রেশমের একাল - সেকাল
পর্ব - ২
কুহেলী বন্দ্যোপাধ্যায়
মানবসভ্যতার প্রারম্ভে আমরা দেখি, আদিম মানুষ প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে বাঁচতে গাছের বাকল, পশুর চামড়া ব্যবহার করত। তারা মাকড়সার জাল বোনা, পাখির বাসা বোনা দেখে কাপড় তৈরির ধারনা পায় বলে মনে করা হয়। নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন নব্যপ্রস্তরযুগে প্রথম ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষ চামড়া সেলাই করা শেখে। বিভিন্ন ধরনের হাড় ও হাতির দাঁতকে সুঁচ হিসাবে আর পশুর নাড়িভুঁড়ি-ধমনিকে সুতো হিসাবে তারা ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে তারা শন, কলা জাতীয় গাছের তন্তুকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে কাপড় জাতীয় বস্ত্র তৈরি করতে শেখে। আদিম মানুষের হাতেই সেই প্রথম তাঁত উদ্ভব।
সুতোকে রোদে শুকানো
কিছুদিন পূর্বে ফ্রান্সের এক গুহা থেকে বিজ্ঞানীরা আধুনিক মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি প্রজাতি নিয়ান্ডারথালদের ব্যবহৃত পঞ্চাশ হাজার বছরের পুরনো সুতো আবিস্কার করেছেন। যা দেবদারু গাছের বাকল থেকে তৈরি। খ্রিস্টপূর্বাব্দ প্রথম শতাব্দীতে পালি সাহিত্যে কাপড়ের পোশাকের কথা আছে। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানরা এক ধরনের তাঁত ব্যবহার করত। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ অব্দে গ্রীসে মাটির পাত্রে প্রাচীন তাঁতের ছবি আছে।প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর সভ্যতাগুলিতেও এর নিদর্শন পাওয়া যায়। সাঁচির বৌদ্ধস্তুপে গাছের বাকলের তৈরি কাপড় দেখা যায়। আর্য-অনার্যরাও এইরকম কাপড় ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে পালযুগের ভাস্কর্যে শাড়ির ব্যবহার দেখা যায়। প্রাচীন বাংলায় উচ্চবৃত্ত সম্প্রদায়ে মসলিন, রেশমকাপড়ের ব্যবহার থাকলেও সাধারন জনগন মোটা সুতোর কাপড়ই ব্যবহার করতো। সেকালের সম্ভ্রান্ত মহিলারা অবশ্য রেশম ছাড়াও সুতি, চান্দেরি, বেনারসি, জামদানী ,পচনপল্লি, বালুচরি পড়তেন।
তাঁতে কাপড় বোনা
বর্তমানে সিল্কের উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। বিভিন্ন রাজ্যে এর চাষ হয়ে থাকে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গেও রেশম চাষ ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। রাজ্যে রেশম তাঁত শিল্পটি মুলত মালদা,মুর্শিদাবাদ,বাঁকুড়া ও বীরভূমে হয়ে থাকে। গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্য রেশম চাষের অবদান অনস্বীকার্য। বীরভূম জেলার বিভিন্ন এলাকায় পলুপোকার চাষ হয়ে থাকে। সাঁইথিয়া-বহরমপুর রোডের কাছে নারানঘাটি ওপ্যাটেলনগর রেশমকেন্দ্রে রাজ্য এবং কেন্দ্রসরকারের অধীনে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রোগমুক্ত ডিম প্রতিপালিত করা হয়। নারানঘাটিতে মুলত রেশমগুটির ডিম প্রতিপালন হলেও জেলায় রেশম শাড়ি তৈরি হয় না। এখানে তসরের শাড়ি হয়ে থাকে। প্যাটেলনগর কেন্দ্রে তসরগুটি সংরক্ষণ থেকে ডিম প্রতিপালনের এক সুদীর্ঘ পর্যায় অবলম্বন করা হয়। এলাকাগুলিতে পোকা পালনের উদ্দেশ্যে অর্জুন ও তুঁত গাছের চাষ করা হয়। এই কেন্দ্রগুলি থেকে বিভিন্ন জেলার এবং অন্য রাজ্যের চাষিরাও ডিম সংগ্রহ করেন। চাষিরা পলু চাষ করেন অতি যত্নের সাথে। অনেকটা কেয়ারি বেবির মতো। পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়া গুটিকে চাষি বিক্রি করে দেন তাঁতিকে। তসর কাপড়ে রঙ করা
বীরভূম জেলায় মূলত তসর শিল্পের কাজ হয় সিউরির কাছে তাঁতিপাড়ায়।গুটি থেকে শাড়ি তৈরির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি গ্রামের মানুষজন করে থাকেন। সুতো তৈরির কাজটি সাধারনত মেয়েরাই করে থাকেন। চরকার সাহায্যে তসরগুটি থেকে তন্ত বের করা হয়। এরপর চাকা লাগানো যন্ত্র দিয়ে সুতোকে সমান করা হয়। বিশেষ থাই পদ্ধতিতে মহিলারা খুব যত্ন সহকারে সুতোকে মসৃণ করেন। শাড়ির গুনাগুণ এর ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। তসর কাপড়গুলিকে তরল রাসায়নিক পদার্থের দ্বারা পালিশ করা হয়। সাধারনত ১মণ রেশম সুতো থেকে ৪কেজি মতো সুতো তৈরি হয়। আর তসরগুটির ক্ষেএে ১কাহন এ ১২৮০টি গুটি থেকে ৯০০-১২০০ গ্রাম সুতো তৈরি হয়। ১কেজি সুতোর বাজার মুল্য ৪০০০ টাকা। গ্রামের বেশির ভাগ পরিবার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে এই শিল্পের সাথে জড়িত। বর্তমানে এখানে সুতো থেকে শাড়ি তৈরির সম্পূর্ণ প্র্রক্রিয়াটিই কেন্দ্রীয় সরকারের অন্তর্গত কে.ভি.আই.সি দ্বারা পরিচালিত। সংস্থার সাথে যুক্ত গ্রামের শিল্পীদের প্রাপ্য মজুরিও এই কমিশনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ।গ্রামে বেশ কিছু পরিবার শাড়ি রঙের কাজে যুক্ত। তাঁরা গ্রামেরই তাঁতিদের বোনা থান থেকে শাড়ি, পাঞ্জাবীর কাপড়, স্টোল তৈরি করেন। তবে শাড়িই বেশি করেন তাঁরা। বাজারে এগুলির যথেষ্ট চাহিদা আছে। কিন্তু আগের তুলনায় কম। শিল্পীদের আক্ষেপ তাঁদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই শিল্প কিছুটা উপেক্ষিত। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তারা তাদের পছন্দ মতো পেশাকেই অগ্রাধিকার দিতে ইচ্ছুক। সুপ্রাচীন দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের প্রতি তারা খুব একটা আশাবাদী নয়।
কারখানায় প্রস্তুত তসর সিল্ক
ভয় হয় কালের গভীরে এই শিল্প আবার হারিয়ে যাবে না তো? পরবর্তী প্রজন্ম যাতে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যময় এই শিল্পের ধারাকে গৌরবের সাথে বহন করে তা আমাদের নিকট একান্তই কাম্য।
🍂 তবে আশার কথা এই যে আমরা যারা সিল্কের অনুরাগী তাদের সংগ্রহে এই শাড়ি এখনো প্রথম সারিতে। সিল্কের ঔজ্জ্বল্য, কোমল স্পর্শ, হাল্কা এবং টেকসই হওয়ার জন্য অধিকাংশের কাছে চিরকালই তা আদরণীয় এবং চাহিদাও বরাবর অক্ষুণ্ণ রয়েছে। রেশমকে সেই কারনেই বলা হয় বয়ন শিল্পের রানি। আর ঠিক সেই কারনেই অষ্টমীর অঞ্জলী থেকে যে কোন উৎসব- অনুষ্ঠানে .... সর্বত্রই সে স্বতন্ত্র ভাবে আপন গুণ ও মহিমার দ্বারা আজও বিরাজমান।
( সমাপ্ত )
0 Comments