দাদুড় খেদা
দেবাশীষ সরখেল
খুব প্রচলিত একটি কথা বাঙালির জীবনে ১২ মাসে ১৩ পার্বণ । মানভূমের গানভূমের জীবন্ তো পরব পাইলে ভরপুর । এখানে ধান মরলেও গান কিছুতেই মরে না। খরা জরা মরায় জীবন জর্জরিত হলেও উৎসবের দুন্দুভি নিনাদে নির্দয় মাটি সতত কম্পমান । বহুতর উৎসব অনুষ্ঠানের মাঝে দাদুড় খেদা একটি অন্যতম মজাদার ও গুরুত্বপূর্ণ পার্বণ ।
'আদুল' ও 'উদোম' 'দাদুড়'-- ইত্যাদি শব্দগুলি পাশাপাশি রাখলে একটি সম্ভাব্য অর্থ দাঁড়ায় সেটি হল নগ্ন । কার্তিক মাসে কালী উৎসবের বিসর্জনের রাতে একটি নাতিদীর্ঘ গাছ কে পুড়িয়ে নগ্ন করা হয়। ধরে নেওয়া হয় সেই গাছটি অলক্ষীর আবাসস্থল।
সাধারণত মানভূমে আখড়া ঝুড়কে কেন্দ্র করে এই বহ্নি উৎসব পালিত হয় ।
কার্তিক মাস হলো সম্ভাবনার মাস। উৎসবের বাস। ফসলের মাস। নানা উৎসবের মাধ্যমে এই সময় গ্রামজীবন ধ্বনিময় ও জাগ্রত হয়ে ওঠে । সেরা উৎসব দুর্গোৎসব বা অন্নপূর্ণার আবাহন । তারপর পর্যায়ক্রমে লক্ষী পুজো এবং কালীপুজো ! কালী পুজোর সঙ্গে মানভূমে আবার নানার অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে আছে । যেমন ডাঙ্গাডুঙুি দিয়ে দেওয়াল রাঙানো , গরুবান্দনা , পাঠা বলি, মোষ বলি, দীপাবলি এবং অলক্ষী বিদায়।
এ সময় লক্ষ্মী আরাধনারও
বহুতর আয়োজন দেখা যায়। যেমন জিহুড লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ লক্ষ্মীপূজো । কালী পুজোর ভেতরেও অদ্ভুতভাবে লক্ষীর অনুসঙ্গ এসে পড়ে । লক্ষীর শুভ আগমনী এবং অলক্ষী বিতাড়ণ । কারণ অলক্ষীকে বিদায় না দিলে লক্ষীর গৃহস্থে বসবাস হয় না। এই অলক্ষী বিদায় কে মানভূমের দাদুড় খেদা বলে।
🍂 এখানে প্রশ্ন জাগে কালি কি প্রাগারজ দেবী । দেবী অন্নপূর্ণা পুজোর সাথে ব্যালেন্স করার জন্যই কি তার আরাধনা ? হয়তো তাই। হয়তো তা নয়। এ বিষয়ে আরো গভীর গবেষণার প্রয়োজন। তবে কালী উৎসবের ভেতর এমনভাবে অলক্ষী বিতাবড়নের একট বহ্নি উৎসব এসে পড়ে , এতে ভাবনার ভিত্তি আরো মজবুত হয়।
দাদুড় উৎসব কে কেন্দ্র করে নানা প্রচলিত ছড়া রয়েছে। কালি উৎসবের রাতে কিশোর কিশোরেরা, সদ্য যুবারা যে কিঞ্চিত অশ্লীল ছড়াটি কাটতে কাটতে পাটকাঠির গুচ্ছ এবং ভাঙ্গা কুলো খাচি নিয়ে ছোটে সেটি হলো এইরকম----
ইঁজরে পিজোরে
বুড়াবুড়ির পঁদ পুড়ো রে
বা,
লক্ষ্মী আসেন গুড়গুরায়ে
আলিক্ষী যান ধরফরায়ে ।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে, মানভূমে সকল যুবা কিশোর হাতে পাটকাঠির গুচ্ছ । পাটকাঠির গুচ্ছের মাথায় শন দিয়ে মাথাটি বড় করা হয় এবং টাইট করা হয় । মস্তকগুচ্ছটি
তৈরি হয়ে গেলে সেখানে কেরোসিন তেল ঢেলে তাকে রীতিমতো দাহ্য করা হয় । কালীপুজোর বিসর্জনের রাতে
প্রত্যেক বাড়ি থেকে ওই পাটকাঠির গুচ্ছ এবং ভাঙ্গা কুলো খাঁচি টুকি বাঁশঝুড়ি ইত্যাদি নিয়ে নির্দিষ্ট আঁকড়া ঝোপের দিকে ছুটতে থাকে। সেখানে লম্ফঝম্প চলে । পাটকাঠি দিয়ে ভাঙ্গা কুলো বা ঝুড়ি ঠুকতে ঠুকতে কিশোরেরা ছড়া কাটে।
এমন একটি ছড়া
অতি বিখ্যাত --
দাইদা বুড়ির দাদ লে
কইসা বুড়ির খোষ লে ।
জনশ্রুতি আছে এই আগুনের তাপ শরীরে নিলে খোষ পাচরা ফোঁড়া দাদ চুলকানি ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না । যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বাস মানুষ ধরে রেখেছে।
লম্ফঝম্পের শেষে ঝোপটিকে ভষ্মীভূত করে যুবারা ,কিশোরেরা ঘরে ফিরে আসে।
মহিলারা সে সময় জলের বালতি নিয়ে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকেন। হাতে থাকে প্রদীপ গুলুপাথর, নতুন গামছা। পা ধুয়ে নতুন গামছা পরে গুলু পাথর মাথায় ঠেকিয়ে প্রদীপের শিখা কপালে নিয়ে শরীরের শুদ্ধিকরণ হয়।
অমাবস্যার অন্ধকার নিশুতরাতে এভাবেই দাদুড় খেদা বা অলক্ষীর বিসর্জন উৎসব সমাপ্ত হয়।
--------------
0 Comments