জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহল ও শেয়ার বাজার /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৭৬

জঙ্গলমহল ও শেয়ার বাজার

সূর্যকান্ত মাহাতো


'শেয়ার বাজার' শব্দ দুটো শুনলেই দুটো জ্যোতিষী কথা মনে পড়ে যাবে, একদিকে 'শনির কোপ', অন্যদিকে 'বৃহস্পতির যোগ'। নয়তো একদিকে রাতারাতি সর্বস্বান্ত হয়ে ওঠা, আবার অন্যদিকে রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠার মূলমন্ত্র। উনবিংশ শতাব্দীতে এই 'শেয়ার বাজার' থেকে অনেক টাকা কামিয়েছিলেন এমন দুই বিখ্যাত বাঙালি মানুষ হলেন, রাজা রামমোহন রায় এবং রানী রাসমণি। (বাংলা ও বাঙালি/অতুল সুর, পৃষ্ঠা- ১৬৪) বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে জঙ্গলমহলের মানুষও এখন 'শেয়ার বাজারে' বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। তারাও রামমোহন ও রাসমনির মতোই টাকা বিনিয়োগ করে লাভবান হতে চাইছেন।

🍂

এই যেমন গোয়ালতোড়ের এক বন্ধু জানাল, সে নাকি প্রায় পাঁচ বছর ধরে শেয়ার বাজারে টাকা বিনিয়োগ করছেন। বিভিন্ন 'মিউচুয়াল ফান্ড' থেকে শুরু করে বিভিন্ন 'স্টক' সবেতেই কম বেশি টাকা বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু পূর্বেই বলেছি 'শেয়ার বাজার' অনেকটাই শাঁখের করাতের মতো। ভাগ্যের চাকা যেন দুই দিকেই ঘুরতে থাকে। তাই কখনো কখনো সে যেমন লাভের মুখ দেখেছে, তেমনি আবার লোকসানেরও মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। তাই বলে শেয়ার বাজারে টাকা বিনিয়োগে বিরত থাকেনি। পরে পরে খবর পাচ্ছি যে, একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের দিকেও এখন অনেকেই মোবাইলে Grow app এর মতো একাধিক অ্যাপের মাধ্যমেও শেয়ার বাজারে টাকা বিনিয়োগ করে চলেছেন। যা একান্তই শহরে সীমাবদ্ধ ছিল, কিছু ধনী মানুষেরাই এর সঙ্গে যুক্ত ছিল, এখন সেটাই প্রত্যন্ত গ্রামে তুলনামূলক কম রোজগার করেও কিছু কিছু মানুষ যুক্ত হয়ে পড়েছেন। টাকাও বিনিয়োগ করছেন।

কলকাতায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকে 'শেয়ার বাজার' কেনা বেচার যে যাত্রাপথ শুরু হয়েছিল, আজ সেটা জঙ্গলমহলের একেবারে প্রত্যন্ত এলাকাতেও পৌঁছে গেছে। এ বড় কম বিস্ময়ের কথা নয়। এখানকার মানুষও 'বুল' বা 'ষাঁড়' এবং 'বিয়ার' বা 'ভালুক' এর মতো শেয়ার বাজার সংক্রান্ত শব্দগুলো ব্যবহার করছে। কতসব 'স্টকের' নামও তারা বলে দিতে পারছে।

অতুল সুরের লেখায় জানতে পারছি যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে প্রায় একশ বছর কলকাতায় নাকি দালালেরা এই শেয়ার বাজার কেনাবেচা করতেন খোলা মাঠে নিমগাছের তলায়। পরবর্তীকালে সেখানে বাড়ি হয়ে উঠলে দালালরা রাজপথে কেনাবেচা শুরু করেছিলেন। তাদের সেই কেনাবেচার মধ্যে চলত তুমুল বচসা। মাঝে মাঝে সেটা এমনই মাত্রা ছাড়িয়ে যেত যে তা একবার দাঙ্গাতে পরিণত হয়েছিল। যার কারণেই নাকি ১৯০৮ সালে 'ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জ এসোসিয়েশন' গঠিত হয়েছিল। (বাংলা ও বাঙালি/ পৃষ্ঠা ১৬৯)

১৯৫৭ সালের ১০ অক্টোবরের আগে পর্যন্ত শেয়ারবাজার নাকি স্বশাসিত ছিল। তারপর তা কেন্দ্রীয় সরকারের 'সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টস রেগুলেশন অ্যাক্ট' এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলেছে। (বাংলা ও বাঙালি, পৃষ্ঠার- ১৬৯)

শেয়ার বাজারের এই ইতিহাসও শুনিয়ে ছিল পাড়ারই এক বন্ধু। লকডাউনের পর থেকে সেও নাকি শেয়ার বাজারে টাকা বিনিয়োগ করছে। চিটফান্ডের এমন পরিণতির পর সে শেয়ার বাজারকে লাভের একমাত্র মুখ বলে মনে করছে।

আমির থেকে ফকির এবং ফকির থেকে আমির সবেরই সম্ভাবনা আছে শেয়ার বাজারে। তারপরেও সেটা জঙ্গলমহলের মতো এলাকাতেও মানুষ উৎসাহী হয়ে পড়েছে এটা বড় কম কথা নয়। শেয়ার বাজারের জটিল অংক তারা কীভাবে বুঝতে শুরু করেছে তা নিয়ে এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল ইউটিউব। এ বিষয়ে শেয়ার বাজারের টার্মগুলো এবং সমাধান ও সচেতনতা সবকিছুই সে ইউটিউব থেকেই শিখেছে। তবে বেশি উৎসাহ ও ঝুঁকি নেওয়ার বিষয়টা পরিচিতদের কাছ থেকেই সে পেয়েছে। পরিচিত বলতে কোন বন্ধু বা আত্মীয়দেরকেই বোঝানো হয়েছে। তাদের এই মার্কেটে যুক্ত দেখে, তাদের কাছ থেকেই বেশি বেশি করে বিনিয়োগে উৎসাহ পেয়েছেন বলে অনেকে স্বীকার করেছেন।

আধুনিক চিন্তা ভাবনা, প্রযুক্তির উন্নতি, আর্থিক সচ্ছলতা যেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। জঙ্গলমহলের মানুষও যে ঝুঁকি নিতে শিখছে এটাই বা কম কিসের!

Post a Comment

0 Comments