জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৭৪/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা  খান

পর্ব ৭৪

আজ ওনার ডায়ালিসিস হল, নব (ডায়ালিসিস ইউনিটের হেড) নিজে করেছে। গতকাল করাতে পারলে ডেটটা ঠিক থাকত। কিন্তু আগের দিন কলকাতা থেকে ফিরে আমাদের দুজনেরই কারো যাওয়ার মত অবস্থা ছিল না। যাক, আজ কোন সমস্যা হয়নি। তবে হাতে এখনো রক্ত জমে আছে। আজ দুপুরে চন্দ্রিমা আসতে পারেনি, ওর স্বামী অসীম বাড়ি এসেছে। তাই দুপুরটা বিস্কুট খেয়েই কাটিয়ে  দিলাম।

       আজ নার্সিংহোম থেকে ফিরে রান্না করলাম। সৌনক ভাত খাইয়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিল, আমি রাজি হইনি। টিফিন নিয়ে এলে খেতেই হল। সন্ধ্যায় ওর সঙ্গে গিয়ে ডঃ ইন্দ্রনীল দেবকে চোখ দেখিয়ে এলাম। ওদের বাড়ির কাছে, তাই নাম লেখিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে সুবিধা হয়েছে, ওর বৌ রনিতাও চোখ দেখাল। আমার পাওয়ার বেড়েছে, কাল আই প্যালেসে চশমা বানাতে দেব। সৌনকের সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গেছলাম বলে চন্দ্রিমা একটু ক্ষুণ্ণ। ওর ভয় এই বুঝি কেউ আমাকে ওর থেকে কেড়ে নিল, পাগলি একটা।

     রাতে ভাল ঘুম হয়নি, বাবলি আসবে, তাই ভোরে রাজুকে ঘুম থেকে তুলে  এয়ারপোর্ট  পাঠিয়েছিলাম। বাবলি একা এসেছে বাপিকে দেখার জন্য। গতকাল খায়রুল্লারচকে জঙ্গলমহল উৎসবে যেতে পারিনি। আজ সন্ধ্যায় বাবলি জোর করে পাঠিয়েছিল। সৌনকের সঙ্গে গেছলাম। তখন ডি এফ ও বক্তব্য রাখছিলেন। ওঁরা আমাকে নিয়ে গিয়ে মঞ্চে বসালেন। ডি এফ ও জুঁই অধিকারি ও আমাকে দিয়ে বিজেতা ছাত্রছাত্রীদের হাতে পুরষ্কার তুলে দেওয়া হল। তারপর শুরু হল আদিবাসী নাচ, ঝুমুর গান ইত্যাদি। অনেকেই ছিলেন এখানে, মধুপদা, প্রসূন পড়িয়া, মনিকাঞ্চন, আলোকবরণ মাইতি, আরও অনেকে মিলে ছবি তোলা হল। মুড়ি খাওয়া হল। রাত ৮ টাতে বাড়ি ফিরলাম। ফিরে ওনার রান্না করলাম।  
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শহরের তরুণ কবিদের ব্যবস্থাপনায় রবীন্দ্র নিলয়ে একটি অনুষ্ঠানে আমি প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলাম। বক্তব্য কেমন হয়েছে জানিনা। প্রভাতদা(মিশ্র)প্রসূন পড়িয়া, আরও অনেকে বলছিলেন, খুব তথ্যপূর্ণ বক্তব্য ছিল। তবে নির্মাল্য (কবি)বলছিল অন্যান্য সময়ের মত জোশ ছিলনা। আমার নিজেরও তাই মনে হয়েছে। আসলে প্রায় ৫ ঘণ্টা নার্সিংহোমে কাটিয়ে শারীরিক মানসিক, সব দিক দিয়েই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, জোশ থাকবা কী করে?

      গতকাল নিজেই বাজার করে ছিলাম মেয়েটা আসবে বলে। সেই বাজার দিয়েই আজ তাড়াতাড়ি রান্না করলাম। রান্না খাওয়া সেরে খুব ঘুমিয়েছি। বিকেলে বাবলির সঙ্গে বড়বাজার গেছলাম, বাবলিই কিছু শপিং করল। শনিবার ওর ফেরার ফ্লাইট। বাড়ি ফিরে দেখি চন্দ্রিমা অপেক্ষা করছে। বাবলি ও জারার জন্য কিছু গিফট নিয়ে এসেছে। ওদিকে দীপ ফোন করেছে, জারার চুল আঁচড়ানো যাচ্ছে না। মস্ত লম্বা চুল নিয়ে বাবা মেয়ে সমস্যায় পড়েছে। শেষপর্যন্ত পার্লারে  গেলে ওরা কিছুটা চুল কেটে শ্যাম্পু করে বেঁধে দিয়েছে। এখানে অনেকেই বাবলির সঙ্গে দেখা করতে আসছে। ও তো মাত্র ৭ দিনের  জন্য এসেছে, এই বিচ্ছেদগুলো এখন আর আগের মত কষ্ট দেয় না।

     এবার ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। ৮ ডিগ্রী থেকে ওপরে উঠছেই না।   ঠাণ্ডা সহ্য করে নেওয়া যায়, গরম একদমই সহ্য করতে পারি না। যাইহোক আজ আমার বকুলের জন্মদিন। ওকে অন্তত আজকের দিনটা আসতে বলি, কিন্তু কথা  শোনেনো। আমি কিন্ত ওর পছন্দের ছানার পায়েস করে রাখি, যদি আসে!

    আজকাল আমি বাইরে গেলে খান সাহেব খুব টেনশন করেন, অস্থির হয়ে ওঠেন। আমাকে একাকে সব করতে হয়, বাইরে তো আমাকে বের হতে হবে। না  হলে কে করবে? সবসময় অন্যদের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়, আমি পছন্দও করি না। তাছাড়া কিছু কাজ আছে আমাকে না হলে হবেই না। এরই নাম বেঁচে থাকা। এরই নাম জীবন।  

    জীবন কখনো একরকম যায় না, ঘাত-প্রতিঘাত থাকবেই। থাকবে সুখের পরে দুঃখ। কিন্তু আমার মত কিছু মানুষ আছে যাঁদের জীবন নানা বইচিত্রে ভরা  হলেও সেখানে দুঃখের পর সুখ আসে না। আমৃত্যু দুঃখের সঙ্গে লড়াই করে যেতে  হয়। জীবনের অন্য দিকটা চমকদার হলেও তা কক্ষনোই উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে না। নিজের মুখোমুখি দাঁড়ালে নিজেকে কেমন যেন অচেনা মনে হয়। সেই   কোনো একগ্রামের ঝাঁকড়া চুলের মেয়েটিকে, যে মায়ের চোখ এড়িয়ে বনে-বাগানে ঘুরে বেড়িয়ে প্রকৃতিকে চিনতে শিখে ছিল, নদীর স্রোতে ভেসে যেতে যেতে সাঁতার শিখেছিল, তাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সেইসময়টাকে ফিরে পেতে। আরও অনেক কিছুই পেতে চাই, যা একদিন আমার ছিল।

     বুঝে উঠতে পারিনা কীসে সুখ? ভালবাসার প্রকৃত অর্থই বা কী? না না,  এসব আমি এখন আর বুঝতে চাইনা। মাঝে মাঝে মনে হয়, এবার বুঝি জীবনটা  ছুটি চাইছে। কিন্তু আমার যে এখনো অনেক কাজ বাকি! উজান পথ বেছে নিলে পথ চলতে কষ্ট তো হবেই। তবে সে জন্য ভয় পাইনা। শুধু হারানোর ব্যথাগুলো মাঝে মাঝে বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। ভয় হয়, এই বুঝি অবসাদ গ্রাস করল! এই জন্যই সবসময় নিজেকে ব্যস্ত রাখা। অধিকাংশ লোকই মানুষের বাইরেটা দেখে সমালোচনা করে। অথচ জানার চেষ্টা করেনা মানুষটা আদৌ ভাল আছেন কী না? এরা মনে করে  জীবনকে উপভোগ করার অধিকার একচেটিয়া শুধু তাদেরই  আছে।তাদের বক্তব্য ওরা ওদের জীবনের দুঃখ কষ্টকে বুকে নিয়েই বাঁচুক। এটাই ওদের ভবিতব্য। ওরা কেন বাইরে বের হবে? কেন ভাল জামাকাপড় পরবে?  কেন ওরা হাসবে?

     তখন বড্ড বেশি করে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কথা মনে পড়ে।খড়গপুর আই আই টি র প্রাক্তন অধ্যাপিকা স্বপ্নাদি(ব্যানারজি) বলেছিলেন, মন খারাপ্ হলে রবীন্দ্রনাথের গান শুনবে, মন ভাল থাকবে। কেউ বলেন খোদার নাম নাও, সব মুসিবত দূর হবে।শান্তি পাবে, আদৌ কি তা হওয়া সম্ভব?

                                        ক্রমশ

Post a Comment

1 Comments

  1. দেবাশীষ গোস্বামীJune 2, 2023 at 12:20 PM

    খুব সুন্দর......

    ReplyDelete