সাবাস সুনীতা উইলিয়ামস
সুমিত্রা ঘোষ
সুনীতা উইলিয়ামসকে নিয়ে কিছু লেখার আগে এক ভারতীয় বংশোদ্ভুত পাঞ্জাবি মেয়ে কল্পনা চাওলাকে স্মরণ করব। প্রথম মহিলা মহাকাশচারী কল্পনা চাওলাকে আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না। ২০০৩ সালে কলম্বিয়া মহাকাশযানে কল্পনা চাওলা সহ কয়েকজন নভোশ্চর মহাকাশ অভিযানে বেরিয়ে আর পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারেনি।কলম্বিয়া ধ্বংস হওয়ায় সমগ্র বিশ্ব শোকে স্তব্ধ হয়েছিল। সেই কলম্বিয়া অভিযানে ব্যাক আপ ক্রু হিসেবে সুনীতা উইলিয়ামস নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কারণে সেই অভিযানে সুনীতা বাদ পড়েন।
জুন ২০০৭ -এ সুনীতা উইলিয়ামসদের আটলান্টিসেও তাপ নিরোধক বর্মে যেমন বড়সড় ফাটল ধরা পড়েছিল, ২০০৩সালে কলম্বিয়া মহাকাশযান একই রকম ফাটলের কারণে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কল্পনা চাওলা সহ কয়েকজন নভোশ্চর নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। এই ব্যর্থতার ক্ষত আজও পুরোপুরি সারেনি নাসার।
মহাকাশ অভিযানের নেশা মানুষের বরাবরের। প্রতিপদে জীবনহানির সম্ভাবনা আছে জেনেও বিজ্ঞানীরা মহাকাশে পাড়ি জমান। তাইতো দেখতে পাই ২০০৩ সালে ব্যাক আপ ক্রু হিসেবে বাদ পড়েও সুনীতা হাল ছাড়েনি, বরং পূর্ণোদমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, পরবর্তী পর্যায়ে যাতে মহাকাশে পাড়ি জমাতে পারেন। নিজেকে ক্রমাগত প্রস্তুত করেছিলেন।
২০০৬ সালে। এবার আর ব্যাক আপ ক্রু নয়, মহাকাশ্চারী দলের অন্যতম সদস্য নির্বচিত হলেন। ছমাস মহাকাশে নাসার স্পেস স্টেশন ডেস্টিনিতে থাকতে হবে। সুনীতার অভিযান পর্বে যাওয়ার আগে তাঁর ছেলেবেলার কথা একটু জেনে নেব। বাবা দীপক পাণ্ডে, মা বনি পাণ্ডে। দীপক আর বনির তৃতীয় সন্তান তথা কনিষ্ঠা কন্যা সুনীতা, মাইকেল উইলিয়ামসকে বিয়ে করে তিনি সুনীতা উইলিয়ামস নামে পরিচিত হন।
সুনীতা যখন খুব ছোট তখন থেকে কুকুর,বেড়াল প্রভৃতি পশু পাখিদের খুব ভালবাসতেন। ওদের আদর করতেন। তখন তাঁর মনে স্বপ্ন ছিল পশু চিকিৎসক হবেন। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের মোড় ঘুরে গেল। বড়ো হয়ে তিনি হলেন মহাকাশচারী। কল্পনা চাওলাকে নিয়ে আমাদের যে স্বপ্নসৌধ অকালে মহাকাশে বিলীন হয়ে গেছিল, সুনীতা সেই জায়গায় নতুন করে ইমারত গড়লেন।
দীপক পাণ্ডের জন্ম গুজরাটে হলেও কর্মসূত্রে তিনি আমেরিকার বাসিন্দা। সুনীতার লেখাপড়া, বেড়ে ওঠা সবই তাই আমেরিকায়। ১৯৬৫ তে জন্ম। ১৯৮৩ বিদ্যালয় পর্বের লেখাপড়া শেষ। তারপর পদার্থবিদ্যায় ১৯৮৭ সালে ইউ এস নেভাশ আকাদেমি থেকে স্নাতক। ১৯৯৫ সালে ফ্লোরিডার ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ। ইতিমধ্যে পশুচিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন মন থেকে মুছে গেছে সেই স্থান দখল করেছে মহাকাশ বিজ্ঞানের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এরপরে ভর্তি হলেন ইউনাইটেড স্টেটস নেভাল টেস্ট পাইলট স্কুলে। সেখানেও সাফল্যের সঙ্গে স্নাতক হলেন। এরপর মনের জেদ আর সাহস অবলম্বন করে সুনীতা নাসায় যোগদানের জন্য চেষ্টা শুরু করে দিলেন। সাফল্যও মিলে গেল। ১৯৯৮ সালে ট্রেনি কর্মী হিসেবে নাসায় নির্বাচিত হলেন সুনীতা উইলিয়ামস। তবে এর পরেও অনেক কাজ অবশিষ্ট থাকে যেমন মহাকাশে যাওয়ার আগে নানাধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সুনীতা নিজেকে তৈরি করতে লাগলেন। ছমাস মহাকাশ স্টেশনে ভরশূন্য অবস্থায় কাটাতে
হবে। এ ব্যাপার যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। তা সত্ত্বেও, সব জেনে বুঝেও, সুনীতা মনোবল অটুট রেখেছিলেন। ঐ সময় তাঁকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। দৈনিক নিয়মানুবর্তিতার পথ থেকে কখনও সরে আসেননি। আমরা জানি যে কোন বড় তথা মহৎ কাজের জন্য দরকার হয় সততা, মনোবল, নিয়মশৃঙ্খলা আর সমর্থ। এর সঙ্গে আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন। তবে মনের জোর, সাহস সবচেয়ে বেশি দরকার হয়।
অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর অবশেষে ২০০৬- এর ১০ ডিসেম্বর আরো ছয়জন সহযাত্রীর সঙ্গে ডিসকাভারি মহাকাশযানে চড়ে মহাশূন্যে পাড়ি দিলেন সুনীতা। এই সাতজনের মধ্যে সুনীতা সহ পাঁচ জনেরই এই প্রথম মহাকাশ যাত্রা। গন্তব্যস্থল নাসা নির্মিত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ডেস্টিনি। ডেস্টিনিতে ছয়জন মহাকাশচারীকে প্রচুর কাজ করতে হয়েছে। ভোর চারটে থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি প্রত্যেকদিনের কাজ। সমস্ত কাজ সেরে তারপর পৃথিবীতে ফেরা। প্রতিদিনের কাজ নিয়ে কাজ শুরুর আগে বেশ ভাল করে আলোচনা করে নিতে হয়। যে যার খুশিমত কাজ করতে পারেন না।
সকাল ছটার সময় ক্যামেরা ঠিক ঠাক ভাবে বসিয়ে মহাশূন্যে পদচারণা করা। এই সময় সকলে নিয়মিত শরীর চর্চা করতেন। তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে পানীয় জল সংগ্রহ করে ডেস্টিনিতে ফিরে আাসতেন। মহাকাশে থাকাকালীন সময়েও সুনীতা পৃথিবীর মানুষকে ভোলেননি, মহাশূন্যে পদচারণা করার সময়ে পদচারণার ভিডিও রেকর্ডিং করে, বিভিন্ন ছবি তুলে মা- বাবা, বন্ধু বান্ধৰদেৱ ই- মেল করে পাঠাতেন। মহাকাশ জীবনের খুঁটি নাটি তথ্যও পাঠাতেন। সুনীতা মহাকাশ থেকে একবার পৃথিবীতে খবর পাঠিয়ে বলেছিলেন মহাকাশে পাড়ি জমানোর সময় সঙ্গে নিয়েছেন ভগবদগীতা এবং গণেশের মূর্তি। এও বলেছেন মায়ের হাতের সামোসা তাঁর খুব প্রিয়। পৃথিবীর বাইরে থাকাকালীন সময়ে সুনীতা সুন্দর পৃথিবীকে যেন আরও ভালবেসে ফেলেছেন। ওখান থেকে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখে একেবারে অভিভূত হয়ে একজন শিশুসুলভ মনোভাব নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তিনি ই-মেল করে এও জানিয়েছেন মহাকাশ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
মহাকাশ অভিযাত্রীদের ডেস্টিনিতে বসবাসের জন্য অনেক রকম ব্যবস্থা করতে হয়েছে। যেমন বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা, ডেস্টিনিতে জল নিয়ে যাওয়া; বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সাহায্যে অক্সিজেন উৎপাদন করা, শীত নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসানো প্রভৃতি কাজ সুনীতা সহ সকলে মিলে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সম্পর করেছেন। সকলে যাতে ঠিকমত অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারেন তার জন্য ভেন্টিনেশনের ব্যবস্থা উন্নতি সাধন করতে হয়েছে।
এসব কেবল নিজেদের জন্য করাই যথেষ্ট নয় এই সমস্ত ব্যবস্থার স্থায়ী রূপ লিপিবদ্ধ করতে হয়েছে কারণ মহাকাশ বিজয়ের ঝাঁপিতে এই সমস্ত ইতিহাস অক্ষয় হয়ে থাকবে। দীর্ঘদিন মহাশূন্যে ভরশূন্য অবস্থান থাকাকালীন শারীরিক অবস্থা কেমন হয় বা এই সময় মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, তার উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করার দায়িত্ব ছিল সুনীতাদের উপর। এসব আবার লিপিবদ্ধ করতে হয়েছে কারণ পরবর্তী মহাকাশ অভিযাত্রীদের এই রেকর্ড কাজে লাগবে। নতুন নতুন গবেষণা তো হতেই থাকবে।
একদিন ট্রেড মিলে ব্যবহার করে চারঘন্টা ম্যারাথন দৌড়েছেন সুনীতা এই ম্যারাথন দৌড়ে সুনীতা রেকর্ড করেছেন। মহাকাশে থাকাকালীন সময়ে সুনীতা আরও রেকর্ড করেছেন। সেগুলি হল মহিলাদের মধ্যে একটানা সবচেয়ে বেশিদিন (১৯৫ দিন) মহাকাশে থাকা । (অথবা ১৯৪দিন ১৮ ঘণ্টা ৪৮ সেঃ)। মার্কিন মহাকাশচারী লুসিডের রেকর্ড ভেঙে দেন সুনীতা। লুসিড ১৮৮ দিন ৪ ঘণ্টা মহাকাশে ছিলেন।
এর পরের রেকর্ড মহাশূন্যে পদচারণা। ২ ফেব্রুয়ারী ২০০৭ সুনীতার সহ মহাকাশচারী রবার্ট কারনবিম মহাশূন্যে হেঁটেছেন। সুনীতা ডেস্টিনি থেকে তাঁকে হাত নেড়ে ওয়েলকাম জানিয়েছেন। এর পর সুনীতা ডেস্টিনি থেকে মহাশূন্যে ঝাঁপ দিলেন। রবার্ট একইভাবে সুনীতাকে স্পেস ওয়াকার হিসোবে ওয়েলকাম জানালেন।রবার্ট তখন মহাশূন্যে হাঁটছেন।
মহাশূন্যে হাঁটার অর্থ পৃথিবীর ভেসে থাকা, ভরশূনা অবস্থায় থাকা। স্পেস ওয়াকার হিসেবে রেকর্ড করেন সুনীতা। ফেব্রুয়ারী (২০০৭)৬.১০ এবং ১৯ তারিখের মধ্যে ২৯ ঘণ্টা ১৭ মিনিট মহাশূন্যে পদচারণাকরেছিলেন। মহিলা মহাকাশচারীদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি দিন স্পেসওয়াকের রেকর্ড করেন সুনীতা। এপ্রিল ২০০৭ -এ ৪ ঘণ্টা ২৪ মিনিট মহাকাশে ম্যারাথন দৌড়েছেন তিনি। এমন রেকর্ড নেই আর কেউ করেননি। নির্দিষ্ট সময় কেটে যাওয়ার পর মহাকাশবিজ্ঞানীদের পৃথিবীতে ে ফিরিয়ে আনতে হবে। ৯ জুন, ২০০৭ সুনীতাদের ফিরিয়ে আনার জন্য ফ্লোরিডা থেকে মহাকাশে পাড়ি দিল আটলান্টিস ফেরি যান। পৃথিবীর বুকে সেটি আবার ফিরে আসবে ১৯ জুন (২০০৭)।
হিসেব মত ১০ জুন মহাকাশ স্টেশনে আটলান্টিস পৌঁছানোর পর সুনীতার উচ্ছ্বসিত গলা শোনা গিয়েছিল আটলান্টিস এসে গেছে। আমরা পৃথিবীতে ফিরব। বাড়িতে ফিরবেন বলে সকল মহাকাশচারী গোছগাছও করেছেন।
ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন আটলান্টিস এর তাপনিরোধক বর্মে ১০ সেমি মতো ফাটল। একইরকম ফাটল দেখা পূর্বা গিয়েছিল ২০০৩ এর মহাকাশ যান কলম্বিয়ায়।
এবারে সকলের মনে তাই উদ্বেগ আর যেন কলম্বিয়ার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আরম্ভ হল সময়ে সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক মরণপণ সংগ্রাম। মহাকাশচারীদের ধৈর্য আর কর্ম কুশলতার এক অগ্নিপরীক্ষা। মহাকাশচারীরা চ ঠিক করলেন স্পেস ওয়াক করে ফাটল সারাবেন। বিপদের উপর আবার বিপদ শুরু হল, যাকে বলে গোদের উপর বিষফোঁড়া। এই সময় দেখা গেল রুশ কম্পিউটারগুলিই বিগড়ে গেছে। এই কম্পিউটারগুলিই মহাকাশ কেন্দ্রটিকে পৃথিবীর কক্ষ পথে পৃথিবী থেকে ৩২০ কিলোমিটার উপরে ধরে রেখেছে । তাড়াতাড়ি কম্পিউটার সারাতে না পারলে জল, অক্সিজেনের যোগান বন্ধ হয়ে যাবে,তাঁরা বিদ্যুৎ পাবেন না। মারা যাবেন সব।ফলে ককম্পিউটারগুলো দ্রুত না সারিয়ে উপায় নেই।সবাই মিলে কাজ শুরু করলেন।
১৭ জুন (২০০৭) কম্পিউটার আবার চালু হল। এজন্য মহাকাশচারীদের আট ঘণ্টা মহাকাশে স্পেস ওয়াক করে ফাটল সারাতে হয়েছে। এবার ঘরে ফেরার পালা। ফিরতি পথে আটলান্টিস ২২ জুন পৃথিবীতে প্রবেশ করার মুখে আবার বিপত্তি। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার পর তিনবার চেষ্টা করেও কেনেডি স্পেস সেন্টারের অবতরণ করতে পারলেন না সুনীতারা। আবার একরাশ উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, মহাকাশচারীরা ভাবছেন ২৩ জুনের মধ্যে আটলান্টিসকে না ফেরাতে পারলে মহাকাশচারীদের পৃথিবীতে ফেরা হবে না কারণ মহাকাশযানের জ্বালানি শেষ হয়ে আসছে, তার ভেসে থাকার ক্ষমতা চলে যাচ্ছে। আটলান্টিসের প্রত্যাবর্তন দুদিন পেছানো হয়েছে তার মেরামতির জন্য। মেরামতির পর খবর পাও গেল সুনীতা উইলিয়ামস এবং অন্যান্য নভশ্চররা সবাই নিরাপদ। তাঁদের জন্য জল, অক্সিজেন ও বিদ্যুতের যোগান নিয়ে আর ভাবতে হচ্ছে না। ফ্লোরিডায় ফেরি যান নামতে পারেনি ঝড়ের কালো মেঘ বা পূর্বাভাস দেখে নাসার বিজ্ঞানীরা ঠিক করেন আটলান্টিস নামবে কালিফোর্নিয়া এডওয়ার্ড এয়ার বেস স্টেশনে। অবশেষে নাসা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে এডওয়ার্ড বিমান ঘাটিতে জরুরীকালীন অবতরণ করল আটলান্টিস ভারতীয় সময় রাত ১টা ১৯ মিনিটে। পৃথিবীর বুকে নেমে এল আটলান্টিস এবং অবশেষে মাটির স্পর্শ পেল । আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন নাসার বিজ্ঞানীরা, তাঁদের চোখে জল, চোখে জল মহাকাশ চারীদের আত্মীয়দেরও। এ অশ্রু আনন্দের। একান্ত আপনজনের ফিরে পাওয়ার আনন্দ। ২৩ জুন ২০০৭ নীল পোষাক পরে ওঁরা ছজন ধীরে ধীরে নেমে এলেন আটলান্টিসের গর্ভগৃহ থেকে। দুজনের মুখে স্মিত হাসি। কিন্তু আমেরিকা থেকে শুরু করে ভারত এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ যাঁরা বসেছিলেন টেলিভিশন সেটের সামনে, তাঁদের উদগ্ৰীৰ চোখ খুঁজছিল একজনকেই। তাঁর নাম সুনীতা উইলিয়ামস। শনিবার (২৩ জুন) সকালে ছয় সতীর্থ পায়ে হেঁটে মহাকাশফেরি আটলান্টিসের বাইরে বেরোতে পারলেও পারেননি সুনীতা। মহাকাশযান মহাশূন্য থেকে ঠিকঠাক ফিরে এলেও মহাকাশচারীদের নানাধরনের শারীরিক জটিলতার সম্ভাবনা থাকে। যেহেতু তেজস্ক্রিয় বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আসতে হয় ভাই হৃদযন্ত্রের সমস্যা থেকে শুরু করে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা অন্যান্য রোগের সম্ভাবনা থাকে। সুনীতার ব্যাপারে সকলে চিন্তিত ছিলেন, সেজন্য বহু উদ্বেগ উৎকণ্ঠার শেষে মহাকাশ ফেরি আটলান্টিসের সকল অবতরণের প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর পরিবার পরিজনকে কাছে পেলেন সুনীতা।
সুনীতা অবশ্য সতীর্থদের মত পায়ে হেঁটে বাইরে আসতে পারেননি। তাঁকে স্ট্রেচারে করে আটলান্টিসের বাইরে বের করে আনা হয়েছে। যাঁরা স্ট্রেচার বাহক ছিলেন তাঁদের পরনেও ছিল বিশেষ পোষাক। নাসা ঘোষণা করেছিলেন সুনীতা সহ সাত নভোশ্চরই সুস্থ আছেন। যেটুকু জটিলতা সুনীতার দেহে দেখা গিয়েছিল তা হল নিঃশ্বাস নেওয়ার কষ্ট, পরে পরে অবশ্য ঠিক হয়ে যায়। সেই সময় টেক্সাসের কাছে মিলনোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে নাসার বিজ্ঞানীরা সুনীতা সহ সাতজন ছাড়াও নাসার কর্মী, আত্মীয় পরিজনরাও উপস্থিত ছিলেন। যেদিন সুনীতা ঘরে ফিরে এলেন সেই রাতেই বহুমানুষ এস এম এস ও ফোনে নিজের প্রিয়জনকে সুনীতার মহাকাশ জয় করে ফেরা নিয়ে খবর বিনিময় করেছেন। কলকাতার পাশাপাশি রাজ্যের বহুমানুষ গভীর রাত পর্যন্ত টিভির সামনে বসেছিলেন। আমি ও টিভি চ্যানেল ছেড়ে উঠতে চাইতাম না। এই বুঝি আটলান্টিস পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করল। সে এক রোমাঞ্চকর উন্মাদনা। এ উন্মাদনা কারুকে বলে বোঝান যায় না। সর্বদা চিন্তা ছিল এ মহাজাগতিক দৃশ্য যদি মিস হয়ে যায়। যদি না দেখতে পাই।
বিভিন্ন চ্যানেলে ক্যালিফোর্ণিয়া থেকে সর্বশেষে ছবি এবং ধারাভাষ্য শুনতে বাড়ির বড়দের সঙ্গে ছোটরাও রাত জেগেছেন। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা পেরোতেই নাসার মহাকাশ যান পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার পর থেকেই উত্তেজনা শুরু হয়েছিল। সমগ্র ভারতবাসীর একটাই প্রার্থনা ছিল নিশ্চিন্তে আটলান্টিস পৃথিবীতে ফিরে আসুক আর যেন কলম্বিয়ার পুনরাবৃত্তি না হয়। ভারতীয় সময় রাত একটা বেজে ১৯ মিনিটে নাসার কন্ট্রোলরুমের র্যাডারে ধরা পড়ল দুধ সাদা রংয়ের আটলান্টিস মহাকাশযান এডওয়ার্ড এয়ার ফোর্স বেসের রানওয়ের ল্যান্ডিং স্ট্রিপ স্পর্শ করেছে পিন্ পাতন নিস্তব্ধতায় এক মহিলা বললেন- আটলান্টিস টার্চ ডাউন।
পৃথিবীতে ফিরে আসার পরেও মহাকাশযানের অনেক তদারকি করতে হয় যেমন কয়েকঘন্টা সময় লাগে শুধু উত্তপ্ত ফেরিযানকে শীতল করতে। এজন্য সাহায্য নেওয়া হয় বিশেষ এক ধরনের শীততাপযন্ত্রের। তারপরের কাজ মেডিক্যাল টিমের। এই সময় নভশ্চরদের পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। তেজস্ক্রিয়ার শিকার হয়েছেন কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য শিবিরে পাঠানো হয়। সুনীতাদের রাখা হয় বিশেষ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ দিন।আটলান্টিসে ফাটল দেখা দিয়েছে শুনে সমগ্র ভারতবাসী যেমন প্রার্থনা করেছিল আর যেন কলম্বিয়ার ঘটনা না ঘটে। ফাটল সারিয়ে নভশ্চররা যেন তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে ফিরে আসেন। বিশেষভাবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুনীতার জন্য উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। এবার সুনীতার জন্য প্রার্থনা সুনীতা ভাল থাকুন। তিনি এবং কল্পনা চাওলা মহিলা হিসেবে নয়, মহাকাশচারী হিসেবে আমাদের গর্বের জায়গায় চিরদিন মন জুড়ে থাকুন। সুনীতার পরবর্তী মহাকাশ অভিযানে আগাম শুভেচ্ছা ভালবাসা জানিয়ে শেষ করলাম।
0 Comments