কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব-৭
সুমিত্রা মাহাত
একটা বড়ো হলরুমে একদিকে ছেলেদের একদিকে মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা। আচমকা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় চোখ মেলে তাকাই। কাঁপুনি দিতে থাকে,মেয়ের গায়ের চাদর ধরে টানাটানি করতে থাকি। সুবিধে করতে না পেরে উঠে বসি। ঘড়িতে তখন তিনটে বাজে। দেখি কোন সচেতন ব্যক্তি লাইন না পাওয়ার আশঙ্কায় সন্তানসহ ওপরের বাথরুমে গেছে। দরজা একেবারে হাট করে খোলা। রুমের মধ্যে যে কিছু অচেতন মানুষ রয়েছে সেদিকে খেয়াল নেই। রুমের উষ্ণতার আমেজ নিতে খোলা দরজা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস হু হু করে ভেতরে ঢুকছে। আমার নড়াচড়াতে মেয়েও উঠে বসে যায়। তাকে আবার চেপে চুপে শুইয়ে দিই। সারাদিনের ধকল আছে আরেকটু ঘুমানো দরকার। উঠে দরজা ভেজিয়ে আবার ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়ি। বুঝতে পারি আবহাওয়াতে একটা বড়ো রকমের পরিবর্তন হয়েছে। কালকের মতো আলো ঝলমলে দিন হয়ত আজ থাকবে না। চারিদিকে কুয়াশাচ্ছন্ন ভাব। পাহাড়ি অঞ্চলের এই পরিবর্তনশীল আবহাওয়া বড় রহস্যময়। এই ঝলমলে রোদ তো এই আলোআঁধারি,এই পরিষ্কার নীলাকাশ তো এই চারিদিক মেঘে ঢেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। এ যেন ছোট্ট শিশুর দুরন্তপনা। ঘড়িতে চারটে বাজলে ছেলে মেয়েকে তুলে দিই। ততক্ষণে বাথরুমে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। প্রথমে মেয়ে তারপর ছেলেকে রেডি করি। ছাদ থেকে চারিদিকের মায়াময় পরিবেশ প্রত্যক্ষ করি। মন্দিরে ভোলানাথ কে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস শুরু হয়ে গিয়েছে। কুয়াশার মতো ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি একটু ধরলে ছাতু ,অল্প ড্রাই ফ্রুটস খেয়ে, ভোলানাথের দর্শন নিয়ে, কোচেদের সঙ্গে ছেলে মেয়ে মাঠে চলে যায় সঙ্গে কিট্ ব্যাগ। প্রথমে অনেকক্ষণ প্র্যাকটিস চলবে তারপর খেলা শুরু হবে। ওদের নিয়ে আর ভাবনা নেই , ওরা আজ সারাদিন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে থাকবে।
মানুষের সঙ্গে সময় কাটাতে আমি ভালোবাসি কিন্তু সবসময় প্রচন্ড ভিড় - ভাট্টা আমার ভালো লাগে না। তাই সারাদিনের নানা কাজ কর্মের ফাঁকে নিজের জন্য একটু নির্জন সময় বের করে নিই। তাছাড়া বাথরুমে থাকা অবস্থায় তাগাদা খেতে ভালো লাগে না। তাই সবাই কে সুযোগ করে দিয়ে আমি ধীরে সুস্থে রেডি হতে থাকি। সকলেই স্টেডিয়ামের দিকে চলে যায়,ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করতে । যে কোন মূল্যে পুরষ্কার ছিনিয়ে নিতে হবে। আমার সে সবের বালাই নেই। সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরতে পারলে হয়। আমার পাল্লায় পড়ে গজগজ করতে করতে শেষ পর্যন্ত হাজব্যন্ড ও চলে যায়। সময়ে ব্রেকফাস্ট নিতে হবে। দোতলা বাড়িতে আমি সম্পূর্ণ একা। বাড়ির মালিক , তার স্ত্রী ও বছর পাঁচেকের একটি ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আনাগোনা করছে। শিবলিঙ্গের পাশে সকাল থেকে অনবরত মন্ত্রোচ্চারণ চলছে , কিছু মানুষ সেখানে একে একে জড়ো হচ্ছে। আমি বাড়ির মালিক ও তার পরিবারের সঙ্গে এক খিচুড়ি ভাষাতে আলাপ করি। খাওয়ার জল চাই, যা এনেছিলাম সব শেষ। জল কিনেই খেতে হচ্ছে। নীচে হলঘরের বাইরে একটি প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে গেলেই মালিকের থাকার ঘর। জল নিতে আমি কিছুটা এগিয়ে যাই। অবাক হয়ে দেখি মূল দরজা থেকে প্যাসেজের অর্ধেক পর্যন্ত টবে নানান রকমের ফুলের গাছ। বিশেষ নজর কাড়ে ধবধবে সাদা রং এর ইয়া বড়ো এশিয়াটিক লিলি। আমাদের এখানকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ সাইজ। আমি চারপাশে চোখ বুলাতে থাকি। পাশেই একটি বাড়ির ছাদে নাইট কুইনের পাতা থেকে তিন চারটে টুকটুকে লাল ফুল ঝুলছে। কুয়াশাচ্ছন্ন ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য ফুল দিনের বেলাতেও খুলে রয়েছে। আমি দুঃসাহস বশত প্রশ্ন করি এই পাতা চাইলে একটু দেবে না ! উনি হেসে বলেন ওটা আন্টিদের, জানিনা দেবেন কিনা। আর এগোতে সাহস হয় না।
🍂ফিরে এসে আমি দোতলার একটি ছোট রুমে সাজুগুজু করতে বসি। ভাবি ব্রেকফাস্ট খেয়ে, গ্রাউন্ডে ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা করে,কাছাকাছি নার্সারি গুলো একটু ঘুরে দেখব। সকাল থেকেই পেঁজা তুলোর মতো মেঘের নীচে সূর্য সম্পূর্ণ আড়াল হয়েছে। একটা থমথমে ভাব। কুয়াশার মতো ঝিরঝিরে বৃষ্টি কখনও পড়ছে কখনও থামছে। এরকম আবহাওয়াতে তো শুধু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে,সঙ্গে ভালো গান আর পাঁপড় ভাজা।
এমনই সাত-পাঁচ ভাবছি এমন সময় বাঁধ ভাঙা জলের মতো হুড় হুড় করে একদল তরুণী আমার রুমের পাশ দিয়ে বাথরুমে যাতায়াত করতে থাকে , আমার রুমেও উঁকি ঝুঁকি মারে। এবার বুঝি , এনাদের বন্দোবস্ত করতেই মালিকের এত মাথা ব্যথা। নীচের হল রুমটি এনারা কব্জা করলেন। পরে পরে কিছু ছেলেও এল। সকলেই শিলিগুড়ি থেকে এসেছে। স্থানীয় ছেলে মেয়ে এরা। কী একটা ইনসিওরেন্স কোম্পানি থেকে এসেছে। সারাদিন মানুষ কে বোঝানো, মিটিং ইত্যাদি চলবে। কাছাকাছি কিছু জায়গা ঘুরে পরদিন বিকেলে শিলিগুড়ি নেমে যাবে। তারা নিজেদের মধ্যে কী ভাষায় কথা বলছে তা বুঝতে পারিনা তবে আমার ভাঙ্গা চোরা হিন্দী বুঝে তারা সঠিক জবাব ই দিচ্ছে। হাজার হোক পাবলিক সেক্টরে কাজ করে অভ্যাস তাদের। আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি তাদের একটা মাত্র শব্দ আমি শিখেছি তা হল 'সরিঞা'(Sorry)। আমাকে মিষ্টি করে তারা অনুরোধ করে আমরা কি রুমের মধ্যে একটু চেঞ্জ করতে পারি। বাপরে বাপ!হ্যাঁ বলেছি কি বলিনি একেবারে ডজন খানেক ঢুকে পড়ে। ফটাফট পরনে কাপড় চেঞ্জ করে ঘিয়া শার্ট, কালো প্যান্ট ও কালো ব্লেজার পরে নেয়। কি সুন্দর যে দেখাচ্ছে সকলকে ! দেখার মতো। অবাক হয়ে দেখি তাদের হাতে পায়ে কোথাও এতটুকু মেদ নেই, শুধুই সুঠাম পেশি। সমতলের মানুষ বালতি বালতি ঘাম ঝরিয়ে তবে এই আকার পায় আর এদের এমনিতেই! আমি রসিকতা করে বলি তোমাদের মধ্যপ্রদেশ সমতল কী করে , স্কিন এত সুন্দর কীভাবে , চুল সবার স্ট্রেট কেন। তারা হেসে জবাব দেয় আমাদের ও মধ্যপ্রদেশ আছে, যা আমরা লুকিয়ে রেখেছি। আসল কথা তা নয় , প্রতিদিন এত ওঠানামা করলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। স্কিনের রহস্য আবহাওয়া ও খাদ্যাভ্যাস। তারা বেশিরভাগ কাঁচা অথবা আধসেদ্ধ জিনিস খায়। সব্জি , স্যালাড ইত্যাদি। যে মোমোর জন্য আমাদের এত লাফালাফি তা তারা প্রায় মুখে তোলে না বললেই চলে। তারা বলে , আমরা তেল একদমই খায় না , চর্বি হলে তো আমাদের চলবে না । সত্যিই তো ওঠা নামার ক্ষেত্রে অনেক কষ্ট হবে যা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। অল্প সময়ের মধ্যেই এমন ভাব জমে গেল কি বলব! রীতিমত আমাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করায় বিকেলে একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। জানায় এখান থেকে মাত্র দশ মিনিট দূরত্বে একটা মন্দির আছে সেখানেই ঘুরতে যাবে। ওরে বাবা!এখানকার দশ মিনিট মানে তো সেই গন্ডা গন্ডা সিঁড়ি কিংবা ঢালু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ওঠো আবার নামো। আমি হ্যাঁ না বলব কি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি কোনক্রমে মাথা নাড়ি।
এখানকার পোশাক আশাক ও খুবই আকর্ষণীয়। দারুণ স্মার্ট লুক দেয়। ছিপছিপে চেহারা হলে তো কথাই নেই। কাপড়ের কোয়ালিটিও খুব ভালো। মেয়েদের ব্লেজার, শার্ট,মিনি স্কার্ট, ফরমাল প্যান্টস এগুলো মন কাড়ে। বিকেলে বাজার ঘুরে মেয়ের জন্য কিছু কিনেছি। পাহাড়ি মেয়েদের পোশাক ও সাজসজ্জা নিয়ে বরাবরই তার আগ্রহ। সে কি এক ধরনের ক্লিপ কেনার জন্য উঠে পড়ে লাগে। অনেক খুঁজেও তা শেষ পর্যন্ত পায় না।
প্রত্যেকে ছোট সাইড ব্যাগ থেকে মেকআপের জিনিস বের কর দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে ঝটপট হাল্কা মেকআপ করে নেয়। মেয়ে থাকলে খুব ই উপভোগ করত এই দৃশ্য। চোখ ফেরানো যায় না। সুন্দরীদের ভীড়ে চাপা পড়ে আমার সে কি করুণ অবস্থা! সবচেয়ে বড়ো কথা কত সহজ, সরল তারা! হাসিখুশি প্রাণময় । তীব্র জীবনীশক্তি আর পজিটিভ এনার্জি তে ভরা। তাদের সরলতার পাহাড়িয়া বাঁশির সুরের সঙ্গে, আমার হৃদয় থেকে উঠে আসা লালমাটির ধমসা, মাদলের সুর কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আমরা 'গোটাই খাঁটি ভিতর তক' , এই সরল সমীকরণে উভয়ের আবেগের ঢেউ আছড়ে পড়ে। তারা মজা করে বলে , তোমাদের খুব ভালো প্রত্যেকের মুখ আলাদা। আমাদের তো সবাই একই রকম দেখতে। সত্যিই তো এটা অবশ্যই আমাদের বাড়তি পাওনা।
ইতিমধ্যে একটি মেয়ে দেখে , ব্যাগের মধ্যে ফ্লাক্সে থাকা চা উল্টে পড়ে তার সমস্ত জামাকাপড়ে দাগ লেগে গেছে। সে তো রীতিমত কান্নাকাটি জুড়ে দেয় , পাহাড়ি ভাষায় কি সব বলতে থাকে। পাশের একজন দয়া করে দু এক লাইন বঙ্গানুবাদ করে দেয়। সেই একমাত্র বাংলা বুঝতে ও বলতে পারছিল।
অল্প সময়েই অনেক কিছু জানি তাদের কাছ থেকে। এখানে যখন খুব ঠান্ডা পড়ে পাহাড়ের উপরের অংশে বসবাস করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। চারিদিক বরফে ঢেকে যায়। খাবার দাবার, জলের যোগান ইত্যাদির অসুবিধা তো আছেই , সঙ্গে বয়স্ক মানুষদের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে এই শীতলতা। তখন তারা সমতলে নেমে যায়। শিলিগুড়িতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। আবার বরফ গলে গেলে , উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে উপরে উঠে আসে। মাটির টান যে বড়ো কঠিন, তা কি সহজে ছাড়া যায়! প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করবে তবু ভিটে মাটি ছেড়ে যাবে না। এর সঙ্গে যে জীবন , জীবিকা ও ভালোলাগা জড়িয়ে রয়েছে! অনেক সময় দেখেছি নদীর ধারে যে সব কুটুম - বাটুম রয়েছে বন্যার সময় ঘর ভেসে গেলে তারা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেয়, আবার জল নামলে নীচে নেমে আসে। নদীর ধারের পলিমাটি তে সোনা ফলে , তা কিছুতেই তারা ছেড়ে যাবে না। যাইহোক সাজগোজ সম্পন্ন হলে , তাদের বিদেয় করে , রুমে তালা দিয়ে আমি গ্রাউন্ড এর দিকে যাই। ইতিমধ্যে দু চার বার তাগাদা আসে আমার ছেলের নাকি খেলা শুরু হয় গেছে। মাটির ঘ্রাণ নিতে নিতে, পাহাড়ি মেয়েদের কলকাকলি কানে নিয়ে আমি স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দিই। আগে ব্রেকফাস্ট নেব তারপর মাঠে ঢুকব।
0 Comments