জ্বলদর্চি

প্রসঙ্গ : লিটল ম্যাগাজিন /ঋত্বিক ত্রিপাঠী

প্রসঙ্গ : লিটল ম্যাগাজিন 

ঋত্বিক ত্রিপাঠী 


আধুনিক বাংলা কবিতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কবি বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪)-ই প্রথম বাংলায় লিটল ম্যাগাজিন শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত 'সবুজ পত্র'(১৯১৪) পত্রিকাকে বাংলা ভাষার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলেছেন। সবুজপত্রের আগে আছে সাময়িক পত্রপত্রিকার দীর্ঘ ইতিহাস। সাময়িকপত্র এখনও আছে। সাময়িকপত্র ও লিটল ম্যাগাজিন এক নয়। 

  ১৮১৮-তে প্রকাশ পায় বাংলা ভাষার প্রথম সাময়িক পত্র 'দিগদর্শন'(সম্পাদক : জন ক্লার্ক মার্শম্যান)। ক্রমে প্রকাশ পায় 'সমাচার দর্পণ', 'সম্বাদ কৌমুদী', সমাচার চন্দ্রিকা' ইত্যাদি। এগুলো লিটল ম্যাগাজিন নয়, সাময়িকপত্র। সংবাদ ও সাময়িকপত্রে গুরুত্ব পায় সমকাল। লিটল ম্যাগাজিন চাইল সমকাল ও ভবিষ্যৎকে জয় করতে। লিটল ম্যাগাজিন হল এক আন্দোলনের নাম।
চলিত ভাষাকে মর্যাদা দিয়ে বাংলা গদ্য ভাষার জন্মান্তর ঘটল 'সবুজপত্র'-র হাত ধরেই। 'কবিতা' (১৯৩৫, সম্পাদক : বুদ্ধদেব বসু) আধুনিক বাংলা কবিতা চর্চার প্রধানক্ষেত্র হয়ে উঠল। রবীন্দ্রভাবনা থেকে সরে নতুন আবহাওয়া-র জন্ম দিতে সচেষ্ট হয়েছিল 'কল্লোল'। স্বতন্ত্র-স্বভাব-মেজাজ নিয়ে এই পত্রিকাগুলো আসলে লিটল ম্যাগাজিন। নিজস্ব চরিত্র নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই আজও বহু লিটল ম্যাগাজিন করে যাচ্ছে। 
লিটল ম্যাগাজিন মূলত সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজ বিষয়ক পত্রিকা--যা সমকালের হয়েও কালজয়ী স্বভাবে স্বতন্ত্র। হাতে লেখা বা মুদ্রিত বা ওয়েব মাধ্যমে মৌলিক, সৃজনমূলক অনুভব প্রকাশের ক্ষেত্র। 'লিটল' শব্দটি ব্যঙ্গার্থে। সে নিজেই নিজেকে ছোটো বলছে। আসলে সে চিরনবীন। সমকালীন বিনোদনে আস্থা না রেখে পাঠককে দীক্ষিত করে তুলতে চায়। সে বিজ্ঞাননির্ভর মনন চর্চায় বিশ্বাসী। অলৌকিকত্বের কোনও স্থান নেই। সে যুক্তিনির্ভর, নিরপেক্ষ, স্বাধীন, মুক্ত। অহংহীন আত্মবিশ্বাস তাকে স্বতন্ত্র করেছে। 
   
  সব লিটল ম্যাগাজিনই পত্রিকা। সব পত্রিকা কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন নয়। কেন ! লিটল ম্যাগাজিনের নিজস্ব দর্শন আছে। সেই দর্শনের মূল দিক হল নিরপেক্ষতা। সেই নিরপেক্ষতা আসে আত্ম-জিজ্ঞাসা থেকে। এ কারণে সে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠককে মনোরঞ্জনের উপাদান দিতে পারে না। সে নিছক ভাববাদে বিশ্বাসী নয়, সে সামাজিক। লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে জড়িত লেখক, সম্পাদক, প্রেসকর্মী সবারই একটাই পরিচয় : লিটল ম্যাগাজিন কর্মী।
পত্রিকা একক ভাবে পত্রিকা। লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে তা নয়। সব লিটল ম্যাগাজিনের সমষ্টির নাম লিটল ম্যাগাজিন। অর্থাৎ সমষ্টির অংশ হিসাবে তার অস্তিত্ব। নানান পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়ে আসবে নতুন রক্তস্রোত। নিছক জনরুচি ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অতীতকে সে বর্জন করবে। সে নিজেকে অতিক্রম করতে চাইবে বারবার। 

  বাণিজ্যিক পত্রিকার মূল লক্ষ্য --পুঁজি। তাই জনরুচি প্রাধান্য পায়। লিটল ম্যাগাজিনের মূল লক্ষ্য -- বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে সাহিত্য সংস্কৃতির নিত্যনতুন ধারাকে চেনানো। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসে আর্থিক সংকট। সেই সংকটকে মেনে নিয়েই সে নতুনের সন্ধান করে। 
আজও অনেকের ভুল ধারণা এই যে আর্থিকভাবে দুর্বল পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিন। তা কিন্তু নয়। সঠিক পরিকল্পনার অভাব থেকেই আসে আর্থিক সংকট। অনেক সম্পাদক বন্ধুগোষ্ঠীর শক্তিতে বিশ্বাসী নন। 'একাই একশ' ভাবেন আর শেষে অন্ধকারে ডুবে যান। আর্থিক দিক থেকে দুর্বল, বিজ্ঞাপনহীন, প্রচারবিমুখ, বিনয়ী সম্পাদকের পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিন হতে পারে না, যদি না তার নতুন কিছু ভাবার শক্তি থাকে। নিজস্ব চরিত্র নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লিটল ম্যাগাজিনের প্রধান শর্তই হল -- তাকে হতে হবে বিশেষ। সম্পাদকের যেন থাকে আত্মজিজ্ঞাসা : কী ছাপছি, কেন ছাপছি, কাদের জন্য ছাপছি। 

  ৫০০ পাতার পত্রিকাও হতে পারে লিটল ম্যাগাজিন। আর্থিক স্বচ্ছল পত্রিকাও হতে পারে লিটল ম্যাগাজিন। দেখতে হবে অর্থ ও পৃষ্ঠা সংখ্যার দিকে তাকাতে গিয়ে চরিত্র নষ্ট হচ্ছে কি না! অপ্রয়োজনীয় বিষয়ভারে কি পৃষ্ঠা বাড়ছে! আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাঠক মনোরঞ্জন মুখ্য হচ্ছে! তা যদি না হয় তবে সম্পাদক সৎ, তাঁর পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিন, নিঃসন্দেহে।
  লিটল ম্যাগাজিন মানে শুধু পত্রিকা প্রকাশ নয়। নানাবিধ কর্মসূচি--যার ব্যবহারিক নাম -- আন্দোলন। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন মানে --

১. মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠায় বারবার সোচ্চার হওয়া। 

২. লিটল ম্যাগাজিনের লেখক সম্পাদকরা লিটল ম্যাগাজিনের অপমানে পথে নামবেন ও প্রতিবাদ করবেন।

৩. দুঃস্থ লেখক শিল্পীর পাশে দাঁড়াবেন। 

৪. রাজনীতির আবর্তে পড়বেন না। কিন্তু সমাজ ও রাজনীতিমনস্ক হবেন।

৫. গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হবেন কিন্তু ব্যক্তিকে অস্বীকার করে নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অনেক সময় ভুল করে, সমাজ সেই সব ভুলকে লালন পালন করে। সেই ভুলকে ধরিয়ে দেবার সাহস দেখায় লিটল ম্যাগাজিন।

৬. লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণাগার ও পাঠাগারের কথা ভাববেন লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা। 

৭. দেশ ও জাতির শেকড়ের সন্ধান পেতে লিটল ম্যাগাজিন পুনর্মুদ্রণে বিশ্বাসী হবে।

৮. জনপ্রিয় কবি নয়, লিটল ম্যাগাজিনের কাছে সামাজিক কবিবন্ধু বেশি প্রিয়। 

৯. লিটল ম্যাগাজিন বিশ্বাস করে একমাত্র সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মই আমাদের রক্ষা করতে পারে অধর্মের হাত থেকে। ধর্মের নামে অধর্ম আজ আমাদের সামনে চরম বিপদ ডেকে এনেছে। 
 ১০. আমি একটা পত্রিকা করছি একা, এর থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এই, আমি বন্ধুগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে লিটল ম্যাগাজিন করছি। নিরপেক্ষতার জন্য এই গোষ্ঠীচেতনা খুব জরুরি।
 
১১. দেশ ও সময় সম্পর্কে অনুরাগ থেকেই লিটল ম্যাগাজিন দেশের, দশের কঠোর সমালোচনা করবে। পাঠককেও করে তোলে আত্মজিজ্ঞাসু। পাঠক সমকালকে নিয়ে প্রশ্ন করতে শেখে।

১২. লিটল ম্যাগাজিন এক বিশেষ গভীর দর্শন। আমি কীভাবে বাঁচব! আমি আমার মতো বাঁচব। সত্যের জন্য।  স্রোত বা ভিড়ের একজন হয়ে নয়। সুতরাং শত বাধা। বাধাকে তুচ্ছ করে, আদর্শ ঠিক রাখতে যন্ত্রণার সঙ্গে সহবাস শ্রেয়। আত্মসম্মানবোধে সে ক্ষমতা ও লোভের কাছে নত হবে না। লিটল ম্যাগাজিন জানে তার লড়াই তার নিজের সঙ্গেই। 

১৩. সঠিক ও সৎ সাহিত্যের সন্ধান ও প্রচার প্রসার করবে লিটল ম্যাগাজিন। এককথায় সাহিত্যের উন্নতিসাধন। কিন্তু এটাই একমাত্র নয়। তার স্বভাবে থাকবে সামাজিকতা। শৌখিন সাহিত্যচর্চার আত্মকেন্দ্রিক স্বভাবকে সে ভাঙবে। সে মানুষের পাশে দাঁড়াবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি। 

  এই প্রসঙ্গে আর কিছু কথা বলা দরকার। 

  প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় লেখকদের লেখা লিটল ম্যাগাজিনের সূচিতে দেখে অনেকেই আঁতকে ওঠেন। তাঁরা জানেন না -- লেখক বাণিজ্যিক হন না-- লেখা বাণিজ্যিক হতে পারে।বিষয় অনুযায়ী লেখক-নাম আসবে সূচিতে। জনপ্রিয়তা অপরাধ নয়। তাছাড়া লিটল ম্যাগাজিন লেখাকে গুরুত্ব দেবে, লেখককে নয়। অচেনা তরুণের লেখা যেন লেখার গুণে মনোনীত হয়। নবীন প্রবীণের মেলবন্ধন যেন ঘটে।
সন্তান প্রসব করলে তরুণী মা হন। পত্রিকার জন্ম দিয়ে একজন হয়ে ওঠেন পত্রিকা সম্পাদক। সন্তানকে লালনপালন করতে করতে যেমন মা হয়ে ওঠেন প্রকৃত মা, তেমনি 'লিটল ম্যাগাজিন কর্মী'-র দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে পত্রিকা সম্পাদক হন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক। পত্রিকা সম্পাদক ও লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক এক নন। 'মা'ও 'প্রকৃত মা' এক নন।

  আজও লিটল ম্যাগাজিন প্রসঙ্গে রাষ্ট্র অন্ধ। তাই সংবাদপত্র হিসাবেই সরকারি খাতায় লিটল ম্যাগাজিনের নাম নথিভুক্ত হয়। লিটল ম্যাগাজিনের ওপর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকখানি নির্ভরশীল। অথচ অক্ষরকর্মীদের জীবন সুরক্ষা বিষয়ে দেশ উদাসীন। এই দেশেরই অবিচ্ছিন্ন অংশ লিটল ম্যাগাজিন। তাই, তার আন্দোলন চিরন্তন। লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্প আসলে লিটল ম্যাগাজিন-ই।
--------
🍂

Post a Comment

10 Comments

  1. AnonymousJune 21, 2023

    সুন্দর এবং যথার্থ আলোচনা। 'লিটল' শব্দটি ব্যঙ্গার্থে... খুব সঠিক উচ্চারণ।

    ReplyDelete
  2. লেখাটি গুরুত্বপূর্ন। ভালো লাগল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. AnonymousJune 22, 2023

      ধন্যবাদ

      Delete
  3. AnonymousJune 21, 2023

    👍👍

    ReplyDelete
    Replies
    1. AnonymousJune 22, 2023

      ধন্যবাদ

      Delete
  4. সাধু সাধু। এ লেখা কখনো পুরোন হবে না। লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন নব্য সাহিত্যিকদের আরো আকৃষ্ট করুক, দায়িত্ববান করে তুলুক এই কামনা করি।

    ReplyDelete
  5. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এই লিটলম্যাগ দর্শন। ধন্যবাদ লেখককে এমন একটি প্রয়োজনীয় বিষয়ের উপর সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করার প্রচেষ্টার জন্য।

    ReplyDelete
  6. AnonymousJune 22, 2023

    অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, প্রাসঙ্গিক, তথ্য সমৃদ্ধ এই লেখা সংগ্রহে রাখার উপযুক্ত।

    ReplyDelete
  7. লিট্ল ম্যাগাজিন সম্পর্কে যথাযথ আলোচনা 🙏

    ReplyDelete
  8. ভাস্কর সেনFebruary 06, 2025

    গবেষণাধর্মী লেখাটি তথ্যসমৃদ্ধ। ইহা একটি সংরক্ষণ যোগ্য দলিল। ত্রিপাঠি মহাশয়কে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete