জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের স্মৃতি /মলয় সরকার



মেদিনীপুরের স্মৃতি

মলয় সরকার

জন্মটা আমার মেদিনীপুর শহরে নয় ঠিকই, পাশের শহর খড়্গপুরেও নয়।তবু পুরো ছাত্রজীবন খড়্গপুরে কাটানোর সুত্রে মেদিনীপুর শহরের সঙ্গে অচ্ছেদ্য আত্মীয়তা। সেই জ্ঞানচক্ষু খোলার শুরুতে তিন- চার বছর বয়স থেকে নানা স্কুল ঘুরে রেলের হাইস্কুলের পাঠ শেষ করে আই আই টির পড়া শেষ করা পর্যন্ত খড়্গপুরে বাস হওয়ায়, মেদিনীপুর শহর এবং তার সংলগ্ন, দুই শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষীণা কংসাবতীর সঙ্গে আন্তরিক সখ্য অস্বীকার করি কি করে! বরং আমার স্মৃতির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে তার অস্তিত্ব।
জন্ম বর্ধমানের দামোদরের পাশেই হওয়ার সুবাদে নদীর সঙ্গে সখ্য আমার আশৈশব। যদিও কংসাবতী বা আদরের কাঁসাই এর মাঝে সেই(সেই সময়ের, এখনকার চেহারার নয়) দামাল দস্যি দামোদরকে খুঁজে পাই নি, তবু শীর্ণা চোয়াল বেরোনো অস্থিচর্মসার কুমারীর দেহে যখন নববর্ষার যৌবনের ঢল নামত, তা আমার মনোহরণ করত বৈ কি।তাই ছুটে চলে যেতাম অনেক সময়ই সেকালের ব্রিটিশদের তৈরী (এখন তার অস্তিত্ব প্রায় নেই) সেতুর কাছে।
যাই হোক, মেদিনীপুর শহরের সঙ্গে স্মৃতির আগল খুলে দিলে তা একটি পত্রিকার ক্ষীণতনুকে ভাসিয়ে দিতে পারে।তাই প্রথমেই লকগেট দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করে কিছু স্মৃতিধারা প্রবাহিত করি।
তখন আমি ক্লাশ টেন এ। রেলওয়ে স্কুলের ইংরাজী মাধ্যম বিভাগে (এখন আর নেই) পড়াশোনা চলছে।আমাদের অঙ্ক শেখাতেন, যিনি তিনি বেশ ভাল মানুষ এবং সদ্যবিবাহিত।আমাদের খুব প্রিয় শিক্ষক ছিলেন লক্ষ্মী নারায়ণ গাঙ্গুলী।উনি থাকতেনও আমাদেরই রেল কলোনীর পাড়ায়, ফলে প্রতিবেশীও বটে।
মাঝে কয়েকদিন উনি ক্লাশে আসেন নি।খবর পেলাম, ওনার স্ত্রী প্রথমবারের মত সন্তানসম্ভবা।তবে রোগিনীর কেস একটু জটিল, তাই চিন্তা। মাস্টার মশায় রেল হাসপাতালে ভর্তি করার ভরসা পান নি।ওনার মনে হয়েছিল, মেদিনীপুর হাসপাতালে নিশ্চয়ই ভাল চিকিৎসা হবে।তাই সেখানেই ওনার স্ত্রীকে ভর্তি করা হয়েছিল।

কেন জানি না, ওনার আত্মীয়স্বজনও বিশেষ কেউ ছিলেন বা এরকম কিছু।যাই হোক, এরকম অবস্থাতেও কেউ আসেন নি।এব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমরা, আমাদের ক্লাবের ছেলেরা (সবাই তখন ওই রেল হাইস্কুলের ছাত্র) সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা সবাই মেদিনীপুর হাসপাতালে ওনার পাশে থাকব।কখন কি প্রয়োজন হয়। উনি আমাদের সবাইকে ওখানে দেখে অকূলে কূল পেলেন।ভুলে গেলেন, আমরা ওনার ছাত্র, উনি শিক্ষক।আমাদের উনি নিজের ভাই বা বন্ধুর মত কথা বলতে লাগলেন।আমরা শিক্ষক-ছাত্রের সম্বন্ধের বাইরে, একটা মানুষ এবং তার সমব্যথীদের মধ্যে যে অন্য এক সম্পর্ক হতে পারে, তার নতুন এক পরিচয় পেলাম। উনি তাঁর উদবিগ্নতা, চিন্তা, সমস্ত কিছু আমাদের (যদিও আমরা অনেক ছোট) উপর ন্যস্ত করতে চাইলেন।

আমরা অপেক্ষা করছি বাইরে, আর মাঝে মাঝে খবর সংগ্রহের চেষ্টা করছি।সন্ধ্যা হয়ে এল।আজ কেউ বাড়ি ফিরব না, ঠিক করেছি, যাই হোক।

কথা হচ্ছিল, এক বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালার সঙ্গে।অন্ধকার নামছে মাথার উপরের ঝাঁকালো নিমগাছের কোল ছুঁয়ে।জ্বলে উঠছে একটি একটি করে রাস্তার আলো, যদিও তখন এত জোরালো আলো ছিল না। রিক্সাওয়ালা বলছিল, বাবু, আমার ছেলে ডাক্তার, মেয়েও ডাক্তারী পড়ছে। বললাম, তাহলে তুমি রিক্সা টানছ কেন? 
শোনাল অদ্ভুত কথা।বলল, বাবু, এই রিক্সা টেনেই সারা জীবন কাটিয়েছি।এর দৌলতেই আজ আমার অভাব নেই, কিন্তু সেজন্য, আমার এই 'মা লক্ষ্মীকে' তো আমি ছাড়তে পারি না।
আমরা সবাই ওর গল্পে, আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে ছিলাম।লক্ষ্য করলাম, নিমের পাতার ফাঁকে চোরা আলোর রেখা এসে রিক্সা ওয়ালার মুখে, অদ্ভুত এক পরিতৃপ্তির আঁকিবুঁকি কাটছে।

এমন সময় এল এক ধাক্কা। একজন বলল, মাস্টার মশায় কাঁদছেন।আমরা দৌড়ালাম, ওনার কাছে।দেখি, উনি হাসপাতালের বারান্দায় মাটিতে বসে ছেলেমানুষের মত হাউ হাউ করে কাঁদছেন। আমাদের সামনে দেখে সে কান্না আরও বহুগুণ বেড়ে গেল।আমরা যদিও ক্রমাগত খবরে খুব স্বস্তিতে ছিলাম না, তবু চরম ধাক্কার জন্য যেন তৈরী ছিলাম না।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
মাস্টার মশায়ের স্ত্রী ডাক্তারদের সব চেষ্টা বিফল করে জীবন শুরুর আনন্দকে নিরানন্দে পরিণত করে পাড়ি দিয়েছেন অমৃত লোকে। 
আমরা কর্তব্যাকর্তব্য হারিয়ে ফেললাম, এই আকস্মিক আঘাতে। 
যাই হোক, নিজেরা শক্ত হয়ে সেই প্রথম,  এই ধরণের কাজ করলাম। হাসপাতাল থেকে দেহ এনে শ্মশান যাত্রার জন্য তৈরী হলাম।মাস্টার মশায় জানালেন, বাড়িতে এমন কেউ নেই যার জন্য দেহ, বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।যদিও এরকম আত্মীয়বিহীন মানুষ আমরা দেখি নি, আশ্চর্য হচ্ছিলাম খুব, তবুও আমরা সমস্ত আইনগত  কর্তব্য সেরে শ্মশান যাত্রার জোগাড় করেছিলাম।

শ্মশানে একটু শান্ত হতে মাস্টারমশায় জানালেন, খুব গরীব, মাতাপিতৃহীন  এক অনাথাকে বিয়ে করেছিলেন উনি, নিছক ভালবেসে।সেই ভালবাসার আগুন জীবনের প্রভাতেই এক প্রবল বর্ষণে নির্বাপিত হল।
আমার,  এরকম এক মৃত্যুর সঙ্গে পরিচয় ঘটল মেদিনীপুরের মাটিতে।
ফিরতে পরের দিন সকাল হয়ে গিয়েছিল। আকাশে তখন নতুন দিনের নতুন সূর্য উঁকি মারছে।

আর একবারের ঘটনা। আমি তখন পূর্ণ যুবক, নতুন বিয়ে হয়েছে।আমাদের অনেক ভাই বোনের সংসারে আমার তরুণী স্ত্রীর নতুন আবির্ভাব হয়েছে। একমাত্র বোনের কিছুদিন আগেই বিয়ে হওয়ায় ঘরে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই শূন্যতাকে ভরাট করার জন্য নবাগতা একেবারে উপযুক্ত ছিল। ফলে বাড়ি মেতে উঠেছিল, রিক্তপত্র বৃক্ষে নব পত্রাগমের আনন্দের মত।
স্থির হল, শীতে পারিবারিক পিকনিক হবে।আর তখনকার দিনে, খড়্গপুর কিংবা মেদিনীপুর শহরের অনেকের কাছেই কাঁসাই নদীতীর ছিল পিকনিকের জন্য আদর্শ জায়গা। যদিও কাঁসাইয়ের একটি বদনাম ছিল৷ এর বুকে নাকি আছে অনেক চোরাবালির গর্ত, যাতে প্রাণ হারিয়েছে বা বিপদে পড়েছে অনেকেই, তবু ক্ষীণধারা কাঁসাইয়ের বুকে পিকনিকের লোভ ছিল আমাদের অপরিসীম।
আমরা, মা বাবা, ভাই, নতুন স্ত্রীরা (আমাদের দুই ভাইয়েরই তখন কেবল বিয়ে হয়েছে) সবাই মেতে উঠলাম আনন্দে।বাবারও তখন সক্ষম বয়স, রিটায়ার করে নি।সবাই খুশী।

শীতের সকাল সকাল হাজির হওয়া গেল নদীর ধারে বালির উপর।ভাল একটি জায়গা দেখে ত্রিপল পেতে সমস্ত জিনিসপত্র জড়ো হল।কোন রাঁধুনী বা বাইরের লোক নেওয়া হয় নি।নিজেরাই সব করব স্থির হল।
 আকাশে নরম সূর্যের শীত মাখা কাঁচা সোনার মত রোদ, আমাদের মনের রোদের সাথে মিশে সমস্ত পরিবেশটা ঊজ্বল করে তুলল।
মা বদ্ধ রান্নাঘরের আর সংসার থেকে বাইরের জগতে পা রেখে এক নতুন আকাশে যেন ডানা মেলল। 
বাবা, চিরকালের গাম্ভীর্যের ছদ্মমুখোশের আড়াল থেকে বাইরে এসে এক অনাস্বাদিত জগতের সন্ধান পেল।আর আমরা, এনাদের, বাইরে এসে অন্য এক রূপ দেখে, নতুন করে আবিষ্কার করতে শিখলাম।
সামনেই ছিল, মাঝিদের ছেড়ে যাওয়া একটি ছোট মাছ ধরা নৌকা।তা যেন, আমাদের আনন্দের স্রোতকে আরও কল্লোলিনী করে তুলল।
রান্না শেষ হতে,  মা জানিয়ে দিল সবাই স্নান করে নাও, খাবার তৈরী।আমরা সব ভাই, বাবা সবাই একসাথে এক হাঁটু সমান ধীর প্রবাহিনী নদীতে নামলাম।বাবা জলে নেমে নিজের বয়স হারিয়ে ফেলল। মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার পাড়াগাঁয়ের ঝাঁপাইঝোরা পুকুরের কথা।অস্বাভাবিক আনন্দে হাসিতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠল।আর সেই আনন্দে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে গিয়ে বাবার বাঁধানো দাঁতের পাটি ছিটকে একেবারে নদীর জলে।
ব্যস, হাসি এক ধাক্কায় বন্ধ হয়ে গেল। খোঁজ খোঁজ, কোথায় দাঁতের পাটি।আমরা তো জল তোলপাড় করে ফেললাম। কোথায় দাঁত! আর, দাঁত না হলে, এত সুগন্ধ ওঠা মাংসের পূর্ণ রসাস্বাদন তো সম্ভব হবে না।
আমরা তো হাল ছেড়ে দিলাম।বাবা তখন বলল, দেখি শেষ চেষ্টা করে। বাবা শেষ চেষ্টা করতে লাগল হারানো দাঁতের পাটি উদ্ধার করতে।আমরা মজাও পেয়েছিলাম ব্যাপারটায় খুব।তাই হাসি ছিটকে আসছিল সবার দাঁতের ফাঁক থেকে।তবে বাবা যখন বহুকাল পূর্বে শেখা, এতদিনের অনভ্যাসের পর ডুবসাঁতার দিয়ে দন্তোদ্ধারে এগিয়ে গেল, আমাদের চিন্তাটা বেড়ে গেল যে, এই বয়সে এই চেষ্টায় ক্ষতি না হয়ে যায়।
হঠাৎ আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে বাবা,  ফোকলা মুখে, একমুখ হাসি সমেত জল থেকে মাথা তুলেই বলল, পেয়েছি। 

বাবার হাত তখন আকাশের দিকে তোলা, এবং তাতে ধরা, ঝকঝক করছে সেই একপাটি হারানো দাঁতের সারি।সেটা যেন, আমার মনে হচ্ছিল, একপাটি সাদা দাঁতের সারি নয়, পূর্ণ একফালি আকাশের চাঁদ।সত্যিই বাবার তখন হাতে চাঁদ পাওয়ার আনন্দ।


সেই আনন্দতে আমাদের বাকী পিকনিক যে,ঝলমল করে উঠেছিল, তা বলাই বাহুল্য।

Post a Comment

0 Comments