জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (ত্রয়োদশ পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত (ত্রয়োদশ পর্ব)

শ্রীজিৎ জানা

লোখার সান দাদা নিশিকান্ত। লোখার চেয়ে দু'বছরের বড়। সোনার কাজ করে। মুম্বাইয়ে থাকে। এইট পাশ করে নাইনে উঠে আর স্কুলে যাইনি। পান্নার বাঞ্ছা কপাট লোখার পিসতুতো দাদা। মুম্বাইয়ে তার সোনার দোকান ছিল। বিশ তিরিশ জন কারিগর তার দোকানে কাজ করত। পান্না গ্রামের বেশিরভাগ ছেলেছোকরা বাইরে সোনার কাজ করে। ঘাটালের উন্নতি সোনার কাজে। জলে ডুবা এলাকায় নাহলে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়ত। সেই কবে থেকে ঘাটাল- দাসপুরের অল্প বয়সী ছেলেরা পাড়ি জমাচ্ছে ভিন রাজ্যে।  পেটের দায়ে কাজের খোঁজে বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকছে তারা। আঠারো ছোঁয় নি এমন কত ছেলেনা ছোকরাগিরি করছে। তার পর কারিগর হয়ে ওঠা। বুদ্ধি আর বরাত সাথে পরিশ্রমের জোরে সোনার ব্যবসায় মারাত্মক উন্নতি করছে অনেকেই। জলডোবা জনপদের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে উন্নতির ছাপ। সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে দাসপুর ঘাটালের স্বর্ণশিল্পীরা। তাদের হাতের সুক্ষ কারুকাজ তাক লাগিয়ে দেবার মতো। অথচ ছোট্ট একটা ঘুপচি ঘরে দিন কাটে তাদের। যেখানে কাজ সেখানেই শোয়া বসা। হাঁটুমুড়ে বসে রাতদিন বিনিদ্র খাটুনিতে জেরবার তাদের জীবন। তবে এই কালিঝুলি মাখা রোজনামচা শুধু কারিগরদের। যারা শেঠ মানে মালিক তারা একটু অন্যভাবে জীবন কাটায়। ভিন রাজ্যে শেঠ বল্লে অবাঙালিকেই বোঝায় না, বাঙালিদের অনেকেই নিজেদের শেঠের পর্যায়ে নিয়ে গ্যাছে।
🍂

নিশিকান্ত ওইরকম বাঞ্ছা শেঠের দোকানে কাজে ঢুকে যায়। পিসতুতো ভাই বলে কাজের জায়গায় আলাদা খাতির পায় নি সে। তাকেও প্রথমে ছোকরা খাটতে হয়েছে। রান্না করতে হয়েছে। নাস্তা এনে দিতে হয়েছে। টুকিটাকি দোষে সিনিয়র দাদারা বাঙরলের ছ্যাঁকা দিয়েছে। একবার  বাঞ্ছা শেঠের হাতে ফাইল পেটা খেতে হয় তাকে। নিশিকান্ত যখন সোনার কাজে যায় তখন এস টি ডি বুথ থেকে ফোন করা যেত। মা বাপ নাই কে আর ফোন করবে তাকে। লোখা মাঝেসাঝে ফোন করে খোঁজ নিত তার। প্রথম দিকে নিশিকান্তের কান্না পেত খুব। জল খেতে পারত না সে। ক্যামন যেন বেস্বাদ লাগত। এক বালতি জলে স্নান করতে হত। গ্রামের পুকুরে ঝাঁপাইঝুড়া করে চান করা তার অভ্যেস। এখানে কাকের মতো দুচার মগ গায়ে ঢেলে নিতে হয়। তার উপরে এক জায়গায় অতজন গাদাগুমা করে শুয়ে থাকা। এরপর মশার কামড়। সবকিছু সহ্য করে রোজগারের ধান্দায় পড়ে থাকা। হপ্তান্তে রবিবার দলবেঁধে একটু মৌজমস্তি। হপ্তার মাঝেও চলে গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে পর্টি। মানে মদ আর মাংস। কেউ কেউ বেহিসেবীপনা করে মেতে যায় জুয়া-সাট্টায়। মায়াবী মুম্বাইয়ের রঙিন দুনিয়ার হোটেল অথবা ডিস্কোতে ঘাম ঝরানো নোট উড়িয়ে দিয়ে আসে। শরীরী চাহিদা মেটাতে মেয়ের সঙ্গে রাত কাটায়। বিনিময়ে মারণ রোগ বয়ে নিয়ে আসে অনেকেই। 
স্বর্ণ শিল্পের হাত ধরে ঘাটালের মানুষের হাতে টাকা আসছে। সমাজজীবনে তার ছাপ পড়েছে। পাড়ায় আকাশ ছোঁয়া মন্দির হচ্ছে। বাজারে বিগ বাজেটের পূজা হচ্ছে। সিনেমা আর্টিস্ট এনে জলসা হচ্ছে। বিয়ে,জন্মদিন,অন্নপ্রাশনের আয়োজনে টাকার ফোয়ারা উড়ছে।  সাথে একাংশ চরমতম সর্বনাশের পথে পাড়ি দিচ্ছে। সাগরপুর,হরেকৃষ্ণপুর,ভূতা,চাঁইপাট,নবীন সিমুলিয়ার কত কত স্বর্ণকার রাজা থেকে ভিখিরি হয়ে গ্যাছে। নিজে মারণ রোগে মরেছে। সাথে স্ত্রী,ছেলেমেয়ের শরীরেও ঢেলে দিয়ে গ্যাছে এইডসের জীবাণু। তাদের আপাত চাকচিক্যময় জীবনের আড়ালে লুকিয়ে আছে কষ্টকর যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে হয়তো ডুবে থাকতে চায় নেশা আর হুল্লোড়ভরা জীবনের তরঙ্গে। কিন্তু কে বোঝাবে তাদের এই অবিবেচক ভাবনা থেকে ফেরাতে।বাঞ্ছা কপাটদের হাতে টাকা আছে। সেই টাকার উপায়ের রাস্তা ক্যমন সেটা যে সবাই জানে।বাঞ্ছার কাছেও তা অজ্ঞাত নয়। সে মনে করে সমাজ তাদের সোনাবালা বলে হেয় করে। বাঞ্ছা কপাট বলে,
—--যতই টাকা কামাই,আর টাকা ঢালি মোদেরকে সবাই সনাবালাই বলে। মতলব কি মোদের পেটে বিদ্যা নাই ত সেইজন্য।  কিন্তু দেশকে আমরা কি দিইনি। মোদেরকে বাদ দিয়ে একটা পোগ্রাম করে দ্যাখা বলব তাহলে বলব দম আছে।
দেশ মানে বাঞ্ছাদের কাছে তাদের গ্রাম। গ্রামের কথায় এখনো তাদের প্রাণ কাঁদে। সেই কান্নার ভিতর দেখানেপনা নেই,আছে নিজের গ্রামের প্রতি সত্যিকারের ভালবাসা। তারাও সেই গ্রামের কাছ থেকে কিছু পেতে চায়। বাঞ্ছা কপাটের গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে,
—সব্বাই শালা মতলবি। দরকার পড়লে চিনে নাহলে থুড়ি চিনে! পুরা সাল ক্যামন থাকি কুনু খোঁজ রাখবেনি,আর গেরামে কুনু কিছু হলেই ফোন করা চালু। মতলব মাল পাঠাও। টাকার সাথেই অদের রিস্তা ওবি দেশে গেলে যেন চিনেই নি হারামি গুলা। ডিমাক গরম হয়ে যায়।

বাঞ্ছা কপাট এক সময় শেঠ ছিল। তখন কী তার রোয়াব। সাজ পোশাকে বাহারি চেকনাই। দশ আঙুলে আটটা সোনার আঙটি। গলায় মোটা দুখানা সোনার চেন। গ্রামে আসা মাত্রই চার ছজন তার আশেপাশে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করতে থাকত। মদ মাংসের ফোয়ারা ছুটত রাতদিন। বাঁধের শ্যামা কালীর পূজায় তিন চার দিন ধরে চলত হাঙ্গামা অর্কেস্ট্রা। পূজা কমিটির সভাপতি হত বাঞ্ছা কপাট। হ্যান্ডবিল, বিলবই, গেস্টকার্ড সবেতেই তার নাম বড় করে ছাপা। হাঙ্গামা শুরুর আগে ঘোষক গম্ভীর গলা করে বার চোদ্দটা বিশেষণ জুড়ে শ্রীমান বাঞ্ছা কপাটকে আমন্ত্রণ জানাত স্টেজে। মিনি স্কার্ট পরা একদল মেয়ে নাচের তালে বাঞ্ছাকে স্বাগত জানাত। বাঞ্ছার পরণে তখন জমকালো পোশাক। তা থেকে ভুরভুরিয়ে বেরোতো উগ্র সেন্ট। তারপর শুরু হত হাঙ্গামা। মানে গভীর রাত অব্দি উদোম নাচ। সেই নাচের মাঝে মাঝেই বাঞ্ছা কপাট স্টেজে উঠে টাকা ছড়িয়ে দিত নাচিয়েদের উপর। ঘোষকের গলায় তখন গরমাগরম কথার ফুলঝুরি। দর্শক আসনে করতালির তোড়। অনেকের চোখেমুখে বিস্ময়ের চিহ্ন। ভীড়ের ভিতরে কথা উঠত ফিসফিসিয়ে, 
—-কী দেখুঠু রে লেউলা। ইসব ত সিনামায় দেখি।
—-সনাপোটি না হলে ইসব পারবেনি, বুজলু!
—--উসব খাদ মিশানা টাকা। মোদের মত খেটে রোজগার কোরু দেখি। 
—--রোজগার কল্লেই হবে নি। মন চাই। খরচেরও ধঁক থাকতে হবে
—-অমন অজলা টাকা হলে সবাই উড়াতে পারে।
—-যাই বল বাগদির ছ্যানা যা করে দেখায়ঠে তায় আচ্ছা আচ্ছা লোক শুয়ে যাবে
—--তবে যাই বল মনা, এমন করে টাকা ছড়ানা ঠিক নয়। ইটা লক্ষ্মীর অবমান। যেদিন লক্ষ্মী ছাড়বে সেদিন থলিঝুলি সব ঝাড়া হয়ে যাবে।
বাঞ্ছার বউ ছিল আরো পাঁচ ঘাট উপরে। শিলাইপারের সীতাকুণ্ডর মেয়ে গঙ্গা। জরির কাপড় ছাড়া অঙ্গে গলাত না সে। রিক্সায় চড়ে হরিরামপুর বাবুর হাটকে বাজার করতে আসত। গা ভর্তি তার সোনার গয়না। সব সময় পটের বিবি সেজে ঘুরে বেড়াত। জা জাউলিরা মনে মনে গঙ্গার ভাগ্য দেখে হিংসা করত। 
—-বিয়া হয়ে এসছিল কাল গেঁড়ি খুদখুদি।এখন দেখুঠু ক্যামন ধপধপা হইচে! 
—-বোম্বের জল গায়ে পড়লে নাকি অমন হই যায়। তবে যাই বল উ একটু বেশিই রঙঢঙ দেখায়।
—--আ গো কথায় বলেনি, ঘুটা গুড়ানির ঝি / চাকরি পেইচে/ চলতে পারেনি/ পালকি চেইচে।
—-যা বলেচু। বলতে শুনুনু অড়া দেখে খড়া। বাজার কত্তে যায় রিক্সা চেপে। থোক থোক বাজার করে আনে। ঝিলঝিলানি কাপড়। শ্বশুর ভাসুর মানার বালাই নাই।ম্যাগিহাতা নাইটি পরে বগল দেখিয়ে ঘুরেঠে।
—-উটা আমরা যেদি কত্তম কত কথা উটত, দেখতু। পয়সাবালা সনাপাটির বউ নি অইজন্যে কেউ লা-কাড়ে নি।
—--কেউ না বোলু, দু'ছ্যানার একটা মিয়ার গ্যান নাই। শহেরা চাল ইখিনে চলবে বল দিখি! অত বাহাল্লি চাল গেরামে চলেনি।
বাঞ্ছা কপাটের মুখের উপরে কেউ একটা তেমন বলত না। বাঞ্ছারও মেজাজ মর্জি উল্টা ধরনের। পার্টির লোকেরাও মন যুগিয়ে চলত। যখন তখন সভা সম্মেলনের খরচ দ্যায়। পার্টির ছ্যানাদের ফূর্তির মদ খরচ দিত। এমন কি পার্টির বড় অফিসের কাজের জন্য একটা মটর সাইকেল পর্যন্ত কিনে দেয় বাঞ্ছা। যেবার ব্যাটার মুখেভাত হল,পার্টির বড় নেতা,এম এল এ থেকে শুরু করে বোম্বে থেকে কত লোক আসে। চারদিন ধরে ভূরিভোজ চলে। মদ মাংসের কাউন্টার আলাদা। নাচ গানের প্যান্ডেল আলাদা। সারা গ্রাম জুড়ে হইহই পড়ে যায় কদিন। এলাহি সব আয়োজন।মুখে মুখে বাঞ্ছা কপাটের নাম ঘুরতে থাকে। গ্রামে পেল্লাই বাড়ি লাগা দেয়।মাঠে ধানি জমি কেনে। বড় রাস্তার ধারে জমি কেনে। বাঞ্ছার বউ সকালের খাবার কে নাস্তা বলে। ডিবাকে বলে ডা্ব্বা। কথায় কথায় বলে,
—বোলো না দিদি হালাত খুব খারাপ। ছেলেটাতো পরিশান করে দেয়। মেয়েটার দিমাক হেবি তেজ। তোমার দাদার ধান্দা এখন ভালো চলছে। জানি না আগে কিসমত কেমন থাকবে।বিজ খানে কাজ পুরো ঠান্ডা ছিল।

গঙ্গার পেটে দুক্লাস বিদ্যা।  সীতাকুনুডুর কালি খুদখুদি গঙ্গা। শিলাইয়ের জলে টবটব করে ডুবত। ডুবে গায়ে পাঁড় পড়ে যেত। বাপ অজা ছাতিক বাঁকে করে চারাপনা ফেরি করত। বাঁধের উপরে তালপতার কুঁড়া খর ছিল। মা মাঠ থেকে গোবরের লাদ তুলে এনে ঘুঁটা করে বিক্রি করত। তেমন ঘরের মেইছ্যানার কপাল দেখে অবাক সকলে। গঙ্গা আগে তার মায়ের সঙ্গে  শিলাইে হালুক বসিয়ে মাছ ধরত। বাগদি ঘরের ঝুড়িঝাঁপড়ি গঙ্গার মুখে হিন্দি কথা শুনে বাপের ঘরের,শ্বশুর ঘরের বাখুলের লোকেরা অবাক হত। কিন্তু বাগদি জাতের উপরে বোধহয় অভিশাপ আছে। বাগদির হাড়ে উন্নতি নাই। কোথা দিয়ে কী হল বাঞ্ছার অত দবদবানি সব নদীর বঁধে ধস পড়ার মতো ধসে যায়।রাজা থেকে ভিখারির দশা হয়ে যায় বাঞ্ছা কপাটের। বোম্বে তার সোনার কাজে কীসব ধরা পড়ে। রাতারাতি ফিরে আসে। জমিজমা বেচে শোধ করে ধার দেনা। যে বাঞ্ছার দোকানে নিশিকান্ত ছকরা খাটত,সেই দোকানে এখন গারিগর খাটে বাঞ্ছার বেটা। একেই বলে সময়ের ফের।

Post a Comment

0 Comments