারা পৃথিবীর সুশীতল বাতাস মনোরম পরিবেশ এর মধ্যে এনেছে তারা যদি অবহেলা করে, গ্রহণ না করে তাহলে আর কোথায় যায়; কার কাছে দাবি জানাবে বলতো?
সবাই এখানে ওখানে বেড়াতে যায়। তা দেখে আর মনে করে আমাকে কেন কেউ সঙ্গে নিতে চায় না। “আমার ঘাড় ভাঙ্গা বলে তোমরা কোথাও নিয়ে যেতে চাও না। রাস্তার লোকেরা সবাই আমার দিকে তাকাবে আর তোমাদের খারাপ লাগবে তাই তো নিয়ে যাও না ঠিক আছে।"
ওর এই কথাগুলিও বোঝার উপায় নেই যারা অভ্যস্ত তারাই শুধু বুঝতে পারে। সত্যি ওকে নিয়ে বেরোলেও ঝামেলা। তবু দিদা যখন তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে তেহট্ট বাসুদেবপুর যান তখন দু-একদিনের জন্য ও সাহাপুর গ্রামটাকে ভুলে যায়। সেই বড়োমা (দিদার মা) ওকে খুব ভালোবাসে। গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়।
কিছুদিন পরে মামাতো বোনদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ছোট্ট বোনটা ওকে একটা বাচ্চা তালগাছের উপর ঠেলে ফেলে দেয়। কপাল কেটে গিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। দিদা রেগে গিয়ে তার উপর এই দুমদাম ধরিয়ে দিলেন। সেদিন মামিমা খুব ভালোবেসেছিল ওকে। ক্ষতস্থান ভালো করে বেঁধে দিয়েছিল। ওকে আজ অনেক আদর করেছিল। সব যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছিল। সেদিন পরে আবার যখন ওকে নিয়ে চেঁচামেচি চলতে লাগলো তখন খোকন ভাবল আমার বেশ আরেকবার মাথা কেটে যায়! মাথা কাটলো কিন্তু তা ওর না। মামাতো বোন ওর ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। সবাই মিলে এমনকি দিদাও ওকে মেরেছিলেন । মামারা এবং দাদু বলেছিলেন ভিটে থেকে নেমে যেতে । “কোনদিন উঠবি না এই ভিটেতে”। সকালেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সবাই ভাবল বাড়িতে গেছে। কিন্তু ওর মা ঐদিন বাপের বাড়ি এলো। ব্যাপারখানা দেখে মাকে বলল "বাদ দে ওর কথা। যেখানে পারে মরতে যাক আপদ যায় তাহলে।" কিন্তু সন্ধ্যেবেলা ওকে দিদা দেখতে পেল ঘরের পেছনে অন্ধকারে বসে আছে। ও জানে যতদিন বাঁচবে ওকে এখানেই থাকতে হবে। আর আসতেই হবে। দিদার গরু আছে। ও বিভিন্ন বাড়ি থেকে ফ্যান নিয়ে আসে গরুর জন্য। আমাদের বাড়িতেও আসে। অস্পষ্ট অথচ কী মধুর স্বরে বলে, “দিদি ফ্যান আছে?” অন্য কোন জিনিস চাইলে ভালো করে বুঝতে পারি না। ও তখন ইশারায় বুঝিয়ে দেয়। একবার চালুনী চাইতে এসেছিল কিছুতেই বুঝতে পারিনি দারুণ সুন্দর একটা একটা ভঙ্গিমা করে বুঝিয়ে দেয় ও কি চাইছে। সে আমি কোনোদিন ভুলবো না। বাড়ির চাকরের মতো থাকে। কোন কাজে ভুল হলে মার খায়। মারের ধমকে ও হৃদয়বিদারক কান্না কাঁদতে থাকে। সেই কান্না শুনে মনে হয় পাষাণও গলে যাবে। কিন্তু আস্তে আস্তে ওর আনন্দের দিন এলো। অ্যাকশন এড সংস্থার এক বিভাগীয় স্কুল ওই গ্রামে ছিল। কয়েকদিনের মধ্যে ও ভালোভাবে সবকিছু শিখে গেল। বাইরে থেকে যাঁরা পরিদর্শনে আসেন তাঁরা ওকে ভালবাসেন খুব আদর করেন। ওখানে পড়তে গিয়েই ও একটু বেড়াতে যাবার সুযোগ পেল। তাও প্রথমবারে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবার সময় এই অবস্থার জন্য নিয়ে যায়নি খোকনকে। তখন ও খুব কেঁদেছিল। তা দেখে ওদের বড়দির খুব কষ্ট হয়েছিল। পরেরবার ওকে পানিত্রাসে আর কোলাঘাটে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক ছেলেমেয়ে গিয়েছিল প্রত্যেকেই আনন্দ ডগমগ করছিল কিন্তু ওর বড়দি লক্ষ্য করছিল সবথেকে বেশি আনন্দ ওর হচ্ছে। রূপনারানের ধারে গিয়ে খোকনের সে কি ফুর্তি। ব্রিজের উপর উঠে ছোটাছুটি করছিল। শরৎচন্দ্রের বাড়িতে ঢুকে ওর মনে পড়েছিল বড়দি আমাদের এখানে আসার আগে বলেছিলেন যারা দুর্বল বঞ্চিত নিপীড়িত উৎপীড়িত, মানুষ যাদের চোখের জলের কোনোদিন হিসাব নেয়নি, তাদের সেই দুঃখময় জীবনের কথাই নাকি শরৎচন্দ্র লিখেছেন। তাহলে এখন যদি তিনি বেঁচে থাকতেন আমার কথা নিশ্চয়ই লিখতেন। আমি সবকিছু বলতাম এঁর কাছে, দুপুরে খেতে বসেও ওর আনন্দ দেখে কে, সন্ধ্যের পরে বাসে চড়ে বাড়ি ফিরে এলো। ফিরে নানান গল্প শোনাতে লাগল দিদাকে এবার ওরা কলকাতায় যাবে সেই আশায় দিন গুনছে। কিন্তু এদিকে যে দিন কাটছে না। ভালো করে খেতেও দেয় না। দিদারও কিছু করার নেই। দিদা দুঃখ পেয়ে ওকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন তখন ও যেতে চায়না। জানে যেখানেই যাক ওকে কষ্ট সহ্য করতে হবে, দিদা পাথর কণ্ঠে বলেন "হয় ওর মৃত্যু হোক কতদিন আর এভাবে কষ্ট পাবে, না হয় আমার মরণই হোক আমি আর সহ্য করতে পারি না"। এরকম অবস্থায় আমার মনে হয় ছেলেটা কোনো কিছু না করে বসে। সারাদিনে দু ঘন্টা ও আনন্দ পায় যখন স্কুলে যায় তাও অন্যরা বলে একেবারে পণ্ডিত হয়ে যাবে। মামাতো ভাইরা খুব ভালোবাসে। তাদের পড়া বলে দেয় খোকন। আর মাঝে মাঝেই ওর কান্না শোনা যায়। কিন্তু ছেলেটা এখন পাষাণ হয়ে গেছে, শত দুঃখেও আর কাঁদে না।
সেদিন ওর এক মামিমার মৃত্যুতে ও এসেছিল। ঘটনাচক্রে আমার সঙ্গে দেখা হলো। কতো বড়ো হয়ে গেছে! নিজের বাড়িতে মায়ের কাছে ফিরে গেছে। সবজির ব্যবসা করছে। নীল রঙের একটা পাঞ্জাবিতে ওকে দেখতে খুব ভালো লাগছে। ভালোবাসা ভরে আমাকে ডেকে বললো “মনি দিদি কেমন আছো”?
(ক্রমশ)
জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে 👇
0 Comments